| 4 মে 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

গোধূলি বেলার ভ্রান্তি

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

                             

                                                        

 

শিরোনামটি লিখে কিছুটা অবাক হলাম নিজেই।  জীবনের গোধূলি বেলায় কোন ভ্রান্তিতে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর? আমাদের অনেকের আশৈশব  চেতনায় তিনি এক প্রাণের মানুষ। শুধু এই প্রজন্ম কেন, আমাদের মা-  দিদিমা , ঠাকুমা এবং আরও আরও কত পূর্ব- মাতৃকার প্রাণের  মানুষ।  কেন তিনি প্রাণের মানুষ? কেন হবেন না? সেই দুশ বছর আগেকার মেয়েদের জীবনের মূক অন্ধকারে তিনিই  অন্যরকম আলোর পথ চিনিয়েছিলেন।  সবাই জানে,  তিনি না থাকলে বিধবা নারীর নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস হতোনা, কত কুমারি মেয়ের পড়াশুনো শেখা হতোনা, আত্মমর্যাদার দীক্ষা হতোনা।  জরাগ্রস্ত মানুষ কত ভুল করে, বিদ্যাসাগরও কি তেমন সাংঘাতিক  ভুল করেছিলেন? যার জন্য তাঁর জীবনীকারেরাও তাঁকে দোষারোপ করতে পারেন? 

এই আলোচনায়  বলব অন্য এক বিদ্যাসাগরের কথা, যিনি কোনদিন চিকিৎসা -বিদ্যার প্রথাগত তালিম নেননি, স্বাস্থ্যবিদ্যায় তাঁর পান্ডিত্যের কথা কেউ তেমন করে জানেনা, সেই মানুষটি কী করে জীবনের উপান্ত বেলায় এক বিশেষ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে  ভীষণ স্পষ্টবাদিতায় এক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভাবনায়  ইংরেজ সরকারকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন?  সমসাময়িক দেশীয় মানুষ বলেছিলেন লোকটার নির্ঘাত মাথা খারাপ হয়েছে, বয়স হয়েছে তো। মস্তিষ্ক আর তেমন ভাবে চলেনা। না হলে যে মানুষ বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য এত খাটলেন , নিজের পয়সা খরচ করে ঋণগ্রস্ত হলেন, বহুবিবাহের বিরূদ্ধে কলম ধরলেন , তরুণ বয়সে বাল্যবিবাহের বিপক্ষে এত প্রবন্ধ লিখলেন, তিনি কিনা সহবাস সম্মতি (The Consent Bill) বিলের খসড়া দেখে বেঁকে বসলেন? ভীমরতি ধরা আর কাকে বলে!  বিষয়টা একটু খোলসা করে বলা যাক।

সময়টা ১৮৯০ সাল। বিলেতে সদ্য আইন পাশ হয়েছে,  যার পোষাকী নাম  কনসেন্ট আক্ট বা সহবাস সম্মতি আইন। এই আইন  তৈরির পেছনে ছিল কম্ বয়সী স্ত্রীর প্রতি অমানবিক আচরণ।   বিলেতে  এই চিত্রটি যত না ভয়াবহ ছিল, বাঙ্লা দেশে তার চিত্র ছিল  আরও অনেক বেশি  মর্মান্তিক। তখন মেয়েদের এক, দুই, তিন বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। মেয়ের বাবা  গৌরীদানের পুণ্য লাভ করতেন।  শিশু কন্যাটি একটু বড় হলেই শ্বশুরবাড়ি থেকে ডাক আসে। হয়তো তার দেহে তখনো তেমন করে   যৌবন আসেনি, শরীর  দাম্পত্য সহবাস এর উপযোগী হয়ে ওঠেনি, কিন্ত স্বামীদেবতা তাকে ছাড়বে কেন?  জোর করে সহবাস হতই যা বহু সময় বলাৎকারের পর্যায়ে চলে যেত।  মেয়ের অভিভাবিকারা শেখাতেন, স্বামীর সব উপদ্রব, এমনকি নির্দয় প্রহার সহ্য করাটাই নাকি স্ত্রী-ধর্ম। অনেক শিশু বা বালিকা এই প্রহার, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মারা যেত।  শ্বশুরবাড়ি থেকে বলা হোত আত্মহত্যা। এমনি এক ঘটনা  ঘটেছিল ১৮৯০ সালে, এগারো বছরের ফুলমণির জীবনে।  স্বামী পঁয়ত্রিশ বছরের হরিমোহন মাইতি  তাকে এমন ভাবে দাম্পত্য সহবাস করতে বাধ্য করে  যে  ফুলমনি  ভয়ঙ্কর রক্তক্ষরণে্র পর  মারা যায়। ফুলমণির মা আদালতে নালিশ করল। হরি্মোহনের বিরূদ্ধে  ফৌজদারি মামলা হল।  কিন্ত এই অপরাধের জন্য তার স্বামীকে বলাৎকারের অপরাধে সাব্যস্ত করা যায়নি, কারণ তখন প্রচলিত ছিল ১৮৬১ সালের ২৫  আইনের ৩৭৫(৫) এর ধারা। সেটি অনুযা্যী স্ত্রীর বয়স দশ বছরের কম হলে এবং তার সম্মতি বা অসম্মতিতে সহবাস করলে সেটি বলাৎকারের অপরাধ বলে গণ্য করা হোত। ফুলমনি ছিল এগারো বছরের বালিকা, তাই মামলার বিচারে অসুবিধা দেখা দিল।  সরকার এর পর নড়ে চড়ে বসল, স্থির হল বিলেতের মত ভারতেও সহবাস সম্মতি আই্নের সংশোধন করা হোক (The Age Of Consent Act) অর্থাৎ বয়সের সংশোধন চালু করা হোক।  কিন্তু তার আগে   বিলের খসড়া করার দরকার।   প্রচলিত আইনি ধারা বদল করে সহবাসের বয়স বারো করা হোক। আর সেই খসড়া বিল পাঠিয়ে দেওয়া হল সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে।  সমাজে প্রবল আলোড়ন দেখা দিল, পক্ষে এবং বিপক্ষে। এই বিলের খসড়া পাঠিয়ে দেওয়া হল সত্তর বছর বয়সী বিদ্যাসাগরকেও।  তিনি শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত।  এই বিষয়ে ধর্মশাস্ত্রগুলো কি ব্যাখা দিতে পারে, সেটা জানাও  যে সরকারের পক্ষে জরুরী।  তিনি তখন কারমাটারে সাঁওতালদের সঙ্গে আনন্দময়  জীবনে লগ্ন হয়ে আছেন। কিন্ত স্মার্ত পন্ডিত কখনো শাস্ত্রমন্থন না করে সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। ফিরে এলেন কলকাতায়, যেখানে তাঁর লাইব্রেরিতে রয়ে গেছে অজস্র শাস্ত্র-সম্ভার।  পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পড়লেন বিভিন্ন যুগে শাস্ত্রের বিধান । তবে  আইনি খসড়ার বয়ানে নিঃশর্ত সমর্থন জানাতে অপারগ বিদ্যাসাগর   সই দিলেন না।   তারপরে সরকারকে  লিখলেন তাঁর সেই ঐতিহাসিক চিঠি, ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৯১ সালে , যার নির্যাসটুকু অনুসন্ধান না করেই তাঁর অনেক জীবনীকার এই সিদ্ধান্তে এলেন যে বিদ্যাসাগরের মতিভ্রম হয়েছে, তিনি বাল্যবিবাহ রদ করতে আপত্তি জানিয়েছেন।

এখানে দুটি প্রসংগ উল্লেখ করতেই হয়। প্রথমত বিলটি ছিল  সহবাসের বয়স সম্পর্কে, বিবাহের বয়স নিয়ে নয়   আর দ্বিতীয়টি   বিবাহ ব্যতিরেকেই সহবাস হওয়ার বিষয়টিও যুক্ত ছিল। আসলে সেকালের বড়লাটের পরিষদে বিলটি পেশ করার সময় স্যার আন্দ্রু  স্কোবল বলেছিলেন, এই বিলের উদ্দেশ্য  মূলত দুটি বিষয়,

“To protect the female children from immature prostitution  and from premature cohabitation. “আরো বলেছিলেন,  “question of child marriage is left untouched by this bill”

কিন্ত  কী লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর?  একটু দেখা যাক, আর কেনই বা তাঁর জীবনীকার  বিনয় ঘোষ তাঁর “বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ”  গ্রন্থে  লিখলেন “সহবাস সম্মতি বিলের বিরোধিতা করে জীবনের অন্তিম লগ্নে বাল্য বিবাহকেই সমর্থন জানিয়ে গেলেন। এ কি তাঁর  বার্ধক্যের  মানসিক দ্বন্দ্ব? অথবা  কার্য ক্ষেত্রে সংস্কার-কর্মের অন্তর্বিরোধের পরোক্ষ স্বীকৃতি ?   

“I should like the measure to be so framed as to give something like an adequate protection to child wives , without any conflicting with any religious usage.. I should propose that it should be an offence for a man  to consummate marriage before his wife has had her first menses.  As the majority of girls do not exhibit that symptom before they are 13, 14, or 15, the measure I suggest would give larger, more real and more extensive protection than the bill. “

কী সাংঘাতিক সাহসী উচ্চারণ! এই চিঠির প্রতিটি বাক্য নির্দেশ করছে  বিদ্যাসাগরের সদা জাগ্রত ও সতর্ক মেধা, মানবতা বোধ এবং যুক্তি বোধ। যথেষ্ট প্রত্যয়ী সুরে বললেন তিনি,  ধর্মীয় ব্যাখা বা ব্যবহারের সঙ্গে কোন রকম সংঘর্ষের কথা উল্লেখ না করেও আমি মনে করি, এই খসড়াটি এমন হওয়া উচিত যাতে বালিকারা রজঃস্বলা  হওয়া অবধি অপেক্ষা করেই স্বামীরা বিবাহের মত কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারেন। যেহেতু  আমাদের দেশের বেশির ভাগ মেয়েই ১৩, ১৪ এমনকি ১৫ বছর বয়সের আগে   রজঃস্বলা  হওয়ার উপসর্গ দেখায় না, আমার অভিমত  এই বিলের থেকেও   আরো বৃহত্তর, আরো বাস্তব- সম্মত  এবং আরো রক্ষণাত্মক উপায় গ্রহণ করা হোক।  বিস্ময় জাগে,  সমকালীন সমাজে,  মেয়েদের এই আপাত  গোপন  শারীরবৃত্তীয় তথ্য বিদ্যাসাগর জেনেছিলেন কিভাবে? এমন অনুমান করা যেতেও পারে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদকারী পন্ডিত  মধুসুদন গুপ্ত হিন্দু নারীদের অন্দরমহলে ঘুরে ঘুরে  এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সমীক্ষা করেন। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা ছিল।  মধুসূদন গুপ্ত মারা যান ১৮৫৬ সালে।

তাহলে কি করে বলা যাবে বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন, বিলে তো বাল্যবিবাহের নাম গন্ধ নেই।  আর রিলিজিয়াস ইউসেজ বলতে তিনি কি বলতে চেয়েছিলেন? শাস্ত্রসম্মত ধর্মাচার কি? বিদ্যাসাগর ওই চিঠিতে  আরো জানিয়েছিলেন হিন্দুদের ধর্মশাস্ত্রে  শাস্ত্রীয়  বিধান  আছে  স্ত্রীর রজঃস্বলা না হওয়া অবধি  স্বামীর পক্ষে  স্ত্রী – সংসর্গ করা উচিত নয়।  করা হলে তার শাস্তিবিধানও  আছে। তবে সেটি একেবারেই লঘু চালের। যেমন একশ বার গৃহদেবতার নাম জপ বা উপবাস ইত্যাদি। যদিও সেটি কেউই  সে বিষয়ে মান্যতা  দিতনা। কিন্ত আইনি ভাবে বিষয়টি দেখা হলে ধর্মের ব্যাখ্যাও চলে আসেই।  বিদ্যাসাগর কিন্ত শাস্ত্র সম্মত ধর্মাচার  আর  দেশাচারের দ্বন্দ্বে   শুদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি  বালিকাদের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ না করে পারেন নি। তবে এই বৈশিষ্ট্যের   কথা বিদ্যাসাগর বলবেন কেন? বলবেন চিকিৎসক, বৈদ্যরা। বিদ্যাসাগর স্বশিক্ষিত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হয়েছিলেন।  তাহলেও একথা বলার অধিকার তাঁর থাকবে কেন?   

ব্রিটিশ  সরকার তাঁর মতামত গ্রহণ করেন নি। সহবাস সম্মতি  আইন পাশ হয়ে যায় ১৯শে মার্চ , ১৮৯১। এই ঘটনার কয়েক মাস বাদে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয়।   মেয়েদের বিয়ের বয়স সারদা আইন অনুযায়ী ১৪ বছর বয়স বলে মান্যতা পায় বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর প্রায় তিন যুগ পরে,  ১৯২৯ সালে।  কিন্ত উনিশ শতকের শেষ ভাগে এক মৃত্যুপথ যাত্রী,  নারী-দরদী, বিজ্ঞান-মনস্ক মানুষ  সারাজীবন অজস্র কর্তব্যের ভারে লগ্ন থেকেও অসহায় বালিকাদের স্বাস্থ্য সমস্যার কথা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে চিনেছিলেন। এইখানেই তাঁর আধুনিকতা, তাঁর  যুক্তিনিষ্ঠ মনন, যা তাঁর জীবনীকারদের অনেকেই  কি ইচ্ছাকৃতভাবেই বুঝতে  চাননি?  এ তবে কার ভ্রান্তি!

 তথ্য সূত্রঃ

 ১।  বিনয় ঘোষঃ  “বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ”  ওরিয়েন্ট লংম্যান,  ১৯৯৯

২, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য  কৃত অনুবাদ, আকাডেমি পত্রিকা।  অষ্টম সংখ্যা, ১৯৯৫।

৩। অশোক সেন, বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত ভ্রান্তি,  আকাডেমি পত্রিকা।  নবম সংখ্যা, ১৯৯৬

৪।অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়ঃ প্রসংগ বিদ্যাসাগরঃ কিছু উচ্চকিত সবগতক্তি, পর্ব ছয়,  ১৮ই নভেম্বর ২০১৮,  www. groundxero.in

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত