১৯৯২ সালে একটা আজব ঘটনা ঘটলো। আমি একটা চাবি খুঁজে পেলাম। খুঁজে পেলাম চৈত্রের শেষের দিনে। বাংলা ১৩৯৮ সাল। পরদিন ১৩৯৯ শুরু হবে। ঠিক এমন এক চৈত্রের শেষে, বৈশাখ আসি আসি সন্ধ্যায় একটা চাবি খুঁজে পেলাম। তখন আমি ছোট। কিন্তু স্মৃতি স্পষ্ট। প্রতিবছর আমি, আমার বোন বৈশাখের দিন ভোরে মা-বাবার কোল চেপে, হাত জাপ্টে, ছায়ানটের বর্ষবরণে যেতাম। চাদর পেতে আমরা উঠি উঠি সূর্যের সাথে নতুন বছরকে নেচে গেয়ে জাগিয়ে তুলতাম, আর সবার মতন।
কিন্তু ১৯৯২ সালে বৈশাখের আগের দিন, চৈত্রের সন্ধ্যেতে আমি একটা চাবি খুঁজে পেলাম। আমার সে সময়ের পড়া উপকথা, লোককথা, রূপকথায় -এমন চাবির গল্প আমি পড়েছি। এই প্রথম নিজের হাতে সেই চাবি ছুঁলাম। ১৯৯২ সালের সেই সন্ধ্যেয় আমরা মা-বাবার সাথে সেজেগুজে টুকটুকে হয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। বাকি জীবনের জন্য আলো বাতাস ভরা এক বারান্দার দরজা খোলার যে চাবি, সেদিন আমি সেখানেই পেয়েছিলাম। সেদিন যে চাবি পেয়েছিলাম, সেটা আমি বুঝেছিলাম অনেক বছর পরে। এখন আমি চাইলে, যখন ইচ্ছা তখন, সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘ্রাণ নিতে পারি, সবটুকু প্রাণ ভরে। বারান্দাটা এখনো আমার। আর ভাবি, ভাগ্যিস চাবিখানা খুঁজে পেয়েছিলাম।
ইন্দিরা রোড। একটা দোতলা বাসা। আমার ছোটবেলার স্মৃতি আতিপাতি খুঁজলে অনেক কিছু মনে পড়বেনা হয়তো। সেই বাড়িতে যাওয়ার পথও আমি হারিয়ে ফেলবো। কিন্তু এমন ভালবেসে দাঁড়িয়ে থাকা সুখী দোতলা বাড়িটির কথা আমার মনে আছে। আর সামনে বিশাল বাগান। খোলা জায়গা। শুনছিলাম চার কাঠা জুড়ে? এই বাড়ির মানুষদেরকে আমি চিনতাম। আমাদের বাড়িতে তাঁদের নিত্য আসা-যাওয়া। কিন্তু এ বাড়িতে আমার স্মৃতি শক্ত হবার পর, আর কখনো এসেছি কিনা মনে পড়ছে না। কিংবা আগে আসিনি। ১৯৯২ সালে চৈত্রের গুনগুনে সন্ধ্যায় আমার স্মৃতির সাথে তার আজীবনের সখ্য হলো।
এই বাড়িটি এক ঝকমকে মানুষের। আমার ছোটবেলায় দেখা। লোক মুখে সেই মানুষের নামেই বাড়িটি পরিচিত। কাজী আরিফ। সেই যে আবৃত্তিকার, স্থপতি, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিকর্মী? ওই যে ঝনঝনে কণ্ঠ, কাটা কাটা উচ্চারণ – “বল বীর – বল উন্নত মম শির! শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির! বল বীর।” বিটিভির কল্যাণে কী পরিচিত সে কণ্ঠ।
আমি তার এত গালভরা পরিচয় তখন জানতাম না। আমি চিনতাম আমার বাবার বন্ধু হিসেবে। আরিফ চাচা – প্রজ্ঞা লাবণী আন্টি। আমার বাবা মায়ের বন্ধু। তাদের কি ঝলমলে কণ্ঠ, কী সুন্দর করে আবৃত্তি করে, কথা বলে। আমি এটুকু বুঝতাম। আমাদের বাড়িতে এলে, “আরিফ চাচা আমার কবিতার বই খুলে আমার সাথে কবিতা পড়তেন, শেখাতেন।” আমি এমন করেই উনাকে চিনলাম। আর সেই চৈত্রের সন্ধ্যেতে, আমি দেখলাম, সেই দোতলা বাড়িটি। আরিফ চাচা-লাবণী আন্টির বাড়ি। সবকিছু পরিপাটি। আমাদের মতন সেজেগুজে উৎসব চেহারা করে এসেছেন কতজন। মেয়েদের খোঁপায় বেণিতে ফুল। ছেলেরাও ফিটফাট। আর আমরা ছোটরা যেমন খুশি তেমন আনন্দে আছি। ঘরের ভেতরের ছোট্ট একটা আয়োজন। কবিতাপাঠ। সাথে গান। চারপাশে কোন এক উৎসব গুনগুন করছে। সেটি বোঝার জন্য বয়সে, জ্ঞানে অনেক বড় মানুষ হতে হয় না। আমরা মেঝেতে শুয়ে, উপুড় হয়ে আসনপিঁড়ি হয়ে, সহজ হয়ে ডুবে গেলাম, সেই উৎসবের পাঠ-গীতিতে। নতুন বছর আসি আসি করছে। জানলাম চৈত্র সংক্রান্তি।
কাজী আরিফের মুক্তকণ্ঠ আবৃত্তি একাডেমির সেই চৈত্র সংক্রান্তি চললো, এক যুগ প্রায়। ঘরের ভেতরে শুরু হলো। আর তো থামল না। দু’বছর পর, ঘর ছেড়ে বাইরে। সামনের সেই চার কাঠা জায়গা, সেটি জুড়ে। সেই বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতে বাম পাশে খোলা মঞ্চ। ঢাকা শহরে, এমন চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব শুরুর অনেকখানি কৃতিত্ব দাবি করে, ইন্দিরা রোডের এই সুখী বাড়িটি, আর এর সাথে জড়িয়ে থাকা সকল মানুষেরা। সেই ১৯৯২, এর থেকে প্রতিবছর, অধীর আগ্রহে, গুছিয়ে সেজে অপেক্ষা বাবা কখন ফিরবে কাজ থেকে, মা কখন ফিরবে। কখন আমরা যাবো? এমন উৎসব, এমন আনন্দ কোথায় আছে আর, যেখানে প্রতিটি মানুষ গুরুত্বপূর্ণ।
যে প্রথম দুটো বছর, ঘরে আয়োজন হল, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্বয়ং এসেছিলেন এ আসরে। এসেছিলেন শামসুর রাহমান। পরিসর বড় হল। ঘর ছেড়ে বাইরে। বার বছর ধরে, আমিও ছোট থেকে বড় হতে হতে চিনলাম, এ দেশের মুক্তকণ্ঠ, সৃজনশীল মানুষদের। এ আসরের প্রথম দিকে, আমি প্রথম শুনেছিলাম, পরম শ্রদ্ধেয় আলী যাকেরের কণ্ঠে কবিতা। তিনি যেন নিজেই এক কবিতা। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ প্রাণ পায়। আর শ্রদ্ধেয় সারা যাকেরের সাথে তাঁর যুগলবন্দী। আহা। আমি হয়তো বুঝি না অর্থ তখন সবটুকুর, কিন্তু আমি বুঝি কী অদ্ভুত সুন্দর। আমার কাছে চৈত্র সংক্রান্তি এক শুদ্ধ আকর্ষণ হয়ে উঠলো। যেমন ইন্দিরা রোদের বাড়িটি। এর পর কাকে দেখিনি, চিনিনি? কলিম শরাফী, সৈয়দ হাসান ইমাম, লায়লা হাসান,মোস্তফা নুরুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, তারিক আনাম খান, নিমা রহমান, খালেদ খান, আর সদ্য হারিয়ে ফেলা পরম প্রিয় মিতা হক। এঁনাদের কথা মনে পড়ছে এখন। এক ঝলকে। আর কে আসেননি? দেশের শুদ্ধ সংস্কৃতির আন্দোলনে জড়িয়ে থাকা, যাদের কথা মনে হয় তাঁরা প্রায় সবাই। কেউ এমনি এসে বসে থাকতেন না। গাইতেন, বলতেন – কবিতা, স্মৃতি। কী হাসি, কী নির্মল আনন্দ।
আমরাও বাদ যেতাম না। আরিফ চাচা তো কাউকে বসে থাকতে দেবে না। “কী পড়বি বল? কবিতা আবৃত্তি করতেই হবে।” রবি ঠাকুরের ছোটদের কবিতার বই, সুকুমার রায়কে হাতে ধরিয়ে দিতেন। “না প্র্যাকটিস কর, সবাইকে মঞ্চে যেতে হবে।” এমন করে মঞ্চে দাঁড়ানো শিখতে শিখতে, ভয় কেটে গিয়েছিল কবে। সেজন্যই কী আজ ও ভয় পাই না, সামনে এসে দাঁড়াতে? মনে আছে, প্রথম সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, রবি ঠাকুরের “অন্য মা”।
এই যে ঘর থেকে বাইরে, ছোট থেকে বড়, আয়োজন ফুলে ফলে লতায় পাতায় বেড়ে উঠলো, খাওয়ার কমতি কিন্তু হতো না কক্ষনো। যে আসতো পেটপুরে খেতে পারতো। সেই বড় বড় ফুলকো লুচি, সবজি, ঘন ডাল, বুন্দিয়া। আলুর দম ও ছিল বোধহয়। আর তেঁতুলের শরবত। খই মুড়ি বাতাসা, যার যত ইচ্ছে, গল্পে আড্ডায়। আর আমাদের জন্য, ছোটদের জন্য ছিল এক আকর্ষণ। এক আইসক্রিমওয়ালা তার আইসক্রিমের গাড়ি নিয়ে মূল গেটের ভেতরে থাকত। আরিফ চাচা আমাদের হাত ধরে নিয়ে যেত। “কী খাবি খা।” আমরা যা চাই আইসক্রিমওয়ালা সেই টিনের গাড়ির সাথে লাগোয়া বাক্সর পেট থেকে বের করে দেয়। চকবার? ললি? পেংগুইন আইসক্রিম আছে? আরিফ চাচা বলতেন, “আচ্ছা যা মন চায় খা।” আমরা সবাই মিলে সেই যেমন ইচ্ছে তেমন আইসক্রিম খেতাম।
আর ঠিক যখন রাত ১২টা, প্রায় প্রতিবার, মঞ্চে এসে দাঁড়াতেন, পরম শ্রদ্ধেয় সৈয়দ হাসান ইমাম। চাঁদ, সূর্যের হিসাব এখানে চলেনা। তিনি সেই হাসিতে মাখানো মিষ্টি মধুর মুখে, ঝিলমিল হাসিতে বলতেন, “কাল বাংলা নতুন বছর শুরু।” তার সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ত গুনগুন করে, কাল নতুন বছর, নতুন একদম। পুরনো দিনকে হাসিমুখে আদরে রেখে এসে, নতুন দিনের শুরু করতাম আমরা।
সেই ১৯৯২, তারপর দশ কি বার বছর, ঢাকা শহরকে চৈত্র সংক্রান্তির আনন্দে ভরপুর করে দিল ইন্দিরা রোডের বাড়িটি। তারপর হয়নি আর এ উৎসব ওই বাড়িটিতে। কিন্তু এ শহর চিনেছিল, জেনেছিল চৈত্র সংক্রান্তির আনন্দ। তারপর কত পথে, নানা সুরে, অন্য ঠিকানায় এ শহর উৎসব খুঁজে নিয়েছে বছরের শেষ দিনে।
সেই চাবিটি, যাকে খুঁজে পেয়েছিলাম ইন্দিরা রোডের সেই সুখী চেহারার বাড়িটিতে , আমি রেখে দিয়েছি কী পরম ভালবাসায়। উৎসবের চাবি, মুক্তকণ্ঠের চাবি, শুদ্ধ সংস্কৃতি শেখার চাবি, খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাংলাকে ভালবাসতে পারার চাবি।
ছবি কৃতজ্ঞতা: প্রজ্ঞা লাবনী
ছবি ১: সৈয়দ হাসান, ইমাম, রফিক আজাদ, কাজী আরিফ, প্রজ্ঞা লাবণী এবং সাথে মুক্তকণ্ঠ আবৃত্তি একাডেমির শিল্পীরা
জন্ম ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স এবং অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটি থেকে এনভায়রনমেন্ট এন্ড সাস্টেইনেবিলিটি বিষয়ে আরেকটি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এর পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত তার লেখা কলাম, ছোটগল্প এবং কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে।
One thought on “ইরাবতীর বর্ষবরণ স্মৃতিকথা: চৈত্র শেষের চাবি । কিযী তাহনিন”
নীরু শামসুন্নাহার says:
প্রিয় কিযী, আমার মিস্টি সোনাবোনটি, তোমার চমৎকার স্মৃতিমেদুর রচনাটি আমার হৃদয়পুরের কিশোরকালের একটা কুঠুরী খুলে দিলো যেনো!
অপূর্ব ভাষার মগ্নময় ছন্দে বোনা কথকতাটি পড়ে কতো স্মৃতি মনে ভিড় করে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকলো। চৈত্র সংক্রান্তী আর পহেলা বৈশাখের দিন দুটির কতো স্মৃতি মনের আকাশে ভেসে উঠছে। কিযীর এই লেখাটি আমার ছোটবেলা— কাকা কবি রফিক আজাদের কাছে সেই তিন-চার বছর বয়সে শুদ্ধ উচ্চারণে কবিতা, ছড়া পাঠের অভ্যাস করা। বাংলা কবিতা, সংগীত, আবৃত্তি, নাটকের নক্ষত্রকুলের মিলনমেলা জমতো বাচিকশিল্পগুরু কাজী আরীফ এবং প্রজ্ঞা লাবনীর বাড়িতে। এই অনন্য স্মৃতিময় রচনাটি যেনো হয়ে উঠেছে নব্বইয়ের বাংলা সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসের আকর! কিযীকে আন্তরিক ধন্যবাদ আমাকে যুক্ত করেছেন এই লেখাটির সাথে। তার স্মৃতির তর্পণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক, জাতীয় লোকসংস্কৃতি চর্চার এক অনন্য দলিল। নববর্ষের লগ্নে , সাম্প্রদায়িকতার ঘোরলাগা সময়ে এটি
একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা বলে মনে করি। কিযীকে নতুন বছরের অশেষ শুভকামনা জানাই। তার সৃজনশক্তি দিনে দিনে আরো পরিপুষ্ট হয়ে উঠুক!
তার সবল-সতেজ ও নিরাপদ জীবন কামনা করি।প্রকৃতি-মাতা করোনা অতিমারী থেকে তাকে সুরক্ষা দিন।
নীরু শামসুন্নাহার says:
প্রিয় কিযী, আমার মিস্টি সোনাবোনটি, তোমার চমৎকার স্মৃতিমেদুর রচনাটি আমার হৃদয়পুরের কিশোরকালের একটা কুঠুরী খুলে দিলো যেনো!
অপূর্ব ভাষার মগ্নময় ছন্দে বোনা কথকতাটি পড়ে কতো স্মৃতি মনে ভিড় করে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকলো। চৈত্র সংক্রান্তী আর পহেলা বৈশাখের দিন দুটির কতো স্মৃতি মনের আকাশে ভেসে উঠছে। কিযীর এই লেখাটি আমার ছোটবেলা— কাকা কবি রফিক আজাদের কাছে সেই তিন-চার বছর বয়সে শুদ্ধ উচ্চারণে কবিতা, ছড়া পাঠের অভ্যাস করা। বাংলা কবিতা, সংগীত, আবৃত্তি, নাটকের নক্ষত্রকুলের মিলনমেলা জমতো বাচিকশিল্পগুরু কাজী আরীফ এবং প্রজ্ঞা লাবনীর বাড়িতে। এই অনন্য স্মৃতিময় রচনাটি যেনো হয়ে উঠেছে নব্বইয়ের বাংলা সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসের আকর! কিযীকে আন্তরিক ধন্যবাদ আমাকে যুক্ত করেছেন এই লেখাটির সাথে। তার স্মৃতির তর্পণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক, জাতীয় লোকসংস্কৃতি চর্চার এক অনন্য দলিল। নববর্ষের লগ্নে , সাম্প্রদায়িকতার ঘোরলাগা সময়ে এটি
একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা বলে মনে করি। কিযীকে নতুন বছরের অশেষ শুভকামনা জানাই। তার সৃজনশক্তি দিনে দিনে আরো পরিপুষ্ট হয়ে উঠুক!
তার সবল-সতেজ ও নিরাপদ জীবন কামনা করি।প্রকৃতি-মাতা করোনা অতিমারী থেকে তাকে সুরক্ষা দিন।