| 10 অক্টোবর 2024
Categories
ইরাবতীর বর্ষবরণ ১৪২৮

ইরাবতীর ছোটগল্প: অবরোধ । বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,iraboti r golpoসুধীর বাবুর  মৃত্যুর জন্য  তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল। বেশ অমায়িক মানুষ ছিলেন। সবসময় মুখে লেগে থাকত হাসি। শেষের দিকে আর স্কুলে আসতে পারতেন না। খুব কষ্ট হত চলতে। ক্যানসার মানুষকে  এভাবেই বোধ হয় শেষ করে দেয়। একমাস আগে তাঁর  সাথে  যখন দেখা হয়েছিল জয়শ্রীর তখনও মুখে  লেগেছিল সেই অনির্বাণ হাসি–বুঝলেন দিদিমণি, দাড়ি কামানোর মতো একদিন চট করে মৃত্যুটাও সেরে ফেলব আমি। কবি রণজিৎ দাশের কবিতা পড়তেন খুব। এই কথাগুলো কবিতার উদ্ধৃতি। মুখে বিষাদ আর মনের কোণে বেঁচে থাকার তীব্র আর্তি। সেই বিষণ্ণ আলোর দিকে চেয়ে জয়শ্রী চমকে উঠেছিল-এরকম বলছেন কেন? আপনাকে আগের চেয়ে  অনেক ভালো দেখছি স্যার। 

-সে তো উপরে। ভেতরে ভেতরে  শেষ  হয়ে যাচ্ছি।

তাঁর কথাই আজ মনে পড়ছিল জয়শ্রীর। ছুটির পর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এইসব স্মৃতিপথ ডিঙিয়ে আসছিল। স্কুলে হয়তো আরও কিছুক্ষন বসে থাকা যেত। কিন্তু ইচ্ছে করছিল না। এলোমেলো চিন্তার ভেতর  সে  তাকাল স্নিগ্ধার দিকে–যাবি?

স্নিগ্ধা ওর সহকর্মী। জুনিয়র। একসাথে যাওয়া আসা করে। এই স্কুলে এসে  ছোটবোনের মতো হয়ে গেছে সে। প্রশ্ন বুঝতে না পারা ছাত্রীর বোকা চাহনি তার চোখে–কোথায় জয়শ্রীদি?

-সুধীরবাবুর বাড়ি।

-চলুন। 

সুধীরবাবুর বাড়ির দিকে যেতে গিয়েও থেমে গেল পা। কী বলবে সেখানে গিয়ে। কোন সান্ত্বনা হয় এই শূন্যতার?

-নারে থাক। পরে একদিন আসা যাবে বলতেই পা দুটো খুঁজে পেল প্রতিদিনের ছন্দ। বাস স্ট্যান্ড পাঁচ মিনিটের পথ। শীতের রোদটুকু গায়ে মাখতে  মাখতে ওরা হাঁটছিল পুরানো বাজারের রাস্তা ধরে। ফেব্রুয়ারির দুই। ঠাণ্ডা কনকনে বাতাসের উপস্থিতি নেই। বিষণ্ণতার আবহ ভুলিয়ে দিচ্ছে এই মৃদু রোদ। সূর্যের মাইল্ড আলোয় সুন্দর লাগছে ওই মাঠ – আকাশ। রিক্সা না নিয়ে হাঁটার আনন্দই উপভোগ করতে  লাগল  দুজনে। চলতে চলতেই তো মানুষকে চিনে নিতে হয় পথ। যেভাবে সে নিজে চিনে নিয়েছে প্রতিটি পদক্ষেপ। সারাজীবন শহরে মানুষ হলেও চাকরির প্রাথমিক পর্ব তাকে কাঁটাতে  হয়েছে একদম প্রত্যন্ত গ্রামে। যেখানে বিদ্যুৎ নেই, হাসপাতাল নেই, মানুষের বেঁচে থাকবার নুন্যতম কোন সুযোগ সুবিধা নেই। রাধানগর সুর্যসেন হাই স্কুল। নামেই নগর কিন্তু গঞ্জও নয়  দেহাতী আদিবাসী গ্রাম। এস এস সি থেকে যখন  অফার এসেছিল তখন আনন্দে লাফিয়ে উঠলেও পরে স্কুল এবং তার পারিপার্শ্বিক দেখে মনে হয়েছিল রাধানগরে এসেই থেমে গেছে সমস্ত পথ। নিজের মনে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব এবং অবরোধ পেরিয়ে শেষ অবধি চাকরিটা তাকে নিতে হয়েছিল যতটা না ভালোবেসে তার চেয়ে অনেকবেশি অর্থনৈতিক প্রয়োজনে। পরে আর্থিক প্রয়োজনগুলো যখন  ক্রমে ফুরিয়ে আসছিল তখন মনে হয়েছিল সে আসলে এক আবর্তের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে নিজেকে যেখান থেকে উঠে  আসা একটা রেজিগনেশন লেটারের  দুরত্ব। অথচ এই অপেক্ষা ফুরোবার নয়। তবু নটেগাছটি মুড়োল  এবং  একদিন সেই প্রতীক্ষার অবসান হল। ছ মাস আগে সাধারন বদলির সরকারি নিয়মে সে যখন এই মহকুমা শহরের একটি নামি স্কুলে এসে জয়েন করল তখন নিজেই হাঁফ ছেড়ে বলেছিল, কোন কিছুই মানুষকে আটকাতে পারে না  বরং পরিণত করে, শেখায়।       

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জয়শ্রী হাঁটছিল বাস স্ট্যান্ডের দিকে। কিন্তু বাস স্ট্যান্ডের কাছে এসে যখন শুনল  এক্সিডেন্টের  কারণে রাস্তা অবরোধ। বাস ট্রেকার কিছুই প্রায় চলছে না। তখন মনটা  আরও ভারি হয়ে গেল। এমনিতেই আজ মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। ভেবেছিল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে একটু ভাতঘুম দিলেই বিষাদের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। তার কোন সম্ভাবনা নেই। এখন  সে কি করবে?

স্নিগ্ধা তাকিয়েছিল দূরের দিকে। সার্কাস ময়দানের দিকে যেখানে মাইক বাজছে। কোনও উৎসব চলছে।বাঙালির তো হিড়িকের অভাব নেই।

– চলুন না দিদি যাই। সামনের মাঠে কোন অনুষ্ঠান চলছে বোধ হয়। দেখে আসি।

-যাবি? চল, এখন তো আর কোন কাজ নেই আমাদের। রাস্তা অবরোধ।  

মাঠের দিকে এগিয়ে এল ওরা। যা ভেবেছিল ঠিক তা নয়। মানুষের জীবনে পরিবেশের প্রভাব এই নিয়ে আলোচনা সভা চলছে সরকারি উদ্যোগে। ব্লক থেকেই আয়োজন করা হয়েছে। সাধারনত এই ধরণের অনুষ্ঠান এড়িয়েই চলে জয়শ্রী। কিন্তু আজ অন্যরকম। তার মনে হয়েছে রুটিন মাফিক চলাফেরার বাইরে আজকের দিনটা একটু অন্য ধাঁচের হোক। জীবন তো সবকিছু নিয়েই। আকাশে মিষ্টি রোদের আভা। মাঠের মধ্যে  একটা চেয়ারে সূর্যের উত্তাপ নিতে বেশ ভালোই লাগছে। আহ্লাদী আলোর স্পর্শ এসে পড়ছে গায়ে। যে মেয়েটি এখন বক্তব্য রাখছে তাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে জয়শ্রীর। অথচ নাম কিছুতেই মনে আসছে না। বক্তব্য শুরু করার আগে নিশ্চয়ই তার নামও ঘোষণা করেছে। অন্যমনস্কতার কারণে তা শোনা হয়নি। মানুষের জীবনে পরিবেশের প্রভাব এই বিষয়ে কি সুন্দর বলে যাচ্ছে-পরিবেশ  যে কেবল তার স্নেহ বেষ্টনীতে মানুষকে ঘিরে থাকে তাই নয়, পরিবেশ তার ক্রোধ দিয়ে, বোধ দিয়ে আশ্বাস দিয়ে ত্রাস দিয়ে, প্রেম ভালবাসা আদর যত্ন নানাবিধ রত্ন দিয়ে  মানুষকে মুড়ে রাখে। একটি শব্দও বানানো নয় , আভিধানিক নয়। ব্যবহারিক  রঙে দীপ্ত এবং উজ্জ্বল। সুধীর বাবুর জন্য  খারাপ লাগলেও রাস্তা অবরোধের জন্য মন চঞ্চল হলেও এই মুহূর্তে জয়শ্রীর  সেসব অনুষঙ্গ  মনে পড়ছিল না। সে তন্ময় হয়ে দেখছিল মেয়েটিকে। তার কথাবার্তার গভীরে ডুবে যাচ্ছিল। বক্তব্য শেষ করে মেয়েটি কি তার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে? কালো রঙে  চিত্রিত উজ্জ্বলতা। পিঠের উপর ঢেউ খেলানো কোঁকড়া চুল  দীঘির কালো জলের মত ধারাবাহিক ভাবে সাজানো। মঞ্চ থেকে নেমে কোথায় যাচ্ছে ঐ শ্যামলী তরুণীটি। এ কি সে তো ধীরে ধীরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।     

-ম্যাডাম, আমাকে চিনতে পারছেন?  আমি  কুকমু সরেন।  

এক বুক বিস্ময় নিয়ে জয়শ্রী তাকিয়ে থাকে  মেয়েটির দিকে। ঠিক কুকমুর দিকে নয়। তাকিয়ে থাকে সময়পথের দিকে। তার চোখে ভাসছিল টালির ছাদ হারানো একটা বাড়ি, শুকিয়ে যাওয়া জামগাছের নীচে জরাগ্রস্থের মতো ভাঙা চৌকি। ষোল বছর আগের এক  মুহূর্তের দিকে ঘুরে  গিয়েছিল তার দৃষ্টি। ক্লাস সেভেন হবে তখন ওর।রোগা ,পাতলা মেয়েটি। কিছুই পারত না। কিছু লিখতে দিলেই  জানলার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আকাশ দেখত।

-দেখি খাতা দেখি, কি লিখেছিস?  

মেয়ে চুপচাপ। মুখে রা নেই। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। মোটা ঠোঁট। ইউনিফর্ম অপরিস্কার। মাথা থেকে নিমতেলের গন্ধ বেরুচ্ছে। রাগ বেড়ে যায় জয়শ্রীর –লিখিসনি কেন?

এবারও উত্তর নেই। চুপচাপ জানলা দিয়ে আকাশ দেখছে সে। রাগ  আরও বাড়তে থাকে। -কি নাম রে তোর? এবার প্রায় নিরুচ্চারিত শব্দে উত্তর এল–কুকমু সরেন।  

সেদিনের কুকমু  আর আজকে তার চোখের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে দুজনের আসমান জমিন ফারাক। মাঝখানে সময়ের চিহ্নগুলো  তুলে আনবার চেষ্টা করে জয়শ্রী।  হ্যাঁ, ক্লাস সেভেনই হবে ওর। সে বছরই স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে অফার পেয়ে জয়শ্রী জয়েন করেছিল ওই স্কুলে। প্রান্তিক গ্রাম। বিপিএল আদিবাসী অধ্যুষিত রুখা প্রান্তর। প্রথম চাকরির আনন্দ নিমেষেই ম্লান হয়ে গিয়েছিল রুক্ষতায়। মনে মনে ভেবেছিল দুটো পয়সার জন্য আর যাইহোক জীবন জলাঞ্জলি সে দেবে না।  ছেড়ে দেবে এই স্কুল। 

 কুকমু! নামের কি ছিরি। তারপর ঠোঁট কামড়ে বিরক্তির সুরে বলেছিল, নিজের নামের মানে জানিস? 

-না। ভয়ে সারা শরীরে কাঁপুনি। দেখি খাতা দেখি।

খাতা নিতে গিয়ে জয়শ্রী দেখল শূন্য সাদা খাতায় সবুজ মাঠ, নির্মল প্রকৃতি আর শরতের কাশফুল আঁকা। আর কিছু নেই-আমি এতক্ষন ধরে বকে যাচ্ছি কিছুই কি মাথায় ঢোকেনি তোর?

এবার মাথা নাড়ে মেয়েটি – না।

প্রচুর বকাঝকা করে সেদিনের মত ক্লাস শেষ করল জয়শ্রী–আজকের মত ছেড়ে দিলাম। নেক্সট দিন এই ঘটনা ঘটলে ক্লাস থেকে বের করে দেব। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতেই লাগল। এরপর আরেকদিন  মেয়েটিকে রীতিমত বেশ জোর ধমক দিল একদিন–বাড়িতে মা বাবা কি কিছুই  শেখায় নি? এটুকু তো অন্তত করতে পারে!

ঝিরিহিরি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। অবাক হয়ে গেল জয়শ্রী। এসব তার শিক্ষকতা শুরুর একেবারে প্রাথমিক পর্বের ঘটনা। এই কান্নায় মনটা কেন যে ভিজে গিয়েছিল জয়শ্রী আজও জানে না-কাঁদিস না, আমাকে খুলে বল সব। কি হয়েছে তোর?

নিজেকে মেলে ধরতে অনেক সময় নিয়েছিল কুকমু। এস টি ফার্স্ট জেনারেশন। স্কুল দেখলে ভয় লাগত খুব। মাস্টার দিদিমনিদের মনে হত  পুলিশ। বাবা মা কেউ লেখাপড়া শেখেনি। মেয়ে পড়াশোনা শিখুক এটাও চায় না তারা। বলত–ইসকুল না জায়ে হাস চরাতে পারিস। ছাগল  বাগালি  কর। তার এসব ভাল লাগত না। বাবা মা কাজে বেরিয়ে পড়লে সে লুকিয়ে লুকিয়ে ইস্কুলে আসত। পড়াশোনায় মনোযোগ না থাকলেও ক্লাস কামাই করত না সহজে। জামকিরি থেকে হেঁটে হেঁটে অনেকদূর রাস্তা ডিঙিয়ে আসতে হত। বৃষ্টির দিনে ভরা নদী সাঁতরে। 

এক একটু করে ভাব হয়ে গেল ওর সাথে। জয়শ্রী বুঝতে পারল ওর গোড়াতেই গলদ। ক্লাস সেভেন হলেও সে এ বি সি ডিও লিখতে পারে না। আর লিখতে পারে না বলেই জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে আকাশ দেখে, মাঠ, পুকুর, ফড়িঙের ডানার শব্দ শোনে। ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিল–ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি তো আছি।  একটু একটু করে খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মেয়েটা। হ্যাঁ, এর জন্য অনেক সময় ও ধৈর্য দরকার হয়েছিল। তারপর থেকে কোন কিছু বুঝতে না পারলে নিরন্তর প্রশ্ন করত। জয়শ্রীর খুব ভাল লাগত। সে তো বোবা নিরুচ্চার মেয়েটার মুখে এই প্রশ্নগুলোই তুলে দিতে চেয়েছিল।

সেই লাজুক মেয়েটির চোখে জড়তার  কোন চিহ্ন আজ আর অবশিষ্ট নেই। বরং এক স্বয়ংক্রিয় সপ্রতিভতায় ভরে আছে সারা মুখ।

– কি ভাবছেন এত গভীর ভাবে?  সামনে এগিয়ে এল তরুণীটি।

– তোর কথাই তো ভাবছি। কত বড় হয়ে গেছিস।

পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল কুকমু। এখন কুকমু  নয় বি ডি ও মেমসাহেব। সামনে থেকে দেখলে বয়স আটাশ ত্রিশের মত মনে হয়। কতদূর রাস্তা পেরিয়ে এসেছে মেয়েটা। জয়শ্রী ভাবতে থাকে-আরে ছাড়, ছাড়, করছিস  কি? ভিড়ে ভর্তি সারা মাঠ। মেয়েটির এভাবে প্রণাম করায় একটু অস্বস্তি বোধ করলেও জয়শ্রী  খুশি হল খুব আনন্দে, গর্বে এবং ভালোবাসায় ওর মাথার উপর স্নেহের হাত রাখল। মানুষের কল্যাণে আরও বিকশিত হোক তোর মেধা।

আপনি এখন এখানে চলে এসেছেন এই খবর আমি জানতাম না,  নইলে আপনার বাড়ি গিয়ে আমন্ত্রন জানিয়ে আসতাম। আমরা ব্লক থেকেই এই উদ্যোগ নিয়েছি। খুব ভালো লাগল আপনার সাথে এতদিন পর দেখা হয়ে। কত কষ্ট করেছেন এক সময়।

-কষ্ট আবার কি রে? মানুষএর জীবন তো এরকমই। বলতে গিয়েও জয়শ্রী থেমে গেল। মনে হল তার বড় বেশি তাত্ত্বিক হয়ে যাচ্ছে কথাগুলো। সে কিছুই বলল না। শীতের সূর্যের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ল- কুকমু  শব্দের অর্থ হল স্বপ্ন।  সূর্যের আলোর মতো দীপ্ত  এক স্বপ্ন । ক্লাস এইট তখন ওর। বলেছিল-তোর নামের মানে জানিস? স্বপ্ন। উজ্জ্বল স্বপ্ন।  তোকে আলোর মত হয়ে উঠতে হবে। রাস্তা দেখাতে  হবে স্বপ্ন দেখাতে হবে  যারা স্কুলে আসতে ভয় পায় তাদের। যারা পড়াশোনার নামে ভয় পায় তাদের সবাইকে আলো দেখাতে হবে। এই এক বছরে রাতদিন পরিশ্রম করে নিজেকে শুধরে নিয়েছিল কুকমু। ক্লাস এইটে এসে  পড়তে পারত  ইংরেজি। বলতেও পারত  অল্পস্বল্প। প্রশ্ন করলে হাত তুলত। খুব ভালো লাগত জয়শ্রীর। ওর ভেতরের ভয় সংকোচ এবং  আড়ষ্টতাগুলো ভেঙে যাচ্ছে। 

-পড়তে আমার খুব ভাল লাগে । কিন্তুক আমার ত বই নাই।

– কেন ? বুক গ্রান্টের টাকা পাস নি?

– সি টাকায় বাপে মদ গিলেছে।

স্পেসিমেন পাওয়া সমস্ত বই ওর হাতে তুলে দিয়ে নিজেকে বেশ হালকা লাগছিল জয়শ্রীর। যেন বইগুলোর যথার্থ ব্যবহার হল। হাফ ইয়ার্লিতে এরকম আহামরি কিছু না হলেও অ্যানুয়ালে ইংরেজিতে আশি পেয়েছিল মেয়েটা। জয়শ্রীর খুব মনে আছে  সেদিনও আজকের মত  প্রণাম করেছিল। সেই মুহুর্তটি এখন আবার ফিরে এল নতুন মাত্রা নিয়ে। 

– এখানে নয় দিদি। আপনি মঞ্চে আসুন। ভাবনার অতলে তলিয়ে যাচ্ছিল জয়শ্রী। সেই স্কুলের  মাঠ। কাশফুল। মেঠো রাস্তা পেরিয়ে  নদী ডিঙিয়ে একটি কিশোরীর হেঁটে আসা । দেখতে পাচ্ছে সে। দেখতে পাচ্ছে ওর মাথায় রক্তের দাগ। বাবা মেরেছে। ও কামিন খেটে বাপের  জন্য মদ খাওয়ার পয়সা জোগাড় করে দেয়নি। মার খেয়েও স্কুলে এসেছিল। ডাক্তার দেখিয়ে ওকে নিজে গিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল জয়শ্রী। টালির ছাদ হারানো বাড়ি। মাঝে পলিথিনের বৃথা আড়াল। জামগাছের মৃদু ছায়া। তার তলে বসে ওর বাবাকে বুঝিয়েছিল মানুষের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। ওর বাবা বোঝেনি। উল্টে বলেছিল–তুই আমার বিটিকে দমতক মাতাছিস দিদিমণি।  

-আসুন ম্যাডাম, কুকমুর  কথায় সম্বিত ফিরল  তার–আমি তো এখানেই বেশ ভালো আছি। আবার মঞ্চে কেন?

– আপনাকে আসতেই হবে।

কুকমুর দিকে তাকিয়েছিল জয়শ্রী। ওর  কোঁকড়ানো নিরীহ চুলে  আজ নদীর ঢেউ । স্নিগ্ধা বলল–মঞ্চ নয় ওর মনের ভেতর আপনি কতখানি জায়গা নিয়ে আছেন আমি তা বুঝতে পারছি দিদি।

আর না বলতে পারল না  জয়শ্রী। পায়ে পায়ে তাকে এগিয়ে আসতেই হল। সমবেত বুদ্ধিজীবি মানুষের উপস্থিতিতে মঞ্চে যেন বিচ্ছুরিত দ্যুতি। জ্যোৎস্নার মত নরম ও পবিত্র এই রশ্মি। তবু এই আলোক বিভার ভেতর জলকাদা মাটির সোঁদা  গন্ধ। এখনও যেন  জয়শ্রীর শাড়ির আঁচল স্পর্শ করে আছে ওর কাদামাখা  বিহ্বল হাত। সেই আন্তরিক হাতেই মাইক্রোফোন নিয়ে বলল–আমি যা হয়েছি, যতটুকু হয়েছি এর জন্য যে মানুষটির প্রভাব আমার জীবনে মায়ের মতো। কিংবা জন্মদাত্রী মায়ের চেয়েও বেশি। এখন তিনি কিছু বলবেন। বিনম্র শ্রদ্ধায়  পা ছুঁয়ে প্রনাম করে বলল-ম্যাডাম  আপনি কিছু বলুন  নইলে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হবে না। মনের ভেতর কথা হাতড়ে যাচ্ছিল জয়শ্রী। এত গুণী মানুষের সমাবেশ। অপ্রস্তুত  এলোমেলো কথা ঠিক মানানসই হবে না এখানে। সে কখনও কোন মঞ্চে কিছু বলেনি। তার গলা কাঁপছে। অথচ তাকে কিছু বলতেই হবে আজ। মনের ভেতর তোলপাড় করছিল কত মুহূর্ত।  মাইক হাতে নিয়ে জয়শ্রী কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তবু সে বলতে শুরু করল-মানুষের জীবনে পরিবেশের প্রভাব কতখানি। চারদিকে বিরুদ্ধ বাতাস। মেঘলা আকাশ। খাঁড়া পাহাড়ি রাস্তা।  দারিদ্র।  অবরোধ। না খেতে পাওয়ার যন্ত্রনা। এর বিপরীতে শুধু স্বপ্ন। দাঁতে দাঁত চেপে পথ হাঁটার স্বপ্ন। কজন পারে এই  অন্ধকারে ঠেলে  বেরিয়ে আসতে। কেউ কেউ থাকে যারা এই অন্ধকার পরিবেশেও আলো জ্বালাবার স্বপ্ন দেখে। কুকমু  আমার ছাত্রী। কুকমু  মানে  স্বপ্ন। সে তার নিজের জীবনে শুধু নয়  সমস্ত মানুষের কাছে একটি  দৃষ্টান্ত । মানুষের জেদ ইচ্ছে আর সংকল্প কি কখনও সীমানা  দিয়ে চোখ রাঙিয়ে আটকানো যায়? স্বপ্ন কি অবরোধ মানে?  চোখে বাস্প জমছে জয়শ্রীর। রক্ত নয় গোত্র নয়  কাস্ট নয় এমনকি পরিবেশও নয়। এক অফুরান ভালোবাসার ঝর্নাই মানুষকে বদলে দিতে পারে।  আজ রাস্তা জ্যাম  না হলে তার সাথে আমার  হয়তো দেখাও হত না। কোন অবরোধ বা প্রতিকুলতাই  মানুষের জেদকে দমিয়ে দেয় না। বরং মানুষকে নতুন পথ খুঁজে নিতে  সাহায্য করে।  আজ  তা দেখলাম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত