অনুবাদ গল্প: ইতালো কালভিনোর গল্প : ‘জেদ’ । শিবব্রত বর্মন
মূল : ইতালো কালভিনো
ভাষান্তর : শিবব্রত বর্মন
লেখক পরিচিতি:
ইতালো কালভিনোর জন্ম ১৯২৩ সালে হাভানার সান্তিয়াগো ডি লাস ভেগাসে। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষিবিদ, যার বদৌলতে তার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয়। আর মা ছিলেন একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী। পরবর্তী জীবনে কালভিনো যখন বিখ্যাত হয়ে উঠছেন আর বিশ্বের সামনে হাজির করছেন চির পরিচিত ভঙ্গিমায় অভিনব গল্প কথনশৈলী, তখন এ দুজনের উত্তরাধিকার হিসেবে তাকে খুব গভীরে শনাক্ত করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিলেন ইতালির তুরিনে। সে সময় থেকেই বাম-বলয়ের সঙ্গে তরুণ কালভিনোর ওঠাবসা শুরু। যুদ্ধের পর যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু পরে ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাঙ্গেরি আক্রমণের প্রতিবাদে পার্টি রাজনীতি থেকে সরে আসেন। কিন্তু গোটা সময়ে লেখায় কখনো খামতি হয়নি। মূলত ছোট গল্পই তার বিচরণ ক্ষেত্র। লিখেছেন তিনটি উপন্যাসও। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে, দ্য ক্রো কামস লাস্ট, দ্য ব্যারন ইন দ্য ট্রিজ, কসমিকোমিকস ও দ্য পাথ টু দ্য নেস্ট অব স্পাইডার্স এবং দ্য হোয়াইট শুনার, ইয়ুথ ইন তুরিন ও দ্য কুইনস নেকলেস। পেশায় সাংবাদিক এ লেখক মারা যান ১৯৮৫ সালে। কালভিনোর এই গল্প নেয়া হয়েছে ইতালো কালভিনোর গল্পগ্রন্থ Numbers in the Dark থেকে।
ওপর দিকে তাকিয়ে থেকে ফুটপাথ ডিঙিয়ে আমি কয়েক পা পিছিয়ে এলাম। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত দুটোকে মুখের কাছে চোঙার মতো ধরে ভবনের সবচেয়ে উঁচু তলার বাসাটাকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘টেরেসা!’
চাঁদের আলোয় শিউরে উঠল আমার ছায়া, সরে এলো পায়ের কাছে।
পাশ দিয়ে হেঁটে গেল কেউ একজন। আমি আবার চেঁচালাম : ‘টেরেসা!’
লোকটা আমার কাছে এসে বলল,‘আপনি আরো জোরসে না ডাকলে ভদ্রমহিলা তো আপনাকে শুনতে পাবে না রে ভাই। আসুন আমরা দুজনে মিলে ট্রাই করি। তিন পর্যন্ত গুণছি, তিন বলামাত্র আমরা দুজন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠবো।’ বলেই লোকটা গুণতে শুরু করে দিলো : ‘এক, দুই, তিন।’ আমরা দুজনেই গলা ছুড়লাম, ‘টেরে…সা…!’
থিয়েটার বা ক্যাফে থেকে ফিরছিল ছেলেছোকরাদের একটা দল। আমাদের এই চেঁচামেচি তাদের চোখে পড়ল। তারা বলল,‘আসেন ভাই, আপনাদের সাথে আমরাও গলা মেলাই।’ মাঝরাস্তায় তারাও আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের মধ্যে প্রথমজন এক থেকে তিন গুণলো আর তখন সবাই একযোগে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘টে..রে…সা…!’
আরো কেউ একজন হেঁটে যাচ্ছিল। সেও আমাদের সাথে যোগ দিলো। মিনিট পনেরোর মধ্যে আমরা জনাবিশেক লোক জমে গেলাম। থেকে থেকেই নতুন কেউ না কেউ যোগ দিচ্ছে।
আগে-পিছে না হয়ে সবার একসাথে চেঁচিয়ে উঠতে পারা কঠিন হয়ে উঠছে। প্রত্যেকবার কেউ না কেউ তিন গোনার আগেই চেঁচিয়ে উঠছে বা সবার চেঁচানো শেষ হয়ে গেলেও গলা ধরে রাখছে। তবে এতোকিছুর পরও শেষ পর্যন্ত আওয়াজটা খুব একটা খারাপ হচ্ছিলো না। আমরা একমত হলাম যে, ‘টে’ ধ্বনিটা একটু নিচু তবে লম্বা লয়ে উচ্চারণ করতে হবে, ‘রে’ ধ্বনিটা হবে উঁচু এবং দীর্ঘ লয়ের, আবার ‘সা’ হবে নিচু এবং সংক্ষিপ্ত। এতে ফল মিললো। আওয়াজটা জোরালো হচ্ছে। কেউ একজন সামান্য হেরফের করে ফেললে একটু গোলমাল বেঁধে যাচ্ছে, এই যা।
আমরা ভুলচুক এভাবে যখন প্রায় কমিয়ে এনে ফেলেছি, তখন কেউ একজন একটা কথা বলে উঠলো। ব্রণ ওঠা লোকের গলা যেমন হয়, লোকটার গলার স্বর সেইরকম। লোকটা বলল, ‘আচ্ছা, আপনি নিশ্চিত তো, ভদ্রমহিলা বাসাতেই আছেন?’
‘না,’ আমি বললাম।
‘তাহলে তো সমস্যা গুরুতর,’ আরেকজন বলল। ‘আপনি ঘরের চাবি নিতে ভুলে গেছেন, তাই না?’
‘আমার চাবি আমার সঙ্গেই আছে,’ আমি জবাব দিলাম।
‘তাহলে সোজা উপরে উঠে যাচ্ছেন না কেন রে ভাই?’ লোকজন জানতে চাইলো।
‘এ বাসায় আমি থাকি না,’ আমার জবাব। ‘আমার বাসা শহরের আরেক প্রান্তে।’
‘আচ্ছা, সেক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন না করে পারছি না,’ খনখনে গলার লোকটা বলল। ‘এখানে তাহলে থাকেটা কে?’
‘আমি জানি না আসলে,’ আমি বললাম।
এ কথা শুনে লোকজনের মধ্যে বেশ খানিকটা হতাশা দেখা দিলো।
‘সেক্ষেত্রে আপনি কি একটু ব্যাখ্যা করবেন মশাই,’ দেঁতো গলার এক লোক বলে উঠলো, ‘এখানে নিচে দাঁড়িয়ে আপনি টেরেসা টেরেসা বলে ডাকাডাকি করছেন কেন?’
‘অন্য কোনো নামেও আমরা ডাকতে পারি, কিংবা এই নামেই ডাকতে পারি অন্য কোথাও গিয়ে : আমার কোনো আপত্তি নেই,’ আমি বললাম।
লোকজন এবার বড়ো বিরক্ত হলো।
‘ভাওতাবাজি করছেন না তো ভাই!’ কর্কশ কণ্ঠের লোকটা সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো।
‘কী যে বলেন!’ আমি কাঁচুমাচু মুখে বললাম। অন্যদের দিকে তাকালাম সমর্থনের আশায়। কেউ কিছু বললো না।
ভদ্রলোক গোছের কেউ একজন বলে উঠলো, ‘আচ্ছা, শেষবারের মতো একবার টেরেসা বলে ডাক দিয়ে দেখি না কেন, তারপর যার যার রাস্তা মাপি।’
কাজেই আরেকবার হাঁক ছাড়লাম আমরা। ‘এক দুই তিন টেরেসা!’ এবার আওয়াজ তেমন জোরালো হলো না। তারপর সবাই যে যার বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়ালো, কেউ এদিকে, তো কেউ ওদিকে।
আমিও হাঁটা দিলাম। রাস্তায় মোড়ে পৌঁছেছি, কি পৌঁছিনি, মনে হলো শুনতে পেলাম, একটা কণ্ঠস্বর তখনও ডাকছে : ‘টে..রে..সা!’
কেউ একজন নিশ্চয়ই থেকে গেছে। সে ডেকে চলেছে। খুব একগুয়ে কেউ একজন।
কৃতজ্ঞতা: আর্টসবিডিনিউজ২৪.কম
ইতালো কালভিনোর জন্ম ১৯২৩ সালে হাভানার সান্তিয়াগো ডি লাস ভেগাসে। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষিবিদ, যার বদৌলতে তার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয়। আর মা ছিলেন একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী। পরবর্তী জীবনে কালভিনো যখন বিখ্যাত হয়ে উঠছেন আর বিশ্বের সামনে হাজির করছেন চির পরিচিত ভঙ্গিমায় অভিনব গল্প কথনশৈলী, তখন এ দুজনের উত্তরাধিকার হিসেবে তাকে খুব গভীরে শনাক্ত করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিলেন ইতালির তুরিনে। সে সময় থেকেই বাম-বলয়ের সঙ্গে তরুণ কালভিনোর ওঠাবসা শুরু। যুদ্ধের পর যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু পরে ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাঙ্গেরি আক্রমণের প্রতিবাদে পার্টি রাজনীতি থেকে সরে আসেন। কিন্তু গোটা সময়ে লেখায় কখনো খামতি হয়নি। মূলত ছোট গল্পই তার বিচরণ ক্ষেত্র। লিখেছেন তিনটি উপন্যাসও। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে, দ্য ক্রো কামস লাস্ট, দ্য ব্যারন ইন দ্য ট্রিজ, কসমিকোমিকস ও দ্য পাথ টু দ্য নেস্ট অব স্পাইডার্স এবং দ্য হোয়াইট শুনার, ইয়ুথ ইন তুরিন ও দ্য কুইনস নেকলেস। পেশায় সাংবাদিক এ লেখক মারা যান ১৯৮৫ সালে।