| 28 নভেম্বর 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

বাবার চোখ দিয়ে দেখা কলকাতা, আমার শহর । সোনালি

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

টালিগঞ্জ আগে জঙ্গল ছিলো।

প্রথম দিকের কলকাতা মানে কলেজ স্ট্রিট, সিমলে পাড়া, হাতি বাগান, হেদোর জলে ছেলেদের সাঁতার শেখা, অবশ্যই হিন্দু স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ, হেয়ার, বেথুন, স্কটিশ চার্চ। রমরম করে চলছে কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, বৌবাজারের গয়না, বিয়ের কার্ড আরও সারি সারি দোকানের লাইন। আহা পুঁটিরাম, প্যারামাউন্ট, পাশের পানের দোকান যেখানে দু চারশ টাকাও দাম হতে পারে একখানা পানের, কালিকার চপ, বসন্ত কেবিন, ওহো।

এদিকে নরেন দত্ত ওরফে স্বামী বিবেকানন্দর বাড়ি। তার থেকে দু পা হাঁটলেই জি সি, কিনা গিরীশ ঘোষ মশাইয়ের ভিটে, পাশেই বাগবাজারে বলরামবাবুর বাড়িতে ঠাকুর রামকৃষ্ণ মশাইয়ের আড্ডাখানা,  সবই হাঁটা পথের মধ্যে। পরে সেইখানেই সারদা মায়ের থাকার জন্যে বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন মায়ের ছেলেরা। সেই গলির পিছনের দিক দিয়ে বেরলেই গঙ্গার ঘাট। আজও সে বাড়ি মায়ের বাড়ি, আর সে ঘাটকে ও মায়ের ঘাট বলেই ডাকে সবাই।

ভীম নাগের দোকানের বিলিতি মস্ত ঘড়িখানার সামনে দাঁড়িয়ে এই সব ভাবতে থাকলে গায়ে কাঁটা দেয়। ঘড়িটা সাহেবি কোম্পানির, কিন্তু তাতে বাংলায় সব নম্বর লেখা। আজও ঠিকঠাক সময় দিচ্ছে।

পাশেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ।

এই সবই আমি বাবার চোখ দিয়ে দেখি ।

বাবা সারাক্ষণ গল্প করেন যে।

ঐটা তাঁর ছোট বেলার পাড়া। ওখানেই ইস্কুল। হেদোয় দাপিয়ে সাঁতার কাটা। সামনের বাড়িতে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় থাকতেন। নজরুল আসতেন সে বাড়িতে। তাঁর গান শুনতেন ছোট্ট বাবা নিজেদের বারান্দায় ঝুঁকে থেকে। বাবার বড়দাদা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার। খুউব ভালো ছাত্র। কলেজে পড়তে পড়তেই তাঁর বিয়ে হয়েছে বাগবাজারের মেয়ের সঙ্গে। বড় বৌদিদি যখন এসেছেন তখন বাবার বয়েস পাঁচের কাছে।

পাশ করে নতুন ডাক্তার পসার জমানোর জন্য বৃহত্তর কলকাতার খোঁজ করছিলেন। টালিগঞ্জ রেলব্রিজের পাশে দ্বারিকের মিষ্টির দোকানের উল্টো দিকে কবিশেখর কালিদাস রায় বাড়ি করে থাকছিলেন। তার পাশেই একটি চেম্বার ভাড়া নিলেন নতুন ডাক্তার।

সেই সময় বাবামশাইয়ের বয়েস পনেরোর কাছে।

রেলব্রিজের একেবারে পাশের গলি, চারু এভিনিউতে ভাড়া নেয়া হয়েছিল বাড়ি। খুব মন খারাপ নিয়ে কলকাতা থেকে গ্রামে থাকতে এসেছিল বাবাদের পরিবার। এখন সে জায়গার নাম চারু এভিনিউ।

সেখান থেকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে রসা রোডের জমি ভারি সস্তা বলেই কিনতে পেরেছিলেন দাদু, মানে আমার দাদা শ্বশুর।

আনওয়ারশাহ রোড আর তার সামনের মসজিদ এবং তার চারপাশের জমি জায়গায় এককালে ক্লাইভের আটকে রাখা দুই রাজপুত্রই ত রাজত্ব করেছেন।  এরা মহীশুরের নবাব টিপু সুলতানের বংশধর। নবাবকে যুদ্ধে হারিয়ে ইংরেজ রবার্ট ক্লাইভ যুদ্ধবন্দী হিসেবে তুলে নিয়ে এসেছিল দুই শিশু পুত্রকে। তার বিবেকে বাধেনি।

সারা জীবন এই বাংলাতেই কাটিয়ে গেল রাজপুত্ররা । কোনদিন আর ফিরে যেতে পারল না নিজেদের দেশ, পরিবারের কাছে। তারা আর তাদের দেখাশুনো করবার লোকজন বাস করতে শুরু করেছিল এই জনহীন জঙ্গলে। বনবাসী বন্দী রাজপুত্ররা এইখানেই বড় হয়ে উঠেছিল।

 জলা জমি,  শেয়াল সাপের বাসস্থান, চারদিকে কাদা আর নোংরার মধ্যে রেখে দেয়া হয়েছিল দুই রাজপুত্রকে। তাদের বাপ, মহীশুরের রাজা টিপু সুলতান তিনশ লক্ষ সোনার মোহর ইংরেজকে দিতে পারলে তবে ছেলেদের ফেরত পাবেন, এই শর্তে রবার্ট ক্লাইভ তুলে নিয়ে এসেছিল দুই শিশুকে।

রাজপুত্র গুলাম মহম্মদ আনোয়ার শাহ,  তার তিনশ লস্করকে সাথে নিয়ে, ইংরেজের দেয়া সামান্য মাসোহারা ধীরে ধীরে  জমিয়ে প্রমাণ রেখেছিল যে সে হায়দার আলির যোগ্য বংশধর।

তৈরি হয়েছিল মসজিদ এই দূর দেশে চৌরঙ্গীর বুকের ওপর খাস ইংরেজদের নাকের ডগায় আর তারপর আজকের টালিগঞ্জ নামক জায়গাটির মাটিতে। রাজপুত্র,  নিজের বাবা এবং মহীশুর সাম্রাজ্যের নামের পতাকা উড়িয়ে ছিলেন এখানে স্বাভিমানের সঙ্গে।

অতি জঘন্য কাদা জলের মাঝখানে, রসা পাগলার খালের পাশে বাস করতে করতেই বুদ্ধির জোরে জমি কিনে বসতি তৈরী করে ছিলেন কিশোর রাজপুত্র। দক্ষিণ এবং মধ্য কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মালিক হয়ে উঠেছিল টিপু সুলতানের পরিবার ।

তৈরী হয়েছিল প্রিন্স গোলাম মহম্মদ ট্রাস্ট,  যা আজ দেশের অন্যতম ধনী ট্রাস্টের একটি।

কর্ণেল উইলিয়াম টালি, গোবিন্দপুর খালের সংস্কার করে তাকে যুক্ত করলেন একদিকে কলকাতার বন্দর আর অন্যদিকে মাতলা আর বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে। এর যোগ রইল গঙ্গার ।

এই নালার পারে বাস করতে আসা মানুষ একে ডাকত, টালির নালা। বুড়ো মানুষরা বলতেন, আদি গঙ্গা। এর পাড়েই কালিঘাটের মন্দির, কেওড়াতলার মহাশ্মশান।

আনোয়ার শাহের বানানো টিপু সুলতানের নামের মসজিদের উল্টো দিকে এই খালের মধ্যে থেকে উঠে আছে রুদ্রের আসন,  সবাই বলে পঞ্চাননতলা। কতদিনের সিদ্ধ আসন তার হিসেব নেই। পাশের গলিতে পূজিত  হন রুদ্রের শক্তি গন্ধেশ্বরী দেবী।

পুরোনো মানুষেরাই খোঁজ রাখেন এখন তার।

 টালির নালার ওপরে  পঞ্চানন মন্দিরকে পাশে নিয়ে উনিশ শ চৌত্রিশ সালে তৈরী হল ব্রিজ।

বরিশা, সিরিটি, সাবর্ণ চৌধুরীদের এদিকের জমিদারি আর বিরাট লোকালয়ের সাথে সহজে যোগাযোগ করার রাস্তা হল এবার।

ইংরেজরা এই নতুন গজিয়ে ওঠা জনবসতির পাশে আরেকটা ব্রিজ বানালো ট্রেন লাইন পাতার জন্য।

লাইনের পাশের ঢালু জমি সরকারি।

কিন্তু গরীব হা-ঘরে মানুষ ঝপাঝপ দখল করে ফেলল সে জায়গাপত্র।

বিরাট অঞ্চল জুড়ে  সমস্ত রেললাইনের পাশে পাশে গড়ে উঠল বস্তি। আঠারোশ নব্বই সাল থেকে।

ক্রমশ কলকাতা ছড়াতে লাগলো। দেশ ভাগের ধাক্কায় ছিন্নমূল মানুষের স্রোত জায়গা খুঁজছিল বাসস্থান তৈরি করার জন্য।

উত্তর কলকাতা এদের রিফিউজি বলে নাক সিঁটকাচ্ছিলো।

এঁরা টালির নালার আশপাশের এবং গড়িয়া, বোড়াল, যাদবপুর অঞ্চলের, অল্পমূল্যে পাওয়া মাটিকে নিজেদের পরিশ্রমে অভিজাত করে তোলার লড়াই শুরু করলেন।

শুরু হল প্রতিযোগিতা।

উঠতি দক্ষিণ কলকাতা বনাম বনেদী উত্তর কলকাতার।

ইংরেজরা এই টালির নালার পাশের জায়গাকে বলল টালিগঞ্জ। ফাঁকা জায়গা প্রিন্সের থেকেই কিনে তৈরি করল গল্ফ ক্লাব।

আর সম্মানের চিহ্ন হিসেবে, গল্ফ ক্লাবের প্রথম ” হোল ” মানে বল ফেলার গর্ত নামাঙ্কিত রইল প্রিন্স গোলাম মহম্মদ আনোয়ার শাহের নামে।

আমি বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসে দেখলাম,

সেই নবাব বংশের খানদানি এন্টিক পালঙ্ক, তিন পাটের ভেনেশিয়ান আয়না লাগানো ড্রেসিংটেবিল বউকে কিনে দিয়েছেন দাদু।

দিদাদের ঘরে সাজের পরে একবার আয়নায় দেখে নেওয়ার আরামই আলাদা।

গলির পিছনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকে ঘুরে গেলে একটা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় একটা কানা গলি। একতলার ঘরের দু দিকে দুটো সাদা সিংহ। দুপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা। একতলার আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে, অসাধারণ মেহগনির  কোট স্ট্যান্ড,  ভেনেশিয়ান কাঁচের আয়না, পুরোনো গড়গড়া,  কালচে ভেলভেটের পর্দা, চোঙা দেয়া কলের গান।

সিনেমা থিয়েটারওয়ালারা এখান থেকে ভাড়া নিয়ে যায় এইসব মঞ্চ সাজানোর জন্য।

এগুলো এন্টিক। জায়গাটার নাম কর্ণওয়ালিশ এক্সচেঞ্জ।

পুরোনো সিনেমা পাড়া পাশেই। আগে স্টুডিও ও ছিল। এখান থেকেই  ভাড়ায়  যেত জিনিসপত্র।

রেলব্রিজ

ছোট বেলা থেকে টালিগঞ্জ রেলব্রিজটাই আমার আইডেন্টিটি। ওকেই সবচে’ বেশি চিনি।

প্রতাপাদিত্য রোড থেকে রেলব্রিজ এর তলা দিয়ে এসে ডান দিকে গলিতে ঢুকলেই, বাড়ি এসে গেছি।

ও ব্রিজের ইঁটগুলোকে অব্ধি চিনি।

প্রতাপাদিত্য রোডের দিকে ব্রিজের ও দিকটা ভারি আপন জায়গা। সামনেই একটা মস্ত উঁচু কদম গাছ।তার ডালপালা ছুঁয়ে একটা বড় বাড়ি। নীচে ফার্নিচারের দোকান। একটা মনিহারি দোকান ও। দোতলায় সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হরপার্বতীর মূর্তি।

এ বাড়ির নিচে, পাশের একতলায় চা আর আড্ডার একখানা বড় দোকান ছিল। এখন আর নেই। আর তার পাশে, উঁচু তাক পেতে রামবিলাসের পান সিগারেটের দোকান। সেটা এখন ও আছে।

বাবারা চারমিনার আর চা দিয়ে সেখানে যে আড্ডা তৈরি করতেন এই জায়গাটুকু ঘিরে, তাতে স্বদেশ আর বিদেশের সাহিত্য, সিনেমা, আধুনিক এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের অপূর্ব নির্যাস আমায় বুদ্ধিজীবী বাচ্চা করে তুলেছিল।

আমাদের  পাড়া মানে একটা  সাত আট ফুট রাস্তা। তার দুধারে মুখোমুখি সার দিয়ে বাড়ি। পিছনে উঁচু দিয়ে রেল লাইন। তার পাশে বস্তির ঝুপড়ি। আমরা গলির সামনের দিকে একটা দোতলা বাড়ির একতলায় থাকি।সামনের দরজা দিয়ে বেরোলে বড় রাস্তা। গলির সাথে কোন যোগাযোগ থাকে না।বাবা মা সে দিক দিয়েই অফিসে চলে যান।আমিও ইস্কুলে যাই।পাড়ার কোন বাড়িতে যাওয়া আমার বারণ।

কিন্তু আমি একলা থাকি আর বাবা মা অফিসে যান তাই আমার আলমারি ভরতি খেলনাপাতি। নানা মাপের ছোটরা আমার সাথে খেলতে আসে।আমাদের ফ্ল্যাটের একটা পিছন দিকের দরজা আছে। জমাদার আসার জন্য একটা  রাস্তা, সেখান দিয়ে কাজের লোকেরা ও আসে। সে দরজাটা খুললেই পাড়া। ছুটির দিনে সেখান দিয়েই আমার সংগীরা ঢোকে। ঠিক পাশের বাড়ির দোতলার রোগা, সাদা, সরু সরু আঙুলের মেয়ে, বুকুনি। ওদের  এক তলার ভাড়াটেদের গোব্দা, ঝাঁকড়া চুল দোলানো খ্যাপাটে পুচকে, কেকা। দু তিনটে  বাড়ি  পরের, ক্ষয়াটে, আরো ছোট ছেলে, বাবুল। এদের থেকে আমি ক্লাসে ঢের উঁচু। কিন্তু মনের বয়েসটা কাছাকাছি যে,সেটা  ওরা টের পেতো। তাই খেলতে ডাকত আমায়। একে আমার ঘর ভরতি খেলনা।তায় পড়াশুনোয় ভাল বলে পাড়ায় খাতির, কাজেই খেলার দক্ষতায় লাড্ডু হলে ও পুপু দিদিই ওদের লিডার।

শীত কালে পিছনের দরজা দিয়ে বেরোনোর অনুমতি মিলত। সকালে জল খাবার খেতে না খেতেই নানা রকম আওয়াজের কোরাস।

কখন বেরোবে?

বল কে আনবে?

র‍্যাকেট আছে  তো?

আগে কার খেলার কথা?

আসলে গলিটাই ছিলো আমাদের খেলার মাঠ। খালি পায়ে অবাধে দৌড়ে পিট্টু, ব্যাডমিন্টন, পিল কেটে গুলি, এর সবকিছুই একান্ত নিরাপদ ছিল ছোটদের জন্য।

আমার সুখ্যাত শিল্পী মেসোমশাই শ্রী মৃদুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে সমসাময়িক কত ভাস্কর চিত্রকরদের সমাহারে শুনেছি শিল্পীরা আমার মাকে বলছেন, এমন মানুষকে দেখলে ছবি আঁকতে মূর্তি গড়তে সাধ যায়।

মা হেসে আমায় টেনে নিয়ে বলতেন,  পঞ্চাশ পেরিয়েছি অনেক দিন ,  আমার একমাত্র পরিচয় আমি মা।

মায়েরা দেশ ভাগের পরে ওপার থেকে এসে কলকাতায় চাকরি করতে শুরু করা প্রথম দলের মেধাবিনী মেয়ে।

বড় হতে হতে শুনতাম,  এখন অনেকে সাহস করে প্রশংসার কথা বলছেন মাকে ; কিন্তু ডালহৌসি স্কোয়ার আগে এ মেয়েকে রণচণ্ডী নামে চিনিত, এই সব কম্পলিমেন্ট সামনাসামনি দেবার সাহস ছিলনা কারো।

সেই যে দ্বিতীয়ার চন্দ্রকলার মত ক্ষীণ, কিন্তু অপূর্ব সুন্দর,  সব সময় ঘোমটা টানা মানুষটি, তাঁকে আশ্চর্য ভাবে সবাই ভয় পেত।

আমি ত পেতামই। তাঁর কঠিন নির্দেশেই

পাড়ার কাকুরা কোন দিন আমায় কোলেও নিতে সাহস পায়নি। আমি একা ঘরে বড় হয়েছি রেলবস্তির সামনে, তবু কেউ আমার দিকে তাকাতে সাহস পায়নি। ইস্তক রেলের ওয়াগনব্রেকার চপার হাতে দৌড়ানো টেরর দুলু গুণ্ডাকে দেখেছি,  কাঁচুমাচু হয়ে, ” না  বৌদি ভুল হয়ে গেছে ” বলে সরে পড়তে।

তারা আমাদের এক কামরার ভাড়াবাড়ির রোয়াকে মাতাল হয়ে মারামারি করতে এসেছিল।

মা ক্লাস ওয়ানের আমাকে হোম ওয়ার্ক করাচ্ছিলেন অফিস থেকে ফিরে। ঘোমটা টেনে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন , ” জানো আমি মেয়েকে পড়াচ্ছি?  তোমাদের এই ব্যবহারে তার লেখাপড়ার ক্ষতি হলে কি ঠিক হবে? “

আমি তখন ও মায়ের হাঁটু ছুঁই। আঁচলের কোনাটা ধরে পিছনে দাঁড়িয়ে দেখলাম মায়ের মুখটা গর্জন তেলমাখা পাড়ার প্যান্ডেলের মা দুর্গার মত জ্বলছে। দুলুকাকা, হ্যাঁ, আমরা বস্তির লোকেদের ও দাদা কাকাই বলতাম,  আমার মতই ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে তাকিয়ে আছে।  তার পর, মাথা নীচু করে ,  ” না বৌদি ভুল হয়ে গেছে। ” বলে দলবলসহ চলে গেল।

বড় হওয়ার রাস্তার সঙ্গে রইলো, প্রাইভেট রোডের রেল বস্তির নাক দিয়ে ঝোল গড়ানো , অপূর্ব ভাষায় কথা বলা কালারফুল বাচ্চার দল।

সঞ্জীব দার ছোট্ট দোকান, মেন রোডের ওপর। ছোটো ছোটো কাঁচের বয়াম। চানাচুর। নোনতা বিস্কুত। হজমি। দোকানের ভিতরে বসে থাকে হাসিখুশি মালিক। ভারি ভাল লোক। আসলে কাকাদের বন্ধু। তাও দাদা বলে পুপু। এই দোকানটা কিন্তু লক্ষ্মণরেখা। এই অবধি যাওয়া যায়,একা।

বাড়ির সিঁড়ির তলায় বস্তির বাচ্চারা বসে থাকে। বরষায়,গরমের সময়।

রেল ব্রিজের মুখে আমেদ কাকুর মাংসের দোকান। মোটা মানুষ । ছোট দোকানের ভেতর হাঁসফাঁস করে। রবি বার হলেই ছোট ব্যাগ আসে । বাবা মাংস রান্না করে কুকারে হুইসিল দিলেই গন্ধ ছড়ায় আমাদের  এক ঘরের বাড়িময়। পুপু আল্লাদে গদগদ ।

এটা ছুটির গন্ধও। মা – বাবা,  পুপু, এক সাথে সারাদিন থাকার গন্ধও। ভীষণ মজার গন্ধও। কিন্তু দোকানে ছাল ছাড়ানো মাংস ঝুলে থাকে। বিশ্রী  টিপিকাল গন্ধও। এই গলিতে ঢোকার রাস্তায় এই ঝোলান মাংসের পাশ দিয়ে রোজ চোখ নাক বুঁজে পেরোতে হয়। বমি পায়।

  এখন এইসব মুছে গেছে। এইখানে এখন পাতাল রেলের রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে। 

ইস্কুলে যাবার পথে দেখা যেত এস আর দাস রোডের রাস্তা ধোয়ানোর ছবিটা। সারা বছরই দেখতাম। কিন্তু, গরমকালে, যখন মর্নিং স্কুল হত , ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় রিকশার দুলুনিতে আরাম লাগতো ঘুম ঘুম চোখে।

 বাকি বছর তো দুপুরে বারোটায় স্কুল। গরমের কষ্ট থেকে ছোটদের বাঁচাতে মর্নিং স্কুল। তার মানেই রাস্তার কালো পিচে হলুদ রাধাচূড়ার আলপনা। ইস্কুলের সামনের কৃষ্ণচূড়াগুলো আমাদের জন্যেই ফোটে। স্কুলের দোতলার ঘরের কোনা করা জানালা দিয়ে তাকালেই বুঝি রবীন্দ্রজয়ন্তী এসে গেছে। তখন স্কুলে আসার মজাই আলাদা। আহা, রিহার্সালের আনন্দ যে পায়নি, সে বাচ্চার জীবনটাই যে মাঠে মারা গেছে। 

কাজেই সকালে উঠে আহ্লাদে ডগমগ হয়ে রিকশা কাকুর গাড়ীতে উঠি , প্রতাপাদিত্য রোডের মোড় থেকে। রিকশাওয়ালার দৌড়ের ছন্দ আর হাতে রাখা গোল চকচকে মোটা ঘণ্টার রিকশার হাতলে ঠোকার টং টং আওয়াজ, কি আরামের হারমনাইজেশান , সে যারা টানা রিকশায়ে না উঠেছে তারা বুঝবে না। আমার ত নিজেকে একটি আস্ত রাজকন্যা মনে হত। আর ঢুলু ঢুলু চোখে দেখতাম, রাস্তার দু ধারে গোল লোহার চাকতি, একটা চেপটা পাত দিয়ে রাস্তার ফুটপাথের সিমেন্টে গাঁথা। অন্যসময় তার পাশ দিয়ে গল গল করে গেরুয়া জল বেরোতে দেখি। ভোরবেলা সেই গোলগুলো খুলে দাঁড় করিয়ে রাখা থাকে।  টগবগ করে জল বেরয় । কখনও বাবা বা মা বলেছিলেন , ওটা গঙ্গা জল। হাফ প্যান্ট পরে কিছু লোক, একটা চৌকো বাক্স , দুই চাকা দেওয়া, তাতে লম্বা হ্যান্ডেল, ঠেলে ঠেলে রাস্তার নোংরা সাফ করে তুলে নিতো। সঙ্গে লম্বা পাইপ থাকতো। কিছু দূর অন্তর ওই জলের ফুটন্ত স্রোতের থেকে জল নিয়ে রাস্তা, ফুটপাথ সব ঝকঝকে করে ধুয়ে ফেলত  এই মানুষেরা , এক নিজস্ব নিঃশব্দ ছন্দে।

 মাঝে এক দিন সাউদার্ন অ্যাভেন্যুতে ওই রকম একটা গাড়ি দেখতে পেয়ে ভারি নস্টালজিক হয়ে পড়লাম।

মাথায় রুপোলী চুল হলে , মানুষ ক্রমেই পাগল হয় আর কি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত