| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

মন ও মননে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি ॥ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আমরা এগিয়ে চলি৷ আমাদের ইতিহাসও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে৷ ইতিহাসের একটা নিজস্ব নিয়মের নিজস্ব গতি আছে৷ এই নিয়ম যেন আমাদের অস্তিত্বের নানা অংশে, নানা টুকরো টুকরো স্মৃতির অনুষঙ্গ জাগিয়ে রাখে৷ এই অনুষঙ্গ কখনও কখনও সঙ্গ দান করে আমাদের৷ সঙ্গযাপনের একান্ত ঘনিষ্ঠতায় আমারা জড়িয়ে যাই স্মৃতিকথায়৷ পাঠকথায় ৷ ইতিকথায়৷ স্মৃতির সংগ্রহশালা থেকে শুরু হয় ইতিহাসকে ফিরে দেখার এক রক্তজ আগ্রহ৷ এই আগ্রহের সপ্রাণ আকর্ষণেই জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির নানা কথায় ডুব দিয়ে আবিষ্কার করা যায় ইতিহাস ও চলমানতার বর্ণবন্ত নানা বাতিঘর৷ প্রতিটি বাতিঘরে যেন আজও জায়মান হয়ে আছে রাশিরাশি আলোর খনি৷ সেই সঙ্গে আছে মনকেমনের আলোছায়া, হৃদকমলের প্রেম-অপ্রেমের অশ্রুগাথা, ধর্ম-সংস্কৃতি-রাজনীতির অনন্য ও অপরিমেয় চলভাষ ৷ এ এমন এক পরিবার যার গর্ভগৃহ থেকে দিনের পর দিন উৎসারিত হয়েছে গোটা বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের নাড়ির স্পন্দন৷ এ এক এমন পরিবার যার আবহ- পরিবেশ থেকে সূচিত হয়েছে বঙ্গভূমের ও নগর কলকাতার নানান রুচি ও অভিরুচির স্বপ্ন আখ্যান৷ মনে হয় যেন রূপকথা! কীভাবে সম্ভব হয় একই পরিবার থেকে অসংখ্য বহুবর্ণ প্রতিভার জীবন্ত উন্মেষ ও বিচ্ছুরণ!

বহু বহু কৃতি ব্যক্তিত্বের সদম্ভ পথ চলা! এ সব ভাবতে গেলে কেমন যেন ঘোর লেগে যায়৷ চেনা বাস্তব আর অচেনা বাস্তবের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ জাগে৷ তবুও খুলে রাখতে হয় নির্মোহ বস্তুনিষ্ঠ চোখ৷ নিরাসক্ত ভাষণে বুনতে হয় মূল্যবানের মূল্যাঙ্কন৷ সেই সঙ্গে মনে রাখতে হয়, এমন এক পরিবারের কথা ভাবতে বসা এবং সেই ভাবনা নিয়ে ইতিহাস ঘেঁটে কিছু ভাবতে ও লিখতে বসার সময় বারবার একটা কথা মনে ভেসে ওঠে, তাহ’ল, এ পরিবার হচ্ছে সেই পরিবার, যার কথা ও ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে আস্ত একটা দেশের কথা৷ এই পরিবারের কথা জানা মানে অনেকটা নিজের দেশের কথাও জানা৷

দেশকে জানার যেমন কোনো শেষ নেই, ঠিক তেমনই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নিয়ে জানারও কোনো শেষ নেই৷ যত জান’ব ততই ঋদ্ধ থেকে ঋদ্ধতর হ’ব৷

প্রকৃতপক্ষে এ বাড়ির প্রতিষ্ঠা পর্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জয়রাম ঠাকুরের কাহিনি৷ এই জয়রাম ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র নীলমণি ঠাকুর অষ্টাদশ শতকের প্রায় শেষদিক নাগাদ জোড়াবাগান এলাকার বৈষ্ণবচরণ শেঠ নামক এক ব্যক্তির কাছ থেকে কলকাতার মেছুয়া বাজার পল্লীর কাছে এক বিঘা দেবত্ত্ব ভূমি লাভ করেন৷ ১৭৮৪ সালের জুন মাস থেকে তিনি এই ভূমিতে বসবাস করতে শুরু করেন৷ অনেক পরে সেই অঞ্চল জোড়াসাঁকো নামে পরিচিত হয়৷ জোড়াসাঁকো অঞ্চলে ঠাকুরগোষ্ঠীর বসবাসের সূত্রপাত হয় এই নীলমণি ঠাকুরের হাত ধরে ৷ ইতিহাসেরও ইতিহাস থাকে৷ তাই জয়রাম ঠাকুর ও নীলমণি ঠাকুরের আগের সলতে পাকানোর পর্বটি খুব সংক্ষেপে জেনে নিলে ঠাকুরবাড়ির ইতিকথার বৃত্তটি আমাদের কাছে সম্পূর্ণতা পাবে৷ খুব স্বল্প কথায় জেনে নেওয়া যাক সেই ইতিহাসের ভেতরে থাকা ইতিহাসটিকে।

সময়কাল খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যবেলা৷ যশোহর জেলার চেঙ্গুটিয়া অঞ্চল৷ জমিদারের নাম দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরী৷ দক্ষিণা বাবুর চারপুত্র— কামদেব, জয়দেব, রতিদেব, এবং শুকদেব৷ শোনা যায়, কামদেব এবং জয়দেব ঘটনাচক্রে তৎকালীন মুসলীম
শাসক মামুদ তাহির বা পীর আলীর চক্রান্তের শিকার হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে একপ্রকার বাধ্য হন৷ এই ঘটনার চূড়ান্ত অভিঘাতে বাকী দুই ভাই রতিদেব ও শুকদেব হিন্দুধর্মের উগ্র সমাজপতিদের দ্বারা কোণঠাসা হয়ে নিজের ধর্মেই প্রান্তিক হয়ে পড়েন৷ বলা যায়, এই দুইভাই নানান সামাজিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে করতে ক্রমশ সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন৷ পীর আলি, এই অনুষঙ্গে ‘পিরালি’ শব্দের জন্ম হয় সমাজমানসে৷

রতিদেব এবং শুকদেব সমাজচ্যুতির তাচ্ছিল্যভরা পিরালী ব্রাহ্মণ হিসাবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত হতে থাকেন৷ মূল স্রোতের ব্রাহ্মণ পরিবারগুলির সঙ্গেও তাদের ব্যবহারিক ও মানসিক দূরত্ব বাড়তে থাকে৷ তবে অর্থবান হওয়ার কারণে তাদের কিছু বাড়তি সুবিধা হয়৷ জাতকৌলীন্যের হারানো গৌরব ফিরে পাবার চেষ্টায় তাঁরা তাঁদের পুত্র ও কন্যাদের উচ্চ অথচ দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিবাহ দেবার চেষ্টা চালাতে থাকেন৷ এই প্রচেষ্টার হাত ধরে শুকদেব তাঁর কন্যাকে পিঠাভোগ নামক স্থানের স্থানীয় জমিদার জগন্নাথ কুশারীর সাথে বিবাহ দেন৷ স্বাভাবিক ভাবেই জগন্নাথ কুশারী পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েন এবং নিজস্ব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুকদেবের আশ্রয়ে নরেন্দ্রপুর অঞ্চলের বারোপাড়া নামক গ্রামে নতুন বসতি স্থাপন করেন৷ ইতিহাসের গতিধারায় শুকদেবের জামাতা হিসাবে পিরালি সংসর্গ গড়ে উঠলেও জগন্নাথ কুশারির নিজস্ব পরিচয়ের সূত্রে নতুন বংশধারার ইতিহাস সূচিত হয়ে ওঠে৷

জগন্নাথ কুশারীর চার পুত্র সন্তান৷ এরা হলেন— প্রিয়ঙ্কর, পুরুষোত্তম, হৃষীকেশ ও মনোহর৷ এদের মধ্যে পুরুষোত্তমের পুত্রের নাম ছিল বলরাম৷ বলরামের পুত্র হরিহর৷ হরিহরের পুত্র রামানন্দ৷ এই রামানন্দের দুই পুত্রের নাম— মহেশ্বর ও শুকদেব৷ আর্থিক প্রতিবন্ধকতা এবং জ্ঞাতি বিবাদের কারণে মহেশ্বর তাঁর পুত্র পঞ্চাননকে সঙ্গে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে যশোর ছেড়ে কলকাতায় এসে ওঠেন৷ সময় কাল সপ্তদশ শতকের শেষদিক৷ ঠিক এই সময়পর্বেই জবচার্ণকের উদ্যোগে কলকাতার নগরকলকাতা হয়ে ওঠার ভ্রূণ জন্ম নেয়৷ জবচার্ণক কলকাতা প্রতিষ্ঠা করলেন, এমন বোকা বোকা অর্থহীন দাবি এখানে করছি না৷ এ সময় একাধিক ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীর আগমনে কলকাতায় নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠার কারণে অভূতপূর্ব কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়৷ জীবিকার নতুন নতুন দরজা খুলে যায়৷

মহেশ্বর এবং পঞ্চানন এই সময় দক্ষিণ গোবিন্দপুরের আদিগঙ্গার তীরে বিভিন্ন মাছ ব্যবসায়ী এবং ধীবর, মালো , কৈবর্ত শ্রেণির মানুষের সমাজসংলগ্ন পরিবেশে বসবাস শুরু করেন৷ প্রথম দিকে মহেশ্বর এবং পঞ্চানন বিদেশাগত বিভিন্ন পণ্যবাহি জাহাজে পণ্য সরবরাহের কাজে নিযুক্ত হন৷ আর্থিক অবস্থা একটু সামলে নিয়ে পিতাপুত্র গোবিন্দপুরে জমি কিনে বসতবাড়ি ও শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন৷ মহেশ্বরের মৃত্যুর পর পঞ্চানন দক্ষতার সঙ্গেই নিজ ব্যবসা চালিয়ে যান৷ তাঁদের প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণ হিসাবে পঞ্চানন কুশারীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি পায়৷ স্থানীয় অব্রাহ্মণ তথা নিম্ন বর্ণের মানুষেরা ঠাকুর-দেবতার অনুষঙ্গে পঞ্চানন কুশারীদের ব্রাহ্মণ হিসাবে ঠাকুরমশাই হিসাবে সম্বোধন করতে শুরু করে৷ স্থানীয়দের দেখাদেখি বিদেশী বণিকরাও তাদের ম’ত ক’রে উচ্চারণে ঠাকুর নামে ডাকতে শুরু করে৷ ধ্বনিপরিবর্তনের কারণে ঠাকুর হয়ে যায় বিদেশী উচ্চারণে Tagoor বা Tagore .

পঞ্চাননের দুই পুত্র জয়রাম এবং রামসন্তোষ উপস্থিত বুদ্ধির জোরে ইংরেজ বণিকদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে৷ পাশাপাশি তারা ফরাসি বণিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ বজায় রেখে চলে৷ জয়রাম এই সংগোগের সূত্রেই ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীতে চাকরী জুটিয়ে নেয়৷ এই জয়রামের দ্বিতীয় পুত্র নীলমণি৷ কিছু আগেই বলেছি, এই নীলমণি ঠাকুরই জোড়াসাঁকো ঠাকুরগোষ্ঠীর সূত্রপাত করেন ৷

১৭৬৫ সাল নাগাদ নীলমণি ঠাকুর কালেক্টরের সেরেস্তাদার হয়ে উড়িষ্যায় গমন করেন৷ এই সময় তিনি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেন৷ ধনীব্যক্তি হিসাবে তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা ঘটে ৷ এই নীলমণি ঠাকুরের তিন পুত্র এবং এক কন্যা—রামলোচন, রামমণি, রামবল্লভ এবং কমলমণি৷ ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে নীলমণি ঠাকুরের মৃত্যু হয়৷ পিতার অবর্তমানে স্বাভাবিক ভাবেই জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসাবে রামলোচন ঠাকুর পরিবারের অভিভাবক হয়ে ওঠেন৷ রামলোচন ছিলেন নিঃসন্তান৷ ভ্রাতা রামমণির পুত্র দ্বারকানাথকে তিনি দত্তক নেন ৷ রামমণির ও মেনকাদেবীর পুত্র দ্বারকানাথের জন্ম ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে৷ রামলোচন দ্বারকানাথকে দত্তক নেবার পর তাঁর স্ত্রী অলকা দেবীর স্নেহচ্ছায়ায় দ্বারকানাথ বড় হতে থাকেন ৷

একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, এই ঠাকুর পরিবারে কয়েক প্রজন্মে যথার্থ প্রতিভাবান ও কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অভাব ছিল না৷ বলতে গেলে অনেক নাম সামনে চলে আসবে৷ তবে এই মর্মে ইতিহাসের আভিজাতিক সূত্র হিসাবে ঠাকুর পরিবারের উল্লেখযোগ্য তিন প্রজন্মের তিন প্রজন্মস্তম্ভ হলেন, দ্বারকানাথ ও তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ এবং দেবেন্দ্রনাথের পুত্র রবীন্দ্রনাথ, সবদিক থেকেই এঁরা উল্লেখযোগ্য ও অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ৷

নীলমণি ঠাকুরের তৈরি ঠাকুর পরিবারকে অতুলনীয় বিত্ত বৈভবে ভরিয়ে তুললেন দ্বারকানাথ৷ তিনি ছিলেন অসামান্য মেধা, দূরদর্শী এবং তীক্ষ্ণ বৈষয়িক বুদ্ধির অধিকারী৷ পারসী এবং ইংরাজী ভাষায় ব্যুৎপত্তি ছিল অপরিমেয়৷ যৌবনে দ্বারকানাথ ম্যাকিনটস কোম্পানির ছত্র ছায়ায় ব্যবসা শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবসায়িক সাফল্য তাঁকে আরও অনেক ইতিবাচক সম্ভাবনার সামনে এনে দাঁড় করান৷

১৭৯৩-এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারকা নাথের ভাগ্য ও জীবন উন্নতির স্বর্ণোদ্বার উন্মোচন করে৷ এই সময় তিনি জমিদারের স্বত্ব, অধিকার ও রাজস্ব বিষয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন৷ তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার মি. ফার্গুনসনের ঐকান্তিক সহযোগিতায় তিনি বাংলা এবং বিহারের বহু জমিদারের আইন-বিশেষজ্ঞ এবং আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা তথা মোক্তার হয়ে ওঠেন৷ মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে দ্বারকানাথ চব্বিশ পরগণার কালেক্টর ও Salt Agent-এর দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন৷

১৮৩৩ সালে দ্বারকানাথ স্থাপন করেন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ৷ ১৮৩৩-এ তিনি স্থাপন করেন দ্বারকানাথ কুঠি৷ শিলাইদহ এবং আরও নানা জায়গায় তিনি নীলকুঠী সহ প্রচুর জমিদারি ক্রয় করেন৷ ১৮৩৪-এ তিধি স্থাপন করেন কার টেগোর কোম্পানি৷ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে দ্বারকানাথ বাষ্পচালিত জাহাজের ব্যবসা শুরু করেন৷ রাণীগঞ্জ অঞ্চলে কয়লা উৎপাদন সংস্থা হিসাবে “বেঙ্গল কোল কোম্পানি” স্থাপন করেন ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে৷ এই কোম্পানির হাত ধরেই এদেশে কয়লা শিল্পের সূচনা হয়৷

দ্বারকানাথ বিপুল পরিমান অর্থ উপার্জন করেছেন বটে, কিন্তু অর্থসর্বস্ব জীবনযাপন করেন নি৷ নানা ধরণের জনকল্যাণমুখি কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর সমাজ ও দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার পরিচয় রাখতে পেরেছেন৷ রাজা রামমোহনের সঙ্গে আন্তরিক ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তিনি জনহিতকর কাজকর্মে গভীরভাবে লিপ্ত
হওয়ার প্রেরণা পান ৷ জমিদার সভা স্থাপন, ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ডাক বিনিময়-ব্যবস্থা, মেডিকেল কলেজ, হিন্দু কলেজ, সতীদাহ নিবারণ, মুদ্রণ যন্ত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি নানান বিষয়ে দ্বারকানাথ ইতিবাচক ভূমিকা নেন৷ প্রতিটি সমাজ-সংস্কার তথা জনহিতকর কাজে তিনি আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন৷ ইংরাজী শিক্ষার বিস্তার এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচারে দ্বারকানাথের সদর্থক ভূমিকা কখনও ভোলার নয়৷ সমাজের নানান স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের নিয়ে তিনি নানা প্রকার সম্মেলনের ব্যবস্থা করতেন৷ এ কারণে তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির উঠোনে একটি সুবিশাল তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেন৷ সেটি ‘বৈঠক খানার বাড়ি’ নামে পরিচিতি পায়৷

দ্বারকানাথ ধর্মীয় সংস্কার মুক্ত ছিলেন বলেই দু-দুবার বিলাত যাত্রা করতে পেরেছিলেন৷ ১৮৪২-এ ইউরোপ বসবাসের সময় তিনি এডিনবরা মহানগরীর সিটি কাউন্সিল কর্তৃক “ফ্রিডম অব দা সিটি” সম্মানে ভূষিত হন৷ দ্বিতীয় বার ইউরোপ সফরে লন্ডনের কাছাকাছি সারেতে ১ লা আগস্ট ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে৷ যেন এক বিরল নক্ষত্র অতর্কিতে নিভে গেল৷ কিন্তু তিনি রয়ে গেলেন মরণজয়ী ইতিহাস হয়ে৷

দ্বারকানাথ ও দিগম্বরী দেবীর পাঁচ পুত্রের প্রথম জন হলেন দেবেন্দ্রনাথ৷ তিনি মহর্ষি নামে পরিচিত ছিলেন৷ এক সুগভীর আধ্যাত্মিক মনন তাঁকে ঋষি সুলভ জীবনচর্যার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ উপনিষদের একনিষ্ঠ অনুরাগী দেবেন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ে ব্যাখ্যা ও আলোচনার জন্য “আত্মীয় সভা” স্থাপন করেন৷ ১৮৩৯-এ “তত্ত্বরঞ্জিনী সভা” এবং ১৮৪০-এ স্থাপন করেন “তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা”৷ এখানে অবৈতনিক বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা গৃহীত হয়৷ দেবেন্দ্রনাথের ঐকান্তিক প্রেরণায় তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রহ্মসমাজের দায়িত্ব গ্রহণ করে৷ এই সভা থেকেই কিছুদিন পরে “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা” প্রকাশিত হয়৷ বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে এ এক ব্যতিক্রমী সংযোজন৷ ১৮৫৯ সাল নাগাদ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে মিলিত হয়ে ব্রহ্মধর্ম সম্বন্ধীয় কার্যে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন৷ এর ফলে বৈষয়িক ব্যাপারে তিনি ক্রমশ উদাসীন হয়ে পড়েন৷ এরই মধ্যে দ্বারকানাথের মৃত্যু তাঁর সুবিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে এতটাই দুবর্ল করে দেয় যে দেবেন্দ্রনাথ বাধ্য হন কঠোর ভাবে ব্যয় সঙ্কোচন করতে৷ দেবেন্দ্রনাথের ভাই গিরীন্দ্রনাথ বেশ বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন এবং তিনিই পারিবারিক ব্যবসা এবং বিষয়-সম্পত্তি দেখাশুনা করতেন৷ কিন্তু ১৮৫৪ সালে তাঁর অকাল প্রয়াণ ঘটলে সংসারে এক চরম আর্থিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়৷ বৈষয়িক দায়িত্ব এবার দেবেন্দ্রনাথের ওপর এসে পড়ে৷ কিন্তু এই দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত মানসিক গঠনই তাঁর ছিল না৷ জমিদারী দেখাশুনা ছাড়া অন্য সব বিষয় তিনি বাকী ভায়েদের মধ্যে বন্টন করে দেন৷ ক্রমশই তিনি সংসারে হাঁপিয়ে ওঠেন৷ আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতেই থাকে৷ ১৮৬৮ সালে তিনি মেছুয়াবাজার স্ট্রিটে ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মসমাজ মন্দির স্থাপন করলেন৷ মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে তিনি পরিব্রাজকের জীবন শুরু করলেন৷ জীবনের শেষ চল্লিশ বছর তিনি মূলত আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করলেন৷ এই সময় হিমালয় ছাড়া বোলপুরের শান্তিনিকেতন ছিল তাঁর অধ্যাত্ম চর্চার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ নিসর্গপট৷ ১৯০৫ সালের ১৯-শে জানুয়ারী ৮৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে৷

দেবেন্দ্রনাথের সন্তান সংখ্যা পনেরটি৷ রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলেও কিন্তু দেবেন্দ্র নাথের বেশীরভাগ সন্তানই ছিলেন বিরল প্রতিভা ও কর্মক্ষমতার অধিকারী৷ দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন অসামান্য ব্যক্তিত্ব৷ “স্বপ্নপ্রয়াণ” তাঁর অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ৷ যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ রয়েছে এ কাব্যে৷ ‘মেঘদূত’-এর অনুবাদ কর্মেও তিনি তাঁর শিল্পী সত্তা ও কাব্য প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন৷ দার্শনিক নিবন্ধে তাঁর ব্যুৎপত্তির পরিচয় সর্বজন বিদিত৷ তাত্ত্বিক প্রবন্ধকার হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল অপরিসীম৷ তিনখন্ডে সম্পূর্ণ তাঁর “তত্ত্ববিদ্যা” গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের এক অজেয় সম্পদ ৷ বাংলায় “শাট-লিখন-প্রণালীর অর্থাৎ শর্টহ্যান্ডের উদ্ভাবনে তাঁর ভূমিকা ছিল এককথায় পথিকৃতের৷ রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথও ছিলেন অসম্ভব মেধাবী ও কৃতি ব্যক্তিত্ব৷ ১৮৬৩ সালে তিনি লন্ডনে প্রথম ভারতীয় হিসাবে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় যথেষ্ট সম্মান ও কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন৷ ভারত সরকারের সিভিলিয়ান পদে তিনি যথেষ্ট কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করেন৷ দ্বিজেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথের সাহিত্য খ্যাতি ছিল বিপুল৷ “সাধনা” পত্রিকার সম্পাদনার কাজে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন৷ দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ সন্তান হেমেন্দ্রনাথও সাহিত্য প্রতিভায় ছিলেন যথেষ্ট উচ্চভাব সম্পন্ন৷ সপ্তম সন্তান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী৷ সংগীত, চিত্রকলা, নাট্যরচনায় তাঁর খ্যাতি ছিল অসামান্য৷

ব্যবসা-বাণিজ্যেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট সক্রিয়৷ একাদশ সন্তান স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক৷ দেবেন্দ্রনাথের ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথের বংশধরেরাও যথেষ্ট প্রতিভাধর ছিলেন৷ গগেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন অপরিমেয় প্রতিভার অধিকারী৷ অবনীন্দ্রনাথের প্রতিভার খ্যাতি ছিল আন্তর্জাতিক৷ ঠাকুর পরিবারের আরও অনেক ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁদের কথা বলার বাইরে রয়ে গেল৷

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের চতুর্দশ সন্তান৷ এই সৃষ্টিছাড়া গভীর গভীরতর বহুমুখী প্রতিভাশীল মানুষটি সম্পর্কে কথা বলা শুরু করলে তা কোথায় গিয়ে শেষ হবে এককথায় বলা অসম্ভব৷ ঠাকুর বাড়ির বহুবর্ণময়, মননশীল, আধ্যাত্মিক ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক আবহ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের ঐ দিগন্তব্যাপী প্রতিভার উন্মেষ ঘটত কিনা সন্দেহ! তাই এই পরিবেশ-সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্র প্রতিভার সার্বিক মূল্যায়ন ও তার মূল্যাঙ্কন নির্ণয় এক কথায় অসম্ভব৷

ভারতীর সংস্কৃতির পুনর্জাগরণে ঠাকুরবাড়ির ভূমিকা ছিল সর্ব অর্থে ইতিবাচক৷ ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিতার মেলবন্ধনে এ পরিবার অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছে৷ সাহিত্য ও সংগীত চর্চার পাশাপাশি স্বাদেশিকতা এবং জাতীয়তাবাদের বিকাশে ঠাকুরবাড়ির ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অস্বীকার করা অসম্ভব৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-র ‘স্বাদেশিকতা’ অধ্যায়ে বলেছেন যে, “বাহির হইতে দেখিলে আমাদের পরিবারে অনেক বিদেশী প্রথার প্রচলন ছিল কিন্তু আমাদের পরিবারের হৃদয়ের মধ্যে একটা স্বদেশাভিমান স্থির দীপ্তিতে জাগিতেছিল… আমাদের পরিবারের সকলের মধ্যে একটি প্রবল স্বদেশপ্রেম সঞ্চার করিয়া রাখিয়াছিল৷ “ঠাকুর বাড়ির উৎসাহেই “হিন্দুমেলা” সংঘটিত হয়৷ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখলেন—”সবে মিলে ভারতসন্তান৷” তাঁরই ঐকান্তিক প্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত হ’ল “সঞ্জীবনী সভা৷” বালক রবীন্দ্রনাথের মনেও স্বাদেশিকতার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে৷ এই তাপের প্রবাহেই তিনি লিখলেন, “হিন্দুমেলার উপহার” এবং “ভারতভূমি”, এই কবিতা দুটি ৷

বাংলা শখের রঙ্গালয় গুলির মধ্যে অন্যতম রঙ্গালয় হিসাবে “জোড়াসাঁকো নাট্যশালা” ছিল অন্যতম৷ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের আন্তরিক উদ্যোগে এই রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয়৷ জোড়াসাঁকোর রঙ্গাললয়ে প্রথম অভিনীত নাটক মধুসূদন দত্তের “কৃষ্ণকুমারী”৷ সম্ভবত ১৮৬৫ সালের ৫-ই জানুয়ারী৷ এর কিছু দিন পরেই অভিনীত হয় “একেই কি বলে সভ্যতা?” রামনারায়ণ তর্তরত্ন রচিত বহুবিবাহ বিষয়ক “নবনাটক” মঞ্চস্থ হয় ১৮৬৭ স লের ৫-ই জানুয়ারী ৷

জোড়াসাঁকো রঙ্গালয়ে মঞ্চ নির্মাণ , দেশীয় শিল্পীদের তৈরি দৃশ্যপট , বিচিত্র যন্ত্রানুষঙ্গ ও আলোর শিল্পকুশলী প্রয়োগ শৈলী প্রচলিত নাট্যভাবনার বাইরে নতুনতর মাত্রা যোগ করে৷ সংগীত প্রয়োগে দেশীয় ভাবধারার প্রকাশ ছিল বেশ উচ্চাঙ্গের৷ দেশীয় রীতির সঙ্গে ইউরোপীয় রীতির সার্থক সমন্বয়ে জোড়াসাঁকো নাট্যশালা বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে ৷

প্রথাগত আঙ্গিকবহুল বাস্তবধর্মী মঞ্চের প্রতিবাদ স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ দৃশ্যসজ্জাহীন, সরল ও অকৃত্রিম যাত্রারীতির বিশেষ ধারা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন নাট্যমঞ্চে৷ তাঁর হাতে এমন এক পরিণত থিয়েটার নির্মিত হ’ল যা আজও সমকালীন৷ কলকাতা এবং শান্তিনিকেতনের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের নাট্যচর্চার অন্যতম ক্ষেত্র ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি৷ এ বাড়ির তেতলার ছাদ, উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, বিচিত্রাভবন এবং জোড়াসাঁকো রঙ্গালয় ছিল রবীন্দ্রনাথের নাটক প্রয়োগ এবং নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাবলীল ক্ষেত্র৷ রবীন্দ্রনাথের নাট্যাভিনয়ের সূচনা ১৮৭৭ সালে ঠাকুরবাড়িতেই৷ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “এমন কর্ম আর করব না” প্রহসনে রবীন্দ্রনাথ অলীকবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করেন৷

১৮৮১ সালের ২৬-শে জানুয়ারী ঠাকুর বাড়ির মহর্ষিভবনের তেতলার ছাদে অভিনীত হয় রবীন্দ্রনাথ রচিত “বাল্মীকি প্রতিভা”৷ এটাই হ’ল নাটককার, পরিচালক, সুরকার ও অভিনেতা হিসাবে একসাথে এতগুলো ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম আত্মপ্রকাশ৷

কলকাতার ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের ঠাকুরবাড়ি তথা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কথা ও কথা নিহিত আখ্যান ও আখ্যান নিহিত উপাখ্যান নিয়ে বলা বা লেখা আজ কেন, তা কো’ন কালেই শেষ হবার নয়৷ এ শুধু পরিবার নয়, এ যেন এক আস্ত পৃথিবী৷ তাই জানা আর অজানার মাঝখানের দূরত্বটা এতটাই অনিঃশেষ ও অপরিমেয় যে, কথা কেবল চলতেই থাকে৷ এ চলা অবিরাম৷ অতৃপ্ত৷ চিরনতুন৷ এ যেন চিরন্তন প্রেরণার অনন্ত মাধুরীমিশ্রিত সর্বকালের বিচরণক্ষেত্র৷

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত