| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প কাফের

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

গাধাগুলোকে সে রাতে আর জল দেখানো গেল না। গোরুগুলো গোয়ালে হাম্বা হাম্বা করে ডাকছিল। এবং বাবুদের ঘোড়াগুলোর চিৎকারে ধরা যাচ্ছে যে, এই হত্যাকান্ড থেকে কেউ বাদ যাচ্চে না। নিশুতি রাত। গ্রামগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাঠে মাঠে মানুষের আর্তনাদ, কখনও পোড়া মাংসের গন্ধ আর এক হাহাকারের ছবি মাঠময় প্রেতের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। সকলেই প্রায় পালাচ্ছিল। অন্ধকার মাঠের ভিতরে, ঘাসের ভিতরে অথবা বন-বাদাড়ের ভিতর দিয়ে পালাবার জন্য ছুটছিল। যুবতীদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরাণ ওর স্ত্রীর নাম ধরে মাঠের ভিতরে দুবার চিৎকার দিয়েছিল– ঠিক তখন একদল মানুষ ছুটে আসছে, হাতে মশাল, আগুন ওদের হাতে–ওই যায়, চলে যাচ্ছে, এবারে গেঁথে ফেল সুপারির শলাতে– এমন চিৎকার ছিল ওদের কণ্ঠে। পরাণ তাড়াতাড়ি মোত্রা ঘাসের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ল। ঘাসের জঙ্গলে ফিসফিস করে ডাকল, ‘কিরণী, কিরণী আছস’।

কোন উত্তর পেল না। সকলেই ভয়ে কথা বলছে না যেন। কোনও রকমে এই নিশুতি রাতে প্রাণ নিয়ে পালানো, কিন্তু পালানো দায়, শহরে গঞ্জে উঠে যেতে পারলে রক্ষা। পরাণ কিরণীকে খুঁজে পেল না। সে একা, এবং একা বলেই বোধহয় হাসিমের কথা মনে পড়ে গেল। জাবিদার কথা মনে পড়ে গেল। যদি ওই রক্ষা করতে পারে। হাসিম ওর পরাণের জন, দুঃখে-কষ্টে পরাণকে বারবার রক্ষা করে আসছে। সেই হাসেম, যদি হাসিম ওকে রক্ষা না করে তবে আর কোথায় নির্ভর করবে। কোথাও যখন সে যেতে পারছে না, সকলে ওকে ঘিরে ফেলেছে হত্যার জন্য, তখন নদীর জলে ভেসে পড়ল পরাণ। সাঁতার দিল, ডুবে ডুবে হাসিমের বাড়ি উঠে ডাকল, ‘একটা তফন দ্যাও আমারে হাসিম। আমি মুসলমানের মতো এক টুপি পইরা চইলা যামু’। অথবা যেন ওর বলার ইচ্ছা ছিল, বনে-জঙ্গলে কিরণীকে খুঁজে পাইনি হাসিম, তোর বাড়িতে কিরণীর খোঁজে উঠে এলাম।

‘কে কথা কয়’।

‘আমি পরাইন্যা। আমারে বাঁচা তুই। যদি মারতে ইচ্ছা যায় তবে মাইরা ফ্যাল। আর পারি না।’

ভয়ংকর দাঙ্গায় হাসিমের মতো মানুষেরা কেমন একঘরে ছিল। ওরা রক্ষার জন্য, মানুষ, প্রাণ, পাখি রক্ষার জন্য দলে দলে বের হয়ে যেতে পারল না। এই বীভৎস ছবির ভিতর ওরা দরজা বন্ধ করে বসেছিল। ওদের চোখ জ্বলছিল, কপাল ঘামছিল, এবং নৃশংস অত্যাচার অথবা আর্তনাদ পাগল করে দিচ্ছিল।

পরাণ দাঁড়াতে পারছিল না। সে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। ঘরে একটা লম্প জ্বলছে। মোরগের ডাক শোনা যাচ্ছিল। শীত তীব্র বলে ঘরের ভিতরে জাবিদা আগুন জ্বেলে দিয়েছে এবং ওরা পরস্পর ফিসফিস করে কথা বলছিল। কেউ শুনতে পাবে কথা, সর্বত্র চর ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা লোক অন্ধকার মাঠে চোঙা মুখে চিৎকার করছে, এই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিচ্ছে। পরাণ শীতের ভিতর বসে ছিল। সে আতঙ্কে যেন খুব ভুল কথাবার্তা শুনছে, যেন কিরণী কোথাও কোনও ঝোঁপের ভিতর বসে ওকে ডাকছে। সে প্রায় কিছুই বুঝতে পারছিল না। ষে শুধু একবার জাবিদার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তারপর কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘কী কইতাছ বইন।’

জাবিদা পরাণকে সাহস দিল। বলল, ‘আপনে আগুন পোহান। আমি আইতাছি।’ বলে সে উঠোনে নেমে অন্য অনেক বাড়িতে সংবাদ সরবরাহের জন্য খোঁজখবর নিচ্ছিল। জাবিদা সব শুনে আতঙ্কিত। ইসমতালির পেটে সুপারির শলা ঢুকে গেছে। ওদের স্কুল বাড়িতে কিছু লোককে আশ্রয় দিয়েছিল ইসমতালি, ওর দলটা ওদের বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ লড়ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। স্কুলে এখন আগুন জ্বলচ্ছে। মাঠের ভিতর ইসমতালি চিৎ হয়ে শুয়ে এখন আসমান তারা নক্ষত্র গুনছে।

হাসিম বলল, ‘ইসমতালি-অ গ্যাল’।

পরাণ ঘটনাটা যেন এতক্ষণে ধরতে পেরছে। যেন এতক্ষণ পর বুঝতে পারল ইসমতালি যাদের স্কুলে আশ্রয় দিয়েছিল, তারা সব পড়ে মরেছে। অনেক আহত হয়েছে। চোঙ মুখে লোকটা সবাইকে সেই খবর দিয়ে মাঠের দিকে যে মসজিদ আছে যেখানে চাকের কূপ আছে এবং জলের ভিতর এখনও যেখানে ছায়া সৃষ্টি হয়–সেদিকে চলে যাচ্ছে।

পরাণের ভয় হল সে বুঝি হাসিমেরও বিপদ ডেকে আনবে। সে উঠে বলল, ‘বইন আমি যাই। মাঠে নাইমা যাই।’ বলে সে ছুটতে চাইলে হাসিম আগলে দাঁড়াল দরজায়। বলল, ‘ যাইবা কই? মাঠে? আমি তো এখনও মরি নাই।’ তারপর বিবির দিকে তাকাল পরামর্শের জন্য। তফন পরে টুপি মাথায় পরাণ নেমে যেতে পারে মাঠে। ছদ্মবেশে সে শহরে উঠে গেলে ভয় নেই। কিন্তু আঞ্চলের মানুষ পরাণ, ধরা পড়ে যাবে। জাহিদা কোন বুদ্ধি দিতে পারল না। মাঠে মাঠে অনেক দূর যেতে হয়, তারপর নদীর পার ধরে। সহসা জাহিদার মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। বেশি সময় আর ঘরে রাখা যাচ্ছে না পরাণকে, বাড়ি বাড়ি চর ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওর মুখে আশার আলো দেখা গেল। সামান্য বুদ্ধি করে নদী পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। তারপর নদীর জলে পরাণ, সঙ্গে একটা পাতিল, পাতিলটা জলের উপর ভেসে যাবে, জলের নিচে পরাণের মুখ, পাতিলের নিচে মুখ রেখে শ্বাস নেবে পরাণ। নদীর পারে বসবে হাসিম, কাঁধে বাঁশের লাঠি, ছোট এক পুটুলি ঝুলবে চিড়ার, এক বাটি জলে চিড়া ভিজিয়ে মাঠের কোনও ঝোঁপে অথবা বন-বাদাড়ে খুদা পেলে পরাণকে খেতে দেবে। জাবিদা নদীর পারের মানুষ। নদীর জল সম্পর্কে, কচুরি পানা সম্পর্কে এবং কোন পারে কী আছে সব তার টিয়া পাখির মতো মুখস্থ।

গোয়াল থেকে হাসিম সামান্য দুধ দুয়ে নিল। জাবিদা শীতের রাতে সেই দুধ গরম করে চারিদিকে তাকাল, এই সময়, নয়তো মশালের আলো নিয়ে যারা মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা পর্যন্ত টের পেয়ে যাবে। জাহিদা দুধ দিল খেতে পরাণকে। পুঁটলিতে চিড়া বেঁধে দিল। হাসিম পাহারাদারের মতো অথবা বরকন্দাজের মতো পাহারা দিয়ে নদী পার করে দিয়ে আসবে। আর পরাণ নদীর জলে পাতিলের নীচে মুখ রেখে, শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য সময় সময় পাড়ে হাসিমের লাঠির শব্দ শুনে জলের উপর ভেসে উঠবে, অথবা এই পাতিলের ভিতরও ইচ্ছা করলে পরাণ শ্বাস-প্রশ্বস নিতে পারে। ওর কোন কষ্ট হবার কথা নয়। নদীতে কী যায়, পাতিল ভেসে যায়, পাতিলের নিচে পরাণ আছে, জলের নীচে সাঁতার কাটছে। কেউ টের পাবে না। পরাণ অনেক জলের নীচে মাছের মতো, অথবা পাখা মেলে মাছের মতো জল কেটে শহরে গিয়ে উঠবে।

ঘোড়াগুলো আর চিৎকার শোনা যাচ্ছে না। বাবুদের ঘোড়াগুলো মরে গেছে। মাঝে মাঝে আকাশে বাতাসে ভীষণ এক কল্লোলের মতো ইতর সব ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছিল। নিরীহ নারী-পুরুষগণ আগুনের ভিতর জ্বলছিল। পোড়া স্যাঁতস্যাঁতে চামসে গন্ধ মাঠে মাঠে, কখনো গোপাটের উপর দিয়ে ভেসে আসছে। মাঠের উপর শুধু অন্ধকার গম্বুজে সাদা পায়রা উড়ছে। বড় বড় মাঠ নদীর পরে–ওরা উড়ে উড়ে সেদিকে চলে যাচ্ছেল। জাহিদা লন্ঠন হাতে উঠোনে নীচে নেমে এসেছিল। পরাণ সকলের পিছনে। হাসিম বলল তখন, খুদা ভরসা। ওরা মাঠে নেমে এলে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল। যত অন্ধকারের ভিতর ওরা অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল। তত মনে হল জাবিদার–আহা কত ঘাস এখানে, কত পাখি এখানে, সবুজ গন্ধ ছিল মাঠময়। পরাণ পিছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। ওর কিরণী কোথায় এখন, ওর সংসার। মাটির মতো আর কী প্রিয় জিনিস আছে চাষি মানুষের। জাবিদার চোখের উপর কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল, দুঃখের দিনে, সুখের দিনে পরাণ, পরাণে মা মাধুপিসি–সকলের কথা মনে হল, মোত্রা ঘাসের জঙ্গলে একবার পরাণ আবিষ্কার করেছিল–জাবিদা, দশমাসের পোয়াতি, জাবিদা ছাগল নিতে এসে অচৈতন্য হয়ে পড়েছে। কোলে করে সে এই মাঠ পার করে দিয়েছিল, ধরে এনে হাসিমকে গালমন্দ করেছিল, সেই পরাণ ওর প্রিয় মাঠ এবং ফসল ফেলে চলে যাচ্ছে। আর এদেশে ফিরবে না। জাবিদার চোখে জল এসে গেল।

ওরা কখনও আগুনের ভিতর দিয়ে কখনও নির্জন মাঠের অন্ধকার অতিক্রম করে ছুটে চলছিল। পরাণ তফন পরেছে, টুপি মাথায় অন্ধকারে মুখ ঢেকে রেখেছে। হাসিম লাঠিতে চিড়ার পুঁটুলি ঝুলিয়ে নিয়েছে। পুঁটুলির ভিতর জামবাটি। যখন পরাণ চলতে পারবে না, জলের ভিতর ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তখন এই সামান্য চিড়াগুড় এবং কিছু উত্তাপ পরাণকে ফের ডুবসাঁতার দিতে অথবা পাতিরে নীচে ভেসে থেকে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। পরান আমার কিরনী গেল কই এই সব বলে যেতে যেতে কপাল থাপড়াচ্ছিল। আমার বাঁইচা থাইকা কি হইব হাসিম। এই সব বলে মাঝে মাঝে অন্ধকার মাঠে বসেই হাউ মাউ করে কাঁদছিল। তখন কেমন পাগলের মত পরাণ। পিছনে দাঁড়িয়ে হাসিম । নানা রকম আশার কথা শোনাচ্ছিল ফিসফিস করে, মাঝ মাঝে বেঁচে থাকার জন্য, নদী পার হবার জন্য এবং নদীতে ভেসে অনেক দূর অনেক পথ সাঁতার কাটার জন্য প্রেরণা দিচ্ছিল–যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে, যেভাবে পারছে পালাচ্ছে, গঞ্জে কিরণী হয়তো তাঁবু, সরকারী তাঁবুতে পরাণের জন্য অপেক্ষা করছে, সবই আন্দাজে বলছিল হাসিম। পরাণকে প্রেরণা দেবার জন্য নানারকমের পাঁচমেশালি কথা পরাণের পিছনে দাঁড়িয়ে বলছিল।

পরাণকে প্রেরণা দিয়ে কোনওরকমে সাঁকো পর্যন্ত হাঁটিয়ে এনেছে। এবার সাঁকো পার হতে হবে। মসজিদের অন্ধকারে ক’জন লোক দাঁড়িয়ে ছিল–ওরা কারা হাসিম টের করতে পারছিল না। সে মাঠের দিকে নেমে গেল। তামাক ক্ষেত, পেঁয়াজের ক্ষেত চাধ্বারে। সে মসজিদের পাশ দিয়ে গেল না। তামাকের ক্ষেতের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকল। কুয়াশার জল লেগে ওদের শরীর ভিজে গেল। পরাণ মন্ডলের কোনও খেয়াল ছিল না, হাসিম মন্ত্রের মত ওর নাম, বাপের নাম নতুন ভাবে শেখাচ্ছে–নাম, মহম্মদ ইদ্রিস, বাজীর নাম–মহম্মদ ইমানুল্লা। অথবা বোবা বনে থাকবে–যা বলবার হাসিম বলবে, ব্যারামি নাচারি মানুষ, শহরে গঞ্জে ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছে। তবে এই অন্ধকার রাতে কেন? তখন কী বলবে হাসিম? সে ভাবল–না এটা ঠিক হবে না। বোবা পরাণ মণ্ডল বড় বড় চোখে তাকিয়ে ব্যা ব্যা করবে শুধু, কোনও কথা বলেবে না, সে বাছুরের মতো টেনে বিপদের স্থানগুলো পার করে নেবে। যেন গঞ্জের হাটে পরাণ মণ্ডলকে বিক্রি করতে যাচ্ছে হাসিম।

মাঠ, জমিন, শ্যাওড়া গাছের বন অতিক্রম করে ওরা হিজলের মাঠে এসে নামল। ওরা সোজা পথে গেলনা। বাঁকা পথে গেল। ঘুরে ঘুরে, যেখানে খুনজখম কম হচ্ছে সে পথ ধরে গেল। কিছু মানুষের শব্দ পেল। হই হই করে গ্রামে ফিরছে । সে বুঝল ওরা কোথাও এতক্ষণ খুনজখমে লিপ্ত ছিল–এখন গ্রামে ফিরছে। সে পরাণকে নিয়ে ফের ঝোঁপের ভিতর লুকিয়ে পড়ল। যখন দেখল মানুষগুলো গ্রামের ভিতর ঢুকে গেছে–এখন ছুটতে পারলে আর ধরতে পারেবে না, তখন ওরা বড় মাঠে পড়ে ছুটতে থাকল।

পরগনাতে পরগনাতে দুঃসহ অরাজকতা। উত্তর দক্ষিণে সোনারগাঁ, পূবে পশ্চিমে মহেশ্বরদি অথবা শীতলক্ষ্যার দুই তীর ধরে ধ্বংসের উল্লাস। মানুষের ভয়ানক দুর্দিন–ধর্মের কথা কেউ শুনছে না, ধর্মবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, উগ্র বিদ্বেষ ক্রমশ এক ভুজঙ্গের মতো গোট অঞ্চলকে গ্রাস করে ফেলেছে। যেতে যেতে হাসিম সেই আগের মত বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছে। ওর প্রায় চার দিকে নজর রাখতে হচ্ছে। কারণ পরাণ , বেহুঁশ পরাণকে না বাঁচাতে পারলে ওর সম্মান থাকে না, মানুষের সম্মান থাকেনা–হাসিম ছুটতে ছুটতে পরাণকে বাঁচার জন্য ফের নানা ভাবে প্রেরণা দিতে থাকল।

ওরা গরিপরদীর আশ্রমে পৌঁছে প্রথম থামল। অশ্বত্থের জঙ্গল এবং ভাঙ্গা মঠের ভিতর কিছু পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। ভোর হতে বাকি নেই। নদীর জলে কিছু পাখির ছায়া পড়ছিল, কোনও পাখি উত্তর-দক্ষিণে হারিয়ে যাচ্ছে। কাক-শালিখেরা তেমনি ডানা মেলে আকালে উড়ছিল, এত বড় খুনের উল্লাস দিনের বেলাতে আরশির মত পরিচ্ছন্ন, যেন কোথাও কোনও মালিন্য লেগে নেই। কিন্তু হাসিম টের পাচ্ছিল, জলের নীচে তখনও বড় এক অজগর ফোঁশে ফোঁশে উঠছে, সময় পেলেই ছোবল দেবে। এখন সামনে শুধু নদীর জল। দিনের বেলায় যেতে গেলে পরাণ মণ্ডল ধরা পড়ে যাবে। জলে নেমে পাতিল মাথার উপর রেখে জলে জলে এখন থেকে হেঁটে যাওয়া । গঞ্জে উঠে যেতে পারলে তিন ক্রোশের মতো পথ আর। মাত্র এই তিন ক্রোশ টেনে নিতে পারলেই হাসিমের সম্মান বাঁচে। পরাণকে সে জামবাটিতে চিড়া-গুড় দিল খেতে। সারা দিনের জন্য পরাণকে জলে ডুবে থাকতে হবে। পরাণ পাতিল মাথায় জলে ভেসে যাবে, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াটুকু মুখ ভাসিয়ে পাতিলের নীচে সেরে নেবে। কিন্তু হায় পরাণের ভিতর জীবনের কোনও লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ে শরীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে গত সালের মেলার কথা বলে, মেলার লাভ-লোকসানের কথা বলে অন্যমনস্ক করতে চাইল পরাণকে। কিন্তু পরাণ, ভুতের মত বসে আছে, খাচ্ছে না, যেন চিড়ে গুড় ঠেলে দিচ্ছে মুখে–হাসিম বসে নজর রাখছে চারিদিকে, খাওয়া হয়ে গেলে আর দেরি করল না হাসিম। পরাণকে নদীর জলে নামিয়ে নিজে পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে থাকল। যেন হাসিম এখন যথার্থই তীর্থযাত্রায় বের হয়ে পড়েছে, মক্কা মদিনা যাচ্ছে, মানুষের ভালবাসার স্থান, যেখানে মানুষে মানুষে কোনও বিভেদ থাকে না, সবই ঈশ্বরপ্রেরিত, জীবন মাত্রেই করুণার যোগ্য–সুতরাং প্রাণধারণের অবহেলা করলে পাপ, হাসিম হাঁটতে হাঁটতে মদিনা, মক্কা যাচ্ছে–নীচে শীতের জল, জলে একটা শুধু এখন পাতিল ভাসছে। পাতিলটা বেগে দক্ষিণ দিকে উঠে যাচ্ছে, দক্ষিণ দিকে জলের উপর ভেসে যাচ্ছে–কোনও টের পাবার কথা নয়, অঞ্চলের একজন মানুষ পাতিল মাথায় নিরুদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে। নদী এখানে অগভীর–জল কম, জলজ ঘাস নেই, জলের নীচে বালি মাটি। পরাণ জলের নীচে গোসাপের মত সাঁতার কাঁটছিল। মনে হবে সব কীটপতঙ্গের মত, মরা বাঁদর অথবা বেড়ালের মতো কচুরিপানার পশে সামান্য এক পাতিল ভেসে যায়, পাতিলের নীচে এক মানুষ আছে, মানুষ জলে ভেসে যায় কেউ বলবে না। পারে লম্বা হয়ে হাসিমের ছায়াটা জলের উপর এসে পড়েছে, আর ঘোড়ার খুরের মত শব্দ ঠক ঠক, বাঁশের লাঠির শব্দ করছিল–এক দুই। ভয় ভয়। শব্দটা জলের নীচে পরাণ শুনছে–সাঁতার ভয় ভয়। সে ডুবে থাকছ। এক দুই তিন, তিনটা শব্দ করছে পাথরে ঠুকে ঠুকে, আর ভয় নেই। সে মুখ তুলে কচুরিপানার ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকল।

নদীর পাড় ক্রমশ পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে যাচ্ছিল। অনেক উঁচুতে হাসিম হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। ওর শরীরটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। অনেক দূর থেকে এখনও সেই শব্দ, ক্রমাগত শব্দ, এক দুই, এক দুই–অদ্ভুত শব্দটা, জলের নীচে মনে হয় কোনও পাতালপুরী আছে, সেখানে রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে ঠক ঠক করে যাচ্ছে, অথবা কদম দিচ্ছে ঘোড়ায়–এক দুই তিন, কদম তুলে ঘোড়া ছুটলেই আর পরাণের ভয় থাকছে না। সে জলের নীচে কিরণীর স্বপ্ন দেখছে। ছোট মুখ কিরণীর, বড় চোখ কিরণীর, ছাগল গোরু পায়রা কিরণীর সব পুড়ে গেছে। এখন কিরণী কোথায়! হল্লাটা বড় সহসা আরম্ভ হয়েছিল, সে জেগে দেখল আগুন জ্বলছে গোয়ালে, বের হয়ে দেখল মানুষের আর্তনাদ, সে সব ফেলে ছুটতে থাকল।

নদীর দুপারে গ্রাম মাঠ ফসল। ঝোপে জঙ্গলে টুনি ফুলের লতা। সামনে মাঝের চরের শ্মশান। আবার সেই এক দুই–ঠক্ ঠক্ শব্দ। পরাণ জলের নীচে, পাতিলে মুখ ভাসিয়ে ডুবে থাকল, অথবা জলের নীচে যেন পরাণ ঝিনুক খুঁজছে, ঝিনুক নয়, পরাণ কিরণীকে খুঁজছে। কিরণী, আমার কিরণী, জলে মাঠে য়ে কিরণী প্রাণের সঙ্গে লেগে থাকত। পরাণ যেতে যেতে বলল, ‘কিরণী, তুই কোনখানে আছস ক। আমি পরাণ তরে ফালাইয়া কই যামু।’

জলের নীচে সে আবার শব্দ পেল–ঠক ঠক ঠক। আর ভয় নেই। সে মুখ ভাসিয়ে রাখল জলের উপর। দুহাতে সে কচুরিপানা কেটে এগুতে থাকল। শক্তি ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে আসছে। শীতের সময় বলে জল হিমের মত ঠাণ্ডা। সে ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছিল, ভয়ে বিস্ময়ে এবং কিরণীর জন্য, এই শীতের জন্য, হিম ঠাণ্ডার জন্য ওর প্রাণশক্তি ক্রমশ উবে যাচ্ছে। হাসিম পাড়ে থেকে ওকে চিৎকার করে সাহস দিচ্ছে–‘আর বেশি দেরি নাই পরাইন্যা। ধামগড়ের কলের চিমনি দ্যাখা যাইতেছে। ওখানে তর কিরণীরে পাইবি।’ ঠিক সেই জলেডোবা মানুষের মতো। যেন পিতা পুত্রকে বলছে–দেখো, দূরে বাতিঘর দেখা যাচ্ছে, আমরা আর একটু সাঁতার কাটতে পারলেই সেই বাতিঘর পাব। আলো, খাদ্য এবং তাপ পাব। অথবা দেখো জন, আকাশের নক্ষত্র দেখো, তোমার মা বাড়িতে আমাদের দুজনের প্রতীক্ষাতে বসে আছেন, আর একটু সাঁতার কাটতে পারলেই আমরা এই ভয়ংকর সমুদ্র অতিক্রম করে চলে যেতে পারব। জাহাজডুবি মানুষ পুত্রকে যেন উদ্বুদ্ধ করছে। হাসিম পরাণকে প্রেরণা দিচ্ছে–আর একটু যেতে পারলেই সেই বাতিঘর, বাতিঘরে আমাদের পৌঁছোতে হবেই।

হাসিম এখন লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। যত নদী নীচে নেমে যাচ্ছে, যত হাসিম উপরে উঠে যাচ্ছে, তত পাড়ের ফাটল গভীর এবং প্রশস্ত হচ্ছে। ওকে খুব সাবধানে ফাটল পার হতে হচ্ছিল। একটু ঘুরে গেলে পথ, কিন্তু সেখান থেকে নদীর জলে পরাণকে দেখা যায় না, পরাণ অতদূর থেকে লাঠির শব্দও শুনতে পাবে না। বর্ষার জলে যখন প্রচণ্ড স্রোত থাকে, তখন যে সব জমি ভাঙতে ভাঙতে ভাসিয়ে নিতে পারেনি, তারা এখন প্রচণ্ড ফাটল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা এলেই ঝুপ ঝুপ শব্দ হবে, জলে ভেসে মোহনায় চলে যাবে। নদী ভাঙতে ভাঙতে পরাণের মতো দূরে সরে যাবে।

পরাণ বোধহয় ওর ডাক জলের ভিতর থেকে শুনতে পায়নি। অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়েছিল হাসিম। নদীর খাড়া পাড়, নীচে সামান্য বালুমাটি, যখন ভয় নেই, যখন কোনও মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না তখন পরাণের আর কিরনীয়। সে বিশ্রামের জন্য ঘাসের ভিতর বসে থেকে ওপারের মাঠে বসন্তের ফসল দেখল। যব গমের গাছ, পাশে বড় গ্রাম নাঙ্গলবন্দ। কামার কুমোর একঘরও নেই। দেবদেবীর মন্দির আছে এখানে। মাটির মূর্তি, ভৈরব ঠাকুরের পূজা হয় এখানে, পাঁঠা বলি হয়, এখন আর কিছুই নেই, দেবদেবীর মূর্তি খড়ের গাদার মতো পড়ে আছে। গরিব চাষি মানুষেরা এসেছিল দেবীর গায়ে সোনার অলঙ্কার থাকলে তুলে নিতে। ঠিক মাথার উপরে অনেক উঁচুতে হাসিম লাঠিতে শব্দ করল ঠক্ ঠক্–ঠিক সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙের মতো লাফ, পরাণ ব্যাঙের মতো জলের ভিতর ডুবে গেল।

হাসিম যেতে যেতে দেখল দুজন যুবক কলা গাছে সুপারির শলা বল্লমের মতো গেঁথে রেখেছে। ওরা বর্শার মতো দূরে সুপারির শলা নিক্ষেপ করছিল–তখন ওরা নদীর এত খাড়া পাড় ধরে এক মানুষ যায় দেখতে পেল। পথ ফেলে, বিপথে যাচ্ছে মানুষটা। ওরা হাতের উপর সুপারির শলা তুলে বলল, ‘যায় কোন মাইন্সে। কোনখানে যায়!’ বলে ওরা হাসিমকে ধরার জন্য যব খেতের ভিতর দিয়েই ছুটতে থাকল। হাসিম কী করবে ভেবে পেল না। পরাণের পরিবর্তে যেন সেই বোবা বনে গেল, বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল তারপর চোখ উল্টে দিল। মানুষের শখ কত রকমের হয়! ওরা খোঁচা দিল একটা হাসিমকে–‘মিঞা, কই যাও?’

‘নারানগঞ্জে যাই।’ সে চোখ উল্টেই রাখল। হাবাগোবা মানুষ হাসিম। বেশি কথা না বলার জন্য নিজেই বিড় বিড় করে বকতে থাকল।

‘তোমার নাম, মিঞা?’

‘মহম্মদ হাসিমালি। সাং নয়াপাড়া, ইসমতালি সেখ আমার চাচা।’

ওরা বলল, ‘পথেঘাটে লোক খুন হইতাছে। তোমার বেজায় সাহস, মিঞা।’

‘আমি সেখের বাচ্চা। আমারে খুন করব কোন মাইনসে।’ বলে চোখ সোজা করে ফেলল। তারপর যেন দাঁড়াতে নেই, সোজা হেঁটে যেতে হয়, সে থপ থপ করে লাঠিতে ঠক ঠক শব্দ করল আর হাঁটল। কিন্তু হায়, পাশের কলমিলতার ভিতর এক পাতিল ভাইসা যায়, পাতিলের উপর এক কাক বইসা যায়, নীচে এক মানুষ ভাইস্যা যায়। মানুষের শ্বাস পড়ে না, জলের ভিতরে এক মানুষ কিরণীর খোঁজে নারানগঞ্জে উইঠা যায়। হাসিম হাঁটছিল, শব্দ হচ্ছে লাঠিতে ঠক ঠক–কাঁসার জামবাটিতে, অথবা হাতের পাথরে সে শব্দ করে করে যায়, ভয় ভয়! পরাইন্যা ভাইস্যা উঠলে ডুইবা মরবি জলে, পরাইন্যা ভয় ভয়। তখন পিছনের লোক দুটো চিৎকার করে উঠল–‘অ মিঞা, দ্যাখছনি পানিতে এক পাতিল ভাইস্যা যায়!’

হাসিমের শরীর অসাড় হয়ে আসছে। সে তেমনি হাঁটছে থপ থপ। থামলেই লোকগুলো টের পাবে। হাসিম এক গেরস্থ মানুষ, হাসিম এক নাচারি ব্যারামি মানুষ, সে পরাণকে নিয়ে শহরে যাচ্ছে। সে কোনওরকমে ব্যারামি নাচারি মানুষ সেজে ওদের গাজীর গীতের গান শোনাল–এক ছিল গাজী ভাই, গাজীর পরাণে সুখ নাই রে নাই। সে ঘুরে ঘুরে লাঠি বাজাল ঠক ঠক। পরাণ ভয় ভয়। চান্দের লাখান মুখখান, গাজীর গীতের বায়ানদার–পরাণ ঘুরে ঘুরে। সে ঘুরে ঘুরে ওদের অন্যমনস্ক করতে চাইল। কিন্তু কে কার কথা শোনে। ওরা শলা হাতে নিয়ে পাতিলের দিকে নেমে যাচ্ছিল।

হাসিম এবার চিৎকার করে উঠল, ‘অ মিঞা ভাই, পাতিল তোমার হাওয়ায় ভাইস্যা যায়।’

‘হাওয়া কোনখানে দ্যাখতাছ মিঞা!’

হাসিম এবারে আদাব দিল, যেন এবার যথার্থই গাজীর গীত শেষ। সে এবার বিদায় নিয়ে চলে যাবে। গানের শেষে আদাব দেবার মতো ভঙ্গি করে ডাকল–‘অ মিঞা ভাই, কন দেখি চান্দে সুর্যে তফাত কী? গমে যবে তফাত কী, মাটিতে ফসল ফলে, অঃ মিঞা, কার লাগি! কোন সে মানুষ আছে তিন ভুবনে ফসলের রস দেয়, পরাণের ভিতর রস দেয়–অঃ মিঞা, দৌড়ান ক্যান, আল্লা বুঝি আপনেগ জ্বালায় সব হাওয়া গিল্যা ফ্যালাইছে।’

ওরা হাসিমের কথা শুনল না। ওরা পাতিলটার পাশে গিয়ে জোরে শলাটা ছুঁড়ে দিল। পাতিলের ভিতর দিয়ে শলাটা পরাণের ব্রহ্মতালুতে ঢুকে পলকের মতো খাড়া হয়ে থাকল। পরাণ জল থেকে উঠে দাঁড়াল সহসা। মুখে পিঠে রক্তের ফোয়ারা নেমেছে। চোখগুলো গোল গোল হয়ে গেল। দুহাত উপরে তুলে পরাণ চিৎকার করে উঠল–কিরণীরে পাইছি। বলে সে পাতিলটা বুকে জড়িয়ে ডুবে গেল ফের। কিছু বুদবুদ দেখা গেল। মানুষ দুজন হা হা করে হাসল তারপর যেদিকে হাসিম পাগলের মতো পালাবার জন্য ছুটছে সেদিকে ওরা ছুটতে থাকল। ‘কাফের যায়!’ ওরা মাঠের ভিতর, খাড়া পাড়ের ভিতর সেই কাফেরকে ধরার জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছিল। আর বলছিল, ‘ওই দ্যাখ কাফের যাইত্যাছে। দ্যাখ এক কাফের যায়, যব গম খেতের ভিতর দিয়া এক কাফের যায়। সন্ধ্যা হয় হয়, যব গম খেতের ভিতর এক কাফের ছুইটা যায়।’ পাখিরা ঘরে ফেরে–যব গম খেতের ভিতর এক কাফের লুকিয়ে রয়। ওরা শলা দিয়ে গাছগুলোর মাথায় বাড়ি মারছে আর সেই গাজীর গীতের বয়ানদারের মতো কাফেরটাকে খুঁজে মরছে। পেলেই শলা দিয়ে পেটে একটা খোঁচা। কাফেরটা হাঁ করে আলিসান এক ভুজঙ্গের মতো পড়ে থাকবে মাঠে।

হাসিম খুব নুয়ে যব খেতের ভিতর দিয়ে ছুটছে। সামনে বড় বড় ফাটল। সে ফাটলগুলো লাফ দিয়ে পার হচ্ছে। মৃত্যুভয় হাসিমকে অস্থির করে তুলছিল, সে একবার গলা তুলতেই দেখল ওরা ঠিক পিছন পিছন আসছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে এতক্ষণে। মরা চাঁদের ফালিটা ধামগড়ের মিলটার চিমনিতে মরা কাকের মতো ঝুলে আছে যেন। সামনের ফাটলটা অতিক্রম করতে গিয়েই মনে হল নীচে এবার পড়ে যাবে। পড়ে গেলে সেই অতল এক গহ্বর। অন্ধকারে গহ্বরটা ভয়াবহ মনে হচ্ছিল। কিন্তু সে উঁকি দিতেই দেখল, ওরা এসে গেছে, ওরা ওকে লক্ষ করে শলা এবার নিক্ষেপ করবে। সে ফের বলল, খুদা ভরসা, বলে লাফ দিয়ে অন্য পারে পড়তেই মনে হল বাঁ পাটা ভেঙে গেছে সে নড়তে পারছিল না, ওরা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হা হা করে হাসছে। এখন খোঁচা মারলেই হাসিম সারা হয়ে যাবে, সে হাতজোড় করে পড়ে থাকল মাটিতে। সে গোঙাতে থাকল। এমন কাছে যখন পাওয়া গেছে, যখন আর কোনও দিক থেকে পালিয়ে যাবার উপায় নেই, তখন লাফ দিয়ে ওপারে চলে গেলে পিঠের ওপাশ থেকে শলাটা ঢুকিয়ে দিলে সুখের হয়। হাসিম ভয়ে কুকুরের মতো গুটিয়ে ছিল। হাসিম কিছু বলছিল না, কী যেন দেখছিল। শুধু শক্ত করে লাঠিটা ধরে রেখেছে ডান হাতে। সে শেষবারের মতো ওরা লাফ দিলে লাঠি দিয়ে ফাটলের মাঝখানে আটকে দিল পথটা। ওরা হড়কে নীচে পড়ে যেতে থাকল। হাসিম কোন তাড়াতাড়ি করল না। সে নীচে মুখ ঝুলিয়ে দিল–কী মিঞারা আসমান দ্যাখ, নদী দ্যাখ। কীরকম লাগে। কোনখানে আছ মিঞা। দোজখের পথটা চোখে পড়তাছেনি।’ হাসিম এবার জোরে হা হা করে হেসে উঠল। পরাইন্যারে আর ভয় নাই। নদীতে সাঁতার দিয়া দ্যাখ পানিতে ঝিনুক আছে, সব ঝিনুকে মুক্তা হয় না রে, পরাইন্যা। বলে কেমন বিলাপ করতে থাকল। তারপর লাঠিটা পাশে রেখে খাদের ভিতর মুখটা ঢুকিয়ে বলল, ‘কী গ মিঞারা, আল্লা সব হাওয়া গিল্যা ফ্যালাইছে! আল্লা কী কয়?’

কাতর শব্দ দ্রুত ফাটল থেকে উঠে ছড়িয়ে পড়ছিল মাঠময়। ফাটলের ভিতর মানুষ দুটোর উপর পাড় থেকে মাটি ধ্বসে পড়ছিল। তখন আঁধার মাঠ। তখন লণ্ঠন নেমে আসছে মাঠে। যব গমের খেতে লণ্ঠন হাতে মানুষ নেমে এসেছিল–কাফের যায় এক, চিৎকারে মানুষেরা ছুটে আসছিল। আর হাসিম হা হা করে হাসছিল। যেন বলার ইচ্ছা দ্যাখ দ্যাখ দুই কাফের জীবন্ত কবর যায়। বলে সে তার জামবাটির বাকি চিড়াগুড়টুকু ফাটলের মুখে ঢেলে দিল এবং বাটি দিয়ে বালি মাটি টেনে বড় বড় ধ্বস নামাল। নীচে তখন আর কাতর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। সে মানুষ জনদের দেখে বলল, দুই কাফের যাচ্ছিল মিঞা– দিলাম, গোরে দিয়া দিলাম।

আর অন্ধকারে হাসিমের মাটি ফেলার কাজ শেষ হচ্ছিল না। পরাণের মুখ কেবল মনে পড়ছিল। পরাণের মাথায় শড়কিটা পালকের মত আটকে ছিল। ওর চোখেমুখে কোনও দৃশ্য ঝুলে ছিল না। মৃত দুই চোখ নিয়ে সে অন্ধের মতো জলের উপর কেবল ভালবাসার ধন, ভালবাসার মাটি এবং ভালবাসার কিরণীকে খুঁজছিল। হাসিমকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভয়ংকর দৃশ্য ভুলতে পারছে না, পাগলের মতো কেবল মাটি টেনে ফেলছে। জোয়ারের জল ফাটলের মুখে ঢুকে গেছে। মাটি জলের ভিতর পড়ে গুলে গুলে যাচ্ছে। ঘামে ওর শরীর ভিজে গেছে, সে খুঁট দিয়ে মুখ মুছে ফেলতেই দেখল সামনে এক লণ্ঠন জ্বলছে। দুজন লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

‘অ মিঞা, পাগলের মতো মাটি ফ্যালতাছ ক্যান?’

হাসিম জবাব দিল না। সে পাগলের মতো মাটি আঁচড়ে নীচে টেনে টেনে ফেলছে।

ওরা ফের বলল, ‘মাটির নীচে কী খোঁজতাছ?’

হাসিম এবার হায় হায় করে বিলাপ করে উঠল, মাটির নীচে সোনা খোঁজতাছি, মিঞা। আমার সোনা কোনখানে হারাইয়া গ্যাছে।’

ওরা হাসিমকে এবার যেন চিনতে পারল, তুমি হাসিম না?

কত দীর্ঘকাল পর যেন মনে হল সে যথার্থই হাসিম। সে সব ভুলে গিয়েছিল। ঘরে ওর বিবি জাবিদা আছে। সে এবার জামবাটিটা বুকের কাছে নিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল পারছে না, উঠতে পারছে না, সে ফের বসে বলল, ‘আপনেরা!’

‘পরাণের বউ কিরণীরে তুইল্যা দিয়া আইলাম।’

‘আমারে ইবার তুইলা লন, আমি যাই।’

যব গম খেতের ভিতর পরাণের পায়রাগুলি তখন উড়ছিল, বক বকম করছিল। নদীর জলে পরাণ ডুব দিল। পাতিল বগলে পরাণ জলের নীচে শুয়ে ছিল। কোন দুঃখ ছিল না। নিজের দেশ, নিজের এই মাটিতে শুয়ে পরাণ স্বপ্ন দেখছে–কলমিলতায় আবার ফুল ফুটেছে। পাখি উড়ছে আকাশে। যব গম খেতের ভিতর পরাণ কিরণীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত