Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,irabotee-gitaranga-special-issue Music

গীতরঙ্গ: পথ হারানোর নেশায় । মণিকা চক্রবর্তী

Reading Time: 3 minutes

কোনো এক দুপুরে,যখন মনখারাপগুলি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশাপাশি। ঠিক তখনি যেন জানান দিয়ে গেল উত্তরের হাওয়া। এক গভীর শীতলতা ধেয়ে আসছে চারদিক থেকে। শীতের স্রোত। আর আমার ভিতরেও এক তীব্র শীত টের পাচ্ছিলাম, তার তীব্র কম্পন, আর পাতাঝরা। শূন্যতার এক বিকট হাহাকার।হলুদ পাতাগুলো ঝরে পড়ছে উত্তরের হাওয়ায়। ঠিক সেই সময়ে যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি, এক অন্তর্গত শূন্যতার বোধে বিবর্ণ; তখনই কোনো এক বাড়ির চালু রাখা টিভি থেকে ভেসে এল একটি গান। রবীন্দ্রনাথের গান। গানটি আমার পূর্বপরিচিত। দ্রুতলয়ের এই গানটি গেয়েছি ছোটবেলায় অনেকবার।তবু যেন সেই অতি পরিচিত গানটিকে সেই মুহূর্তে আমার মনে হল একেবারেই অচেনা। যেন তাকে আজই, নতুন করে প্রথম চিনতে পারলাম। মনে হল জন্ম-জন্মান্তর ধরে এই গান গেয়েছি কতবার,তবু তাকে একবারও আজকের মতো করে চিনতে পারিনি।

শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে।
পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।।
উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে,
তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে ।।
শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা
তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।
শীতের পরশ থেকে থেকে যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে,
সব খোওয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্ সকালে।।

আগে কখনও মনে হয়নি এই গান এমন করে নতুনত্ব আনতে পারে আমার জীবনে। আমার সকল রিক্ততা আর নিঃস্বতাও পেতে পারে এমন একটি উত্তরণ। আমি গানটির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম গীতবিতান খুলে। বেশ কয়েকবার পড়লাম। প্রকৃতি পর্যায়ের এই গানটি দাদরা তালের। বেহাগ ও খাম্বাজ রাগের প্রভাব আছে সুরে। স্থায়ীতে শীতের হাওয়ার দাপট। সে যেন নেচে নেচে ঝরিয়ে দিচ্ছে,লুটিয়ে দিচ্ছে,হাসি মুখে, দাপটের সাথে ,ক্ষমতার সাথে, আর অনেকটা প্রেমের সাথেও ঝরিয়ে দিচ্ছে সকল নিস্ফলতাকে।

অন্তরায় এসে দেখতে পাই উড়িয়ে দেবার মাতন। কাঙাল হয়ে যাবার পরও কী সিদ্ধির ফল পাওয়া যায়? হ্যাঁ পাওয়া যায়। আর তাই বলা হচ্ছে,’তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে’।ব্যর্থতা আর শূন্যতার কাছ থেকে আমরা পালিয়ে বাঁচতে চাই। তবু তখনই কী ফলের দেখা মেলে! কোনো এক গভীর রাত্রি পার হয়ে দেখা দেয় প্রভাতের আলো! হ্যাঁ তাই। এর পরেই থাকে নৈর্বক্তিক প্রশান্তি। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করতে চাই না, এই নির্বাপনের মাঝেই আছে মুক্তির পথ।শূন্যতাকে মেনে নিয়েই আবার নতুন করে জেগে ওঠা যায়। পূর্ণ হওয়া যায়। সেই পরম শূন্যতায় এলেই পাওয়া যায় পরম পূর্ণতাকে।তাই গানের সঞ্চারীর লাইন দুটি হাজার বার পাঠ করি। পাঠ করতে করতে তা মিশে যায় আমার আত্মার সাথে নিমগ্ন হয়ে। ‘শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা/তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা…

কী অবলীলাক্রমে একটি সরল গানের ভিতর ঢুকে যেতে পারে এত বড় বিশাল মাপের একটি অভিব্যক্তি! ছোট্ট বেলায় গানটি ছন্দে ছন্দে গেয়েছি। তখন শুধু জেনেছি তার ছন্দ। শিশুরা এই গানটি খুব নেচে নেচে গাইতে ভালবাসে। কিন্তু এই গানের ভিতরের প্রবল শক্তিটুকু আমি আবিষ্কার করেছি আমার চল্লিশ বছর বয়সে এসে।আর আবিস্কারের পর পেয়েছি নিজের কাছ থেকে নিজের পরিত্রাণ।
অস্থায়ীর শেষ লাইনে এসে আবার মুগ্ধ হই।‘ সব খোওয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্ সকালে’… এই হতশ্রী সংসারে সবই শূন্যতায় পরিনত হয়। তীব্র শূণ্যতাকে ঘিরে মানুষের চিরকালের ভয়। তবু কবি তাকে চেয়েছেন আকুলভাবে। সব হারাবার বোধের দিকে স্থির দৃষ্টিতে। সব হারানোর ব্যথাও যে অনুভূতির স্নায়ুতে স্নায়ুতে আনন্দের প্রবাহ ঘটাতে পারে,তা জানে কয়জনে!এই বিরাট ফাঁককেও যে এমন প্রেম আর মমতা দিয়ে ভরাট করা যায়, তা শিখে নিলাম কবির কাছ থেকে। শাপগ্রস্থ মানুষের হাহাকার ,ব্যর্থতা,মৃত্যু সবই যে শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী ভস্ম থেকে আবার শক্তিতে পরিনত হতে পারে তা কিছুটা জানতে পারলাম জীবনের শিক্ষা থেকে,আর বাকীটা রবীন্দ্রনাথের গানে গানে।

২.

অন্য একটি গান যা আপাতনিরীহ দৃশ্যরূপের আড়ালে থেকে অন্য এক আবিস্কারের দিকে আমাকে একসময় তীব্রভাবে ধাবিত করে। গানটি প্রথম শুনেছি রেকর্ড প্লেয়ারে কনিকা বন্দোপাধ্যায়ের কন্ঠে। ‘মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ-’। মধুর বলবার পর একটি কমা, এই শব্দটিকে দিয়েছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। এক অসামান্য মাধুর্য,ভারহীনতা, আর মুগ্ধতা। দাদ্রা তালের গান,পূজা পর্যায়ের। বেহাগ রাগের স্পষ্টতা আছে গানটিতে। যখন প্রথম শুনলাম তখনও গানটি ভালভাবে বুঝে উঠবার বয়স হয়নি! লিখতে লিখতে ভাবছি, আজও কী ঠিক ঠাক বুঝতে পারি তাঁর গান ! অথবা সত্যিই কী কখনও কোনো বয়সে ঠিক ঠিক বুঝে নেয়া যাবে! সে যে অধরা মাধুরী। গানটির সুরের আড়ালে রয়েছে কল্যাণবোধ, ও সৌন্দর্যতৃষ্ণা। রয়েছে প্রকৃতির এক রহস্যময় অসীমতা,বিরাটত্ব,নিস্পৃহতা আর নীরবতায় আচ্ছন্ন করার প্রবহমান প্রেক্ষিত। রবীন্দ্রনাথের গানে কথার মূল্য এতটাই বেশি যে তার সার্থক রূপটি বারবার পাই সঞ্চারীর মাধুর্যে-

‘সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার ’পরে
অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে।’

গানের এই জায়গায় সুরটি তীব্রভাবে বাজতে থাকে মনের সাথে সাথে চোখের উপরেও। অর্থাৎ যাকে বলে ভিজুয়ালাইজেশন। দৃশ্যের ভিতরে দৃশ্য। অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনের ধারনাটি আজকের প্রেক্ষিতে, ইথারশরীরে কতটা যুক্তিযুক্ত, তা কিন্তু আমরা আধুনিক ডিভাইসগুলির মধ্যে দিয়ে অনেকটাই অনুভব করতে পারি। মনে মনে ভাবি, সেই রহস্যময় সন্ধ্যার একাকী লগ্নে কবির একাধিক সত্তা কী কোনো এক বিশ্বাসের গূঢ় রহস্যের ভিতর এমন একটি অনুভবের প্রজ্ঞায় উপনীত হয়েছিল, এত বছর আগে! কবিদৃষ্টির উৎসারণে এক অন্যরূপ মানস উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যেন সে বলে যায় ভাবীকালের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা। প্রকৃতির সঙ্গে বিজ্ঞান ও দর্শনের এক আর্শ্চয সিনথিসিসের ভিতর অসামান্য মনে হয় এই গানটিকে। মধুর-মধুর-মধুর। যেন বারবার মধুর সম্বোধনেও বহু রঙের বিচ্ছুরণ মোটেই কমে যায় না। বরং প্রকৃতির আর্শ্চয মায়া ও আবেশের ভিতর একাধিক স্বর ও অনুভব অতি –জাগতিক প্রভাব নিয়ে জেগে থাকে।

এই গোধূলির ধূসরিমায়/শ্যামল ধরার সীমায় সীমায়/শুনি বনে বনান্তরে অসীম গানের রেশ।’ গানের শেষের দিকে, গোধূলির ধূসর সীমায় এসে গানটি এমন এক স্বপ্নজগতের আবেশ তৈরি করে দেয়, যেন গানটি পৌঁছে দিতে চায়, ‘ভগবান বুদ্ধের সেই নির্বাণলোকে, যেখানে চাঁদ ওঠে না, কিন্তু অন্ধকারও নেই।’

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>