Categories
তিনি কি তবে যিশু নন
আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্ম আর শিল্প দুটোই ইউরোপ কেন্দ্রিক হয়ে পড়ার কারণে যিশুর এই চেহারাটিই সবচেয়ে বেশী পরিচিতি পেয়েছে – একজন দাড়িওয়ালা শ্বেতাঙ্গ মানুষ, যার রয়েছে লম্বা বাদামী চুল এবং নীল চোখ।
বিশ্বের প্রায় দুইশো’ কোটি খ্রিস্টানের কাছে এটিই যিশুর পরিচিত ছবি, কিন্তু বাস্তবের সাথে হয়তো এর খুব কমই মিল রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যিশু সম্ভবত ছিলেন কালো, খাটো এবং তিনি চুল ছোট করেই ছাঁটতেন – যেমনটা দেখা যেত ওই সময়ের অন্য সব ইহুদির মধ্যে।
যিশু আসলে দেখতে কেমন ছিলেন, বাইবেল পড়ে তা জানার উপায় নেই। বাইবেলে যিশুর জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে, কিন্তু তাঁর চেহারা সম্পর্কে কোন বর্ণনা নেই।
“গসপেলগুলোতে তাঁর শরীরের কোন বর্ণনা নেই, বলা হয়নি তিনি লম্বা ছিলেন না-কি খাটো, সুদর্শন না শক্তপোক্ত – শুধু বলা হয়েছে, তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ৩০ বছরের মতো,” বলছেন নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসবিদ জোয়ান ই. টেলর।
লন্ডনের কিংস কলেজের ধর্মতত্ত্ব ও ধর্ম গবেষণা বিভাগের এই অধ্যাপক একটি বই লিখেছেন – হোয়াট ডিড জেসাস লুক লাইক? অর্থাৎ যিশু দেখতে কেমন ছিলেন?
“এই যে তথ্যের অভাব, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ,” বলছেন আরেকজন ইতিহাসবিদ আন্দ্রে লিওনার্দো শেভিতারিস, যিনি ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরের ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক।
“যিশু দেখতে কেমন ছিলেন, তা তাঁর প্রথমদিককার অনুসারীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিবেচ্য ছিল বলে মনে হয় না। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যিশুর চিন্তা-ভাবনার বিষয়টি লিপিবদ্ধ করা”।
প্রথম শতাব্দীর খুলি পরীক্ষা
২০০১ সালে বিবিসি প্রযোজিত একটি তথ্যচিত্রের জন্য মুখমণ্ডল পুনর্গঠন বিষয়ক ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড নিভ বাস্তবের কাছাকাছি যিশুর একটি প্রতিমূর্তি তৈরি করতে তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কাজে লাগান।
যিশু যেখানে বাস করতেন সেখান থেকে পাওয়া প্রথম শতকের তিনটি খুলি ব্যবহার করে তিনি এবং তাঁর দল একটি ত্রিমাত্রিক মডেল দাঁড় করান, আর তৈরি করেন এমন একটি মুখমণ্ডল, যা হয়তো হতে পারতো যিশুর মুখ।
ওই সময়ের ইহুদিদের কঙ্কাল থেকে দেখা গেছে যে তাদের গড় উচ্চতা ছিল ১.৬০ মিটার, আর বেশীরভাগ পুরুষের ওজন ছিল ৫০ কিলোগ্রামের একটু বেশী।
অধ্যাপক টেলর যিশুর বাহ্যিক চেহারা সম্পর্কে এ রকমই একটি ধারণায় পৌঁছেছেন।
“বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক গঠনের দিকে থেকে ওই সময়ের ইহুদিরা আজকের ইরাকী ইহুদিদের অনুরূপ। তাই আমার মনে হয় যিশুর চুল ছিল ঘন বাদামী থেকে কালোর মধ্যে, চোখ বাদামী, বাদামী ত্বক – একেবারেই একজন মধ্যপ্রাচ্যের পুরুষ,” টেলরের বক্তব্য।
তামাটে ও লম্বা চুল
ব্রাজিলের গ্রাফিক ডিজাইনার এবং ফরেনসিক ফেসিয়াল রিকনস্ট্রাকশন বিশেষজ্ঞ সিসারো মোরায়েস বিবিসি ব্রাজিলের অনুরোধে যিশু খ্রিস্টের একটি বৈজ্ঞানিক ইমেজ তৈরি করেন।
তাঁর মন্তব্যে তিনি বলেন, “যিশু নিশ্চিতভাবে শ্যামবর্ণের ছিলেন। কারণ ওই অঞ্চলের মানুষের গায়ের রঙটাই এমন। এরা মরুভূমির মানুষ, যাদের থাকতে হয় প্রখর সূর্যের নীচে।”
আরেকটি মজার বিষয় হলো যিশুর চুল।
ঈশ্বরের বানী প্রচারের জন্য যিশুর নির্বাচিত ১২ জনের একজন পল লিখেছিলেন যে “লম্বা চুল রাখা পুরুষের জন্য গ্লানিকর”, তাই যিশুর লম্বা চুল রাখার কথা নয়, যদিও ছবিতে এমনটা দেখানো হয়।
“তখনকার রোমে পুরুষদের মধ্যে প্রচলন ছিল দাঁড়ি কামিয়ে রাখা এবং চুল ছোট করে কাটা। যদিও প্রাচীন আমলে দার্শনিকেরা সম্ভবত লম্বা দাঁড়ি রাখতেন,” বলছেন ইতিহাসবিদ জোয়ান টেলর।
অধ্যাপক লিওনার্দো শেভিতারিস বলছেন, যিশুর তৃতীয় শতকের যে প্রতিরূপটি পাওয়া গেছে, তাতে তাকে একজন তরুণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যার ছিল ছোট চুল।
বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “তাকে অনেকটা তরুণ একজন দার্শনিকের মতো দেখা গেছে – একজন দাঁড়িওয়ালা দেবতা নয়, বরং একজন শিক্ষক”।
সাও পাওলো ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক উইলমা স্টিগাল দেখান যে খ্রিস্টানদের প্রথমদিকের আইকোনোগ্রাফিতে যিশুকে অনেক রকমভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে – “কখনো দার্শনিক বা শিক্ষকের মতো দাঁড়ি সহ, কখনো দাঁড়ি ছাড়া, টিউনিক পড়া, কখনো সূর্য দেবতার মুখাবয়ব, আবার কখনো বা সাধারণ একজন মেষপালক।”
স্বর্গীয় রূপ
অধ্যাপক টেলর বলেন, গত বেশ কিছু শতাব্দী ধরে যিশুর যে ছবিটি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি একটি স্বর্গীয় রূপ – ঈশ্বরের পূত্র। এই ছবিতে যিশু মানবীয় নন।
“এই বিষয়টি সবসময়েই আমাকে মুগ্ধ করেছে,” বলছেন তিনি।
লম্বা চুল-দাঁড়ির যিশুর ছবিটি উঠে আসে মূলত মধ্যযুগে, বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে।
অধ্যাপক শেভিতারিস যেমনটা বলছেন, ওইসব ছবিতে যিশুকে দেখানো হয়েছে একজন অপরাজেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে – ইতিহাসের ওই সময়ের রাজা কিংবা সম্রাটদের মতো করে।
সাও পাওলোর ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ফ্রান্সিসকো রিবেইরো নেটো বলছেন, প্রাচ্যের গির্জাগুলোতে যিশুকে সব সময়েই বিশেষভাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, যেমন তাঁর শির উঁচু, তাঁর দুই চোখের মাঝখানের ভাজে প্রজ্ঞার চিহ্ন এবং নশ্বর পৃথিবী ছাড়িয়েও তাঁর দেখার ক্ষমতা।
“অনেকের মাঝে যখন তাকে দেখানো হয়েছে, তখন তাকে দেখানো হয়েছে বড় করে, যার মানে হলো তিনি অন্য মানুষদের তুলনায় শ্রেয়। আর ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে দেখানো হয়েছে জীবন্ত এবং গরিমা সমৃদ্ধ, যা ধারণা দেয় যে তিনি পুনরায় ফিরে আসবেন।”
কিন্তু পশ্চিমের গির্জাগুলো এমন ধরাবাঁধা কোন নিয়ম অনুসরণ করেনি। ফলে শিল্পীরা নিজেদের মতো করে যিশুর ছবি এঁকেছেন।
“অনেক ছবিতে তাকে আঁকা হয়েছে মিষ্টি করে, আবার কোন কোন ছবিতে তিনি কষ্ট ভোগ করছেন কিংবা একজন শহীদ,” বলছেন রিবেইরো নেটো।
এই সমাজবিজ্ঞানী বলছেন যে যখন কোন কিছুকে শিল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তখন সংস্কৃতি তাকে প্রভাবিত করে।
“সেই কারণে নীল চোখের যিশুকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই, সমস্যাটা হলো আপনি ধরে নিচ্ছেন স্বর্গীয় ভাবটিতে ইউরোপীয় ভাবধারা থাকতে হবে, কারণ এটা তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে সামাজিক মাপকাঠিতে যারা ওপরের দিকে রয়েছে।”
ইতিহাসবিদ শেভিতারিস মনে করেন “ইউরোপীয়” যিশু এবং নতুন যেসব দেশে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার হয়েছে, সেসব দেশের যিশুর মধ্যে পার্থক্য ঘোচাতে পরের দিকে এমন একজনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়েছে, যিনি হবে “এথনিক” যিশু।
তিনি বলেন, “চীনে এক সময়কার পর্তুগিজ উপনিবেশ ম্যাকাওতে যে যিশুকে দেখা যায়, তাঁর চোখ বেশ সরু, আর পোশাকও পড়েন অনেকটা চীনাদের মতো করে।”
“আর ইথিওপিয়াতে এমন যিশুও দেখা গেছে, যার রঙ কালো।”
সূত্রঃ বিবিসি