| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

যুগান্তর মিত্র’র ছোটগল্প: ভাসান

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

আচ্ছা সুমির মায়ের চলছে কী করে বলো তো? রান্নাঘর থেকে বিপাশা কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে এসেছিল।

মানে? আয়না থেকে চোখ সরিয়ে বিপাশার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিল সুদেব। সুমির মার কীভাবে চলছে আমি জানব কী করে? আর সক্কাল সক্কাল এটা কোনও প্রশ্ন হল?

অফিস যাওয়ার আগে সুদেব স্নান সেরে নেয়। তারপর দাড়ি কাটে সে। এতে নাকি ভেজা গাল নরম থাকে। তপুদা একবার বলেছিল। সেই থেকে এটাই রপ্ত করে নিয়েছে সুদেব। প্রতিদিনের অভ্যেস। তাছাড়া অফিসে বেরোনোর ঠিক আগে আফটার সেভ লোশন লাগায় গালে। এই গন্ধটা এত ভালো লাগে সুদেবের যে স্নানের আগে দাড়ি কাটে না আর।

দাড়ি কাটার সময়ই প্রশ্নটা করেছিল বিপাশা। সুদেবের পাল্টা কথায় কোনও জবাব দেয়নি সে। হাতে হাতে কাজ সেরে নিচ্ছিল। এমনকি সুদেবের দিকে তাকায়ওনি।

এইরকম একটা প্রশ্ন আসতে পারে, সুদেবের কল্পনার অতীত। কে কীভাবে সংসার চালায় তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও মানে হয়? সুদেব বিরক্তি প্রকাশ করলেও বিপাশার ভাবান্তর নেই কোনও। সে ব্যাখ্যা দেবার মুডে ছিল। বলছিলাম কী, বিয়ের পরে সুমি তো মাকে এক টাকাও সাহায্য করে না। আগে তাও একটা মুদি দোকান ছিল বাড়ির সঙ্গে। সুমির বিয়ের সময় সেই যে বন্ধ হল কদিন, তারপর থেকে আর খোলেনি। আয় নেই কোনও। তাও কীভাবে চালাচ্ছেন কাকিমা?

আরও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সুদেব। অফিস যাওয়ার সময় এসব কী প্রসঙ্গ তুলছে বিপাশা! একজন একলা বিধবা মহিলার সংসার কীভাবে চলছে, সেটা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল ওর কাছে এই সক্কালবেলা?

বিপাশা যথারীতি সুদেবের হাতের তালুতে স্টিলের ছোট্ট এক চামচ মৌড়ি দিয়ে বলেছিল, আসার সময় একটু পনির এনো তো। চিলি পনির করব। অনেকদিন করি না। একটু আগেই যে সুমির মায়ের সংসার চলা নিয়ে প্রশ্ন করছিল, সেকথা যেন খেয়াল নেই তার।

আফটার সেভের সুন্দর গন্ধ সঙ্গে নিয়ে সুদেব পা বাড়িয়েছিল অফিসের পথে। গলির মুখ থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে যেতে যেতে বিনবিন করে বিপাশার কথাগুলো ঘুরছিল তার মাথায়। বিপাশার মনে যে প্রশ্নটা এসেছে, এতদিন তার মনে কেন আসেনি, ভেবে অবাক হয়েছিল সুদেব। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আগামী রবিবার এক ফাঁকে ঘুরে আসবে সুমিদের বাড়িতে।


আরো পড়ুন: যুগান্তর মিত্রের গল্প রাইকিশোরী

(২)

শুভর সঙ্গে পড়ত সুদেব। উচ্চমাধ্যমিকে শ্রীপতিবাবু বাংলা আর ইংরেজি পড়াতেন। তখন স্যারেরা ব্যাচ করে পড়াতেন। প্রতি বছরই পরীক্ষার পরে দলবেঁধে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতেন। আর না-হলে পিকনিক হত। বছর-বছর পড়ানোর ব্যাচ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এও ছিল এক কৌশল। মাথাপিছু অল্প টাকা নিতেন স্যার। বাকিটা নিজেই দিতেন। সুদেব শুনেছে, সেই ব্যবস্থা এখনও চালু আছে অনেকের ব্যাচে।

সুদেব পড়ত সায়েন্স নিয়ে। শুভ আর্টস নিয়ে পড়লেও স্যারের ব্যাচে বাংলা-ইংরেজি পড়তে গিয়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল সুদেবের। মাধ্যমিকের আগে মুখচেনা ছিল শুভ। সেভাবে কথা হত না। কেননা শুভর স্কুল ছিল আলাদা। এমনকি সুদেব যে ক্লাবের মাঠে খেলতে যেত, শুভ সেই ক্লাবে যেত না। ওর ছিল অন্যদিকের এক ক্লাব।

সেবার স্যার দীঘায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বাস ছেড়েছিল বেশি রাতে। ঘণ্টা পাঁচেক জার্নির পরে ভোরে বাস পৌঁছেছিল ওল্ড দীঘায়। হোটেলের ডর্মেটোরিতে কোনওরকমে ব্যাগপত্র ফেলেই প্রায় সবাই হইহই করে চলে গিয়েছিল সমুদ্রে। খুব মজা হয়েছিল ওদের।

দুপুরে খাওয়ার পরে অনেকেই গানের লড়াই খেলছিল। সুদেব একবার ছাদের ওপর যেখানে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেখানে গিয়েছিল। রাতের মেনু আগেভাগে জেনে নিতে চেয়েছিল সে। সেখানেই দেখা হয়েছিল শুভর সঙ্গে।

চল আবার সমুদ্রে দাপিয়ে আসি। শুভ বলেছিল সুদেবকে। সেও তখন ছাদে ছিল।

তুই তো স্নান করলি দেখলাম! মিহিরদের দলের সঙ্গে নেমেছিলি।

হ্যাঁ, স্নান তো করেছি। আবার কবে আসব তার ঠিক আছে? চল না একবার ঘুরে আসি।

সমুদ্রের ঢেউগুলো সুদেবকেও টানছিল খুব। হোটেল থেকেই শব্দ শোনা যাচ্ছিল। লাইন দিয়ে পরপর ঢেউ আসে। একটার গায়ে আর-একটা ঝাঁপিয়ে পড়ে। তীর থেকে ফিরে যাওয়ার সময় এ-ওকে ধাক্কা মারে। এসব চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সুদেবের।

আমি কিন্তু স্নান করব না। পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখব। সুদেব বলেছিল।

তাই থাকিস। চল চল। দেরি করিসনি।

ছাদ থেকে নেমে হোটেলের গেট দ্রুত পেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় ফিসিফিস করে শুভ বলেছিল, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। চুপচাপ চলে আয়।

সমুদ্রে নামার আগে একটা বড় বোল্ডারে পাশাপাশি বসেছিল দুজন। সুদেব ভেবেছিল শুভ হয়তো আর নামবে না। কিন্তু একটু বাদেই বলেছিল, তুই এখানেই বোস। আমি নামছি জলে। কথাটা বলেই ট্রাকসুটের মতো পায়জামাটা খুলে নেমে গিয়েছিল জলের দিকে। যাবার আগে বলেছিল, আমি কিন্তু আর ফিরব না। সমুদ্রেই মিশে যাব।

কী বলছিস এসব?

হ্যাঁ রে, সত্যি। ঐ বাড়িতে আমার আর একদম ভালো লাগছে না! তোকে কেন টেনে আনলাম জানিস? একজনকে সাক্ষী রাখলাম।

ঢেউ পেরিয়ে পেরিয়ে শুভ অনেকটা সমুদ্রের ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছিল। সুদেব চাইলেই চিৎকার করে অন্যদের বলতে পারত, ওকে আটকান। ও জলে ড়ুবে মরতে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই বলেনি কাউকে। যখন অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল, তখন সুদেব চিৎকার করে ডেকেছিল, আর যাস না শুভ। চলে আয়। কিন্তু শুভ ওর দিকে চোখ ফেরায়নি। হঠাৎ সুদেব দেখতে পেয়েছিল, একটা বড় ঢেউ আছড়ে পড়ল শুভর গায়ে। টাল সামলাতে না-পেরে শুভ জলে পড়ে গেল। সেই যে হারিয়ে গেল চেহারাটা, আর দেখতে পায়নি সুদেব। অনেকক্ষণ ধরে জলের ঢেউয়ে শুভর হারিয়ে যাওয়া শরীরটা খোঁজার চেষ্টা করেছিল।

সমুদ্রে আরও যারা স্নান করছিল, তারাই বলাবলি করছিল একটা ছেলে তলিয়ে গেছে। ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল সুদেবের। দ্রুত হোটেলে ফিরে এসে স্যারকে আড়ালে ডেকে জানিয়েছিল পুরো ঘটনাটা। হোটেলের রুমে রুমে গিয়ে স্যার খুঁজে দেখেছিলেন, সত্যিই শুভ কোথাও ছিল না। স্যার জানতে চেয়েছিলেন, বেরনোর সময় তোদের দুজনকে কে কে দেখেছে?

কেউ না স্যার। আমরা লুকিয়ে গিয়েছিলাম। কেউ টের পায়নি।

তাহলে তুই চুপ করে থাকবি। আমি সবাইকে বলব শুভ একাই গিয়েছিল। না-হলে তুই কিন্তু বিপদে পড়তে পারিস। পুলিশি হাঙ্গামা হবে খুব। একদম চেপে যা ব্যাপারটা।

অনেক রাতে রামনগর থানার পুলিশ সমুদ্রের ধার থেকে একটা মৃতদেহ পেয়েছিল। স্যার আর দু-তিনজন গিয়ে বডি দেখে শনাক্ত করেছিল শুভকে। তারও একদিন বাদে পোস্টমর্টেম করা কাটাছেঁড়া শুভর বডি ফিরেছিল এলাকায়। যে বাসে ওরা দীঘায় গিয়েছিল, সেই বাসেই পরদিন ভোরে সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্যার। তার আগেই অবশ্য খবর পেয়ে এদিক থেকে কয়েকজন গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে গিয়েছিল টাকাপয়সা নিয়ে। বডি আনার ব্যাপারে নাকি কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। নেতাটেতা ধরে স্যার সব সামলে নিয়েছিলেন। কানাঘুষো সেসব শুনেছিল সুদেব।

আসলে বন্ধুর মৃত্যুশোকের থেকেও সুদেবের কাছে বড় হয়ে উঠেছিল ভয়। যদি কেউ দেখে থাকে তাদের দুজনকে! দীঘাতেই একবার সাম্য জিজ্ঞাসা করেছিল ওকে, তোরা দুজন না একসাথে বেরিয়েছিলি? আমি যেন দেখলাম…

আরে না না। আমি তো স্যারের সঙ্গে ছাদেই ছিলাম। স্যার বললেন, শুনলি না?

ও আচ্ছা। এটুকু বলেই থেমে গিয়েছিল সাম্য। কিন্তু ওর চোখেমুখে সন্দেহের পর্দা দুলে উঠেছিল। খেয়াল করেছিল সুদেব। এবার যদি এলাকাতেও একই কথা বলে বেড়ায়! তখন কী হবে? সুদেব কি চাইলে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারত না শুভকে? ওর ভয়ার্ত মুখ দেখেই সুদেবের বাবা বলে দিয়েছিলেন শ্মশানে যাওয়া চলবে না।

দিন দুয়েক পরে শুভদের বাড়িতে গিয়েছিল সুদেব। ছেলের মৃত্যুর পর শুভর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে শুভর বাবা তাঁকে নিয়ে সেদিন ডাক্তারখানায় গিয়েছিলেন। সুমি তখন ঘরে একাই ছিল। চেয়ারে বসতে বলেছিল সুদেবকে। দাদার কথা বলতে বলতে সুমি কেঁদে ফেলেছিল সেদিন। চেয়ারে বসা সুদেবের দুই হাঁটুর মাঝে মুখ রেখে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। ওর বাবার মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা, প্রতিদিন অশান্তি করা, সংসারে ঠিকমতো টাকাপয়সা না-দেওয়া ইত্যাদি নানা কথা বলছিল সুমি। দাদা ছিল বন্ধুর মতো। সেকথাও বলছিল কাঁদতে কাঁদতে। নির্বাক সুদেব বেশ কিছুক্ষণ স্থবিরের মতো বসে থেকে ফিরে এসেছিল ঘরে।

এর বছর তিন-চার পরে একদিন আচমকা ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন শুভর বাবা। বেসরকারি চাকরি করতেন। তেমন কিছু জমানো টাকাও ছিল না। অফিস থেকে পেয়েছিলেন সামান্য টাকাই। সবমিলিয়ে ভয়ংকর বিপদে পড়ে গিয়েছিল পরিবারটা। সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা মেয়েকে নিয়ে বহু কষ্টে দিন কাটিয়েছেন শুভর মা। সকালের দিকে বা সন্ধ্যায়, এরপর যখনই সুদেব ওদের বাড়িতে গেছে, দেখেছিল কাকিমা ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াতেন। সুমিও কিছু টিউশানি ধরেছিল। গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হয়েও আর পড়েনি সুমি। পড়াশোনা, চাকরির চেষ্টা, এইসব নানা কারণে ধীরে ধীরে ওদের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল সুদেব।

পথে দেখা হলে সুমির সঙ্গে কথা হত সামান্যই। সেইসময়ই একদিন কানে এসেছিল বাপিদার সঙ্গে প্রেম করছে সুমি। যাক, বাঁচা গেল! বাপিদা রেলে চাকরি করে। বয়সের পার্থক্য থাকলেও পাত্র হিসাবে ভালোই বাপিদা। ভেবেছিল সুদেব। তবে বাপিদা চাইলেও সুমি বিয়ে করেনি তাকে। বিপিন নামে একজনের প্রেমে পড়েছিল পরে। তাকেই বিয়ে করেছে। মাঝে দু-একবার এখানে-ওখানে দেখা হয়েছিল কাকিমার সঙ্গে। কথা হয়নি তেমন করে।

সুমিদের বাড়ির পাশেই রীতু ভার্মার যোগা ক্লাশের কেন্দ্র। সেখানে বিপাশা যোগা শেখাতে নিয়মিত যায়। তাছাড়া এর-তার থেকেও সুমিদের খবর ভেসে আসে। নিজে থেকে অবশ্য খোঁজ নেয় না আর। সুদেব নিজেই একদিন শুভর সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল বিপাশাকে। তবে ওর সঙ্গে সমুদ্রে যাওয়ার কথাটা বেমালুম চেপে গিয়েছিল। কী কী কথা হয়েছিল, সেসবও বলেনি। কোনওদিন কারও সামনে আর উচ্চারণই করেনি।

(৩)

রবিবার সন্ধ্যায় বন্ধ দোকান লাগোয়া ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় সুদেব। কড়া নাড়বে কিনা ভাবতে ভাবতেই দরজায় হাত রাখে সে। তখনই নড়ে উঠল দরজাটা। তার মানে ভেজানো ছিল দরজা! কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে ‘কে’ শব্দ ভেসে এল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সুদেব।

কেমন আছেন কাকিমা?

সুদেব! কতদিন পরে এলে বাবা!

হ্যাঁ কাকিমা, আজকাল এদিকে আসাই হয় না।

নানা কথার ফাঁকে সুমির মা বললেন, তোমাকে প্রতিদিনই দেখি খুব তাড়াতাড়ি চলে যাও।

কোথায় দেখেন?

রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াই মাঝে মাঝে। সময় তো কাটে না! তখনই দেখি হন্তদন্ত হয়ে অফিস যাচ্ছ।

এ বাবা! আমি তো খেয়ালই করিনি। আপনি ডাকেননি কেন আমাকে কোনওদিন?

ডেকে কী করব বাবা? অফিসে যাওয়ার সময় বিলম্ব করা কি ঠিক হবে?

কিন্তু আমার চোখে তো পড়েননি কখনও!

আমি মোড় থেকে একটু ভেতরের দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি।

কথাটা আর এগোয় না। তার বদলে তিনি বলে ওঠেন, বিপাশাকে আমার বেশ লাগে। কী চমৎকার মেয়ে!

আপনার সঙ্গে আলাপ আছে কাকিমা?

হ্যাঁ। লম্বা করে ঘাড় নেড়ে জানান তিনি। গতকালই তো এসেছিল।

তাই নাকি? আমাকে বলেইনি! আশ্চর্য হয় সুদেব।

হয়তো বলতে ভুলে গেছে। পাশের বাড়িতে আসে। সেখান থেকে দু-একদিন ছাড়া ছাড়া আসে। কত গল্প হয়।

বিপাশা এখানে আসে মাঝেমাঝে? কোনওদিন বলেনি তো আমাকে! বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়ে সুদেবের।

এক কাপ চা খেয়ে উঠে পড়ে সুদেব। ওখানে বসে থাকতে কেমন অস্বস্তি হয় তার। বিপাশা তাকে কেন গোপন করেছে এখানে আসার কথা, সেটা ভেবেই অস্বস্তি বেড়ে চলে। বিপাশা সেদিন সকালে কথাটা নিজেই তুলেছিল! তাহলে কি কোনও উদ্দেশ্য ছিল প্রসঙ্গটা তোলার? তাকে বুঝতেই দেয়নি! কিন্তু কেন? বিপাশার আচরণের কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না সে।

বিপাশা নিজেই তাড়া দিয়ে পাঠিয়েছিল। সকালের দিকে একবার বলেছিল, ঘুরে এসো না সুমিদের বাড়িতে। আজ বাজার করার কিছু নেই। দুপুরে নিমন্ত্রণ আছে প্রতিবেশী শিবুদের বাড়িতে। বিবাহবার্ষিকী। কিন্তু সুদেবের অফিসের একটা জরুরি কাজ ছিল। তাই ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছিল তখন। সন্ধ্যায় যাবে বলে জানিয়েছিল। বিকেল ফুরোতেই বিপাশা তাড়া লাগিয়েছিল। কিন্তু একবারও সন্দেহ হয়নি। এখন কেমন যেন সব ঘোলাটে মনে হচ্ছে।

ঘরে ফিরে বিপাশার দিকে তাকিয়ে থাকে সুদেব। কীভাবে প্রসঙ্গটা তুলবে ভাবার আগেই বিপাশা জিজ্ঞাসা করে, কাকিমা কী বললেন?

তুমি যে ওবাড়িতে যাও, বলোনি তো কোনওদিনও! কেন বলোনি? সুদেবের জিজ্ঞাসায় উষ্মা মিশে আছে।

তুমি কি কৈফিয়ত চাইছ? তাহলে জবাব দেব না। আর জানতে চাইলে বলতে পারি।

ধরে নাও জানতেই চাইছি। চোখ সরু করে বলে সুদেব।

তুমি কি কোনওদিন আমাকে বলেছ যে বন্ধুর সঙ্গে তুমিও গিয়েছিলে সমুদ্রে? বলোনি তো! জবাব দেওয়ার বদলে বিপাশা যেন কথাটা ছুঁড়ে মারে সুদেবের দিকে।

বিদ্যুৎচমকের মতো চমকে ওঠে সুদেব। তুমি কী করে জানলে?

কাকিমার থেকে শুনেছি।

কাকিমা জানেন?

হ্যাঁ জানেন। তোমাদের সেই স্যার জানিয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন কোনওদিন যেন তাঁর জীবিতাবস্থায় না-জানানো হয়।

স্থবির হয়ে চেয়ারে বসে থাকে সুদেব। বিপাশার দিকে তাকাতে পারে না আর।

তুমি যদি সেদিন চ্যাঁচামেচি করতে, তাহলে হয়তো তোমার বন্ধু বেঁচে যেত। এই অবস্থায় হয়তো পড়তে হত না কাকিমাকে।

হয়তো হয়তো হয়তো… সবকিছু হয়তো দিয়ে হয় না বিপাশা!

আহ্, তুমি রেগে উঠছ কেন? কাকিমা সব জেনে গিয়েছেন বলে? জানলেও উনি তোমাকে দোষারোপ করেননি। বরং রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তোমাকে দেখবেন বলে। ওনার ছেলের সঙ্গে নাকি তোমার চেহারার মিল পান।

মিল? আমার সঙ্গে শুভর চেহারার মিল? কই, কোনওদিন তো ভাবিনি ব্যাপারটা! মনে মনে ভাবে সুদেব।

কী যে কষ্ট করে চলেন কাকিমা ভাবতে পারবে না! আমি মাঝে মাঝে কিছু কিছু টাকা দিই। উনি নিতে চান না। জোর করেই দিতে হয়।

অনেকক্ষণ চুপ থেকে সুদেব বলে, তুমি আর টাকা দিও না। আমিই দেবো এবার থেকে।

থাক থাক। তোমার উপরির টাকা থেকে নাই বা দিলে!

উপরি! বিপাশা চাইলেই ঘুষ বলতে পারত। কিন্তু বলেনি। এ কি তাকে স্বস্তি দিতে? চোখ বন্ধ করে ফেলে সুদেব। তার বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে, শুভ কিংবা শুভর মতো এক কিশোর জলের গভীরে ভেসে যাচ্ছে। ফেনার মতো ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে চলেছে রাশি রাশি টাকা। হঠাৎই মনে হয়, জলের গভীরে চলে যাচ্ছে যে কিশোর, তার মুখটা অবিকল সুদেবের কিশোরবেলার মতো। এত দূর থেকেও চিনতে অসুবিধা হয় না তার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত