কবি সৌরভ দত্তের কাব্যগ্রন্থ : জেগে আছো হিমরক্ত । পলাশ পোড়েল
আজকের আলোচনায় আমরা কবি সৌরভ দত্তের লেখাকে একবার ছুঁয়ে দেখবো। সৃষ্টিকে কতভাবে প্রকাশ করা যায়। চেতনার রঙ এর পার্থক্য ঘটে। জীবন ও সমাজের একটি চালচিত্র তৈরি হয়। শোষণের বিরুদ্ধে,অত্যাচারের বিরুদ্ধে জমে থাকা পুঞ্জিভূত ক্ষোভ শব্দের বারুদে বিস্ফোরণ ঘটায়। একটা কবিতা বলে যায়, জীবনের বারোমাস্যা।সুখ দুখের পার্বণ।কি যেন অন্তরের আকুতি গ্রাস করে সমস্ত চেতনাকে। মূলতঃ এটি একটি রাজনৈতিক চেতনা বা প্রতিবাদী কলমে খণ্ড-খণ্ড চিত্রের কবিতা। সমগ্র কিছু নিয়ে একক বামপন্থী সত্ত্বার চেতনার সিঁড়িতে উত্তোরণের পথনির্দেশ।। প্রতিবাদী কন্ঠস্বর এর জোরালো কলমশক্তি। কবি নিজেই বলেছেন— “বসে বসে দেখি সময়কে কাটছে ঘূণপোকা। অসহায় মানুষের কোনমতে টিকে থাকার নাম—যাপন।রক্তের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী।ভূ- লুন্ঠিত নারী মর্যাদা। সাম্প্রদায়িকতার আগুনে সম্প্রীতি পুড়ে ছারখার।দেশ- রাজ্যের এসবই আমায় ভাবায়।সাহস জোগায় ঋজু মেরুদন্ড তুলে ঘুরে দাঁড়াবার।হাতে তুলে দেয় প্রতিবাদের সঙিন।যা আমাদের নিজস্ব অভিব্যক্তির ভাষা হয়ে ওঠে— লেখা হয় চেতনার ধারাপাত।”
একুশটি কবিতা যেন একুশটি বুলেট,যা পাঠকের হৃদয়কে সঠিক বিদ্ধ করতে সক্ষম। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায় সমস্ত চিন্তাভাবনার জট। জটিলতা।। তেমনি গ্রন্থটিও প্রতিবাদী প্রচ্ছদ। রঙের আঁচড়ে প্রতিবাদের ভাষায় প্রচ্ছদ এঁকেছেন তুষার বসু।এটাও যেন একটা মাইলফলক।
বইটি ছোট কিন্তু পড়তেই অন্য বিস্ময়। একবার পড়ি আর অনুভব করতে গিয়ে পুনরায় আবার শব্দের টানে ছুটে যায় মন। এইভাবে ৩৬ পাতার একটি সম্পদকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করি। হয়তো বিপ্লবী বামপন্থীদের লেখা ও মার্কসের বইগুলো আমার চিন্তার সেই জট খুলতে অনেক সাহায্য করেছে। কিন্তু সেটা ছিল অন্য জগতের।আত্মচেতনা। দর্শন। আর এটা জীবনের কথা। সৌরভের কলমে শব্দের কামানদাগা।
কবিতার অনেক চিত্র। সমাজের অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার নারীদের কথা উঠে এসেছে। নারী জীবনে “ধর্ষন “এর ঘটনা ঘিরে ধরে দৈনিক”। এমনি।এক-” কামদুনি”। প্রতিবাদ। ভালোবাসা,মুখোশ খুলে “যুবতীর রক্তস্নানের পর/এখনও ঘাস মাটি মেখে/উঠে আসে নিশ্চিন্ত হায়নারা.”। আসলে মুখ মুখোশের লড়াই চলে। তবু গজ কচ্ছপের যুদ্ধে একদিন খুলে যায় সাদা রোদে। বৃষ্টি নামে। চোখে।লড়াই চলে।” একটি শব্দ প্রতিশোধ রক্তরাঙা..”। আসলে কবি দেখেন- ” আমি বারবার আটকে যাচ্ছি চক্রব্যুহে।”তাই কবিক যেতে যেতে জীবনের সরল সমাধান করতে হয়।” আবিষ্কারে পথ পাল্টায়”।সূত্রবীজ । কবি শুধু নিজস্ব চেতনার আয়নাতে বিশ্বকে দেখেন। সময়ের সমস্যার বেদনায় নরম হাতের স্পর্শ রাখেন। তবুও সংশয় কাজ করে মনে মনে-” এ দেশ আমার নয়” ।
তারপর উত্তোরণের দরজা খুলে যায়। দেশ দশের তালিকায় সংখ্যাতত্ত্বের হিসাব।বাঘবন্দী খেলার জীবন। প্রকৃত মানুষ জানে জীবনের সহজ গণিত।শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। পরিযায়ী বেদনা। ঘুরে ঘুরে আসে চাঁদ, নদীর কাছে কবির আত্মসমর্পণ। কবি মুখোশধারী হতে চান না, চান না অসত্য বিপথগামী করুক। তিনি অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথ ধরে নির্বাণ লাভ করতে চান। যেখানে ভালোবাসা ছুঁয়ে থাকে।একলা বাঁচার কৌশল শিখে মানবতার ধ্বজা ওড়াতে। মায়ের কথা বলতে।
বিপ্লবের কথা বলতে। নিজের শেষ রক্তকণিকার সুরে সুরে প্রাণ জাগাতে।প্রান্তরপ্রহরীর মতো। অরুণোদয়ের পথে। আঘাত এলেও লড়াই থামবে না। মৃত্যু এলেও না— একটা সূর্য নেভাতে চাইলে/ হাজার সূর্য উঠবে।তাই তো দৃঢ়ভাবে বলেছেন- ” মেহনতী মানুষের জাঠা/গণতন্ত্রের ধ্বজা হাতে/বিপন্ন মানুষের বাঁচার তাগিদে।”জীবন দর্শন চিনিয়ে দিচ্ছে কবিকে।
কবিতায় পাতায় পাতায় উঠে এসেছে( হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা, শব্দগুচ্ছ,দিন বদলের পথ, হিজিবিজি,সময় কি দিল, সহিষ্ণুতা,যদি তুমি প্রশ্ন তোলো, ভাঙার গান, রাক্ষুসে মোরগ প্রভৃতি)কবির কিছু নিজস্ব লৌকিক চেতনা। সহজিয়া উচ্চারণে বিষাদ সিন্ধু। জীবনের অন্যরকম যাত্রা। অনুভব।
মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লেখা কবিতার অন্যমাত্রা এনেছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস ও তার পরম্পরা।কবির লেখা- মে দিবসের কবিতা, ধর্মঘটের কবিতা পড়তে পড়তে সেই কথাই মনে পরেছে।যেন জনতার ঢল।জনজোয়ার।লড়াই।” আজকে আবার মিলেছে সর্বহারা/……. আমিও ফিরেছি নতুন ভোরের গানে।” কবি শক্তি খুঁজে পান। এগিয়ে চলে সংগ্রাম। মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। তাইতো— ” কালো আকাশের বুক চিরে/ আবার আসুক নেয় সূর্যের নতুন রোদ।”
গণতন্ত্র যেখানে মাটির সঙ্গে মেশে সেখানে এইধরনের প্রতিবাদী কলম তরোবারি হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চলে। রক্ত ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে। শহীদের মৃত্যু হয় না।মার খায়। রক্তাক্ত। তবু ” রক্তঝরা নবান্ন অভিযান”। শপথ নেয় নতুন দিন আনার।যেমন প্রতিটি ঐতিহাসিক আন্দোলন ছিল। সময়ের দলিল লেখক হিসেবে কবির বিভিন্ন ঘটনার তথ্যপুঞ্জি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট লেখার মতো। সমস্ত কিছু ধরে রাখতে চান। মানুষের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারেন।ঘুন ধরা সমাজকে নাড়িয়ে দিতে চান।
রাজ্য ও রাজনীতি পাশাপাশি এসেছে বিভিন্ন বিষয়ে। দেশের সীমানা পেরিয়ে চলে গেছেন কবি বিশ্বের দরবারে। কাঁটাতারের বেড়া টপকে বাংলাদেশ। বিপ্লবের রনাঙ্গনে। এভাবেই এসেছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের কথা।ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।।” একুশ রক্ত পলাশ রাঙা/লাল আবীরের রেখা/ভুলতে পারি কখনও বা/একুশ লাইন লেখা।” একুশ আমার একুশ তোমার। কবিতায় স্মরণ যেমন আছে তেমনি লড়াই করার শপথ আছে।” শহীদ স্মরণে জীবনে মরণে/একুশকে পাশে রাখি/আমরা বাঙালি থাকবই আজ/ কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি।”
***
কাব্যগ্রন্থ : জেগে আছো হিমরক্ত?
কবি : সৌরভ দত্ত
প্রকাশক : ডি.ওয়াই. এফ. আই ( মাজু, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ)
মূল্য: ৩৫ টাকা ।
শিক্ষক, আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ক্যুইজমাস্টার, ও সম্পাদক।জন্ম – পিয়ারাপুর, উদয়নারায়ণপুর, হাওড়া। পিতা ও মাতার নাম- ৺নিমাই ,৺ আল্পনা। শিক্ষাগত যোগ্যতা- ডবল এম এ( ভূগোল, এডুকেশন) , বি এড। পেশা- সহ শিক্ষক, বড়দা গঙ্গাধর হাইস্কুল। *সম্পাদক- হাওড়া জেলার কথা ও আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক পলাশ সাহিত্য পত্রিকা।* সাহিত্য চর্চা- পাঁচারুল শ্রীহরি বিদ্যামন্দিরে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তে পড়তে লেখালেখি শুরু। বিভিন্ন ছোট পত্রিকা( মেটেফুল, অভিযান, পাঞ্চজন্য, শম্পা,সারঙ্গ আলো ভূমিজ ইত্যাদি), রং বেরং, দৌড়, আমি অনন্যা, তথ্যকেন্দ্র, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান এর মতো কয়েকটি বড় বাণিজ্যিক পত্রিকায় লেখা প্রকাশ পায়।সারা ভারতবর্ষ এবং আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। রেডিও তে নিয়মিত কবিতা পড়া হয়। * FM Rainbow থেকে সেরা পলেসুর সম্মান লাভ। হাওড়া জেলা বইমেলা কমিটির সম্মান, হাওড়ার বঙ্কিম মেলার সম্মান, হাওড়ার সত্যজিৎ রায় জন্মোৎসব কমিটির সম্মান, এই সময় পত্রিকা সম্মান ছাড়াও অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ও পত্রিকা থেকে সম্মান লাভ। *প্রকাশিত বই- গৌর দাসের আখড়ার বোষ্টমি,একতারার সুর, উদয়নারায়ণপুর জনপদ কথা ( ব্যক্তিগত ভাবে) , ভূমি (একটি আবাদের গল্প),বোষ্টমী ও বাউল কথা। হাওড়া জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে নিরন্তর কাজ চলছে। *ওয়েবসাইটে হাওড়া জেলার কথা গ্রুপ ও পেজ নিয়ত জনপ্রিয় হচ্ছে।
বর্তমান ঠিকানা : কুলডাঙা, পাঁচলা, হাওড়া