| 26 এপ্রিল 2024
Categories
চিত্রকলা বিনোদন

হতভাগ্য এক শিল্পী বসন্ত জানা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

প্রদোষ পাল


‘বসন্ত কুমার জানা’ নামটা কি শোনা শোনা লাগছে? আশাকরি অনেকেই চিনতে পারছেন। হতভাগ্য এই শিল্পীর সঙ্গে ভারতবর্ষের অন্যতম প্রবাদপ্রতিম শিল্পী যামিনী রায়ের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। যামিনী রায়ের সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা অথচ তাঁকে ‘হতভাগ্য’ বলছি, কেন? রহস্য হয়তো এখানেই! আবার সে কারণেই ‘বসন্ত জানা’ নামটা অনেকেই শুনে ফেলেছেন। কিছুই যাঁরা জানেন না বসন্ত জানা সম্পর্কে, তাঁদের একটু সংক্ষেপে বলে দেওয়া দরকার।

১৯৪৯ সাল নাগাদ তৎকালীন যুগান্তর পত্রিকায় যামিনী রায় সম্পর্কে দীর্ঘ লেখা ও ছবি সহ একটি প্রতিবেদন বেরোয়। বসন্ত জানা সুদূর এগরার এক গ্রামে বসে সে প্রতিবেদনটি পড়ে চমৎকৃত হন। তখন তাঁর বয়স ২২/২৩ বছর। সংরারের আর্থিক দুরবস্থায় ষষ্ঠ শ্রেণির পর আর পড়া চালাতে পারেন নি। ছবি আঁকার প্রতি বরাবরই ঝোঁক। নিজের মতো ছবি আঁকছেন গ্রামে বাস করে। প্রতিবেদনটি পড়ে আরও চমৎকৃত হওয়ার কারণ, যামিনী রায়ের ছবির সঙ্গে তাঁরও ছবির বিষয় ও ফর্ম যেন মিলে যাচ্ছে। আসলে যামিনী রায় গ্রাম বাংলায় যে সব ফর্মকে নিজের ছবির বিষয় করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। বসন্তও প্রায় একই বিষয় নিয়ে গ্রামে বসে কাজ করছেন। কিন্তু দুজনের সময়ের ব্যবধান অনেক। যামিনী রায় তখন শুধু বয়সে নয় ভারতবর্ষের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। কিছুই জানতেন না বসন্ত, জানলেন ঐ যুগান্তর পত্রিকা পড়ে। চিঠি লিখলেন যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদককে। অনুরোধ করলেন, যামিনী রায়ের ঠিকানা যদি পাওয়া যায়। সম্পাদম গ্রাম্য ঐ যুবকের অনুরোধ রাখলেন। যামিনী রায়ের ঠিকানা পাঠিয়ে দিলেন বসন্ত কে। বসন্ত চিঠি দিলেন যামিনী বাবু কে। সঙ্গে পাঠালেন খসড়া আকারে কিছু ছবি। যামিনী রায় বসন্তের চিঠি ও ছবির খসড়া পড়ে মুগ্ধ। ১৯৪৯ সালের ৩০ শে আগস্টের চিঠিতে লিখলেন,

“কল্যাণবরেষু, তোমার ছবি তিনখানি পেয়ে খুব ভাল লাগল, মূল তত্ত্বটি যে তুমি ধরতে পেরেছ, তা তোমার ছবি দেখিলেই বোঝা যায়। আমি অন্তরের সহিত কামনা করি তুমি সফলকাম হও।

কিছুদিন থেকে আমার শরীর খুবই খারাপ যাচ্ছে, তাই বিস্তারিত লিখিতে পারিলাম না, পরে তোমাকে আবার চিঠি দেব। তুমি কিছু পুরাতন পট, (পটুয়াদের আঁকা) সংগ্রহের চেষ্টা করিবে ঐ জেলায় বহু যায়গায় পটুয়াদের আঁকা পট পাওয়া যায়। এবার যদি ছবি পাঠাও খামের ভিতর সাধারণ কাগজে খসড়া মত পাঠাইবে। কেমন থাক চিঠি দিও, একটু সুস্থ হইলে তোমাকে জানাইব, তুমি একবার আসিয়া দেখা সাক্ষাৎ করিয়া যাইবে। তোমার চিঠিতে তোমার আন্তরিকতার অনুভব করিয়া তৃপ্তি পাই। আমার শুভ কামনা গ্রহণ ক’রো। ইতি মঙ্গলাকাঙ্খী শ্রী যামিনী রায়।”

LETTR-01

একটু অবাক হচ্ছেন? ঐ সময় যামিনী রায় সম্পর্কে যাঁরা জানেন একটু অবাক হওয়া্রই কথা। তখন যামিনী রায় ভারতবর্ষের একমাত্র নামি ও দামি শিল্পী। তাঁর কোনো ছবি পড়তে পায়না। আঁকছেন আর সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতারা লুফে নিচ্ছেন। এতো চাহিদা বাজারে, তিনি যেন হিমশিম খাচ্ছেন যোগান দিতে। এমন একজন ব্যস্ত শিল্পী কোন অজ পাড়া গাঁয়ের বসন্তকে নিয়ে এতো ভাবলেন! কেন? কী প্রয়োজন ছিল তার? আমরা জানি, প্রথিতযশারা সাধারণত কেমন ব্যবহার করে অনুজ শিল্পীদের প্রতি! সামান্য দু একটা কথা বলেই যেন ধন্য করে দেন! তবে? যামিনী রায় এত আগ্রহ দেখালেন অচেনা ঐ গ্রাম্য যুবকের প্রতি! একি যামিনী রায়ের মহানুভবতা? নাকি বসন্তের মধ্যে এমন কিছু দেখলেন নিবিড় করে ভালো না বেসে পারলেন না? এতো ভালোবাসা জড়ানো চিঠি অমন বিখ্যাত নামিদামী শিল্পী কেন লিখবেন? কী দায় ছিল তাঁর?

শুরু হলো এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। যামিনী রায়ের মতো শিল্পী তার মতো অজ গাঁয়ের একজনের ছবি এতো ভালো বলেছেন। প্রচন্ড উৎসাহে বসন্ত রাত দিন ছবি আঁকতে থাকলেন। আর যামিনী রায়ের কথা মতো “খামের ভিতর সাধারণ কাগজে খসড়া মত” ছবি পাঠাতে থাকলেন। যামিনী রায়ের আপ্লুত ভাব ঝরে পড়ছে চিঠির পর চিঠিতে।

ইতিমধ্যে ‘কল্যাণবরেষু’র সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘বসন্তবাবাজীবন’। প্রায় দু বছর চলল এই চিঠি বিনিময়। তখনও দুজন দুজনকে দেখেন নি। দু’বছর পর বসন্ত একজনের সঙ্গে গেলেন যামিনী রায়ের বাড়ি। অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তার আঁকা ছবি।

শুরু হলো আর এক অধ্যায়। শুধু যামিনী রায় নয় অচিরেই তাঁর পরিবারের সবার প্রিয় হয়ে উঠলেন বসন্ত। যামিনী রায় যেমন নিজের ছেলের মতো ভালো বাসছেন, তাঁর স্ত্রী, ছেলে বৌমা থেকে নাতি পুতি সবার অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠলেন বসন্ত।

যামিনী রায়ের স্ত্রী’র লেখা একটি চিঠি, যেখানে সাল উল্লেখ নেই। শুধু রয়েছে ‘৪ঠা বৈশাখ বুধবার’। “কল্যানবরেষু, বাবা বসন্ত তোমার চিঠিখানা পেয়ে বড়ো আনন্দিত হয়েছি। সাংসারিক নানা কাজের ঝঞ্ঝাটে সময় মত উত্তর দিতে পারি নি সেজন্য কিছু মনে করো না বাবা, বাবুর পত্রে তোমার খবর প্রায়ই পাই। সেজন্যই আর ভিন্ন পত্র দেই না আমরা সকলেই তোমাকে অত্যন্ত আপনজন মনে করি। বিশেষ করে আমি মনে যানি আমার ধর্ম্ম মৃণাল, পটল, মনি যেমন তুমিও সেই রকম, মাতৃস্থান অধিকার করেছো-তুমি আমার কাছে এসে খাবে। এতে আমি রড়ই আনন্দিত হয়েছি। যত শীঘ্র পারো তুমি চলে এসো। বাবুর শরীর ভালো যাচ্ছে না। তুমি কেমন আছো- আমরা সকলে ভাল আছি খোকাখুকুরা ভালো আছে, তারাও খুব খুসি তুমি আসবে জেনে। তুমি আমার আন্তরীক আশির্বাদ জেনো। ভববানের নিকট প্রার্থনা করি শান্তি পাও। ইতি তোমার মা”

(বানান অপরিবর্তিত)

LETTR-02 COVER PAGE

LETTR-02 BACK PAGE

বসন্ত জানা যামিনী রায়’কে বাবা বলে সম্বোধন করতেন। আর তখনকার দিনে বাবাকে অনেকে বাবু বলে সম্বোধন করত। ‘ধর্ম্ম মৃণালা, পটল, মনি’ হলেন ওঁদের ছেলে মেয়ে। ‘খোকাখুকুরা’ নাতিপুতি।

পড়লে কত আপন মনে হয়, না? নিজেই লিখেছেন, “বিশেষ করে আমি মনে যানি আমার ধর্ম্ম মৃণালা, পটল, মনি যেমন তুমিও সেই রকম, মাতৃস্থান অধিকার করেছো-তুমি”।

কিন্তু আশ্চর্য কী জানেন এমন সন্তান তুল্য আপন একজন, যার সঙ্গে যামিনী রায় ও তাঁর পরিবারের সম্পর্ক প্রায় ২৩ বছর, অথচ এই ২৩ বছরে ওঁদের পরিবারের বাইরে একজনের সঙ্গেও বসন্তর পরিচয় করিয়ে দেননি। সবাই জানেন যামিনী রায়ের বাড়িতে প্রচুর গুণী মানুষের সমাগম ঘটত। একদিনের জন্যও সন্তানতুল্য বসন্তকে তাঁদের সামনে হাজির করান নি। বরং শত চেষ্টা করে গিয়েছেন আড়াল করার। দীর্ঘ ২৩ বছরের সন্তান’দের বিবাহ, নাতি পুতিদের অন্নপ্রাশন সহ নানান পারিবারিক অনুষ্ঠানে একবারের জন্যও বসন্তকে আসতে বলেন নি। অথচ চিঠিতে জানিয়েছেন বিবাহ সংবাদ! আশ্চর্য হচ্ছেন?

একবার যামিনী রায় প্রচন্ড অসুস্থ। বাড়ি শুদ্ধ বিভিন্ন মানুষের সমাগম। আর্টকলেজের ছাত্রছাত্রী সহ বিভিন্ন শিল্পী যামিনী বাবুকে দেখতে আসছেন। সংবাদপত্রে সংবাদ পড়ে পাছে বসন্ত এসে পড়ে! সমস্ত গোপনীয়তা যদি ফাঁস হয়ে যায়! তড়িঘড়ি ওঁর ছেলে টেলিগ্রাম করে জানালেন, বসন্তবাবু যেন না আসেন।

আচ্ছা, খুব স্বাভাবিক ভাবে দেখলে এই পদক্ষেপকে অস্বাভাবিক মনে হয় না? প্রিয়জনের অসুস্থতায় আর এক প্রিয়জনের দেখতে আসারই তো কথা। যেহেতু তিনি বয়স্ক, যেকোনো মুহূর্তে কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাই প্রিয়জনকে খবর দেওয়াই তো স্বাভাবিক। যাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন, তাকে দেখতে আসতে বারণ করবেন? জীবনে এমন ঘটনা শুনেছেন? হ্যাঁ, এমনই ঘটেছিল। শুধু টেলিগ্রাম নয়। পরে ওঁর পুত্র চিঠি লিখলেন বসন্তকে। ভাদ্র ১৩৭৭ সালে লিখলেন, “পরম কল্যাণীয়েষু, বসন্ত, বাবার কাছে লেখা আপনার পত্র পেয়েছি। বাবা একটু একটু করে বল পাচ্ছেন যদিও সম্পূর্ণ সুস্থ হতে সময় লাগবে। ডাক্তারবাবুর ব্যবস্থানুযায়ী ঔষধ ও পথ্য ঠিকমত ব্যবহার করছেন। স্বাভাবিক বল পেলে আপনাকে নিজে হাতে চিঠি দেবেন। যতদিন তিনি না পারেন আমরা নিয়মিত আপনাকে চিঠি দেব। আপনি বেশি চিন্তা করিবেন না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আপনাদের সুস্থ রাখেন। আপনারা আমাদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। ইতি ধর্ম্মদাস।

পুঃ-এখানে এবার অন্যান্য বারের তুলনায় বর্ষা বেশ প্রবল। সেইজন্য বেশ সুস্থ হলে এবং এখানে বেশ শুখনা হলে আপনি এসে বাবাকে দেখে গেলে আমরা সকলে খুসী হব।”

আহা! আসতে বারণ করার যুক্তি বটে! “এবার অন্যান্য বারের তুলনায় বর্ষা বেশ প্রবল।”

২৩ বছরের সম্পর্কে যামিনী রায় প্রায় ৩০০/৩৫০টি চিঠি লিখেছেন বসন্তকে। এবং সব চিঠি পড়লে দেখা যাবে কোনো কারণে বসন্তকে আসতে বারণ করার অজুহাত হিসেবে প্রায়শই এই বর্ষার কথা বলা হয়েচ্ছে। জানিনা ওঁরা কি সুন্দরবনে বাস করতেন? যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবনযাত্রা নাজেহাল হয়ে যায়! খোদ বালিগঞ্জীয় মানুষরা বর্ষাকে ভয় পেলেও নিত্য কাদাজল ঘাঁটা গ্রামের মানুষদের জল কাদা বর্ষাকে কীসের ভয়? তবুও স্রেফ বৃষ্টির জন্য পরমাত্মীয়কে আসতে বারণ করা স্বাভাবিক মনে হয়?

কিন্তু কেন এই গোপনীয়তা?

যামিনী রায়ের সঙ্গে দীর্ঘ ২৩ বছরে তিনি বসন্তকে লিখেছেন প্রায় ৩০০/৩৫০ চিঠি। যামিনী রায়ের মতো ব্যস্ত মানুষ যদি এতো লেখেন বসন্ত তবে কত চিঠি লিখতে পারেন? পুঙ্খানুপুঙ্খ সমস্ত চিঠি পড়লে জানা যায় বসন্ত’র পাঠানো প্রতি তিনিটি চিঠির পর একটি করে চিঠি লিখতেন যামিনী রায়। তার মানে আনুমানিক ৮০০/৯০০ বা ১০০০ চিঠি লিখেছিলেন বসন্ত বাবু।

গভীর এক রহস্যে বসন্ত’র লেখা এই বিপুল চিঠির একটারও হদিশ নেই আজ। আর খসড়া আকারে পাঠানো ছবি? প্রতি তিন মাস অন্তর বসন্ত যেত যামিনী রায়ের বাড়ি। চিঠির ভেতর খসড়া আকারে স্কেচ পাঠানো ছাড়াও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন প্রতি তিন মাসে আঁকা ছবি। প্রায় দু হাজার ছবি বা খসড়া তো বটেই। আশ্চর্যজনকভাবে সেসব ছবি ও খসড়ার একটারও আজ আর হদিশ নেই।

প্রশ্ন আসা কী অস্বাভাবিক, কোথায় গেল বিপুল চিঠি ও ছবি? যামিনী রায় বা তাঁর পরিবারের অন্যান্যরা কোন অধিকারে অন্যের চিঠি ও ছবি নষ্ট বা সরিয়ে ফেলতে পারেন? যেই করুক কাজটি খুবই অন্যায়! আশা করি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কী কী বিশেষ কারণে সমস্ত দিক থেকে বসন্ত’কে এতো আড়ালের চেষ্টা!

এ সব রহস্য জানতে গেলে অবশ্যই আপনাদের পড়তে হবে বসন্তকে লেখা যামিনী রায়ের চিঠিগুলি। সেই সঙ্গে শিল্প ইতিহাসের কিছু পাতা পড়ে দেখতে হবে। বসন্ত’র সঙ্গে আলাপের আগে আর পরে যামিনী রায়ের ছবির বিষয় ভাবনা’র কি কোনো পরিবর্তন হয়েছিল? হলে কেন হলো? বেলিয়াতোড়ের বাড়ি ছেড়ে শিল্পী জীবনের পুরোটা শহরের প্রাণকেন্দ্রে কাটানো যামিনী বাবুর ছবির বিষয়ে পঞ্চাশের দশক থেকে হঠাৎ কেমন করে আবার গ্রাম বাংলা ফিরে এল?

শিল্পী হিসেবে আর একটা দিক আমাকে ভীষণই কষ্ট দেয়। যামিনী রায়ের মতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পী জানতেন তাঁরই স্টাইলে ছবি এঁকে বসন্তের বেশিদূর যাওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়। তা সত্বেও একবারও তিনি বসন্ত’র ভুল ধরিয়ে দেননি। বারংবার বসন্ত নিজের ছবি নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন, সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তার পথ ঠিক দিকে এগোচ্ছে তো? যামিনী রায় জেনে বুঝেও পুত্রসম বসন্ত’কে চিঠির পর চিঠিতে বলে গিয়েছেন তার পথ ঠিক দিকেই এগোচ্ছে!

“তোমার চিন্তা ও বিচার ঠিক রাস্তাতেই চলছে। শুধু কামনা করি লক্ষ্য বস্তুকে পাবার জন্য তোমার চেষ্টা সার্থক হোক।” (২৪/৬/৫১)

“তোমার সব চিঠিগুলিই পেয়েছি। তোমার যুক্তিপূর্ণ বিচার বুদ্ধি, ঠিক মতই চলছে। সত্য ও মূল সত্য সর্ব্ব দেশে, সব মানুষের একই, কোন যুগেই এর পরিবর্তন নাই। মানুষের ভিতর দেবতাও, অসূরও আছেন। তাঁর ইচ্ছা হলে পঙ্গুও গিরি লঙ্ঘন করিতে পারে”। (৩০/৫/৫১)

এতো সুন্দর দার্শনিক চিঠি কোনো প্রতিথযশা শিল্পীর কাছ থেকে আমার বা আমাদের মতো এঁদো শিল্পী পেলে জীবন ধন্য হয়ে যেত। কোনো প্রশ্ন আসতো না, অন্য কোনো দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করতো না! পাগলের মতো এঁকে যেতে ইচ্ছে করতো! তবুও আজ অনেক কিছু যাচাই করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সে যুগে? প্রায় পৌনে একশো বছর আগে? স্বাভাবিক ভাবেই বসন্ত বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রতিষ্ঠিত যামিনী রায়ের উৎসাহ মাথা পেতে কাজ করে গিয়েছেন। কোনোদিকে আর তাকান নি। তাঁর তাকানোর আর কোনো জায়গাও ছিল না। শিল্পী বলে একমাত্র যামিনী রায়কেই চিনতেন। ওঁর বাড়িতেই যেতেন। যামিনী বাবু নিজে যখন কারো সঙ্গে পরিচিয় করিয়ে দেনননি, আর কোথায় যেতেন গ্রাম্য বসন্ত?

আর একটি চিঠিতে রয়েছে,

“ছবিগুলি সম্বন্ধে তোমার মনে(র) মধ্যে যে জিজ্ঞাসা রহিয়াছে তাহা বেশ বোঝা যায়। ইয়া চিত্র শিল্পের একটী বিশেষ লক্ষন। তোমার চেষ্টা ঠিক পথেই যাচ্ছে। এই মন নিয়ে কাজ করিলেই নিশ্চয়ই কাম্য বস্তু পাওয়া যাইবে।” (৭/৩/৫৫)

অর্থাৎ “চিত্র শিল্পের একটী বিশেষ লক্ষন” বসন্তর মধ্যে ছিল, তা স্পষ্ট। এবং এও স্পষ্ট বসন্ত বাবু বরাবরই নিজের পথ সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন, এবং বাবা তুল্য যামিনী রায়কে অজস্র চিঠিতে নিজ-মনোভাব জানিয়েছিলেন। বিনিময়ে যামিনী রায় কী করেছেন? মিথ্যাচার? তা ছাড়া আর কী বলবো একে? আগেও বলেছি আবার বলছি বর্ষীয়ান শিল্পী হিসেবে তার তো না জানার কথা নয় একজনের স্টাইলে, সে যদি আবার গগনচুম্বি হন তাঁর স্টাইলে এঁকে কারো পক্ষে কোনোদিন “লক্ষ্য বস্তুতে” পৌঁছোনো সম্ভব নয়।

বাস্তবেও তো তাই হলো। ১৯৭২ সালে যামিনী রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ২৩ বছরের একটা বিরাট অধ্যায় শেষ হয়ে গেলো। যামিনী পরিবারের পরম প্রিয় বসন্ত’র দিকে ফিরেও তাকাননি তাঁর পরিবার। যামিনী রায়ের মৃত্যুর খবরটুকু পর্যন্ত দেননি ওঁর পরিবার। সংবাদপত্রে খবর পড়ে বসন্ত জানলেন বাবা আর নেই। গ্রামের বাড়িতে মস্তক মুন্ডন করে বাবার শ্রাদ্ধও করলেন।

এতদিনে বোঝা গেল পরম আত্মীয়তা আসলে কত ফাঁপা! সবই কোনো না কোনো স্বার্থে!

ঘটনাচক্রে আমার অগ্রজ অতীশ পালের চোখে বসন্ত বাবু না পড়লে হয়তো এ ইতিহাস সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেত। আজ পৃথিবী যতটুকু বসন্ত বাবুকে জানছেন সবই দাদার জন্য।

আপাতত এটুকুটেই থামতে হচ্ছে। কারণ আরো অনেক অনেক কথা বলবার জন্য কয়েক মাসের মধ্যে একটি বই প্রকাশ হতে চলেছে।

কিছুদিন আগে ফেসবুকে বসন্ত জানা ও যামিনী রায় সম্পর্কিত কয়েকটি পোস্ট ও আলোচনা’র কারণে অনেক বন্ধু এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা চাইছেন বসন্ত বাবুকে লেখা যামিনী রায়ের চিঠি, বসন্ত বাবুর আঁকা অবশিষ্ট ছবি, এবং ওই বিষয়ক প্রবন্ধ সহ একটা বই প্রকাশ হোক। এবং এই বই প্রকাশের সমস্ত খরচ তাঁরাই বহন করতে চান। কিছু ছোটো প্রকাশকও সাহায্য করতে চাইছেন। ব্যপারটা চমকপ্রদ ও আশাব্যঞ্জক। বেশ কিছু গুণী লেখক ও গবেষক বইটিতে লেখার সম্মতি জানিয়েছেন। এ বছরের শেষদিকে আশাকরি বই বেরিয়ে যাবে। এই পত্রিকার পাঠকদের কাছেও অনুরোধ রইলো, আপনারাও আমাদের পাশে দাঁড়ান। বইটার যদি ব্যপক প্রচার ও বিক্রি হয় তবে সে সমস্ত অর্থ আমারা বসন্ত বাবুর পরিবারের হাতে তুলে দেবো। আপনাদের সমস্ত রকমের সাহায্য প্রার্থনীয়।

( বসন্ত জানার প্রতিকৃতি : প্রদোষ পাল

বসন্ত জানা ও যামিনী রায়ের চিঠি শিল্পী প্রদোষ পালের সৌজন্যে প্রাপ্ত।)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত