| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

আসেন না জীবনানন্দ কিন্তু সব নদী সব পাখি ঘরে আসে

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

এক বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি জীবনানন্দ। শহরের ট্রামলাইনে তাঁর পথ চলা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু যে ট্রাম তাঁর আজীবনের পথ চলা থামিয়ে দিয়েছিল, সেই ট্রাম পরে নিজেই এক অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে যায়! তার আর কোনও অস্তিত্বই নেই। শুধু থেকে গিয়েছে অফুরান শব্দস্রোত! জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লিখছেন দেবাশিস ঘড়াই। 


হারিয়ে যাওয়া কয়েকটি খাতা! আর তাতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। সময় নষ্ট না করে বিশেষ দলও তৈরি করে ফেলেছিল কলকাতা পুলিশ। তার পর তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু হয়েছিল কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায়। শেষ পর্যন্ত এক পুরনো বইয়ের দোকান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল কয়েকটি খাতা। কিন্তু তা-ও সব ক’টা নয়! বইয়ের দোকানদারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ পৌঁছে গিয়েছিল বইপাড়ারই এক মুদিখানার দোকানে। সেখানে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, হারানো খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তৈরি ঠোঙায় সর্ষে বিক্রি করছেন ওই মুদিখানার দোকানদার! তিনি জানিয়েছিলেন, সাত কিলো ওজনের ওই রদ্দি কাগজপত্র তিনি কিনেছিলেন সাড়ে ১২ টাকায়! শেষ পর্যন্ত যেটুকু অক্ষত ছিল, উদ্ধার করা হয়েছিল তা। যিনি খাতা হারানোর অভিযোগ করেছিলেন, হারানো জিনিস উদ্ধারের খুশিতে পুলিশকর্তাকে নিজের বাবার লেখা একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইয়ের নাম ‘রূপসী বাংলা’, কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। বইয়ের উপরে লেখা ছিল, ‘কৃতজ্ঞতার সাথে মঞ্জুশ্রী দাশ।’ তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৮০ সাল।

৩৮ বছর আগের সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তৎকালীন ডিসি ডিডি (২) ও প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘জীবনানন্দ দাশের প্রথম জীবনের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি খোয়া গিয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছিলেন তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রীদেবী। যত দূর মনে পড়ছে, তিনি মেচেদা থেকে লোকাল ট্রেনে ফিরছিলেন। ট্রেনের বসার সিটের তলায় রাখা সুটকেসেই জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ছিল। অনেক খাতা ছিল। যখন হাওড়া স্টেশনে নামেন, তখন দেখেন ওই সুটকেসটি নেই। সুটকেসচোর ভেবেছিল গয়না বা টাকাপয়সা আছে। কিন্তু সে সব কিছু না পেয়ে রদ্দি কাগজ হিসেবে বেচে দিয়েছিল। তবে হারানো পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ উদ্ধার করা গিয়েছিল। পুরোটা পাওয়া যায়নি!’’ জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির একটা অংশ বাক্স করে আর ফেরত আনা যায়নি। ফলে জানা যায়নি, চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপিতে আরও কী কী অলৌকিক-শব্দবিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল!

বুকজোড়া বরিশাল আর পায়ে কলকাতার উন্মুত্ত প্রান্তরের ঘ্রাণ। শহরের ‘অবিশ্বাসী’ ট্রামলাইন তাঁর দু’পা টেনে নেওয়ার আগে পর্যন্ত ওই দুই ভূখণ্ড কখনও একে অপরকে ছাপিয়ে, কখনও পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। জন্ম নিয়েছিল বাংলা কবিতার নির্জনতম, নিভৃত জগতের— জন্ম নিয়েছিল জীবনানন্দ-ভুবন। বাংলা ভাষার অলৌলিক-অপার্থিব শব্দসম্ভার, নির্জনতম শব্দেরা ব্যক্তিগত জীবনে চূড়ান্ত অসুখী, জীবনভর আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভোগা, একের পর এক চাকরি ছাড়া, লোকের সঙ্গে সহজ ভাবে মিশতে না পারা, সমালোচকদের আক্রমণে ধ্বস্ত এক মানুষকে মাধ্যম করে পেয়েছিল নিজেদের বিস্তার! কিন্তু কোথা থেকে জীবনানন্দ পেয়েছিলেন এই শব্দ সংকেত, এই অনন্ত শব্দস্নাত স্পর্শ? পারিবারিক দিক থেকে কবির সেই নির্জন জগতের সন্ধানে বেরোলে কিন্তু হোঁচটই খেতে হবে। জীবনানন্দের ঠাকুরদা সর্বানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশালের ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম মুখ। ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করে বৈদ্যত্বের চিহ্নস্বরূপ তিনি ‘গুপ্ত’ বর্জন করেছিলেন। মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে অশ্বিনী দত্তকে হারিয়ে কমিশনারও হয়েছিলেন তিনি। জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশও ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের এক জন চিন্তক, প্রবন্ধ রচয়িতা, বক্তা, শিক্ষক। মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন সে সময়ের প্রখ্যাত কবি, যিনি রান্না করতে করতেও অনায়াসে কবিতা লিখতে পারতেন। এমনকি, জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দ পুজোর আগে বিদ্যালয়ে আবৃত্তি করবেন বলে লিখে ফেলেছিলেন ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’র মতো মুখে মুখে ঘোরা কবিতা! জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দেরা ছিলেন সাত ভাই। জীবনানন্দেরা ছিলেন তিন ভাই-বোন। জীবনানন্দই ছিলেন বড়। ভাই অশোকানন্দ নয় বছর ও বোন সুচরিতা ষোল বছরের ছোট ছিলেন। সব মিলিয়ে একান্নবর্তী পরিবার। ফলে পারিবারিক ওই উষ্ণ আবহে জীবনানন্দ কী ভাবে ওই নির্জন ভূখণ্ডের সন্ধান পেয়েছিলেন, তাতে বিস্ময়ই জাগে।

‘‘কাউকে দেখানোর জন্য নয়, নিজের জন্যই যেন লেখাগুলো লিখতেন। লিখে ট্রাঙ্কভর্তি করে রাখতেন। ছাপাতে দেওয়ার আগে ওখান থেকেই বার করে দিতেন। ছোটবোন সুচরিতা খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন তাঁর। কখনও কখনও তাঁর সামনে তিনি বার করতেন ওই ট্রাঙ্কের লেখা। বাকিরা সেই অর্থে কিছু জানতেনই না। তাঁর জীবদ্দশায় সব ক’টি কাব্যগ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা মিলিয়ে বড়জোর সাড়ে তিনশো লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। বাকি ট্রাঙ্কভর্তি সব লেখাই তো তাঁর মৃত্যুর পরে উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো যেন একটা আলাদা জগৎ,’’ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে বসে কথাগুলো বলছিলেন অশোকানন্দের পুত্র অমিতানন্দ দাশ। জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য, পুত্র সমরানন্দ, কন্যা মঞ্জুশ্রী অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, দেশভাগের ক্ষত নিয়ে এ দেশে আসার পরে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়িতেই জীবনানন্দ কিছু দিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে ল্যান্সডাউন রোডের (বর্তমানে শরৎ বসু রোডের) এক ভাড়াবাড়িতে তিনি চলে যান। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়িতেই ট্রাম-দুর্ঘটনার দু’দিন আগে হন্তদন্ত হয়ে এসে জীবনানন্দ জানতে চেয়েছিলেন, সকলে ঠিক আছেন কি না। কারণ, রাস্তায় কার কাছ থেকে যেন শুনেছেন, পরিবারের কারও ট্রাম অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সকলে ঠিক আছেন শুনে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

 

ক্যামেরা, পোশাকবদল

জ্যাঠামশাইয়ের ‘আলাদা জগৎ’-এর সঙ্গে অমিতানন্দের পরিচয় হয়েছিল ছেলেবেলাতেই। তখন তাঁর বয়স বড়জোর সাত। অশোকানন্দ কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকতেন। সেই সুবাদেই দিল্লিতে যাতায়াত ছিল অমিতানন্দদের। এক বার সপরিবার জীবনানন্দও দিল্লি গিয়েছিলেন। সেই সফরের স্মৃতি রোমন্থন করে অমিতানন্দ বলেন, ‘‘এক দিন পরিবারের সকলে মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছি। মঞ্জুদির (কবিকন্যা) বয়স তখন বছর কুড়ি হবে। আমি বায়না করাতে মঞ্জুদি হাতের বালা বা গলার হার, কী যেন একটা খুলে আমাকে দিয়েছিল। জিনিসটা বেশ ভারী ও দামি ছিল। কিন্তু আমি সেটা কোনও ভাবে হারিয়ে ফেলি। তা নিয়ে মা (নলিনী দাশ) ও জেঠিমা খুব বকাবকি করছেন। কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের সে সবে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন এ সব ঘটনা নিয়ে তাঁর কোনও উৎসাহই নেই।’’ অমিতানন্দই জানালেন, জীবনানন্দের যে ছবিটি সমস্ত পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়, তা ওই দিল্লি-সফরের সময়েই তোলা। তুলেছিলেন অমিতানন্দের মা। ‘‘মায়ের তখনকার দিনের একটা বক্স-ক্যামেরা ছিল। তা দিয়েই পারিবারিক গ্রুপ ফোটো তোলা হয়েছিল। জ্যাঠামশাই ধুতির উপরে শার্ট পরতেন। কিন্তু পরে যখন ওই ফোটো ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়, সেটা কী ভাবে যেন মেকওভারে পাঞ্জাবি হয়ে গিয়েছে,’’ হাসছিলেন অমিতানন্দ।

 

কাস্তের আঘাত, বর্মের আড়াল

১৮৯৯ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ, ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়া শিশু জীবনানন্দকে সারিয়ে তুলতে কুসুমকুমারীর লখনউ, আগ্রা-সহ নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, একটু বেশি বয়সেই বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে ভর্তি, প্রতিটি বার্ষিক পরীক্ষায় বাঁধাধরা পুরস্কার, তার পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ১৯১৭ সালে আই.এ পাশ, ১৯১৯-এ প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক ও পরে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করে ১৯২৬ সালে চাকরি জীবনের সূত্রপাত সিটি কলেজে—জীবনের এই মাইলফলক ধরে এগোলে জীবনানন্দের নির্জন-ভূখণ্ডে পৌঁছনোটা প্রায় অসম্ভব! অলৌলিক-ইন্দ্রিয়াতীত জগতের সন্ধানে বেরোলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই ছোটবেলায়। যেখানে বগুড়া মোড়ের বিশাল জায়গা জুড়ে বাড়ি, সেই জমির ঝোপের মধ্যে হলুদ ছোপ পড়া আনারস ফল, কাঁঠালগাছ, আমগাছ, শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ, গভীর রাতে সুপুরি নিয়ে ইঁদুরের লড়াই, মাছ ধরা, ঠাকুমার গল্প, মফস্‌সলের নদী-খালের মতো বরিশালের সর্বব্যাপী প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপকরণ, দৃশ্য, মুহূর্তের সঙ্গে ছোটবেলায় তাঁর যে অদৃশ্য, বিনিসুতোর বাঁধন তৈরি হয়েছে, সেই বাঁধন আজীবন তাঁর সঙ্গে চলেছে, সে তিনি যেখানেই যান না কেন! সেই সমস্ত দৃশ্যই হাট করে খুলে দিয়েছে তাঁর কল্পনার দরজা, যার মধ্যে পরবর্তী কালে অনায়াসে প্রবেশ করেছে পারস্য গালিচা, বিলুপ্ত নগরী, নীল সুপুরির বনেরা! বড়মামা ছাদে মাদুর পেতে আকাশের তারাদের চেনাচ্ছেন, জীবনানন্দ বিস্ফারিত চোখে দেখছেন সে সব অগুনতি নক্ষত্র, অসীম- অনন্ত মহাকাশকে, মামাবাড়ির ছাদের উপরের রাতের আকাশ যেন আজীবনের বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিচ্ছে ছোটবেলার জীবনানন্দের সঙ্গে, পরে সেই নক্ষত্রপুঞ্জই ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতার খাতায়। শব্দের পরে শব্দে, দূরতম নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আলো এসে পড়ছে যেন, আর তাতে ভেসে যাচ্ছে আকীর্ণ চরাচর! শুধু কি প্রকৃতি, মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, তারও তো হাতেখড়ি সেই বরিশালেই। যেখানে অবশ্যম্ভাবী ভাবে চলে আসেন ফকিরের মতো দরিদ্র চাষি বা সকালে প্রতিদিন বাড়িতে দুধ দিতে আসা প্রহ্লাদের মতো মানুষেরা। বর্ষাকালে উঠোনে বড় ঘাস জন্মেছে। সত্যানন্দ ফকিরকে ডেকেছেন সেই ঘাস কাটার জন্য। ফকির কাস্তে চালিয়েছেন আর তাতে কাতর হয়েছেন জীবনানন্দ। তখন ফকির তাঁকে বুঝিয়েছেন, ‘‘চিন্তা করবেন না দাদাবাবু। এর পরেই কচি, সবুজ, নতুন ঘাস হবে।’’ কে বলতে পারে, ‘আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে গেলাসে পান করি,’ এই লাইনটি লেখার সময়ে বাল্যকালের সেই মুহূর্ত তাঁর মনের উপরে ছাপ ফেলেনি। তখন ফকির ঘাস কাটতে কাটতে তাঁকে শোনাননি মাটির কথা, ফসলের কথা! বা বাড়িতে দুধ দিতে আসা প্রহ্লাদ দাঁড়িয়ে পড়েছেন, নড়ছেন না। জীবনানন্দ তখন ইংরেজিতে বা বাংলায় হয়তো কোনও কবিতা আবৃত্তি করছেন। পড়া শেষ হলে প্রহ্লাদ তাঁকে বলছেন, ‘আপনি বড় ভাল পড়েন দাদাবাবু।’ যদিও সে কবিতার অর্থ বুঝতে পারার কথা নয় প্রহ্লাদের, কিন্তু সেই শব্দধ্বনিই মুগ্ধ করেছিল তাঁর মতো মাটির কাছের মানুষকেও। মাটি-প্রকৃতি-মানবমনের সঙ্গে তাঁর যে সখ্য, সেই বন্ধুত্ব তাঁর আজীবনের সঙ্গী, সম্বল, সম্পদ। কিন্তু পরে যখন দেখেছেন তাঁর নিজস্ব মনন ক্ষেত্রের সঙ্গে বাইরের জগতের কোনও মিল নেই, তখন তিনি গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে, একটা বর্ম তৈরি করেছেন! অথচ এক বার সে বর্ম ভাঙতে পারলেই তিনি তাঁর কাছে সহজ মানুষ। অনেকে হয়তো বাড়িতে এসেছেন, বাথরুম ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার বাথরুম কি ফাঁকা আছে?’ তাঁর সহাস্য উত্তর, ‘দিল্লির মসনদ কি কখনও ফাঁকা পড়ে থাকে!’ বা যখন সজনীকান্ত দাস তাঁর কবিতার ভাষার শ্লীলতা, অর্থ, বোধ নিয়ে শনিবারের চিঠিতে বেআব্রু আক্রমণে নেমেছেন, কখনও লিখেছেন, ‘গণ্ডারমারী কবিতা’ লিখেছেন জীবনানন্দ, আবার কখনও লিখেছেন, জীবনানন্দের লেখা ‘নির্জন পেঁচার মতো প্রাণ যদি অলৌলিক না হয় তা হলে সীতার পাতাল প্রবেশও অলৌলিক নয়।’ আর তাঁর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে আসরে নেমেছেন বুদ্ধদেব বসু স্বয়ং। সজনীকান্ত-বুদ্ধদেবের পারস্পরিক কাব্য-দ্বৈরথের উত্তপ্ত আবহেও জীবনানন্দ স্মিত হেসে বলেছেন, ‘সজনীকান্তবাবু তো আমার ভালই প্রচার করছেন।’

 

কে ছিলেন বনলতা সেন

আসলে বোধহয় জীবনানন্দ চাইতেন না তাঁর ভিতরের নির্জন স্থানটি কোনও ভাবে উপদ্রুত হোক, যেখানে আস্তে আস্তে জন্ম নিচ্ছে ‘ঝরা পালক’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘রূপসী বাংলা’র কবিতারা। কিন্তু সেই নির্জন ভূমিই প্রথম টাল খেল সিটি কলেজে। কর্মজীবনের পাশাপাশি সাহিত্য পত্রপত্রিকায় লেখার শুরু মোটামুটি এই সময়েই। ১৯২৭ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হল। শুরু বিতর্কেরও। তাঁর কবিতায় অশ্লীলতা আছে— এই অভিযোগে তাঁর সিটি কলেজের চাকরি যায়, এমন একটা বহুল প্রচারিত মত আছে। ‘‘আদৌ ব্যাপারটা তা নয়। কলেজে সরস্বতী পুজো নিয়ে একটা গোলমাল হয়েছিল। ছাত্ররা পুজো করতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্ম কলেজে কেন পুজো হবে, আপত্তি ছিল কলেজ কর্তৃপক্ষের,’’ বলছিলেন অমিতানন্দ। সেই সময়েই জীবনানন্দকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর মত কী? পুজো হলে ক্ষতি কোথায়, এমনই নিরাসক্ত জবাব দিয়েছিলেন তিনি! ব্রাহ্ম হিসেবে চাকরি হওয়া সত্ত্বেও তিনি কেন কলেজের সপক্ষে কথা বলেননি, তাতেই অসন্তুষ্ট হন কর্তৃপক্ষ। তার পর কলেজের ছাত্র সংখ্যা কমে গেলে অনেক জুনিয়র অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁরও চাকরি গিয়েছিল, জানাচ্ছেন অমিতানন্দ। আসলে ব্রাহ্ম-আবহে বড় হয়ে ওঠা জীবনানন্দ প্রথম দিকে ব্রাহ্ম সমাজ নিয়ে কবিতা, প্রবন্ধ লিখলেও পরে আর সেই জগতের কাছে ফেরত যাননি। কারণ, তত ক্ষণে জীবনানন্দের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল ধানসিড়ি নদী, নীল হাওয়ার সমুদ্র, শব্দহীন জ্যোৎস্নারা! আর জন্মেছিলেন বনলতা সেন। কিন্তু কে এই বনলতা সেন? অমিতানন্দ জানালেন, ‘‘আমরা যেটুকু শুনেছি তিনি জীবনানন্দের এক খুড়তুতো বোন ছিলেন। তাঁর প্রতি দুর্বল ছিলেন উনি। কিন্তু সম্পর্ক গড়ার সাহস পাননি। তাঁর ছায়াতেই তিনি বনলতা সেন লিখেছিলেন বলে পরিবারের বড়দের মুখে যতটুকু শুনেছি।’’ আবার জীবনানন্দের ডায়রিতে ‘ওয়াই’ বর্ণ সংকেতে এক নারীর প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। টীকায় সম্পাদক কবি-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ জানিয়েছিলেন, এই ‘ওয়াই’ জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন বুলুর (কমলা দাশগুপ্তের) বান্ধবী। বরিশালেই তাঁকে চিনতেন জীবনানন্দ। অন্তত ১৯৩১-৩২ পর্যন্ত তিনি অনেকখানি মন জুড়ে আছেন জীবনানন্দের। তিনিও বনলতা হতে পারেন। আসলে বনলতা কে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সব সময়েই মুচকি হেসেছেন জীবনানন্দ। কোনও উত্তর দেননি।

 

অসুখী দাম্পত্য

সামগ্রিক কর্মজীবনে পাঁচটিরও বেশি কলেজে কাজ করেছেন জীবনানন্দ। এ যেন এক বিপন্ন বিস্ময়, যা তাঁকে স্থিত হতে দেয়নি। যার সূত্রপাত সিটি কলেজে কাজ যাওয়ার পরপরই। কলকাতায় থাকতে এক দিকে তিনি সমসাময়িক বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে-র চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু তখনও তাঁর কবিতা পত্র-পত্রিকা থেকে ফেরত আসে, নতুন কবিতা সংকলনে তাঁর নাম ছাপা হয় না। অন্য দিকে ব্যক্তিগত, আর্থিক জীবনেও অনিশ্চয়তা। ভাল না লাগায় ১৯২৯ সালে বাগেরহাট কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন। সেখা‌ন থেকে দিল্লি। ১৯৩০ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি দিল্লিতে ছিলেন। তার পর বিয়ে করতে বরিশালে এসে আর দিল্লি যাননি। অমিতানন্দের কথায়, ‘‘বিয়ের কয়েক মাস আগে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন হঠাৎ। তখন থেকেই তাঁর দাম্পত্য জীবনে সঙ্কট শুরু হয়। যা আর কখনও মেটেনি। জেঠিমা সুন্দরী ছিলেন, শিক্ষিতা ছিলেন, গানও ভাল গাইতেন। কিন্তু তিনি সেই এক্সপোজ়ারটা পাননি। দাম্পত্য জীবনে খামতি থাকার জন্য ছেলে-মেয়েকে খুব প্রশ্রয় দিতেন। ক্ষতিটা হয়তো পুষিয়ে দিতে চাইতেন।’’ অসুখী দাম্পত্য ফুটে উঠেছে তাঁর লেখা একাধিক উপন্যাসেও। অমিতানন্দের খুঁজে পাওয়া একটি ডায়রিতেও দেখা গেল সেই অস্থির জীবনের ছায়া। সেখানে লিখছেন এক জায়গায়, ‘বাড়িতে থাকতে রোজি সন্ধ্যার পর ভাবতাম একটু অন্ধকারে থাকা যাক—জ্যোৎস্না বা লম্ফের আলোতে—কিন্তু একটা না একটা কারণে রোজি আলো জ্বালতে হত—তারপর মেসে চলে গেলাম সেখানে roommateদের জন্য আলোর ব্যবস্থা না হলে চলত না—’ আবার আরেক জায়গায়, ‘চিরদিন দুঃখ ভোগ করে যাওয়াটাই তো জীবনের উদ্দেশ্য নয়…’

 

অশ্লীলতার অভিযোগ

ব্যক্তিগত জীবনে ত্রস্ত ছিলেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু কোথাও তাঁর একটা স্থির বিশ্বাসের ভরকেন্দ্রও ছিল! হয়তো সে বিশ্বাসে শাণিত তরবারির স্পর্ধা ছিল না। কিন্তু সে বিশ্বাস ছিল ফসলসম্ভবা মাটির মতো নরম অথচ ঋজু। না হলে তাঁর বিরুদ্ধে যখন লাগাতার ধূসর, পলায়নকারী মানসিকতা, দুর্বোধ্য, বিশেষণগুলি (নেতিবাচক অর্থেই) ক্রমাগত ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন কেন বলবেন, ‘‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ আমার কবিতার প্রধান আবহাওয়া নয়…’ অথবা ‘ক্যাম্পে’ কবিতার অশ্লীলতার অভিযোগ নিয়ে কেন লিখবেন, ‘যদি কোনো একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে তা জীবনের— মানুষের-কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসহায়তার সুর।’ কর্মজীবন টালমাটাল হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন, ‘যে জিনিস যাদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সবই অসাড়তার নামান্তর নয় কি?’ এই উচ্চারণের জন্য তো স্পর্ধা লাগে, সাহসও। যেমন ভাবে বিশ্বাস লাগে এই সারসত্যটুকু বলতে, ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।’ এই নিষ্কম্প বিশ্বাস তাঁর কলকাতার উপরেও ছিল। এমনিতে ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবন, ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার আগে এবং আবার কলকাতায় ফেরা পর্যন্ত, এ শহরে তাঁর আবাস-মানচিত্রে ছিল কখনও মেস, কখনও অশোকানন্দের বাড়ি, কখনও ল্যান্সডাউনের ভাড়াবাড়ি। কর্মজীবনে টালমাটাল মুহূর্তে অন্য জায়গায় চাকরির সুযোগ হচ্ছিল, কিন্তু তবু তিনি যাচ্ছিলেন না বলে জানালেন অমিতানন্দ। তাঁর কথায়, ‘‘অসমে, পঞ্জাবে ও অন্যত্র চাকরি হলেও কলকাতা ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না!’’ দেশভাগের পরে কলকাতায় এসে বন্ধু সঞ্জয় ভট্টাচার্যের চেষ্টায় ‘স্বরাজ’ নামে একটি নতুন দৈনিক পত্রিকার রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগটি সম্পাদনার কাজ পেয়েছিলেন। ‘স্বরাজ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ১৯৫০ সাল নাগাদ কিছু দিন খড়্গপুর কলেজে কাজ করছিলেন। সেখান থেকে শহরে ফিরে কখনও বড়িশা কলেজ, ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজ, হাওড়া গার্লস কলেজে কাজ করেছেন। আর শহর ছেড়ে যাননি! এ শহরও তখন তাঁকে আস্তে আস্তে চিনছে। তত দিনে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে (যদিও সব মিলিয়ে অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছে তখনও দেড় হাজারেরও বেশি কবিতা, উপন্যাস, গল্প)। স্বীকৃতি পাচ্ছেন তিনি, জুটেছে পুরস্কারও। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসায় আপ্লুত হয়েছেন তিনি, আর বুদ্ধদেব বসুর মতো যাঁরা ভাষাবিন্যাসে অচলায়তন ভাঙার সমর্থক, তাঁদের কাছে তিনি তো তখন রীতিমতো আবিষ্কার! তাই শহরের সমস্ত সাহিত্য আলোচনায়, কবিতাপাঠে তিনি আমন্ত্রিত।

 

মনপবনের নৌকা

কিন্তু তার পর সে দিন! ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর। আগের দিনই রেডিয়োয় ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন। তা নিয়ে সে দিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। তার পর প্রতি দিনের মতো ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই হাঁটা যে তাঁর অভ্যেস। ও পার বাংলায় বাল্যকালের সেই স্টিমারের জেটি। কিছুটা দূরে ঝাউয়ের সারি। লিচু, অজস্র ফুল-ফল সমারোহে বিশাল কম্পাউন্ড নিয়ে ব্রাউন সাহেবের কুঠি। সে সব পার হয়ে ব্রাহ্ম সমাজ সার্কিট হাউসের গির্জা, তা ছাড়িয়ে গেলে শ্মশানভূমি, লাশকাটা ঘর। সে সব পথ হাঁটতে হাঁটতে আকাশে মেঘ দেখে বালক জীবনানন্দ ভাইকে বলতেন, তিনি একটা মনপবনের নৌকা তৈরি করবেন। সে দিনও কি জীবনানন্দ আকাশে মেঘ দেখে মনপবনের নৌকার কথা ভাবছিলেন? না হলে কেন ট্রামের অবিরাম ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ, ট্রাম চালকের চিৎকার শুনতে পাবেন না তিনি! ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর জখম জীবনানন্দকে রাস্তা থেকে তুলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন অপরিচিতেরা। সেখানেই আট দিনের লড়াই।

মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির রং সারাটা আকাশ জুড়ে’।

‘‘সেই ট্রামটি এখন আর নেই! এক সময়ে আগুন লেগেছিল। তাতেই পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ট্রামটি। তবে কবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে বনলতা নামে একটা হেরিটেজ ট্রাম চালু হয়েছে,’’ বলছিলেন পরিবহণ দফতরের প্রাক্তন পদস্থ কর্তা। তিনি আরও জানালেন, বহুল আলোচিত ওই ‘নকড ডাউন’-এর কোনও তথ্য এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!

নেমেসিস? হবে হয়তো। না হলে কবির ‘ঘাতক’ ট্রাম নিজেই আগুনে কেন ভস্মীভূত হবে!

শহরের প্রাণঘাতী ট্রামলাইনে তাঁর পথ হাঁটা থেমেছিল, আবহমানের শব্দস্রোত থামেনি!

‘সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী’, কিন্তু হয়তো সেই আবহমানের খোঁজে বেরিয়েই জীবনানন্দ আর ফেরেননি! বাংলা কবিতার নির্জন চরাচর ধরে জীবনানন্দ হেঁটে গিয়েছেন দূরে, দূরতম দ্বীপে, একাকী, নিঃসঙ্গ অবস্থায়। তাঁর গা থেকে খসে খসে পড়েছে বাংলা কবিতার অবিশ্বাস্য সব লাইন, অসম্ভব সব শব্দ। তার পর সে সব শব্দ মিশে গিয়েছে আলপথে,

মাঠের ধারে, ধানসিড়ি নদীর কিনারে। আর তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন এ বাংলায়, দুই বাংলার বিস্তীর্ণ চরাচরে— মাটির ভিতর মাটি হয়ে, ফসলের ভিতর ফসল হয়ে, পাখির ভিতর পাখি হয়ে…

 

 

[ঋণ: জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা, বেঙ্গল পাবলিশার্স (প্রা.) লিমিটেড, আনন্দবাজার পত্রিকা]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত