ক্ষতি তার ক্ষতি নয়

Reading Time: 2 minutes

অনেকদিন  পর হঠাৎ আবার বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাবা উল্টোদিক থেকে আসছিল, একটু যেন ঠোকর খেতে খেতে। বাইফোকাল চশমায় সব উঁচুনিচু দেখে কিনা। আমি প্রথমে খেয়াল করিনি। হঠাৎ চমকে উঠে দেখলাম সামনে বাবা।

বাবা আমায় চিনতে পারেনি। না চেনবারই কথা। যাকে রেখে গিয়েছিল ১৮ বছরের এক কিশোরী, সে এখন মধ্য চল্লিশে। এখন বাবা আর আমি প্রায় সমবয়সী। আর বছর পাঁচেকের মধ্যেই আমি বাবার বয়সটা ধরে ফেলব।

‘বাবা কেমন আছো?’

বাবা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়, একটু যেন সম্ভ্রম ফুটে ওঠে  চোখে। চুলের ওপর তোলা সান গ্লাস, এথনিক গয়না আর দক্ষিণী শাড়িতে কক্ষনো দেখেনি তো আগে। আমার গলার কাছে একটা শক্ত পুঁটলি পাকায়।

‘আমাকে চিনতে পারলে না বাবা? মনে আছে সেই ২০শে জানুয়ারি, ৮৮, শীতের রোদে ভাসা দুপুর? তুমি আমাকে কালকূটের পৃথা পড়ে শোনাচ্ছিলে? আর মা বারবার এসে বকাবকি করছিল তোমাকে। ১৮ বছরের মেয়েকে কীসব শোনাচ্ছ! তুমি বলেছিলে আমি ওকে তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছি।’

বাবার চোখে মুহূতের জন্যে যেন স্মৃতি খেলে যায়, ঠিক জলের আয়নার মতো।

‘আচ্ছা, তাই? চলুন না ওই রথের ওপর বসে কথা বলি। কথা বলতে বলতে ঠিক মনে পড়ে যাবে। দাঁড়ান, তার আগে একটা চারমিনার নিয়ে আসি, মোড়ের পটার দোকান থেকে’

‘চারমিনার পাবে নাকি এখন? ব্র্যান্ড বদলে গেছে।’

বাবা একটু মুষড়ে পড়ে।

‘বদলে গেছে? কিন্তু এই যে রাসমঞ্চ, রথ, এই মাঠ, ওদিকে কোষাঘাট, শো হাউস সিনেমা হল, সবই তো আছে একরকম। আর একটু হাঁটলে জিতেনের চপের দোকান, কমলের সাইকেল রিপেয়ারিং – সব দেখতে পাব মনে হয়’

‘পাবে হয়তো। বাইরে থেকে এক মনে হবে, কিন্তু ভেতরটা আমূল বদলে গেছে। অনেকক্ষণ হেঁটে গেলেও কেউ তোমাকে চিনতে পারবে না। আমাকেই পারে না’

‘পারে না? আপনাকেও পারে না?’

আবার আমার চোখে জল এসে যায়। আমি তাড়াতাড়ি সানগ্লাসটা চোখে নামিয়ে নিই। বলি

‘বললে যে রথে বসবে’

বাবা অন্যমনস্কভাবে বলে ‘চলুন’

তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো ভাঙ্গাচোরা রথ, পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকানো লোহার শিকল, দেখলে গা শিরশির করে।

‘মনে আছে, তুমি আমাকে একটা খাতা দিয়ে কিছু লেখার জন্যে এখানে পাঠিয়েছিলে। বলেছিলে রথে বসে কিছু লিখে আনো। তখন আমার ছ বছর বয়স।’

বাবাকে এই প্রথম একটু কৌতূহলী মনে হয়।

“আচ্ছা! কিছু লিখেছিলেন খাতাটায়?’

আমি চোখের জল আটকে গলা পরিস্কার করে বলি

‘তোমার কিচ্ছু মনে নেই! তখন আমাদের দোতলা উঠছিল। বাড়িতে খালি বালি , সিমেন্ট, ইঁট নিয়ে কথা। আমি খাতাটা আঁকড়ে ধরে পেন্সিলে গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছিলাম সিমেন্ট কিনে এবছর আমাদের খুব লস হয়েছে।’

‘লস!’

বাবা যেন চমকে ওঠে, তার চশমার নিচে কি জানি, ভুল হতে পারে আমার, বৃষ্টির ছাঁটের মতো অশ্রু!

তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে বাবা। আমি উঠতে পারি না, আজকাল হাঁটুতে কী একটা ব্যথা।

‘আমি আসি তাহলে?’ বলে একটু ইতস্তত করে হঠাৎ আমার মাথায় হাত রাখে বাবা।

‘শুনুন, আমি আপনার বাবার বয়সী না হলেও বয়সে খানিকটা বড়ই হব, আমি বলছি, কোন লস হয়নি, কোথাও কোন ক্ষতি হয়নি!’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>