তুমি যদি হতে সুচিত্রা সেন
আচ্ছা, রূপালি আলো কাকে বলে? কখনো ভেবে দেখিনি। আজ আমার মনে হয়! কী মনে হয় জানো? রোদ পালানো বিকেল বেলায় যে আলো হাল্কাভাবে আমাদের ঘিরে ধরে সেই আলোটারই রঙ রূপালি। যে আলোয় আকাশটাকে ইচ্ছেমতো রঙের খেলায় সাজিয়ে নেওয়া যায়। তখন স্বপ্নগুলোকেও মনেহয় যেন একেকটা সিলভার স্ক্রিন।
কিন্তু জানতাম না বাস্তবেও নায়িকা হয়। সেই আমাদের ছোটবেলায়, আমরা যারা আশির শেষের দিকে জন্মেছিলাম, আমাদের কাছে নায়িকা মানেই সাদা কালো আপট্রন টিভিতে দেখা হৃদয় আরপার করা সেই দুটো চোখ। সাপের মতো উদ্ধত ফণা তুলে ঘাড় হেলিয়ে যে বলে দিতে পারে “আমাকে টাচ্ করবে না!”
তখনও সিনেমা হলে বেশি যাওয়া শুরু করিনি। হিন্দি সিনেমা বলতে তো ‘চিত্রহার’ অনুষ্ঠানে দেখা কিছু গান আর শুক্র শণিবারে একটা কি দুটো হাফ নতুন – হাফ পুরোনো ছবি। তবে ওই রবিবারের বাংলা ম্যাটিনিটার আলাদাই এক জাদু ছিল। চারটে বাজতে না বাজতে সব্বাই মিলে টিভি খুলে হাঁ! মধ্যিখানে খাটে বসে চেয়ারে পা ঝুলিয়ে আমি। সেই ছোট্ট থেকে ওই জাদুই তো দেখে এসেছি দিনের পর দিন মুগ্ধ হয়ে। হয়তো অজান্তেই এক নায়িকার ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল মনের ক্যানভাসে। তারপর বড় হয়ে তোমায় দেখলাম। মিলিয়ে নিতে চাইলাম ছবির সাথে মনে আঁকা ছবি। দেখে আবারও মুগ্ধ হলাম, টাচ করতে পারলাম না। যত দিন গেছে বুঝেছি তোমাকে টাচ করতে পারা কত কঠিন! জানি এবার আমায় অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। ‘তুমি’ কে? ‘তুমি’ কোথায় থাকো? আমি কিছুতেই সে জায়গার নাম বলব না। তারচেয়ে বরং জায়গাটার একটা নাম দিই। যদি বলি জায়গাটার নাম ‘দিলের বাগ’! বেশ হবে।
হ্যাঁ দিলের বাগ। সেখানেই প্রথম তোমায় দেখি। এই দ্যাখো একটা কাক ডেকে উঠল। ঝুট্ বোলে কাউয়া কাটে। তুমি হয়তো ভাবছো কি ডাহা মিথ্যে! আমায় বুঝি তুই আগে কখনো দেখিসনি? হ্যাঁ দেখেছি। ছোট থেকে বড় হওয়ার মূহুর্তে অন্তত চারবার তো বটেই। কিন্তু সে দেখা আর এ দেখায় প্রচুর ফারাক। এই দেখা ছিল অন্তরালের সুচিত্রা সেনকে হঠাৎ চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার মতো। সোয়াশো বছরে একটিবারের জন্য আকাশে তারা খসা দেখতে পাওয়ার মতো।
আমার ভাগ্নির বিয়ের ধুমধাম অনুষ্ঠানের ঠিক পরের রাতে। নিচের ঘরে, পাশের অন্য ঘরগুলোয় হুল্লোড়ের রেশ তখনও কাটেনি। কখন যে একফাঁকে আলাদা হয়ে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলে তুমি। কেউ খেয়াল করেনি। আর আমি খুঁজতে খুঁজতে আচমকাই গিয়ে পড়েছিলাম তোমার ঘরে। নিশিপাওয়া ঘোরের মধ্যেই কখন যে ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকলাম! চুরি করে দেখে ফেললাম তোমাকে। আগের দিন রাত জাগার ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে তুমি। ফুলকাটা হলুদ নাইটি পায়ের পাতা পর্যন্ত মোড়া। সে অবস্থায় একটু গুটিসুটি মেরে দুহাত জড়ো করে হাতে গাল রেখে ঘুমোচ্ছিলে। ঠিক যেন এক পরীর মতো। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তোমার অদৃশ্য দুটো ডানা। ডানাদুটো সবার নজর বাঁচিয়ে মুড়ে রেখেছো লুকিয়ে। বন্ধ চোখের পাতাদুটো সদ্য ফোটা পদ্মের পাপড়ির মতো নিখুঁত করে আঁকা। ঘরের সাদা আলো মোমের মতো পিছলে যাচ্ছিল তোমার ত্বকে। ঝলমল করছিল সারামুখ!
যারা তোমায় কাছ থেকে দেখেছে তারা জানে আমি সত্যি বলছি কিনা। বাকিরা ভাবতেই পারে রূপকথা। আমি শুধু অপলক দেখছিলাম। তোমার ঘুমন্ত ঠোঁটের কোণে আলতো একটু মুচকি হাসি লেগেছিল। স্বপ্ন দেখছিলে? আমি জানি, এই স্বপ্নগুলো রুপালি রঙের হয়। অভি কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। তোমার পিসতুতো ভাই অভি। আমার বন্ধু অভি। আমরা তিনজনে প্রায় একই বয়েসী। হঠাৎ আমার পিঠে হাত রাখল। মুখে খেলা করছিল হাসি। লজ্জা পেয়েছিলাম কি একটু! হতে পারে। তবে চোখমুখ তোমায় দেখার ঘোরেই বোধহয় আচ্ছন্ন ছিল। ঘোরটা এক ঝটকায় কেটে গেল বারান্দায় আরও দু’একটা মুখ লক্ষ্য করে। গোটা বাড়িটাই কি আমার পিছু নিয়ে এখানে এসে পড়ল নাকি? সিঁড়ির কাছ থেকে কার যেন গলা পেলাম মনে হল, “ওকে নিয়ে নিচে আয় অভি! মনে হচ্ছে ওর নেশা হয়ে গেছে!”
আমি থ! মুখে একরাশ প্রশ্নচিহ্ন। “কী হল অভি? আমি তো কিছু করিনি!”
অভি আলতো চাপ দিল কাঁধে। “ধূর পাগলা!কী আর করবি তুই? তোর ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। “
-“তাহলে?”
-“তাহলে আর কি! এখানে ছেড়ে গেলে সারারাত তুই মাহিকে ড্যাবড্যাব করে দেখেই যাবি! মশা কামড়াবে! পাগল, চলে আয়।”
অভি হাত ধরে টানছে। টানছে আমার স্বপ্নের ভেতর থেকে। “আয় চলে আয়, দাঁড়াস না…মাহির ঘুম ভাঙে যাবে, চলে আয়…।
ঘুমের মধ্যেই ঠেলাঠেলি শুরু করে দিত মা। “ওঠ বাবু তাড়াতাড়ি ওঠ! সিনেমা শুরু হয়ে গেছ। দেখবি না? কতটা হয়ে গেল যাহ!”
চোখ কচলে জানতে চাইতাম “কী বই?”
-“সাগরিকা। উত্তম সুচিত্রা। ওঠ শিগগির!”
আসলে অন্যদিন টিউশান থাকত বলে দুপুরটা আমাকে বেশিক্ষণ ঘুমোতে দেওয়া হতনা। রবিবার ছুটি। কিন্তু ঘুমের অভ্যেসটটা পাছে চেপে ধরে তাই এই ফন্দি। বাহানা উত্তম সুচিত্রা। অন্যদিন কাঁচা ঘুম ভেঙে টিউশান পড়তে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতাম ঠিকই। তবে এই দিনগুলোয় টিভি দেখার আকর্ষণটা কাজ করত। গান ভেসে আসছিল “এই মায়ারাত শুধু ফুল পাপিয়ার/এই মধুরাত শুধু তোমার আমার…” আর কিছু বুঝি বা না বুঝি সুচিত্রা সেনকে চিনে গিয়েছিলাম। আবেশে তাকানো। ঠোঁটের নড়াচড়া আর বারবার শোনা গানের কলি এসব নিয়ে সিনেমা চলাকালীনই আলোচনা শুরু হয়ে যেত। আমার আগের দুতিনটে জেনারেশন তো এই নামটার নেশাতেই বুঁদ ছিল!
শ্যামল জেঠুর বাড়ি ছিল টালিগঞ্জে। স্টুডিওপাড়ার খুব কাছে। মাঝেমাঝেই বুক ফুলিয়ে বলত “আমি সুচিত্রা সেনকে দেখেছি”। শুনে ঝুঁকে পড়ত সবাই। “তাই নাকি শ্যামলদা! কোথায়…কোথায়?
আসলে গল্পটা ছিল সবারই জানা। তবু কি নেশার টানে যে ওরা বারবার জানতে চাইত কে জানে! শ্যামল জেঠুও গোঁফে তা দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলে যেতেন শ্যুটিং দেখার কিসসা কাহিনী। দাদুমণি কিছু বলতনা। ঠোঁট টিপে হাসত। সবার সব বলা হয়ে গেলে শেষে ছোট্র করে শুধু একটা কথাই যোগ করে দিত “রমা আমার কাছে গান শিখেছিল।” ব্যস, সবাই চুপ।
সুচিত্রা সেনের ডাকনাম ছিল রমা। দাদুমণিও সে নামেই ডাকতে পছন্দ করত। সারাজীবন শিল্প সাধনা করে আর্টপাগল মানুষটা দুটোমাত্র জিনিসই তো অর্জন করেছিল। এক, অল ইন্ডিয়ে রেডিওয় চাকরি। আর দুই, ওই যে..”রমা আমার কাছে গান শিখেছিল। তারপরে সেতো অনেক কাহিনী। বদলে গিয়ে সুচিত্রা সেন হয়ে গেল।”
এসব কথা থেকে ছোটবয়সেই একটা জিনিস সহজেই বুঝে নিয়েছিলাম, সুচিত্রা সেন আসলে কেউ নয়। ওই নামে কেউ ছিলওনা কোনোদিন। চেষ্টা করে সুচিত্রা সেন হতে হয়। রমা সুচিত্রা সেন হয়েছিলেন। কিন্তু ওঁকে দেখতে পাওয়া ব্যাপারটা কেন হট টপিক সেটা বুঝেছি আরও পরে। প্রচুর পত্র পত্রিকার সাথে একটা বিখ্যাত বাংলা ফিল্ম ম্যাগাজিনও আমাদের বাড়ি আসত। ঠিক লুকিয়ে না হলেও খানিকটা আড়াল করে সেসব ম্যাগাজিন আমি গিলতাম। সেখানেই জানতে পাই, উনি প্রকাশ্যে কাউকে আর দেখা দিতেননা। একবার ভোটের ছবি তুলতে গিয়ে এক ফোটোগ্রাফার তাক করে ছবি তুলে নিল, সে নিয়ে কি হইচই! তারপর, কৃশানু ডাক্তার। আমার বন্ধুর বড়মামা, আই স্পেশালিস্ট। পন্ডিতিয়ায় চেম্বার। চোখ দেখাবেন বলে যন্ত্রপাতি নিয়ে বাড়িতে চলে আসতে বলেছিলেন অধরা নায়িকা। ডাক্তারের চোখ তো চড়কগাছ! ম্যাডাম এটা কী করে সম্ভব?
“তাহলে রাত দশটা নাগাদ চেম্বার ফাঁকা করে দেবেন, কেউ যেন না থাকে। আমি আসব’। চেম্বার ফাঁকাই ছিল। ম্যাডাম এসেছিলেন। পরদিন চেম্বারে প্রেসের লোকের হুড়োহুড়ি। কৃশানু ডাক্তার নাকি সুচিত্রা সেনকে দেখেছেন। উরিব্বাস! বিরাট খবর। হইচই…।
সহজে যাকে দেখতে পাওয়া যায় না তাকে হঠাৎ সামনে দেখলে এমনই প্রতিক্রিয়া হয়। এই শহরে আরও একবার আচমকা তোমায় দেখতে পেয়ে আমারও একটা হার্টবিট মিস হয়ে গিয়েছিল। গড়িয়াহাটে, যশোদাভবনের ঠিক নিচে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে দিলের বাগের সেই জীবন্ত বার্বিডল! তুমি কি লক্ষ্য করেছিলে তোমার চারপাশের মানুষগুলো কত তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল? আমি কিন্তু দেখেছিলাম একটা অদৃশ্য গন্ডি আাঁকা ছিল তোমার চারপাশে। আর মাঝখেনে আলোর বৃত্ত তৈরি করে জ্বলজ্বল করছিলে তুমি। আমি দেখে অবাক।
-“তুই এখানে!”
অবাক হয়তো হয়েছিলে তুমিও। প্রকাশ করোনি। বলেছিলে “বাস ধরবো বলে দাঁড়িয়ে আছি। নিউটাউন যাব। হ্যাঁরে বসার জায়গা পাবো তো এখান থেকে?”
-“মনে হয় পাবি না”।
অচেনা শহরে চেনা মাদুষ খুঁজে পেলে একটি মেয়ে আশ্বস্ত হয়। তুমিও হয়েছিলে খানিকটা।
-“তুইও কি ওইদিকেই যাবি?”
-”না ঠিক ওদিকে নয়, তবে তুই চাইলে তোর সাথে অনেকটা যেতে পারি।”
-“দাঁড়া তবে একটা উবের বুক করি।”
এখন ভাবি কি অনায়াসেই সেদিন বলে দিয়েছিলাম ‘অনেকটা যেতে পারি। তাই না! কতটা? ভাবিনি। তারপর থেকে কতবারই তো তোমাকে পৌঁছে দিতে গেলাম। তুমি যতটা বলেছো ততটাই। কখনও আরও একটু বেশি। বারণ করতে। ‘আর আসতে হবেনা। তোকে তো আবার এতটা রাস্তা একা একা ফিরতে হবে। এবার যা।” বারণ শুনিনি। সত্যিই বলতে। ফেরার পথটা ভীষণ একা হয়ে যেতাম। শীতের রাতে হিম জমে ভারি হয়ে উঠত বুক। তার মধ্যেই কিছুটা উষ্ণতার ছোঁয়াও তো ছিল। যখন তোমার মেসেজ ঢুকত ‘বাড়ি পৌঁছেছিস ?’
তখনও রাস্তায়। মিথ্যে করে লিখতাম ‘এই তো এবার ঢুকবো।‘
–’আচ্ছা রে! গুড নাইট! স্যুইট ড্রিম…’
রোমাঞ্চ হত। কেউ দেখেনি তোমায়। কোনোদিন কেউ জানবে না এই নিরিবিলি কথোপকথন। একটু আগেই তোমাকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার কথা শুধু হিমেল বাতাসেই ঘুরপাক খেয়ে যাবে চিরটাকাল। আমার ভাবতে ভাল লাগত। বারবার কোথাও একটা পৌঁছতে হবে তোমাকে। আর সঙ্গী হয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব আমি। ড্রিম! ড্রিম! আমার সবকিছুতেই তো ড্রিম। সাদা কালো আপট্রন টিভিটা ঝিরঝির করছে। অ্যান্টেনায় সিগন্যাল ধরছেনা। একটু আপ ডাউন করে দিতেই স্বপ্নের মতো ফুটে উঠল দৃশ্য। হয়তো এমনই এক রাতে তুমুল বৃষ্টিপাত! সেরাতে তোমায় পৌঁছে দিয়ে আর ফিরে আসতে পারবোনা। পোশাক বদলে একটা ঢিলেঢালা গাউনে তুমি। দুটো গ্লাসে শ্যাম্পেইন ঢালা। কিচেনে রান্না করবে তোমার মাসিমনি। মাঞ্চুরিয়ান চিকেন। তুমি মিষ্টি গলায় গান গেয়ে উঠবে ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে/সখী যাতনা কাহারে বলে/সখী ভালবাসা কারে কয়!…’ গান শেষ হলে আমি মেঝেয় নেমে তোমায় কদমবুশি করবো। পায়ের পাতায় চুমু এঁকে দেবো আপন খেয়ালে। তুমি শিহরিত! এর মানে কী! এর মানে নিদারুণ ভালোবাসা। এর মানে সারা দুনিয়াটাকে তোমার পায়ে এনে রাখবার অদম্য ইচ্ছে!
হঠাৎ স্বপ্নটা ভেঙে যায়। শুধু আবছা মনে থাকে তোমার ঠোঁটের তির তির কম্পন। কে বলে স্বপ্ন রঙিন হয়না? হয়। এমনকি সাদা কালো সিনেমাও নতুন করে কালার প্রিন্ট করা যায়। এই তো সেদিন ‘হারানো সুর’ কালারে বেরোল। নন্দনে দেখলাম। ‘কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার…।’
তুমি সিনেমা হলে যেতে পছন্দ করো না। আমি তবু দুটো টিকিটই কাটতাম। পাশের সিটটা ফাঁকাই থাকত। টিকিট চেকার সেটা প্রায়ই লক্ষ্য করে একদিন মুখে টর্চ মেরে প্রশ্ন করেছিল “কেউ আসবে?”
বলি, “এখনও আসেনি। তবে একদিন ঠিক আসবেই “।
“পাগল কাঁহিকা, হুঁঃ!” বলে বাঁকা হেসে টিকিটচেকার অন্যদের সিট দেখাতে ব্যস্ত। তুমি যে আমার পাশে চাইলেই যখন খুশি এসে বসতে পারো কেউ বিশ্বাসই করতনা।
বিকেল ধীরে ধীরে গোধূলির দিকে হেলে পড়ে। রূপালি আলোটা তখন নিজেকে অন্ধকার চাদরে ঢেকে ফেলবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সন্ধ্যে হয়। দূরে আকাশপটে একটা দুটো তিনটে করে চোখ খোলে ঝিকিমিকি তারা। তারাগুলোর সবারই নিজেদের মধ্যে রেষারেষি। কেউবা একটু দূরে, কেউ একটু কাছে। ঝিকমিক কারো বেশি বা একটু কম। ওরই মধ্যে কোনো একটি তারা বিশেষভাবে জ্বলজ্বল করুক কে না চায়! তুমি চাইছিলে। আমিও হয়তো মনে মনে সেটাই চাইছিলাম। সুখবর বয়ে আনল তোমার ফোনের মেসেজ। কি এক নতুন প্রোডাকশন হাউজ, নতুন ফিল্মের জন্য ওরা নতুন মুখ খুঁজছে। খোদ ডিরেক্টর ফোন করে অডিশনে ডেকেছে তোমায়।
“খুশির খবর। তা আমাকে কী করতে হবে ম্যাডাম?”
তুমি বললে, “সিম্পল্ কাজ। তোর কাছে তো আমার অনেক ছবি আছে…”
-“তাই! কিকরে জানলি? “
-“বাজে বকিসনা আমি জানি। শোন, তোর পছন্দমাফিক চারটে ছবি বাছাই করে কাল বারোটার মধ্যে ঢাকুরিয়ায় চলে আসিস। আর হ্যাঁ সঙ্গে তোর ছবিও আনিস।“
-”আমার ! আমার ছবি দিয়ে কী হবে ?”
-”জমা দিবি। রাজর্ষিদাকে আমি তোর কথাও বলেছি।“
-“রাজর্ষিদা! সে আবার কে? “
-“রাজর্ষি রয়। আরে ওই ফিল্ম ডিরেক্টর। কানেকশনটা যার থ্রু দিয়ে হচ্ছে। আচ্ছা দেরি করিসনা। কাল টাইমে চলে আসিস।” সমস্যায় পড়লাম। যতই তুমি বলো সিম্পল কাজ। তোমার ছবি বাছাই করাটাই সবচেয়ে কঠিন। শোকেস, টেবিল, বইয়ের পাতায় যেখানে যত ছবি লুনো ছিল সব এনে জড়ো করি। অ্যালবামটাও উপুর করে দিই বিছানায়। আমার কান্ড দেখে বাবা মিটিমিটি হাসছে। বিছানাময় ছবি সাজিয়ে থম মেরে বসে আমি। ঠিক করতে পারিনা কোনগুলো বাছবো! কখনো তুমি ঝর্ণার ধারে। কখনো কার্শিয়াংএ পাহাড়ী মেয়েদের সাথে। কোনোটা আবার খুব ক্যাজুয়াল আমি জানি ওটা ঘুম থেকে উঠে বিকেলে তোলা। মুখ ভার। ফেসবুকে সাড়ে তিনশো লাইক পড়েছিল। সবাই কমেন্টে জানতে চেয়েছিল ঠিক কী হয়েছে তোমার! শরীর খারাপ? মন খারাপ? নাকি অন্যকিছু!
এয়ারপোর্টের এন্ট্রেন্সে দাঁড়ানো ছবিটা বেশ ফর্ম্যাল। পোর্টফোলিওয় একটা অন্তত এমন ছবি দরকার। খুঁজে পেতে বহু কষ্টে চারটে ছবি বাছলাম। মনের অজান্তেই একটা লম্বা নিঃশ্বাস পড়ল। ফুসফুসে একটা কেমন চাপ চাপ অনুভূতি। ভাবলাম , আমার পছন্দ করা তোমার ছবি কে জানে কাদের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছি। পরদিন সময়মতোই পৌঁছে যাই। তারপর অটো ধরে দুজনে সোজা গড়িয়া। আমি কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার যাওয়াটা নেহাতই অছিলামাত্র। হিরো হবো বলে পোর্টফোলিওয় ছবি গুঁজে ফিল্মমেকারের দোরে দোরে ঘোরবার কোনো বাসনা আমার নেই। তুমি সেটা ভালোমতোই জানো। বলেছিলাম, “দ্যাখ আমাকে দিয়ে ওসব হবেনা।“
-“তবু একটা চান্স নিতে ক্ষতি কী? “
-“আমার যাওয়াটা কি সত্যিই জরুরী?”
-“হ্যাঁ জরুরী”। ব্যস এর ওপর আর কথা চলে?
গড়িয়ায় আমাদের নিতে এলেন রাজর্ষি রয় স্বয়ং। লম্বা, ফিটফাট হ্যান্ডসাম বত্তিরিশ। জিমটিম করে ফিগারটাও বেশ বানিয়েছেন। চোখে রিমলেস্ চশমা। মুখে টপক্লাস মন জয় করা হাসি।
-“আররে গ্ল্যমক্যুইন! ওয়েলকাম ! সেই কখন থেকে আমি তোমার অপেক্ষায়…।”
আমার দিকেও একবার চোরা নজর বুলিয়ে নিলেন রাজর্ষি। মুখে বললেন, এসো। তবে হাসিটা মিয়োনো। নিছক সৌজন্য বিনিময়। আমরা খালপাড়ের রাস্তা ধরেছি। কোথাও একটা হাতুরি পড়ছিল। কাছাকাছি হয়তো কোনো কামারশালায়। গনগনে লাল ধাতব পাতের ওপর তীব্র হ্যামারিংয়ের শব্দ। হাঁটতে হাঁটতে তোমরা অনর্গল কথা বলছিলে। আমি একটু দূরত্ব রেখে চলছিলাম। তোমাদের কথা বিনিময় থেকেই জানতে পারলাম প্রোজেক্টটা ফাইনাল হলে এই ফিল্মে রাজর্ষি রয় নিজেই হিরো হবেন।
-“ওয়াও, এটা তো দারুণ!”
-”তবে না তো কি! গোটা ইউনিটটাই বলতে পারো আমার হাতে। প্রোডিউসার বাবুদাও আমার দূর সম্পর্কের রিলেটিভ। তুমি খালি অডিশনে ঠিকঠাক পারফরমেন্সটা দাও। বাকি আমি বুঝে নেবো।”
আমার পা চলছিল না। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা ফুঁড়ে অনেকগুলো অদৃশ্য বেঁকাচোরা বিকৃত হাত আমার পথ আটকে দিচ্ছিল বারবার। ফ্লাইওভার, খালপাড়, আশেপাশের বাড়িঘর সব যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আবার ঝিরঝির করতে শুরু করেছে সেই সাদাকালো আপট্রন টিভিটা। পিন পড়া নিস্তব্ধতার ভেতরে খুব শ্লো মোশানে অনেকদূর থে ভেসে আসছে একটা প্রিলিউড -“লাল্লালা লা…”
দুধারে দিগন্তবিস্তারিত প্রান্তর ভেদ করে বাইক চালিয়ে চলেছেন রাজর্ষি রয়…পিছনে সুচিত্রা সে! পরক্ষণেই মনে হল না না সুচিত্রা নয়, তুমি নায়কের কাঁধে হাতের ভর রেখে গান ধরেছো। রাজর্ষি বলল, “তুমি বলো” তুমি বললে, “না তুমি বলো” ”না তুমি…”
আচমকা এসে থামলাম একটা বড় বাড়ির গেটে। আমার স্বপ্নটাও সেখানেই মুখ থুবড়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখি সামনেই একটা বাইক দাঁড় করানো রয়েছে। বাজাজ কাওয়াসাকি, নিউ হ্যান্ড। তুমি মুচকি হেসে জানতে চাইলে “এটা কার?”
রাজর্ষি রয় বললেন, “কার আবার, আমার।“
তারপরেই সামনের হলঘরটায় দেখা দিল অনেকগুলো অপরিচিত মুখ। সকলেরই চোখ ঘুরে গেছে তোমার দিকে। আমি তখন দরদর করে ঘামছি।
এটা ছিল ফার্স্ট অডিশন। সিলেক্টেড হলে সেকেন্ড রাউন্ড। তারপর স্ক্রিন টেস্ট। ছেলেমেয়ে এসেছিল প্রচুর। তবে তুমি যে সিলেক্টেড হবেই তাতে সংশয় ছিলনা। সেকেন্ড রাউন্ডের জন্য আর কী কী করা দরকার বিশেষ করে ডায়ালগ থ্রোয়িং প্র্যাকটিসটা খুব জরুরী, ফেরার পথে সেসবই বলে যাচ্ছিলে। তার অর্ধেক কথাই আমার কানে ঢুকছিলনা। কান মাথা বোঁ বোঁ করছিল। তুমি সেটা লক্ষ্য করেছিলে। –”কি রে, কী হল তোর? হঠাৎ গুম মেরে গেলি যে!”
“না কিছু হয়নি” মুখে বললেও ভেতর পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। সাতজন বিভিন্ন সাইজের এবং বিভিন্ন বয়সের পুরুষ মানুষের সাত দুগুণে চোদ্দটা চোখ যখন তোমার মাথা থেকে পা অবধি জরিপ করছিল, আগুনটা তখনই ধরেছিল। আরও বেশি দাউদাউ শুরু হল যখন ওরা তোমায় নাচতে বলল। জানি এগুলো সবই ছিল রাউন্ডে উতরোবার আবশ্যকীয় টেস্ট। তবু আমি আর সে ঘরে বসে থাকতে পারছিলাম না। বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছিলাম। ধোঁয়া টানতে পারিনি। অবহেলায় পুড়ছিল আমার হাতের সিগারেট।
আমারও পালা এসেছিল যদিও। অনেক পরে। তুমি হয়তো তখন ভেতরের ঘরে। ফর্ম ফিলআপ করছিলে। তাই দেখতে পাওনি তোমার চোখের আড়ালে আমার ওপর কী নির্যাতন শুরু হয়েছিল। প্রত্যেকটা জুরির চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম তীব্র বিষ। তোমার সঙ্গে আমাকে ওরা দেখেছিল শুরুতেই। এখন পালা এসেছিল বিষ উগরে দেবার। আমিও কেমন যেন ঘেঁটে গিয়েছিলাম। আলটপকা খাপছাড়া সব প্রশ্ন। যে উত্তর আমার কেন অনেকেরই জানা নেই। ওরা আমাকে কিসের রোল প্লে করে দেখাতে বলেছিল শুনবে? বাদুড়। হ্যাঁ, বাদুড় কেমন করে হাঁটে। তারপর গোটা ঘর জুড়ে হাসির হল্লা!
হয়তো সত্যিই সেমূহুর্তে আমার মধ্যে কোনো বাদুড়ের সত্তা কাজ করছিল। মনের কোণে লম্বা লম্বা ঝুল হয়ে লটকে ছিল অন্ধকার। অনেকটা বাদুড়ের মতোই। বাদুড় সত্যি রক্ত চোষে কিনা সেসব হয়তো কল্পনা, তবে আমার দাঁতের ধার আমি নিজের ঠোঁটে বেশ টের পাচ্ছিলাম। ভ্যাম্পায়ার! আসলে এক নির্বাসিত ভ্যাম্পায়ার সেদিন ফিরছিল তোমার সাথে। তাই সে কোনো কথা বলছিল না।
রাতে মেসেজ পেলাম তুমি সিলেক্টেড। আমি তখন মদের নেশায় চুর। মাথার মধ্যে আপট্রন টিভিটায় ঝিরঝির করে কাঁপছিল একটা ছবি। ফিল্ম ম্যাগাজিনে দেখা বিখ্যাত সেই ছবিটা। কাঁধ খোলা সুচিত্রা সেন। গালে লেখা ‘নো কিস্ ‘। ফোটোগ্রাফারের নাম মনে নেই। তবে বেশ গর্ব করে লিখেছিলেন, ম্যডাম কীভাবে পাশের ঘর থেকে পোশাক বদলে এসে একলা ঘরে কাঁধ খুলে পোজ দিয়েছিলেন তাকে। কাঁহি নজর না লাগে এই ভঙ্গীতে গালে লেখা হয়েছিল, নো কিস!
দপ্ করে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠল। ওই গালেরই ওপর ছিটকে পড়ল অ্যাসিড! আমি ছুঁড়লাম? না না, আমি না! কিছুতেই না! ঝনঝন শব্দে ছবিটা গুঁড়ো হয়ে গেল। রাস্তার হলুদ আলোয় দেখি, হাতে ধরা রামের বোতল ভেঙে ফেলেছি। ভেঙে গেঁথে দিয়েছি নিজেরই হাতে। চুঁইয়ে নামছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। অ্যাসিড জ্বলনে জ্বলে যাচ্ছে সময়…।
ঝুপসি অন্ধকারে হঠাৎ পথ হারিয়েছে মাতাল চিন্তাভাবনাগুলো। বুঝতে পারছিনা আমি কে? আমি রাজর্ষি রয় নই। আমি উত্তম কুমার নই। আমি দিবানাথ সেনও নই। তুমি যদি সুচিত্রা সেন হও, কে তবে আমি? কোনো ম্যাগাজিনে সে কথা লেখেনি! ঠিক করলাম নিজের অস্তিত্বকে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। চব্বিশ ঘন্টার কাজ নিয়ে শহরের উপকন্ঠে পালিয়ে গেলাম। সে অনেকদূর। বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে কাঁচা রাস্তাঘাট ভেঙে যায়। আমার পুরোনো নাম্বারটাও আর ছিল না। কিন্তু পালাতে চাইলেই কি পালানো যায়! একদিন তোমার মিউজিক ভিডিও রিলিজ করল। ফোনে ইউটিউব খুললেই তুমি। চোখ বন্ধ করেও রেহাই নেই। মগজের আপট্রন টিভিতে যে তোমারই ছবির প্রিমিয়ার চলছে সমানে। সপ্তাহে একদিন বাড়ি গিয়ে বাবার কাছে টাকা রেখে আসি। বলি, “খুব তাড়াতাড়ি আমাকে প্রচুর টাকা জমিয়ে ফেলতে হবে বাবা!”
-“কেন রে? কী করবি টাকা দিয়ে!”
-“পাসপোর্ট বানাবো।” বাবা অবাক! -“পাসপোর্ট কী হবে?”
পরের সপ্তাহের জামাকাপড় ব্যাগে পুরতে পুরতে আনমনেই বলি, “মাহি যদি হঠাৎ কোনোদিন মুম্বাই চলে যায়! অচেনা শহরে আমাকেই তো খুঁজবে? আমি ছাড়া কে পৌঁছে দেবে ওকে?” গোধূলি ক্রমশ সন্ধ্যে পেরিয়ে মাঝরাতের দিকে ঢলে পড়তে থাকে…।
কিঞ্জল ছদ্মনাম। নামটি এক বান্ধবীর দেওয়া। এ নামেই লেখালেখি। আসল নাম পার্থ রায়চৌধুরী। ১৯৮৮ সালের ১৭ই ডিসেম্বর, দক্ষিণ কলকাতার কসবা এলাকায় জন্ম। ২০০৬ সালে বালিগঞ্জ জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক পাশ। বাবার আকস্মিক মৃত্যু এবং আর্থিক টানাপোড়েনের কারনে হায়ার সেকেন্ডারিতে এডমিশন নিয়েও পরীক্ষায় না বসতে পারা।প্রথাগত শিক্ষার এখানেই ইতি ঘটে। তখন থেকেই কর্মজীবন শুরু। রেস্টুরেন্ট, ইন্স্যুরেন্স এজেন্সি, পেট ক্লিনিক, বিপিও, ফ্যাক্টরি সুপারভাইজার, এইচ আর কন্সাল্টেন্সি…বিভিন্ন জায়গায় কাজের বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
লেখালেখিতে আসা আচমকাই।স্কুলের এক সহপাঠীকে চমকে দিতে গিয়েই সাদা উত্তরপত্রে কলমের অর্গল প্রথম খুলে যায়। সাহিত্যে ও সংগীতে অনুরাগ তখন থেকেই।দু-তিন বছর ধরে কলম সচল। ‘তথ্যকেন্দ্র’ পত্রিকা এবং সংবর্তক, ধ্রুব সাহিত্য কহন সহ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। জীবন ও লেখা হাত ধরে পাশাপাশি চলেছে।