| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতীর বর্ষবরণ ১৪২৮

ইরাবতীর ছোটগল্প: বাদুর ও ব্রান্ডি । শাহনাজ মুন্নী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,iraboti r golpoদিনাজপুরে দশ মাইল নামে একটা জায়গা আছে সেখানকার হাটে একটা ছোট্ট টংঘরে চড়ুই পাখি বিক্রি হয়। পাখি নয়, আসলে বিক্রি হয় পাখি ভাজা কিংবা বলতে পারেন চড়ুই পাখি ভাজা। দশ মাইলের ওই টংঘরের সামনে গেলেই আপনি দেখতে পাবেন বিরাট তারের খাচার মধ্যে ছটফট করছে শত শত চড়ুই, শোনা যায় মাঠের মধ্যে জাল পেতে এসব চড়ুই ধরা হয়। তারপর খদ্দের এলে টপাটপ চড়ুই তুলে জবাই করে ছিলে মশলা মেখে তারপর ডুবো তেলে ঝটপট ভেজে দেওয়া হয়। হয়ে যায় গরম গরম আর মচমচে আস্ত চড়ুই ফ্রাই। চড়ুই খেলে নাকি মর্দানা শক্তি বাড়ে, তাই যৌন সামর্থ্য প্রত্যাশী পুরুষের ভিড় দশ মাইলের ওই দোকানটার সামনে লেগেই থাকে। অবশ্য আপনাকে আমি দশবারো বছর আগেকার গল্প বলছি, এতদিনে ওই এলাকায় হয়তো আর একটা চড়ুইও অবশিষ্ট নেই। বৃদ্ধ, প্রৌঢ় আর যুবকেরা তো খেতই, আমাদের গ্রামের কৌতূহলী ভোজনরসিক কিশোরেরাও লোভে পড়ে হয়তো কোনো কিছু না বুঝেই দশ মাইলের ওই টংঘরে চড়ুই ভাজা খেতে যেত…।

আকমল তখন বলল, তার আসলে চড়ুই পাখি দরকার নেই।
তাহলে চওড়া ঠোঁটের ধনেশ পাখি?

ধ্যানী বলে যার সুনাম আছে, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের তাদের পাওয়া যায়। বান্দরবানে রুমা নামে একটা জায়গা আছে, শুনেছেন? সেখানে বড় বড় গাছের কোটরে বাসা বেঁধে থাকে ওরা। উত্তেজনা বাড়বে এই আশায় খামোকাই লোকজন কেন যে নিরীহ পাখিটির জ্ঞাতি গুষ্টি ধ্বংস করে দিচ্ছে!
ধনেশ পাখিও না, আসলে আকমল খুঁজছে বাদুর, বাদুরের মাংস। বেচারা বাদুর, পাখি বা পশু কোনো গোত্রেই পড়ে না, সেটা বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার হচ্ছে এর মাংস খুঁজে পাওয়া। আকমল শুনেছে বাদুরের মাংস খেলে হাঁপানি ভালো হয়, সাদিকার বাড়াবাড়ি রকমের হাঁপানির টান আছে, কতো ডাক্তার, কতো ওষুধ, কতো সাবধানতা, কিছুতেই কিছু হয় না, প্রায়ই গভীর রাতে চোখ বড় বড় করে অসহায়ের মতো জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকে সে। ইনহেলার নেয়ার পর কিছুটা শান্তি। কিন্তু সেই শান্তিও ক্ষণস্থায়ী। আকমল শুনেছে বাদুরের মাংস খেলে হাঁপানি নাকি একেবারেই বিদায় নেয় আর জীবনে কাছেও ঘেষে না-এই মহৌষধের কথা সে জেনেছে হায়দার কবিরাজের কাছে। হায়দারের সংগ্রহে জোকের তেল, শিয়ালের মাংস, শকুনের নখ, ধনেশের ঠোঁট সবই আছে। নেই শুধু বাদুরের মাংস। আকমল জানে সজ্ঞানে সাদিকা কখনই বাদুরের মাংস খেতে চাইবে না। তাকে বলতে হবে, এটা মুরগির মাংস, ভালো করে তেল মশলা দিয়ে রান্না করলে বাদুরের মাংস নাকি মুরগির মাংসের মতোই সুস্বাদু লাগে। আকমল কল্পনা করে খুব আরাম পায় যে সাদিকা মুরগির মাংস ভেবে তৃপ্তি করে বাদুরের মাংস খেয়ে নিচ্ছে আর তারপরই চিরজীবনের জন্য হা করে, খাবি খেতে খেতে কষ্টকর শ্বাস টানা বন্ধ করে হাঁপানিমুক্ত ঝরঝরে শরীর নিয়ে ফুরফুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমার একটা বাদুর দরকার। বাদুর?
বাদুর তো দিনে মরা, রাতে জাগা পাখি, নিশাচর। চীনারা কি মনে করে জানেন? মনে করে, বাদুর সুখ আর দীর্ঘায়ুর প্রতীক। তবে ওই যে রক্তচোষা বাদুরের লোকগল্প শুনেছেন না? ভ্যাম্পায়ারের কথা? শুনেছেন? এ জন্য বেশিরভাগ সময় মনে করা হয় বাদুর অশুভ, মৃত্যু আর রোগের প্রতীক।
আমার একটা বাদুরই দরকার।
পাবেন, বাদুরও পাবেন, একটু অপেক্ষা করতে হবে। খবর দিতে হবে বাদুর শিকারীদের। তারা আবার আজব মানুষ, সব সময় লোকালয়ে আসে না,
আকমল একটা স্বাস্থ্যবান বাদুরের অর্ডার দিয়ে খুপরি ঘরটা ছেড়ে বেরিয়ে আসলে বুঝতে পারে বাইরে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার, আকাশে ঝাঁক বেঁধে কালো রঙের পাখির দল উড়ে যাচ্ছে- ওরা কি বাদুর, নিশাচর উড়ন্ত স্তন্যপায়ী, অন্ধকারের গন্ধ শুকে জেগে উঠেছে যারা সেই না-পাখি, না-পশু দলছুট প্রাণীকূল, আদুর বাদুর চালতা বাদুর, কলা বাদুরের ঝাঁক, দুই পায়ে ডাল আঁকড়ে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা আলো-বিদ্বেষী প্রাণী… আচ্ছা, বাদুর কি পোষ মানে? কেউ কি চেষ্টা করেছে ওদের পোষ মানাতে? একটা বাদুর কতদিন বাঁচে? বনি আদম শেখ একটু কেশে বলেন, বাদুর না, আমি আসলে শকুন সম্বন্ধে ভালো বলতে পারব, ওদের সব তথ্য আমার কাছে আছে, কারণ শকুন হচ্ছে প্রায় বিলুপ্ত প্রাণী।
আর বাদুর?
না বাদুর আছে, বাদুর লুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা এখনও তৈরি হয় নাই।
তাই? বাদুর পাওয়া যায়?
যায়। গ্রামে গেলেই পাবেন। লোকে বলে না বাদুর গাছ, যেসব গাছে শুধু বাদুরই ঝুলে থাকে, শহরেও বাদুর পাবেন। পাবলিক বাসগুলোতে মানুষ তো বাদুর ঝোলা হয়েই চলাফেলা করে, দেখননি?
বাদুর কয়দিন বাঁচে?
এসব তথ্য ইন্টারনেট সার্চ দিলেই পাবেন। দাঁড়ান দেখে নেই, হ্যাঁ ২০ বছরের মতো বাঁচে, বাদুর পোষা? হ্যাঁ বিদেশে অনেকেই ব্যাট হাউস বানায়, বাদুরের দল এসে সেসব ব্যাট হ্উাসে থাকে।
আমিও একটা ব্যাট হাউস বানাবো, আমাদের ছাদে, বুঝলে, যাতে বাদুরের দল এসে থাকবে।
সাদিকা একটু অবাক হয়ে বলল, বাদুরের ঘর? ছাদে? কেন?
এমনি।
কবতুরের ঘর বানাও, ইচ্ছা হলে কবুতর পালো, বাদুর কেন? একটা কুৎসিত প্রাণী …যতসব উদ্ভট…
-আরে ধুর! কুৎসিত না, বাদুর আসলে খুব সুন্দর প্রাণী, আর তুমি উদ্ভট বলছ? বিদেশে ব্যাট হাউস খুবই কমন একটা ব্যাপার, প্লাইউড দিয়া বানাইতে হয়, একটা ১৫ ফুট লম্বা লাঠির মাথায় বসাবো হাউসটা, কালো রঙের হাউস…
সেই হাউস কি বাদুর দেখতে পাবে? ওরা তো অন্ধ, চোখে দেখে না।
আরে না, এইটাও ভুল ধারণা। বাদুর তোমার আমার চেয়ে ভালো চোখে দেখে।
আচ্ছা, বাদুর পুষে তোমার লাভটা কি শুনি? বাদুর দিয়া হবেটা কি?
বাদুর কিন্তু মশা খায়, জানো, একটা বাদুর ঘণ্টায় পাঁচশ মশা খেয়ে ফেলে। তোমার আর কয়েল কিনে মশা মারতে হবে না, প্রাকৃতিক উপায়ে মশক নিধন হয়ে যাবে…
কিন্তু আমি শুনছি, বাদুর নাকি যে মুখ দিয়া খায় সেই মুখ দিয়াই হাগে…ওয়াক থু… ভাবতেই ঘিন্না লাগে…
কি জানি? এইটা তো জানি না। তবে আমার নানীর কাছে একটা গল্প শুনছিলাম, অল্প অল্প মনে আছে। তোমাকে বলি, অনেকদিন আগে পৃথিবীর সব প্রাণীরা ভাবল তারা দুই ভাগে ভাগ হবে, এক ভাগে থাকবে পাখিরা, অন্য ভাগে পশুরা। তাই হইলো, পাখিরা গেল একদিকে, পশুরা গেল আরেকদিকে। বাদুর করল কি, প্রথমে গেল পাখিদের দলে। বলল, আমি উড়তে পারি, পোকামাকড় খাই আমি তো পাখিই। একটু পরে তার মনে হইলো, আমিতো ডিম পাড়ি না, বাচ্চা দেই, আবার স্তন্যপান করাই, আমি আসলে পশুদের দলেই পড়ব। সে পাখির দল ছেড়ে পশুদের দলে আসলো, একটু পরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই আবার তার উড়তে ইচ্ছা হইলো, সে আবার ফিরে গেল পাখিদের দলে। কিন্তু পাখিরা তাকে আর দলে নেয় না, মনের দুঃখে সে আবার গেল পশুদের দলে, পশুরাও রাগ করে মুখ ফিরিয়ে নিল, বাদুর তখন পড়ল দো-টানায়, নিজের পরিচয় নিয়া সে তখন দ্বিধান্বিত। তার সেই দ্বিধা সম্ভবত এখনও কাটে নাই,
আকমলের এক লেখক বন্ধু গল্পটা শুনে মন্তব্য করল, ব্যাপারটা অনেকটা এমন, ধরো একজন কবিতাও লেখে, গদ্যও লেখে, কবিরা তাকে দলে নেয় না বলে সে গদ্যকার আবার গদ্যকাররা ভ্রু কুঁচকে বলে, আরে ও তো কবি। ফলে তার কোনো দলেই জায়গা হয় না। বহুমুখী প্রতিভা হলে যা হয়-এক্ষেত্রে তুমি বাদুরকে বলতে পারো বহুমুখী প্রতিভা। দ্বিধান্বিত কিন্তু বহুমুখী প্রতিভাবান বাদামি শরীর আর কালো লম্বা পাখার প্রাণীটি কি ছাদের উপর তৈরি করা ওই ব্যাট হাউসে বাসা বাঁধবে? বাদুরকে আকৃষ্ট করার জন্য ছোট্ট বাসাটাতে পাকা কলা ঝুলাইয়া রাখি, কলা পচে কালো হয়ে যায়, বাদুরের দল আসে না। ছাদের উপর ধান চাল ছিটাইয়া রাখি, কাক, চিল, চড়ুইয়ের উৎসব লেগে যায়, বাদুরের দেখা মেলে না। মিলবে কেন, বলো? তোমার উদ্দেশ্য কি ভালো, মহৎ? তুমি কি শুধু আদর করে আহ্লাদ করার জন্য, নিঃস্বার্থভাবে তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এত যত্ন করে বাদুরের ঘর বানাইছ? তোমার উদ্দেশ্য তো বাদুর না, বাদুরের মাংস… যে মাংস বউকে খাওয়াইয়া তুমি তোমার বউয়ের হাঁপানি ভালো করতে চাও। তারপর সুস্থ বউ নিয়া ঘুরবা, বেড়াবা, হাওয়া খাবা, বারে মজা। তোমার স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বাদুরের দল নিজে থেকে উড়ে এসে নিজেকে কোরবানি করে দেবে, এতই সোজা!
নাহ, বাদুরই যদি না আসলো তাইলে আমার ব্যাট হাউজ দিয়া কি ঘোড়ার ডিম হবে? ওইটা বরং নামাইয়া ফেলি। আকমল কাউকে কিছু না বলে চুপ-চাপ ছাদে চলে যায়। তারপর বাদুরের ঘর নামাইতে গিয়া দেখে অবাক কান্ড, ঘর তো খালি নাই, বাদুরের ঘরের ভেতর খড়কুটা নিয়া এক জোড়া চড়ুই দিব্যি বাসা বেঁধে সংসার শুরু করে দিয়েছে। কারো জন্য আসলে কোনো কিছু খালি থাকে না। দেখছো ! ঠিকই কিভাবে যেন জায়গা দখল হয়ে যায়, এই চড়ুই দম্পতি কত অবলীলায় অন্যের জন্য বানানো বাড়ি দখল করে ফেলল….এইসব ভাবতে ভাবতে আকমল ব্যাট হাউজটা না ভেঙেই নিচে নেমে আসে। সাদিকা তখন ঘুমাচ্ছে, সারারাত প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ভুগেছে বেচারী, খাটে বসে বসে আকুপাঁকু করে নাকে মুখে শ্বাস টেনেছে, চোখগুলো মনে হয়েছে গহ্বর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, বিছানাতে একদমই পিঠ ঠেকাতে পারেনি। সকালবেলা তাই তার ঘুম না ভাঙ্গিয়ে আকমল সোজা বনিআদম শেখের আস্তানায় চলে আসে।
মানুষকে কতভাবে অপমান করা যায় জানেন? বাদুর শিকারীরা আমাকেই সেইভাবে অপমান করছে। আপনের বাদুর তো আনেই নাই আমাকে বলে আগামী অমাবস্যা না আসলে নাকি বাদুর পাওয়া যাবে না, এইটা একটা কথা? বলেন, অপমান না?
বাদুর আপাতত বাদ দেন, আমাকে দুই বোতল ব্র্যান্ডির ব্যবস্থা করে দেন, পারবেন?
ব্র্যান্ডি?
হ্যাঁ, শুনছি ঠান্ডার মধ্যে খাইলে নাকি শরীর গরম হয়, হাঁপানিতে উপকার হয়, পারবেন যোগাড় করতে? তাইলে আর খামাকা একটা প্রাণসংহারের দরকার নাই…..
আমি পারবো না, তবে আমার এক শিষ্যা আছে, বাশিল বেড়ি বাঁধের উপরে বস্তিতে থাকে, নাম কৃষ্ণচূড়া, দ্যা ব্ল্যাক লেডী। ও যোগাড় করে দিতে পারবে। এক সন্ধ্যায় চলে যাবেন, আমার নাম বলবেন, কাজ হয়ে যাবে।
আরে দূর, কি যেসব কন, আমার জ্ঞানী বন্ধুরা কইছে বস্তিতে ওইসব মাল পাওয়া যায় না। আপনের জ্ঞানের অভাব আছে বরং কারো কাছ থেকে একটা মদের লাইসেন্স যোগাড় করলেই হবে, নয়তো বিদেশি পাসপোর্ট।
রাখেন ওইসব যন্ত্রণা, আপনে কৃষ্ণচূড়ার কাছেই যান, দেশী বিদেশী সব ওর কাছে আছে, খদ্দের বুইঝা বাইর করে। শনিবার সন্ধ্যা বেলায় যান, আমি বইলা রাখব …
বাশিলা বেড়ি বাঁধে ঢোকার মুখে সূর্যাস্তের আবছা আলোয় আকমল দেখে ইউনিফর্ম পরা দুইজন পুলিশ কনস্টেবল এক বয়স্ক লোকের সাথে উচ্চস্বরে বাহাসে লিপ্ত, আকমল পাশ দিয়ে যাবার সময় বয়স্ক তাকে থামায়। দেখেন তো ভাই, আমি রিটায়ার্ড হাবিলদার, এইখানে হাঁটতে আসছি। আর উনি আমাকে খামাকাই আটকাইছে, যাইতে দিচ্ছে না।
এই, এই, এই।
একজন পুলিশ কনস্টেবল ধমকে উঠে, খামাকা আটকাই নাই। আমি তোমার মুখে গন্ধ পাইছি, সন্দেহজনক গন্ধ, মিছা কথা কও কেন?
আরে ভাই আমি রিটায়ার হাবিলদার।
কই দেখি, আইডি কার্ড দেখি। কতক্ষণ ধরে বলতেছি কার্ড দেখাও।
কার্ড কি সাথে থাকে নাকি মিয়া। কার্ড নাই।
এই তো সন্দেহজনক কথাবার্তা।
আকমল তখন মধ্যস্ততা করার জন্য বলে, আরে রাখেন তো ভাই, মুরুব্বী মানুষকে ছাইড়া দেন, যাইতে দেন উনাকে।
কনস্টেবলরা তখন বয়স্ককে ছেড়ে আকমলের দিকে মনোযোগী হয়। আপনে কে? এখানে কি জন্য আসছেন? আইডি কার্ড দেখান। আপনের কথাবার্তাও সন্দেহজনক। এদিকে আসেন। আপনের মুখ শুঁকে দেখবো, গন্ধ পাই কিনা, কাছে আসেন।
আকমল কাছে আসার বদলে দুই পা পিছিয়ে একটু সরে যায়।
আরে ভাই আমার মুখ তো আপনাকে শুঁকতে দিবো না।
কেন দিবেন না, কেন?
আরে মিয়া, একটু সরে দাঁড়ান। মুখ একটা ব্যক্তিগত অঙ্গ। সেখানে আপনার নাক ঢুকানো আমি পছন্দ করছি না। ’
কনস্টেবলদের তবু নিবৃত্ত করা যায় না। তারা তেড়িয়া মেজাজে চিল্লায়।
আপনেরা থানায় চলেন। থানায় গিয়া সব পরিচয় বাইর করব।
আর তখনই ঘ্যাঁচ করে একটা মোটরসাইকেল এসে ওদের পাশে থামে। কনস্টেবলদ্বয় সালাম দিয়ে সোজা হয়ে যায়, বয়স্ক হাউমাউ করে কালো পোশাক পড়া মোটরসাইকেল আরোহীকে ঘটনা বলে। কনস্টেবলরাও পাল্টা কিছু বলতে চাইরে তাদের হাত ইশারায় থামিয়ে দিয়ে কালো পোশাক গম্ভীর গলায়, ‘কে আপনারা, কই থেকে আসছেন, কি ব্যাপার?’ এরকম দু’চারটা মামুলি প্রশ্ন শেষে বলে,
‘আচ্ছা, আপনারা চলে যান, দুদিন আগে এখানে একটা মার্ডার হইছে তো….’
কালো পোষাক মোটরসাইকেলে স্টার্ট দেয়।
আকমল তখন বাশিলা বস্তিতে ঢুকে একটা জীর্ণ টংঘরের সামনে নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে চায়ের অর্ডার দেয়। চায়ে চুমুক দিয়ে সে দোকানিকে জিজ্ঞাসে।
আইচ্ছা ভাই, কৃষ্ণচূড়ার ঘর কোনটা?
দোকানি তখন পাল্টা জিজ্ঞাসে, আপনে পুলিশ, না সাংবাদিক? তাইলে কি আর্মি? গোয়েন্দা? নাকি তার আত্মীয়স্বজন? ’
আকমল মাথা নাড়ে, কোনটাই না।
‘তয় কি? মাল কিনবেন? আগে কুনোদিন আইছেন? হের ঘর খুঁজেন ক্যাঁন?’
আমার ব্র্যান্ডি দরকার, দুই বোতল।
আজকে জানগা, পুলিশে রেইড দিবো, দুই/চাইরদিন পরে আসেন।
দোকানি ফিসফিস করে বললে আকমল আর দেরি না করে বাসায় ফিরে আসে, সাদিকার কাছে।
‘চিন্তা কইরো না। তোমার জন্য ব্র্যান্ডি যোগাড় করতেছি। প্রতিদিন দুই চামুচ করে খাবা, শরীর ভলো থাকবে, দুই দিন পর পর শ্বাস উঠবে না।’
ব্র্যান্ডি কি? নতুন ওষুধ?
ওষুধের মতেই, আঙ্গুরের রস, বিদেশি, গন্ধটা একটু কড়া, এই আর কি।
সাদিকা তার সরল চোখ মেলে হাঁপানি থেকে পরিত্রাণের আশায় আকমলের দিকে তাকিয়ে থাকলে আকমল হাসে, বলে,
কি দেখো হ্যাঁ?
দেখি না ভাবি। ভাবি এই অসুখটা আমার কেন হইলো, বিড়ালের লোম থেকে এইটা হয়। আমার দাদি বিড়াল পুষতো আর ছোটবেলা আমি তো দাদির সাথেই থাকতাম, বিড়াল ধরতাম; আদর করতাম, বিড়ালের সাথে ঘুমাইতাম, খেলতাম….দাদিরও তো হাঁপানি ছিল, মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা করতে আইসা দাদি মারা গেছিল।
আরে ধুর এইসব ঠিক না, বাদ দেও তো…. তোমার ইনহেলার আছে না শেষ?
প্রায় শেষ আর মনে হয় কয়েকটা পাফ নেওয়া যাবে, আনা লাগবে।
আইচ্ছা, আনবোনে, দুই চাইর দিন পর….
দুই চার দিন পর সন্ধ্যাবেলা আকমল আবার বাশিলা বস্তির জীর্ণ টংঘরের সামনে নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। দোকানী ফিসফিস করে,
‘কৃষ্ণচূড়াতো বহুদিন হইলো কারো সাথে বড় বিশেষ মিলামেশা করে না, এমনেই ও শ্বাস টানের রোগী…. একবার টান উঠলে সহজে দম নিতে পারে না….নিজের মতোই থাকে…মাল চাইলে তো আমার কাছ থেইক্যাও নিতে পারেন…’
কিন্তু আকমল কৃষ্ণচূড়াতে স্থির থাকায় দোকানী উদাসী ভঙ্গিতে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখায়, ওই যে টাট্টিখানার পিছনে ডাইনের গলি দিয়া ঢুইক্যা বামে যাইবেন, বস্তির এক্কেরে শেষ মাথায় চিপার মধ্যে একটা শিরীষ গাছের তলে আন্ধাইর মতো জায়গায় আলাদা একটা ঝুপড়ি ঘর দেখবেন সেইখানেই ওর ঘর…
ঝুপড়ি ঘরটাকে দেখে আকমলের মনে হলো প্রাগৈতিহাসিক কুটির। জীর্ণ, পুরানো, স্যাঁতসেঁতে ছাতা পড়া যেন বাতাসের একটু হাল্কা সমর্থন পেলেই বাঁশের বেড়া দেওয়া ক্লান্ত ঘরটা হাটু ভেঙে ঝুপ করে শুয়ে পড়বে। আর ঘরের চারপাশে ঘাস, লতাপাতার বাড়ন্ত বাহার, যেন এদের ওপর বহুদিন কেউ হাঁটাচলা করে না। আকমল চা দোকানীর কথামতো শিরীষ গাছ খুঁজে। কিন্তু বাস্তবে এখানে শিরীষ গাছ কোথায়? এত স্রেফ একটি বাদুর গাছ, যে গাছের ডালে ডালে পাতার বদলে ছোট বড় শত শত বাদুর ঝুলছে।
বাহ্ বেশ, বাদুর আর ব্র্যান্ডি দেখছি একসাথেই পাওয়া যাবে। আকমল ভাবে, কিন্তু হাতের কাছে এতে সব ওষুধ থাকার পরও কৃষ্ণচূড়ার শ্বাস টান বা হাঁপানি থাকে কিভাবে? দুই চুমুক ব্র্যান্ডি বা এক বাটি বাদুরের মাংস তার জন্য কোনো ব্যাপারই না। উপশম তবে কতদূরে? কার কাছে? কোথায়? আকমল যেন ভাবে আর তখনই তার গা ঘেঁষে একটা রুগ্ন লোম উঠা ঘেয়ো কুকুর কুঁই কুঁই করে বেরিয়ে যায়। আকমল একটু চমকে পিছিয়ে এসে কৃষ্ণচূড়ার ঘরের ঝাঁপে টোকা দেবে কিনা ভাবে। শত হলেও নারীর গৃহ এটি, তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা থাকতেই পারে। আর তখনই আকমলকে হতভম্ব করে ঝুপড়ির ঝাঁপ খুলে কালো কাপড় নাকি কালো বোরকা নাকি কালো লোমে আবৃত একটি কৃষ্ণ নারী অথবা একটি কালো প্রাণী কিংবা দৃশ্যান্তরে একটি কালো বাদুর বেরিয়ে এসে ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ে যায়…. তার পেছন পেছন শুকনো সন্ধ্যায় ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় শিরীষ গাছে এতক্ষণ ধরে ঝুলে থাকা বাদুরের দল….
ঘটনার আকস্মিকতায় আকমলের হঠাৎ মনে পড়ে সাদিকার জন্য ইনহেলার কিনতে হবে আর তার পকেটে কোনো টাকা নাই অথবা কোনো উপশম নাই অথবা এটি একটি হাঁপানিগ্রস্ত শ্বাস টানা সন্ধ্যা যে অক্সিজেনের অভাবে অবিরাম মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে চায়, আপাতত জরুরীভাবে তার একটি ইনহেলার প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত