ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৮) । বাসুদেব দাস
জ্যোতিপ্রসাদ যৌবন থেকেই অসমিয়া জাতীয় জীবন সজীব এবং শক্তিশালী করে তোলায়, অসমিয়া জাতীয় পরম্পরা, সভ্যতা সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদদুষ্কৃতি নাশ করে সুন্দর এবং শক্তিশালী অসমিয়া সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তাই জ্যোতিপ্রসাদ জনতাকে নিজের জাতীয় পরম্পরা, সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতি থাকা কর্তব্য সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ’ ভাবীকালের সংস্কৃতি’ নামের প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
জ্যোতিপ্রসাদ অনেক প্রবন্ধ নৃত্য-গীত সম্পর্কীয়।’ ডিব্রুগড় কলেজে বাৎসরিক সংগীত সম্মেলনের সভাপতির ভাষণ’,’ অসমীয়া সংগীতের ধারা’,’ বর্তমান অসমীয়া সংগীতঃ কামরুপী সঙ্গীতের ধারা’,’ আমাদের নাচ এবং তার সংশোধন’,’ ভারতীয় নৃত্যগীতের ক্রমবিকাশ এবং অসমীয়ার স্থান’– এই প্রবন্ধগুলিতে অসমিয়া তথা ভারতীয় নৃত্য গীত সম্পর্কীয় বিভিন্ন কথা আলোচনা করা হয়েছে। অসমিয়া তথা ভারতীয় সংগীতের সুরে বিদেশি সুর এবং বাদ্যযন্ত্রের প্রভাব জ্যোতি প্রসাদ আগারওয়ালা মুক্তমনে গ্রহণ করেছেন। জ্যোতিপ্রসাদ অসমিয়া বনগীত, বিহু গীত, বরগীত ইত্যাদি লোকসঙ্গীতের সুরের সঙ্গে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুরের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন নতুন রাগের উৎপত্তি হবে বলে আশা করেছিলেন। অসমিয়া সঙ্গীতে নতুন রাগ রাগিনীর আমদানি করতে গিয়ে পুরোনো অসমিয়া সঙ্গীতের বিশেষত্ব যাতে লোপ না পায় জ্যোতিপ্রসাদ সেদিকেও লক্ষ্য রেখেছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদ’ অসমের ফিল্ম শিল্প’ এবং’ অসমের ফিল্ম শিল্প গড়ে তোলায় অসমিয়া দর্শকের দায়িত্ব’ এই দুটি প্রবন্ধে অসমিয়া চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং পরিচালনা সম্পর্কে বহু কথার উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া জ্যোতিপ্রসাদ যে’ অসমিয়া চলচ্চিত্রের স্রষ্টা সে কথাও প্রবন্ধ দুটির মধ্যে জানতে পারা যায়। যে সময়ে অসমে মহিলা অভিনেত্রীর অভাব ছিল, সেই সময়ে জ্যোতিপ্রসাদ অসম যাতে কোনো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে না থাকে সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখে অসমিয়া চলচ্চিত্র ‘জয়মতী’ এবং ‘ ইন্দ্র মালতী’ নির্মাণ করেছিলেন। অসমেসেই সময় চলচ্চিত্র নির্মাণের উপযোগী শিল্প প্রধান পরিবেশ না থাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছিল। জ্যোতি প্রসাদের চলচ্চিত্র যে দোষত্রুটি থেকে মুক্ত ছিল না সে কথা তিনি নিজেই প্রবন্ধ দুটিতে স্বীকার করেছেন। কিন্তু তার চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ধরনের দোষ ত্রুটি থাকলেও অসমিয়া চলচ্চিত্র নির্মাণের অগ্রদূত হিসেবে জ্যোতি প্রসাদের নাম অসমের ইতিহাসের চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৭)
জ্যোতি প্রসাদের অন্য একটি প্রবন্ধ হল ‘আইদেউর জোনাকী বাট’। এই প্রবন্ধটি অসম প্রাদেশিক মহিলা সমিতির ২২ সংখ্যক অধিবেশনের কৃষ্টি সভায় জ্যোতিপ্রসাদ দেওয়া ভাষণের লিখিত রূপ।ভারতের জাতীয় আন্দোলনে রাজনীতির সীমা অতিক্রম করে বিভিন্ন সমাজ সংস্কারমূলক কার্যকলাপে হাত দেওয়ায়, এবং জাতীয় আন্দোলনের প্রয়োজনে মহিলাদের অধিক জড়িত করায়, ত্রিশের দশকে মহিলা আন্দোলন এক অভূতপূর্ব নারী জাগরণের রূপ নিয়েছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী কালেও তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছিল। জ্যোতিপ্রসাদ এই জাগরণকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেছিলেন। তিনি ভবিষ্যতের মানব সমাজ তথা অসমিয়া সমাজে নারীদের এক গৌরবময় স্থান আশা করেছিলেন। আলোচ্য প্রবন্ধেটিতে ‘জোনাকী বাটর আইদেউ’,’ আলোকনেত্রী মাতৃ সকল’ ইত্যাদি উচ্ছ্বাসভরা সম্বোধনের মধ্যে জ্যোতিপ্রসাদ নারীকে পুরুষের সহযাত্রী এবং সহকর্মী রূপে কল্পনা করেছেন । তিনি উৎসাহ এবং উদ্দীপনায় নতুনদিনের নারীদের সমাজের আলস্যরূপ শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।–
‘ আজি জাগা মোর মাতৃ
জাগা আজি জোনাকী বাটর যত
শকতি রূপিণী অভিযাত্রী
আন্ধারর স’তে শেষ সংগ্ৰামর বাবে
জাগা জননী জাতি–
প্রালয়িকী ছন্দে
অভিনব জীবনর
সুর লয় তালে মানে
আলোকময়ী গানে গন্ধে।’
জ্যোতিপ্রসাদের অন্য দুটি প্রবন্ধ হল ‘বিয়াল্লিশের কাহিনী'( ঢেকিয়াজুলি) এবং’ নালিয়া পুলের বিপদ সংকেত’। জ্যোতি প্রসাদের রাজনৈতিক জীবন যদিও ঘটনাবহুল ছিল,তাঁর রাজনৈতিক রচনা এবংভাষণ বেশি সংগৃহীত এবং সংরক্ষিত হয়নি। বিশেষভাবে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া তথা মন্তব্য কমই সংরক্ষিত হয়েছে।’বিয়াল্লিশের কাহিনী'(ঢেকিয়াজুলি) এবং’ নালিয়া পুলের বিপদ সংকেত’ এই দুটি প্রবন্ধে যথাক্রমে ঢেকিয়াজুলি এবং নালিয়া পুলের দুটি রাজনৈতিক ঘটনার বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমটি বর্ণনাত্মক এবং দ্বিতীয়টি বিচারধর্মী। কিন্তু দুটি প্রবন্ধেই স্বাধীনতার পরবর্তী কালের কংগ্রেস দল এবং সরকারের প্রতি মোহভঙ্গের ছাপ স্পষ্ট।
‘রবীন্দ্র স্মরণ’ নামে ১৯৫০ সনে রচিত ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী’র জন্য লেখা সংক্ষিপ্ত রচনাটিতে জ্যোতিপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্বকে স্মরণ করে বলেছেন অর্ধমৃত ভারতীয় জাতীয় সংস্কৃতিকে রবীন্দ্রনাথ নবযুগের গায়ত্রী মন্ত্রে সঞ্জীবিত করে গেছেন এবং আজ তার ফলেই ভারত নিজেকে চিনতে পেরে নিজের সভ্যতার স্বরূপ চিনতে পেরে পৃথিবীতে নিজের স্থান খুঁজে পেয়েছে ।
‘শিল্পীর পৃথিবী’ জ্যোতিপ্রসাদের সাহিত্যকীর্তির একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এটি একটি অভিভাষণ।১৯৪৮ সনে জ্যোতিপ্রসাদ শিবসাগরে অনুষ্ঠিত সদৌ অসাম শিল্পী সংঘের অধিবেশনে সভাপতিরূপে এই ভাষণটি প্রদান করেছিলেন। রচনাটি জ্যোতিপ্রসাদের চিন্তার উত্তরণের একটি দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এক বিশাল পরিসরে লেখা এই রচনায় শিল্পী, কলাকার, সাহিত্যিকদের সমাজ এবং জনগণের প্রতি বাঞ্ছিত দায়বদ্ধতা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। সংস্কৃতির দুটি রূপ অন্তর সংস্কৃতি এবং বহিঃ সংস্কৃতির উপযোগিতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পদগুলি মানুষ উপভোগ করে শান্তিতে জীবন যাপন করার জন্য মানুষের মনকে একটি সাংস্কৃতিক রূপ দিতে হবে।

অনুবাদক