Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,jyoti-prasad-agarwala-part-17

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৯) । বাসুদেব দাস

Reading Time: 3 minutes

    ‘শোণিত কুঁয়রী’ জ্যোতিপ্রসাদের কোমল বয়সের সৃষ্টি । তা সত্বেও নাটকটি অসমিয়া সাহিত্যে কয়েকটি নতুন বৈশিষ্ট্য বহন করে এনেছে। নাটকটিতে দৃশ্য অনুযায়ী পটভূমি রচনা এবং সাজসজ্জা নির্দেশে জ্যোতিপ্রসাদ মৌলিকতার পরিচয় দান করেছেন। নাটকটিতে মোট পাঁচ অঙ্কে কাহিনি উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথম অঙ্কে  কোনো দৃশ্য বিভাজন নেই। দ্বিতীয় অংকে চারটি দৃশ্য, তৃতীয় অঙ্কে ছয়টি  দৃশ্য এবং চতুর্থ ও পঞ্চম অঙ্কে যথাক্রমে ছয়টি এবং পাঁচটি দৃশ্যে বিভক্ত করা হয়েছে। শুরু থেকে নাটকটিতে শৃঙ্খলিত ভাবে দৃশ্য সজ্জা এবং দৃশ্য পরিকল্পনা করে জ্যোতিপ্রসাদ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দান করেছেন।

    ‘শোণিতকুঁয়রী’ নাটকের আরও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর গীত এবং সংগীত। নাট্যকার নিজেই ভূমিকাতে এর সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। জ্যোতিপ্রসাদই প্রথম এই নাটকে বিয়ানাম,আইনামের ধাঁচে গীতরচনা করে নাটকের সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনেন। এই নাটকে ব্যবহৃত কয়েকটি গীত নাটকের ঘটনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। তাছাড়া নাটকটিতে অসমিয়া বিহু নাচ  এবং কামরুপী নাচ ব্যবহার করে ও অসমিয়া নৃত্য প্রচলনে জ্যোতিপ্রসাদ যথেষ্ট উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। অসমের স্থানীয় বিভিন্ন লোকনৃত্যকে জাতীয় নৃত্যের মর্যাদা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। এর প্রথম পদক্ষেপ দেখা যায় আলোচ‍্য ‘শোণিত কুঁয়রী’ নাটকে।


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৮)

 

    `’কারেঙর লিগীরী’ জ্যোতিপ্রসাদের দ্বিতীয় নাটক। তখন তিনি বিলাতে। তাই নাটকটির বিভিন্ন দিকে পশ্চিমী নাটকের নাট্যকারদের নাট্যরীতির কিছু প্রভাব দেখা যায়। নাটকের কাহিনিতেও বেশ চমৎকারিত্ব রয়েছে। নাটকটি যদিও মূলত চরিত্র প্রধান, এর মধ্য দিয়ে সামাজিক রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বেরও প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। নাটকটির অন্য একটি  বৈশিষ্ট্য এই যে সামন্তবাদের দ্বারা আশ্রিত আভিজাত্যের বিরুদ্ধে প্রেমমূলক কাহিনির আধারে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হয়েছে। মূল চরিত্র সুন্দর কুমার(কোঁয়র), শেফালি(শেৱালি) এবং কাঞ্চনমতী। এই তিনটি চরিত্র নাট্যকারের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। নাটকটির সমস্যা যদিও আধুনিক জীবনের লক্ষণাক্রান্ত তবু এর বহিরঙ্গ এবং উপস্থাপন রীতি ঐতিহাসিক নাটকধর্মী। নাটকের প্রধান চরিত্র সুন্দরকুমার একজন সুদর্শন যুবক বিদ্বান এবং শাস্ত্রানুরাগী । রাজমাতা তাকে বিয়ের কথা বলে, কিন্তু সে কোনো মতেই রাজি নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মায়ের আহবানে সাড়া দিয়ে সুন্দরকুমার নিজের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বুড়াগোঁহাইর কন্যা কাঞ্চনমতীর সঙ্গে বিবাহ পাশে আবদ্ধ হয়। কিন্তু কাঞ্চনমতীর মন বাঁধা পড়ে ছিল সুন্দরকুমারের বন্ধু অনঙ্গরামের সঙ্গে। এ কথা জানতে পেরে সুন্দরকুমার দুজনের মিলন ঘটাতে চায়। সে বন্ধু অনঙ্গরামকে বলে-‘ তোমার  কাঞ্চন কুমারীকে আমি তোমার কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই- আমাদের বিয়ের সম্বন্ধে বিচ্ছেদ ঘটাতে চাই।’ কিন্তু কাঞ্চনমতী এবং অনঙ্গরাম সুন্দরের কথায় সম্মত হয় না। কাঞ্চনমতী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। শেফালির(শেৱালির) সঙ্গে সুন্দরের গুপ্ত প্রণয় রয়েছে এই সন্দেহে রাজমাতা শেফালিকে অন্য রাজ্যে নির্বাসনের আদেশ  দেয়। কুমার এ কথা জানতে পেরে সমস্ত বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে শেফালিকে  উদ্ধার করে জীবনসঙ্গী করার মানসে নাগা পাহাড়ে যাত্রা করে। এই খবর পেয়ে শেফালি পাহাড়ি ঝরনায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। এই আত্মহত্যা এই জন্য নয় যে শেফালি সুন্দরকে ভালোবাসতো না। সে ভেবেছিল সুন্দর তাকে বিয়ে করলে রাজপুরুষরা সুন্দরকে হত্যা করবে বা গদিচ্যুত করবে। তারই প্রতিকার হিসেবে শেফালি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। শেফালির মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়া  কুমার নারীর প্রেমের মর্যাদা স্বীকার করেছে এবং তার হৃদয়ের গোপন কন্দরে  থাকা শেফালির প্রতি ভালোবাসাকে স্বীকৃতি জানিয়েছে। সংক্ষেপে এটাই নাটকের কাহিনি। নাট্যকার নাটকে প্রেমের   মহত্ত্বকে অতি সুন্দর ভাবে রূপায়িত করেছেন। নাটকে শেফালির মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তার প্রেমের মৃত্যু হয়নি মৃত্যুর আগে সে কুমারকে প্রেমের প্রতীকস্বরূপ লাল ফুলের মালা উপহার দিয়েছিল। এই মালাই শেফালির প্রেমকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জ্যোতি প্রসাদ আলোচ্য ‘কারেঙর লিগীরী’ নাটকের চরিত্র সৃষ্টিতেও অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অনেকগুলি চরিত্র রয়েছে। তার মধ্যে পুরুষ চরিত্র হল সুন্দর কুমার ,সুদর্শন, অনঙ্গরাম,চাওদাং , সৈন্য, মাঝি। অন্যদিকে নারী চরিত্র হল কাঞ্চনমতী,শেফালি, রাজমাতা শিউলি বুড়াগোঁহাইনী ইত্যাদি ।সুন্দরকুমার আলোচ্য নাটকের প্রধান পুরুষ চরিত্র এবং নাটকের নায়ক। জ্যোতিপ্রসাদের সবগুলি নাটকের মধ্যে সুন্দরকুমার হল একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পুরুষ চিত্র।সুন্দরকুমার রাজপুরুষ,রূপগুণের অতুলনীয় অধিকারী,শাস্রজ্ঞ এবং আদর্শবাদী।কিন্তু তিনি নারী বিদ্বেষী।তাই সে বিয়ে করতে অনাগ্রহী। সে মনে করে-‘মহিলা এবং সংক্রামক ব্যাধি একই ধরনের।একবার মহিলার সংস্পর্শে এলে সে তোমাকে অধিকার করে বসবে।সেইজন্য মুক্তি এবং শান্তিপ্রয়াসী মুনি ঋষিরা ,আমাদের ধর্মের অনেক শাস্ত্রগ্রন্থ কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ করে দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছেন। নাটকে প্রথম থেকেই সুন্দর কুমারের বিপ্লবী মন ফুটে উঠেছে।তিনি সমাজের রক্ষণশীল সামন্তযুগীয় প্রথার বিরোধিতা করে একটি আধুনিক সমাজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।তাই জ্যোতিপ্রসাদের সুন্দরকুমারকে আধুনিক যুগের প্রগতিবাদী চরিত্র বলা যেতে পারে।

    সুন্দর সত্যের আশ্রয় নিয়ে কাঞ্চন এবং অনঙ্গের প্রেমকে সমাজের সামনে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল।কিন্তু তাঁর এই সত্যনিষ্ঠ কার্য প্রত্যেকের জীবনে নামিয়ে আনল দুঃখ-যন্ত্রণা। তার এই কাজ কাউকে সুখি করতে পারেনি।বরং সহজ সরল শেফালি এবং কাঞ্চনমতীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।   

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>