এক কাপ চা আর তার পেছনের অন্ধকার ইতিহাস
রাস্তঘাটেই চোখে মেলে এমন অতি সাধারণ একটি পানীয় চা। কিন্তু ভারতে একে নিয়ে রয়েছে অসাধারণ এক গল্প। এক কাপ চা অতি সাধারণ বিষয় মনে হলেও বিশ্ব অর্থনীতির গ্লোবাইলাইজেশনে এর অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। এমনকি বলা যায়, দাসপ্রথা বা দাস ব্যবসা এবং শক্ত মাদকের উত্থানকে আরো চাঙ্গা করেছিল চা।
চায়ের বিষয়টি এতটাই সিরিয়াস যে, ডিউক এবং ডাচেস অব ক্যামব্রিজ সম্প্রতি ভারত সফরে চা-কে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি নন।
পৃথিবীর সব দেশে অতি জনপ্রিয় একটি পানীয় চা। গোটা ভারতে চা দারুণ জনপ্রিয়। ‘মাসালা চা’ বলতে পাগল তারা। ভারত থেকে এটি ছড়ায়নি। তবে গোটা বিশ্ব চায়ের মূল উৎস থেকে সরে এসেছে। চা বা ভারতের ‘চায়ে’ শব্দটির মূল উৎস এসেছে মান্দরিন শব্দ ‘চা’ থেকে।
ভারতে প্রথমবারের মতো এটি রিফাইন করা হয়। চাইনিজরা সহস্র বছর ধরে চা পান করে আসছে। ১৭ শো শতকে ডাচ বণিকরা তাদের সফর থেকে এর সন্ধান পায়।
পানীয়টি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথমে ওষুধ হিসাবে গ্রহণ করা হতো। তবে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর কফি শপে আরো আকর্ষণীয় করে তোলা হয় চা।
সেই যীশুর আমলে ভারতে চিনির ক্রিস্টাল তৈরি প্রক্রিয়া বের করা হয়। তারা এক ধরনের মিষ্টি ঘাসের রস বের করতো সেদ্ধ করে। এই ঘাস এশিয়া অঞ্চলে হাজার হাজার বছর আগে চাষ হতো।
কিন্তু আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আঁখ চাষের জন্যে সেই আফ্রিকা থেকে দাস আনা হতো। পরবর্তিতে চিনি উৎপাদন শুরু হয় ব্যাপকভাবে। প্রথমে এটি ইউরোপে বেশ সস্তায় মিলতো। তবে কোথাও কোনো এক সময় এক কাপ চায়ে দুই-এক চামচ চিনি দেওয়ার চিন্তা কারো মাথা থেকে বেরিয়ে আসে। এর পরই তাতে দুধ মিশ্রণের বুদ্ধি আসে। চা হয় আরো ফ্যাশনেবল।
ইউরোপের মিষ্টি চায়ের স্বাদ আমেরিকা এবং আফ্রিকার মধ্যকার দাসপ্রথাকে আরো বেশি চাঙ্গা করে তোলে। অর্থাৎ, এ কারণে পৃথিবীর আরেকটা অংশ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
সেই সময়ের বিচারে চায়ের ইতিহাসকে ‘আফিম যুদ্ধের’ মতো ‘চা যুদ্ধ’ বলা যায়। চা এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়। কাজেই একে মাঝারি ধরনের নারকোটিক ড্রাগ বলে গ্রহণ করা যায়।
১৮ শো শতকে প্রচুর পরিমাণে চা উৎপাদিত হতো চীনে। ব্রিটেন তা প্রচুর কিনতো নিজেদের জন্য। সিল্ক বা পোসালিনের চেয়ে বেশি পরিমাণ কেনা হতো চা। তবে চীনার এ বিনিময়ে তেমন আগ্রহী ছিল না।
চা নিয়ে ব্রিটেন যখন বাজারে কারসাজি করতে শুরু করলো, তখন তা আমেরিকান কলোনিস্টরা ভালোভাবে গ্রহণ করলো না। বোস্টন হারবারে চা বোঝাই একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মাধ্যমে ব্রিটিশরা আমেরিকার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে।
এদিকে, ব্রিটেনের চায়ের প্রতি নেশা গোটা জাতিকে ব্যাংকের কাছে দেউলিয়া বানাতে শুরু করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা ছিল পূর্বে। তারা দেখে, চীন আফিম কিনতে উৎসাহী। তারা ভারতীয় উপমহাদেশে আফিমের বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা কৃষকদের বেশি আফিম উৎপাদনে উৎসাহ জোগায়। যখন চীন আফিমের ব্যবসা অবৈধ ঘোষণা করে, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া চোরাচালানের মাধ্যমে আফিম বিক্রি শুরু করে।
আফিম নিয়ে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া ভবিষ্যতের চায়ের বাজারের ওপর দৃষ্টি রাখতে থাকে। আর এ কাজে ভারতকেই তারা বেছে নেয়। ১৮৩০-এর দশকে প্রথমবারের মতো ভারতের আসামে টি স্টেট গড়ে তোলা হয়। চা গাছের চারা আনা হয় চীন থেকে। আঁখের মতো চা উৎপাদনের দাসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ১৮৩৩ সালে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। এরপর বিকল্প বের করেন ইস্ট ইন্ডিয়া মেধাবী মস্তিষ্কগুলো। দাসের পরিবর্তে কম্পানি চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করে। ধীরে ধীরে তারা ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের চা রপ্তানি শুরু করে।
প্রাথমি অবস্থায় এই মূল্যবান চা কেবলমাত্র রপ্তানির জন্যে উৎপাদন করা হতো। কিন্তু ভারতীয়রাও চা পান করতে শুরু করে। চিনি ও দুধের মিশ্রণে তারা ব্রিটিশদের অনুসরণ করে। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘মাসালা চায়ে’।
ব্রিটিশদের মতো বাড়ির সামনে লনে বসে আরাম করে চা পানের বিষয়টি ভারতীয়রা গ্রহণ করে নেয়। কিন্তু ক্রমে দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে চা পান ও বানানোর প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন আসে।
প্রথমত, ভারতীয় উপমহাদেশের চা ব্রিটিশদের চেয়ে অনেক বেশি কড়া, দুধপূর্ণ এবং মিষ্টি হয়ে ওঠে। চা বিক্রেতারা শিল্পী বনে যান যারা চা তৈরি করতে জানেন। এখানে দুধের সঙ্গে কড়া চা মেশানো হয়। তুলনামূলক অনেক বেশি চিনি দেওয়া হয়। আবার অনেকে আদা বা দারুচিনি মেশানো শুরু করেন। আরো আকর্ষণীয় চা বিক্রেতারা হয়তো এলাচ বা মরিচের মিশ্রণে ভিন্ন কোনো স্বাদ আনেন।
অবশেষে মিষ্টি, মসলাপূর্ণ তরল প্রতি চুমুকে ভিন্ন স্বাদ দেয়। ছোট ছোট পাত্রে গরম ধোঁয়া ওঠা চা পান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সবাই এক কাপ গরম চা উপভোগ করুন। তবে চা পানের সময় তার অন্ধকার ইতিহাস মাথায় আনার প্রয়োজন নেই। অবশ্য আন্তর্জাতিক ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে এবং পৃথিবীকে সীমাহীন সম্পদশালী করতে এই চায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সূত্র : বিবিসি
