—হোয়াট অ্যাবাউট ইওর ফ্যামেলি?
—বাবা আছেন। একটা বড় ভাই আছেন। বিবাহিত। তিনি অন্য শহরে থাকেন। বাবা বাড়িতে একা। এখানে আমি একা। আমার খুব একা একা লাগে। ঘরের ভিতর, রাস্তায়, শহরে, একা একা লাগে। কারো প্রেম দেখলে আমার মন খারাপ হয়। গোপনে কষ্ট নিয়ে মাথা নীচু করে আমি তখন সেখান থেকে চলে আসি। মনে মনে নিজেকে বলি, ‘একদিন আমারও হবে।’ তারপর অনেক অনেক দিন চলে যায়। অনেক অনেক রাত চলে যায়। আমার আর দিন আসে না। আকাশে মেঘ জমে, বৃষ্টি নামে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টিতে হাত মেলে দেই। উঠোনে দেখি একদল হাঁস ভিজতে ভিজতে প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসছে। দেখি, বারান্দার কোল ঘেঁষে কয়েকটি নয়নতারা ফুলগাছে বেশ কিছু ফুল। তারা ছাচের চালের জলে ভিজে যাচ্ছে নীচে। বাতাসে বৃষ্টির সাঁটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে বারান্দা। আমাকেও। এসব দেখতে দেখতে আমি আকাশের দিকে তাকাই। আকাশে ভরা বর্ষা, মেঘ, মুষুলধারে বৃষ্টি। ঘরে ফিরে আসি। টেবিলে গোছানো বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার আলতো শীত করতে থাকে। একটা খাতা টেনে নেই। সেখানে একটা কবিতায় চোখ আটকে যায়। উৎপলকুমার বসুর ‘নবধারাজলে’—
মন মানে না বৃষ্টি হলো এত
সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে।
এখন এক ঢেউ দোলানো ফুলে
ভাবনাহীন বৃত্ত ঘিরে রাখে—
স্রোতের মতো স্রোতস্বিনী তুমি
যা-কিছু টানো প্রবল দুর্বিপাকেতাদের জয় শঙ্কাহীন এত,
মন মানে না সহজ কোনো জলে
চিরদিনের নদী চলুক, পাখি।
একটি নৌকো পারাবারের ছলে
স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল
অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার,
তোমার গ্রামে, রেলব্রিজের তলে,
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।
পড়ে আমার মন আরো বিষণ্ণ হয়। মুখ কাচুমাচু করি। টেবিলের বইগুলার দিকে আরো বিষণ্ণতা নিয়ে তাকাই। যেন পৃথিবীর কোথাও কোনো মানুষ নেই আমার। মনে পড়ে, আমার এক বন্ধু ছিলো। সুদর্শনা। স্বপ্নচারিণী। গোপনে আমি যার প্রেমে পড়েছিলাম। গোপনে যে আমার প্রেমে পড়েছিলো। সে বলতো, সে কলাগাছের বউ। তখন আমার খুব কলাগাছ হতে ইচ্ছে করতো। একাধিক পাতার ছায়ায় তাকে আগলে রাখতে ইচ্ছে করতো। আমার এখন খুবই তার কথা মনে পড়ছে। তার গাল ছড়িয়ে হাসিটা মনে পড়ছে। তার হাতের আঙুল, ঠোঁট, তার চুলের দীঘল অন্ধকার… এসব মনে পড়ছে আর মন আরো বিষণ্ণ থেকে বিষণ্ণতর হয়ে উঠছে। হাসতে হাসতে সে একবার আমাকে বলেছিলো, ‘জানো, রাই আমাকে বলে, তোরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে কর।’ শুনে আমি হেসেছিলাম। যে নিজেই জীবন থেকেই পালিয়ে বাঁচে সে পালিয়ে গিয়ে রাঙাবে অন্যজীবন! চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সেই নীরবতার সে কোনো অর্থ করতে না পেরে সম্ভবত নিজেও অসংখ্য প্রশ্নবোধক রেখে মিলিয়ে গিয়েছিলো। ‘জীবন এমনই’ মেনে নিয়ে আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। আমার আর ভালো লাগছে না এখন। আসেন, আরকেটি কবিতা পড়ি। তন্ময় হাসান-এর ‘এক্স লাভার’—
আমাদের কোথাও হারাবার কথা ছিলো। সেই অবকাশ আসেনি। পরের দিনের সন্ধ্যা এসেছিলো। মুখিয়ে থাকা দুটি চোখের উপর ভর করে সন্ধ্যা এসেছিলো, এসেছিলো কান্না। সেদিন তোমাকে নৈশব্দের চেয়েও প্রিয় মনে হয়েছিলো! আমাদের হারানো হয়নি! হারিয়ে গেছে আমলকী ঘ্রাণ, রোজকার মাতাল রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে আমি যেই সন্ধ্যায় ভাবি ঘরে ফিরবো সেই সন্ধ্যায় তোমার বিস্মরণের চোখ মনে পড়ে! আর তখন মাথার ভিতর প্যারেড করে চারশ সৈন্যদল। আমি ভাবি যার পৃথিবী স্থির, নিশ্চল, তার কাছে প্রস্থান কেমন? তার সন্ধ্যার রঙ কী?
‘আমার আসলে কেউ নাই’ বলে মাঝে মাঝেই আক্ষেপ হয়। একজন প্রেমিকা থাকলে খুব ভালো হতো। ফলে প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা সত্বেও ভালোবাসা পাওয়া হয় না আমার।
—আমি দুঃখিত।
—পৃথিবীতে দুঃখ পেতে নাই। দুঃখ পৃথিবীকে দুঃখিত করে। আমরা বরং আরেকটি কবিতার দিকে এগোই, চলেন। মীর নিশাত তাসনিম তানিয়ার ‘উপবৃত্ত’—
কারো নাভি দেখলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে—
মনে পড়ে দুধ জ্বাল দেবার কথা।
আরো ভয় হয় গরমের দিনে
বেলায় বেলায় নষ্ট হবে তরকারি।
কারো নাভি দেখলে আমার সন্তানের কথা মনে পড়ে—
মনে পড়ে হাঁটাতে শেখানো — অ-আ-ক-খ লেখা,
বুক খুলে শরম ছেড়ে মেলে দেয়া স্তন,
মা, মা — ডাকতে শোনা প্রথম চিৎকার।কারো নাভি দেখলে চোখে আঁতুড়ঘর ভাসে—
ভাসতে থাকে— একটা নাভি জন্ম দিচ্ছে আরেকটাকে।
ভীষণ রকম নীরবতা আচ্ছন্ন করে থাকে। আমাদের কথা ফুরিয়ে যায়। আকাশ থেকে তখনও বৃষ্টি পড়তে থাকে। কোথাও যেন গলা ছেড়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে কেউ। তার ছাড়া ছাড়া শব্দগুলো বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে কানে এসে পড়ছে—
মন হারাবার আজি বেলা
পথ ভুলিবার খেলা
মন চায়…মন চায়…
হৃদয় জড়াতে কারো চির-ঋণেঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে…
আমার মন ডুবে যায়…
প্রচ্ছদ: বিধান সাহা
কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রচ্ছদ শিল্পী
এমন বৃষ্টির দিনে পড়ে ভালো লাগল, বিধান। চমৎকার।