ইরাবতীর বর্ষবরণ গল্প: হোটেল ক্ষিরোদেশ্বরী । নিবেদিতা আইচ
ক্ষিরোদেশ্বরী হোটেলে সকাল থেকে চুলা জ্বলেনি আজ। শিবু, দেবু তো বটেই গত কুড়ি বছরে এমন দিন দেখেনি সবচেয়ে পুরনো কর্মচারী খগেন্দ্রনাথও। সেই ভোরবেলা দোকান খুলে ঝাট দিয়ে জল ছিটিয়েছে ফুট ফরমাস খাটবার জন্য রাখা নতুন ছেলেটা। প্রতিদিনের মতো স্নান সেরে ধুপ আর মোমও জ্বেলেছে লক্ষ্মীঠাকুরের ছবির সামনে। সেও এখন বোকা বোকা মুখ করে বসে আছে। সবাই সময়মতো কাজে এসে গেছে, রোজ যেমন আসে। এসে অব্দি দেখছে রান্নাঘরের সামনে মুখ গোঁজ করে বসে আছে খগেন্দ্রনাথ।
প্রতিদিন শিবু আর দেবু দুভাই দোকান বন্ধ করে রাতে একসাথে বের হয় ৷ ট্যানারি মোড় পর্যন্ত কখনো হেঁটে কখনো অটোতে চেপে যায় একসঙ্গে, তারপর বাঁদিকের রাস্তা ধরে শিবু বাড়ি ফিরে যায় আর দেবু চলে যায় ক্ষিরোদেশ্বরী দেবীর বাড়ি। রোজ রাতে ওখানে গদিঘরে ঘুমায় সে। ক্ষিরোদেশ্বরী দেবীর ছেলে বিদেশে ল পড়তে চলে যাবার কিছুদিন পর থেকেই এ নিয়ম হয়েছে৷ মাঝে তার শ্বশুর মারা গেলেন। একবার ডাকাতও পড়লো বাড়িতে। পাহারা দেবার জন্য তাই লোক থাকতে হয়।
দেবুর দিকে চোখ মটকাচ্ছে বড়ভাই শিবু। সাড়ে সাতটা বেজে গেল। এখনো কাজ শুরু হয়নি বলে তার ভালো লাগছে না কিছুই। তার ওপর দেবু কেমন নির্বিকার হয়ে আছে তখন থেকেই। যেন সে জানতো এমন কিছু ঘটবে। মুখে পান দিতে দিতে ওকে কনুই দিয়ে গুতো দেয় শিবু। কুইচ্চা মুরগির মতো টিপ মাইরা বইয়া থাকলে চলবো? ঐ মোড়া গিয়া দেইখ্যা আয় য্যা!
তাড়া খেয়ে দেবু উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ে না৷ ইতস্তত করে। হোটেলে আসবার আগে রান্নাঘরের চাবি আনতে সে একবার গিয়েছিল দোতলায়। ক্ষিরোদা দেবীর দরজা তখন বন্ধ পেয়েছে। ডাকাডাকি করে সাড়া না পাওয়ায় এক পর্যায়ে খানিকটা ভয় পেয়েই বেরিয়ে এসেছে সে। ঘুমের মধ্যে মরে টরে গেছে কিনা কে জানে!
তখন থেকে খগেন্দ্রনাথ কয়েকবার জেরা করে ফেলেছে দেবুকে। ক্ষিরোদেশ্বরীকে নিয়ে খগেন দুশ্চিন্তাতেই পড়েছে। শরীর খারাপ হয়নি তো মানুষটির? গত কুড়িটা বছর ধরে ভোর সাড়ে ছটার মাঝে স্নান সেরে যে মানুষ ঘরদোর গুছিয়ে ঠিক পৌনে সাতটায় দোকানে পা রাখে, দুর্গাষ্টমীর পূজা ছাড়া একটা দিনও যার ব্যতিক্রম দেখেনি সেই মানুষ আজ নাকি নিজের ঘরের দরজাই খোলেনি। ব্যাপারটা তো দুশ্চিন্তারই!
-দিদিমণিয়ে রাও হরছিল নি? ঐ দেবু, তুই হুনছস তো ঠিক কইরা? খগেন্দ্রনাথ এতক্ষণ বসে থেকে এবার উঠে এসেছে। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শিবুও। দেবুর তবুও সাড়াশব্দ নেই। এবার খগেন্দ্রনাথই হনহন করে বেরিয়ে গেল হোটেল থেকে। দেবু মনে করার চেষ্টা করছে গতকাল রাতের কথাগুলো। বের হবার আগে খাবারটা হোটেলে খেয়ে নিয়েছিল সে, রোজ যেমন খায়। তারপর দাদাকে ট্যানারি মোড়ে নামিয়ে দিয়ে ক্ষিরোদা দেবীর বাড়ি গেছে। সাড়ে দশটা নাগাদ সে গদিঘরে ঢুকেছিল। মনে আছে পাশের বাড়িতে তখন উঁচু ভলিউমে আবহাওয়ার খবর চলছিল। বাড়িটি দোতলা। ক্ষিরোদেশ্বরী থাকেনও দোতলাতেই। সবচেয়ে দক্ষিণের ঘরটাতার। ঘরের বাতি জ্বলছিল তখনো।বাড়িতে কেউ এসেছিল। নিচতলায় বসার ঘরের বাইরে থেকে শব্দ শুনতে পেয়েছিল, বাইরে স্যান্ডেলও দেখেছিল দেবু। অসময়ে এটা ওটা কাজ ধরিয়ে দেবে ভেবে সে আর ভেতরে উঁকি দেয়নি। এই এক বৃত্তান্ত শিবু ঘুরেফিরে বারবার শুনতে চাইছে। সত্যি বলতে খগেনের মতো শিবুও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। ক্ষিরোদা দেবীর ভালমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে তাদের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। দেবুর তো সংসার নেই তাই চিন্তাও নেই। ও এমন হাওয়া খেয়ে বেড়াবে, কদিন আগেও যেমন বেড়াত। তখুনিই খগেন্দ্রনাথকে ফিরতে দেখে শিবুর ধরে প্রাণ এলো যেন, ছুটে এগিয়ে গেলো সে৷ মুখটা থমথমে হয়ে আছে মানুষটার। এবার দেবুর বুক ঢিপঢিপ করছে। খারাপ কিছু হয়ে গেলে তার ঘাড়েও দায় পড়তে পারে। দোষ কিছু আছে বৈকিওর। অত রাতে ওরকম চেঁচামেচি শুনেও তো সে বের হয়ে একবার দেখেনি। লোকটা কে ছিল? ক্ষিরোদা দেবীর স্বামী? কিন্তু সে লোক তো কবে মরে ভূত হয়ে গেছে! চিৎকার করে জমিজমা নিয়ে কীসব যেন বলছিল লোকটা। তা সে সামান্য কর্মচারী হয়ে এদের পারিবারিক ফ্যাঁসাদে পড়তে যাবেও বা কেন! বেশ করেছে বের হয়নি৷ কিন্তু এখন সে এগিয়ে গেল ঠিকই। খগেন্দ্রনাথ কী খবর নিয়ে এসেছে জানতে খুব আগ্রহ হচ্ছে তার।
-কী কইন খগেনদা, হেই ব্যাডা না কুনকালেই মইরা গেছিল? শিবু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। খগেনদা হাতের তেলো দিয়ে মুখের ঘাম মুছছে, ছুটতে ছুটতে এসেছে লোকটা।
-হেই সুমু বেহে মিল্যা বিছরাইছি, ফাইছি না, মনো হরছি মইরা গ্যাছে। ব্যাডায় আসুলে আরেক মোড়া গিয়া বেয়া হরছিল। অহন ভাত পায় না দেইখ্যা বুলে আয়া পড়ছে৷
-এতদিন বাদে নি এইনো আইলো! এরামো! মুখটা লালচে হয়ে আছে খগেনের। বেঞ্চির দিকে তাকাতেই এবার যেন পিত্তিটা জ্বলে গেল তার। চোখমুখ কুঁচকে হাক দিয়ে উঠলো লোকটা।
-অই বাপ্পী, অই ছ্যাড়া এই ল চাবি। চুলা জ্বালা! খাড়া আজকা তর ঘুম আমি বাইর করাম। বাপ্পী মানে নতুন ছেলেটা, কাজকর্ম না থাকায় বাইরে রাখা বেঞ্চিতে খানিকটা ঘুমিয়ে নিচ্ছিল। হাকডাক শুনে এবার ধড়মড় করে উঠে বসলো। একটু পর চুলা জ্বললে আর কুটোবাছা শুরু হলে এক কোণে বসে লুচির জন্য ময়দা ময়ান করতে থাকে দেবু। মনে মনে ঠাকুরের নাম নেয়, বুকে থুতু ছিটায়। যা ভেবেছিল সে রকম খারাপ কিছু হয়নি ভাগ্যিস। তবে ঝামেলা যেটুকু হয়েছে তা মেটেনি। খগেনদা নইলে এমন গম্ভীর হয়ে থাকতো না। ডুমো ডুমো করে কেটে রাখা আলু, পটল, কুমড়োগুলো অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় তুলতে তুলতে শিবু নিচুস্বরে ডাক দেয় খগেনকে৷
-অ খগেনদা, দিদিমণি আইজকা বেন আর আইতো না! পায়েসটা হইবো কিবা? এই এলাকায় নিরামিষ হোটেল আর একটিও নেই। পাশেই সিদ্ধিপুর কালী মন্দির। উপবাসী লোকজন পূজা অর্চনা সেরে এখানে বসে শান্তিমতো খেয়ে নেয়। দূর দূরান্ত থেকেও গাড়ি ভাড়া করে ভক্তরা এলে ক্ষিরোদেশ্বরী হোটেলে এসেই বসে৷
ক্ষিরোদা দেবী আগে অন্তত তিন কি চারপদ নিরামিষ নিজ হাতে রাঁধতেন। সয়াবিনের মালাইকারী, পনিরের ডালনা, ছানার রসা, মোচার ঘন্ট,আলু পোস্ত তার হাতের এসব আইটেম লোকজন একবসায় কয়েক দফা করে অর্ডার দিত। আজকাল বয়সের কারণে হোক, লোকের চাহিদা বাড়ার কারণেই হোক একহাতে সেসব আর অত পারেন না। তবে লাবড়া, রাবড়ি পায়েস আর সুজির মোহন ভোগটা তিনি নিজেই করেন এখনো। আজ এই পদগুলো কী করে হবে ভাবতে গিয়ে গলা শুকিয়ে আসে শিবুর। খেতে বসে লোকজন তো গাল দেবে ওদের।
সে চাপা গলায় ডাক দেয়- ও খগেনদা! কইনছে দিহি কিবা ভাও করাম? খগেন্দ্রনাথ যেন শুনতেই পায়নি কিছু৷ গরমতেলে পাঁচফোড়ন আর শুকনো মরিচ ছেড়ে দিয়ে সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে আলতো করে খন্তা নাড়ছে। শিবু অস্থির হয়ে ওঠে। খগেনদা গো, হুনুইন না ক্যারে! খগেন এবার খানিকটা কেশে গলা পরিস্কার করে। তারপর বলে- দিদিমণিয়ে কইলো একখান পদও য্যান কম না হয় খগেন, তুই যা, আমি হেই বেলা ঘুরান দেম নে। এলিগাই না হুড়মুড়ায়া আয়া হড়ছি!
-হেই মানুষডা থাকব কয়দিন এবা? কী মনে অয় গো খগেনদা?
-কিবায় কইতাম! আর কুনোহানে বেন যাওনের দিশ ফাইছে না ব্যাডায়! চুলায় সোনা রঙের মুগডাল টগবগ করে সেদ্ধ হচ্ছে। কথা বলতে বলতে খোসা ছাড়ানো ঝিঙ্গেগুলো একে একে তার মধ্যে ছেড়ে দেয় খগেন। তারপর আবার অন্যমনস্ক চোখে জানালার বাইরে চোখ রাখে।
তার মনে আছে ক্ষিরোদা দেবীর স্বামী বিনয়চন্দ্র লোকটি যৌবনকালে বেশ কয়েকবার নিরুদ্দেশ হয়েছিল। স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র পুত্র। শুরু থেকেই ওরকম খামখেয়ালি আর বাউন্ডুলে স্বভাব। তার ওপর বিয়ের দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হবার পরেও ঘরে ছেলেপুলে আসেনি। এমন লোককে সংসারে বাধার অন্য কোন মন্ত্র বা ছলাকলা বোধ হয় ক্ষিরোদা দেবীর জানা ছিল না। খগেন দেখেছে দীর্ঘদিন পর ফিরে এসে আবার বাড়ি ছাড়ার উপক্রম হলে কতদিন স্বামীর পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করেছেন ক্ষিরোদা দেবী।
খগেন্দ্রনাথ তখন ও বাড়িতেই ফুট ফরমাস খাটতো। এই নিরামিষ হোটেল তখনো চালু হয়নি। শুরু থেকেই বিনয়চন্দ্র কোনোরকম চাকরি কিংবা ব্যবসায় স্থির হয়ে থাকতে পারেনি বলে সংসারে তার আর্থিক অবদান ছিল না কখনোই৷ ফলে পারিবারিক জমিজমা থেকে যা আয় হতো তা দিয়েই চলতো এককালের সম্ভ্রান্ত এই পরিবারটি।
মাঝে টানা দু’বছর বিনয়চন্দ্র বাড়ি ফেরেনি৷ ক্ষিরোদা দেবী তখন সংসারের হাল ধরেছিলেন। টুকটাক কাজকর্ম করে ঠিক চালিয়ে নিচ্ছিলেন। একবার তার শ্বশুর শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে অবস্থা যখন প্রায় মরো মরো, বিনয়চন্দ্র কোথা থেকে খবর পেয়ে ঠিক এসে হাজির হলো। সেবার ছেলেকে শিক্ষা দিতেই হয়ত তার সামনে ক্ষীরোদা দেবীকে মোটা অংকের নগদ টাকা তুলে দিয়েছিলেন বৃদ্ধ লোকটি। ছেলের কাকুতি মিনতি, অভিমানের কথা কিছুই শোনেননি।
বিনয়চন্দ্র তবু এক সপ্তাহ বাপের চারপাশে ঘুরঘুর করলো, আকারে ইঙ্গিতে উইলটা নিজের নামে করিয়ে নিতে চাইলো। সেবার তার অনুমান মিথ্যে করে দিয়ে বুড়ো লোকটি সুস্থ হয়ে উঠলেন।সুস্থহলেন ক্ষিরোদা দেবীর সেবার গুণে।
বিনয়চন্দ্র গভীর হতাশা নিয়ে ফের নিরুদ্দেশ হলো। সেই যে গেল আর ফিরেই এলো না। এলে দেখতে পেতো সে চলে যাবার একমাসের মাঝেই তার স্ত্রীর শরীরে গর্ভধারণের লক্ষ্মণ দেখা দিয়েছে। আর সেই নগদ টাকা দিয়ে সিদ্ধিপুরে প্রথমবারের মতো একখানা নিরামিষ হোটেল খোলা হয়েছে, শুরু থেকেই যার প্রধান পাচক স্বয়ং ক্ষিরোদেশ্বরী দেবী, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যার রান্নার সুখ্যাতি ছড়িয়ে গেল আশেপাশে সব এলাকায়।
ক্ষিরোদেশ্বরীর ছেলে হবার পর বিনয়চন্দ্রকে খগেন্দ্রনাথ হন্যে হয়ে খুঁজেছিল। কোথাও খুঁজতে বাকি রাখেনি। দীর্ঘদিন তোলপাড় করে সন্ধান করবার পর একসময় জানাগেল লোকটা আরেক মহিলার সাথে সংসার শুরু করেছে। ততদিনে বিনয়চন্দ্র ও ক্ষিরোদেশ্বরীর ছেলের বয়স চার কি পাঁচ হয়ে গেছে। টানা দুদিন তত্ত্বতালাশ করে নিশ্চিতভাবে সব জানবার পর খগেন বাড়ি ফিরে এলো। ফিরতেই ক্ষিরোদা দেবীর সামনে পড়লো। প্রতিবারের মতো হতাশ হতে হবে জেনেও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ক্ষিরোদা। খগেনের সেদিন কী হয়েছিল তা এই এতগুলো বছরেও সে নিজেই ঠিক বুঝতে পারে না। মুখের ওপর মিথ্যে বলে দিয়েছিল। বলেছিল সে শুনে এসেছে ঠিক ওরকম দেখতে একজন লোক মাসখানেক আগে গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে। ক্ষিরোদা দেবী এমন খবর শুনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি কথাটি। তাই আজ অব্দি শাঁখা নোয়া কিংবা সিঁদুর পরা ছাড়েননি । কেবল সেদিনের পর থেকে রঙিন, ছাপা প্রিন্টের কাপড় বাদ দিয়ে ফ্যাকাশে, একরঙ্গা একপেড়ে শাড়িই পরেন।
দিদিমণির মতো এমন লক্ষ্মীঠাকুরের পাশে ঐ হতচ্ছাড়া লোকটাকে ভাবলে বিতৃষ্ণাই লাগে খগেনের। নেশা করে, বাউন্ডুলের মতো চক্কর কেটে কেটে বিনয়চন্দ্র দেখতে এখন ঠিক ভিখারির মতো হয়েছে। সকাল সকাল সে চেহারা দেখে এসেছে খগেন, রীতিমতো অশ্রদ্ধা লেগেছে তার। সহ্য করতে পারেনি বলে চলে এসেছে সে। শুধু সেজন্য নয়, ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিও কি কম হচ্ছে তার? ওরকম একটা কথা গোপন করা কি ঠিক হয়েছিল তখন? শুধু কি গোপন করেছিল! বানিয়ে বানিয়ে মৃত্যু সংবাদ দিয়েছিল৷ এতবড় মিথ্যাচারের কী ব্যাখ্যা সে দেবে নিজেও বুঝতে পারছে না। এরপর ক্ষিরোদেশ্বরীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে কি? যতই সময় যাচ্ছে এই এক ভাবনা এখন ওকে গিলে খেতে চাচ্ছে। রান্না শেষ করে বাইরে এসে সেই কখন থেকে ফ্যানের হাওয়ায় বসেছে। তবু অনবরত দরদর করে ঘামছে সে।
দুপুরের আগেই ক্ষিরোদেশ্বরী হোটেলে এসে হাজির হলেন। দোকানে লোকজনের ভিড় অন্যদিনের মতোই। সোজা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলেন তিনি। শিবু তখন পা দুটো ছড়িয়ে বসে নারকেলের গরম গরম গরম পুর হাতে নিয়ে একের পর এক নাড়ু করছে। আর দেবু বড় বড় দুটো হাঁড়িতে দুধ জ্বাল দিতে ব্যস্ত। কাল সত্যনারায়ণ পূজা, তার জন্য সন্দেশ আর প্যারা তৈরি করতে হবে আজই। মনে আছে কি ওদের? ক্ষিরোদা দেবী সেখানে খগেনকে দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক খোঁজ করতে শুরু করলেন।
সবাই কাজ ফেলে জড়ো হলো ওখানে। দিদিমণির সাজপোশাক দেখে সবাই বিস্মিত। ক্ষিরোদার গলার শব্দ পেয়ে খগেনও ধীর পায়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।শুধু গায়ের কাপড় বদলেছে বলেও নয়, চোখমুখ ফোলা ফোলা লাগছে, সারারাত বোধ হয় কেঁদেছেন ক্ষিরোদা। কামের সুমু এরুম আক কইরা চায়া থাকলে চলবো?
ক্ষিরোদা দেবী কাজ বন্ধ দেখে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে খেপে ওঠেন এবার। সুজির মোহন ভোগটা এখনো হয়নি কেন জানতে চেয়ে চেঁচামেচি শুরু করেন। সারাদিন ধরে ঝিমাতে থাকা হোটেলের পরিবেশটা মুহূর্তেই বদলে গেল। কৌতূহল চেপে রেখে যে যার কাজে ফিরে গেলে খগেনের ডাক পড়ল। মিনিট খানেক সময় নেন ক্ষিরোদা দেবী। তারপর থেমে থেমে বলেন- তুই ঠিহই করছিলি খগেন, আমার ছ্যাড়াটা মানুষ হইতো না এমুন বাপের লগে থাকলে।
গতকাল দোতলায় বসে ঠিক এ কথাটা ভাবছিলেন তিনি। দূর থেকে গলাটা শুনেই চিনতে পেরেছেন লোকটিকে। তখন থেকেদরজায় খিল তুলে দিয়ে নিশ্চুপ বসে ছিলেন নিজের ঘরে। অনবরত চেঁচামেচি করে, গালাগাল করে যখন কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি তখন খানিকটা কাকুতি মিনতি করেছে বিনয়চন্দ্র।
ক্ষিরোদেশ্বরী বুঝতে পারছিলেন এত বছরের ব্যবধানেও যার স্বভাব বদলায়নি, স্ত্রীকে অপমান করতে যার এখনো একফোঁটা লজ্জা হয় না তাকে আর গ্রহন করে নেবার মানে নেই। সারারাত জেগে থেকে পুরনো সব কথা নেড়েচেড়ে দেখেছেন ক্ষিরোদা, নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করেছেন।
অল্প সময়ের জন্য ঘুম এলেও ভোরে দেবুর ডাকে বিছানা ছাড়তে হয়েছে তাকে। দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়ানো অর্থহীন শেকলগুলো খুলে রেখে আগাগোড়া সাদা রঙে নিজেকে জড়িয়ে নিতেই এতগুলো বছরের অপেক্ষা, ক্লান্তি সব ধুয়ে মুছে যেন মনের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি এসে জুড়ে বসলো। দরজা খুলে নির্বিকার ভঙ্গিতে লোকটির মুখোমুখি হলেন তিনি। মুখের ওপর লোকটাকে অস্বীকার করলেন। বললেন- এ তো অন্য লোক, তার স্বামী তো কবেই মরে গেছে! এত বড় কথা সহজে মানতে চায়নি বিনয়চন্দ্র। তেড়ে গিয়েছিল ওর দিকে।
খগেনের শুকনো মুখটা দেখে ক্ষিরোদা দেবী ফিক করে হেসে ফেললেন এবার। বললেন পুলিশের ভয় দেখাতেই নাকি চুপসে গেছে লোকটা, ভয়ে কেঁচোর মতো সটকে পড়েছে কোথাও। খগেনের বিস্ময় কাটে না। সে চেঁচিয়ে ওঠে- হাছোই? কী কইন দিদি! বিধবা বেডিরে ত্যাক্ত হরন এতু সুজা? তুই আর মন খারাপ হরিস না। এমুন একখান স্বামী বাঁচলেই কী আর মরলেই কী! খগেন তবু অনুতাপে মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে বলে ওঠে- সংসারডা বেন আমিই ভাঙছি দিদিমণি… গলাটা ভেঙ্গে আসে ওর৷ কথা জড়িয়ে যায়। বুকের কাছে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
ক্ষিরোদা দেবী হাতের ইশারায় তাকে চুপ করতে বলেন। আরে পাগলা! সংসার তো এই মোড়া! হুটেল ক্ষিরোদেশ্বরীই আমার সংসার। কথাটা বলতে বলতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘরের আয়োজন দেখতে চলে গেলেন তিনি।
জন্ম ২ এপ্রিল, চটগ্রামে। বাবার চাকুরীসূত্রে তার শৈশব কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন মফস্বল শহরে। তিনি পেশায় চিকিৎসক। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা এবং খবরের কাগজে নিয়মিত লেখেন। ব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখিতেই তিনি মনের খোরাক খুঁজে পান।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ -কিছু গল্প অবাঙমুখ (২০১৮), নৈর্ঋতে (২০২০)।