গীতরঙ্গ: হুতোমি দৃষ্টিতে হুজুগে কলকেতা । দিলীপ মজুমদার
আজব শহর কলকেতা।
রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি
মিছে কতার কি কেতা ।।
হেতা ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে
বলিহারি ঐকতা।
যত বক বিড়ালে ব্রহ্মজ্ঞানী
বদমাইশির ফাঁদ পাতা ।।
অতএব শুরু করা গেল হুতোমকে দিয়ে। লাস্ট সেঞ্চুরির আগের সেঞ্চুরিতে হুতোম লিখেচিলেন এক নকশা। হুতোমপ্যাঁচার নকশা। তিনি লিখেচিলেন, কলকেতা শহরে নতুন নতুন মাতলামি দেখা যায়। দুই সেঞ্চুরি পার হয়ে গেল, অদ্যাবধি হুতোম বেদবাক্য হয়ে রইলেন । কলকেতার হুজুগ আর ফুরোলো না। হুতোমের মতে সবগুলি সৃষ্টিছাড়া আর আজগুব।
লিখতে লিখতেই বেজে উঠল খোল-কত্তালের শব্দ। দরজা খুলে দেখি, কোন ভেজাল নেই, খাঁটি নবদ্বীপ মার্কা সুললিত ধ্বনি। রাধে কিষ্ট রাধে কিষ্ট, কিষ্ট কিষ্ট হরে হরে। কে বাবা তুমি কলির চৈতন্য? ভালো করে দেখতেই বেবাক অবাক। মাতা মুড়নো, টিকিসমেত আস্ত এক সাহেব। সঙ্গে গুটিকয় নববৈষ্ণব যুবক। তাঁরা দিশি মাল। সাহেবের পেচোন পেচোন রপ্টে রপ্টে বেড়াচ্চেন। এ তো হুতোমের আমলের সাহেব নন। নব বৈষ্ণব আন্দোলন সম্বন্ধে বিস্তর পুঁতি লেখা হয়েচে আর সুগুলি পাঠ করলে জানা যাবে: ফ্রাস্টেশন, ডিপ্রেশন এখন জগতের ব্যাধি, তার থেকে উদ্ধারকল্পেই এই কেত্তন, এই কেষ্টভজনা। জয় রাধে কেষ্ট। শোনা যাচ্চে তাবৎ বড় বড় দেশে কেত্তন মাহাত্ম্য প্রচারে বড় ঘটা। তাই বড় বড় আপিস হয়েচে, সেখানে দেশ-বিদেশের লোকজন গমনাগমন করচেন। আমাদের দেশেও হয়েচে ইসকন নামে এক সংস্থা। তাদের আপিসে গেলে তাক লেগে যাবে । তবে এই আধুনিক সেঞ্চুরিতে নিন্দুক আছেন অনেক। তাঁরা বলেন নব বৈষ্ণব আন্দোলনের পেছনে মাতা আছে, এঁরা এক ধরনের পোলিটিক্যাল এজেন্ট।
নিন্দুকদের কতা থাক। তবে কেষ্ট ভজনাতে যে দেশের তাবৎ লোকের শান্তি মেলেনি তার প্রমাণ আচে। কেষ্টর পাশাপাশি একদল মানুষ মহাদেবকে নিয়ে পড়েচেন। সামান্য রগচটা, হাড়হাভাতে পিজান্টস ফ্যামিলির লোক হলেও মহাদেবকে মানুষ দেবাদিদেব বলে মনে করেন। তা, দেবাদিদেবের তপিস্যা চলবে, অথচ গাঁজা-চরস থাকবে না, এ কী কতা? গাঁজার কলকে হাতে পূর্বে যাঁদের শ্মশানভূমিতে বিচরণ করতে দেখা যেত, এখন তাঁরা পার্কে, গড়ের মাঠে, হাউসে হাউসে ছড়িয়ে পড়েচেন । লম্বা রুক্ষু চুল, বাহারি চকরাবকরা জামা, তালিমারা প্যান্টালুন, নিমীলিত চক্ষু জোড়ায় জোড়ায় সব ঘুরে বেড়াচ্চেন। এাঁদের কেউ বলচেন হিপি, কেউ বলচেন হাংগরি। মাঝে মাঝে গগনবিদারী চিৎকার: দম মারো দম…।
হুতোম হে, শুধু বাবু নয়, বহু তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এখন গাঁজা-চরস- কোকেন-মারিজুয়ানা-এলএসডিতে মগ্ন হয়ে আচেন। কলকাতার বিরাট ক্যানভাসের উপর ভেসে উঠচেন এঁরা। চাদ্দিক প্রকম্পিত করে ধ্বনি উঠচে, ব্যোম। ব্যোম বৈকি, জয় বাবা মহাদেব, হরহর ব্যোম ব্যোম।
এর সঙ্গে নতুন একটা ভাঁড়ামি যুক্ত হয়েচে। রামনামে মাতাল হচ্চে মানুষ। বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্র সত্যি নাকি জন্মেচিলেন আমাদের এই পবিত্র ভারতভূমিতে। পোলিটিক্যাল প্রভাব বিস্তারের জন্য এবার রামকেই ধরা হয়েচে। রামনবমী পালন করা হচ্চে। তলোয়ার নিয়ে মিছিল বেরিয়ে পড়চে । অবিশ্যি এ ব্যাপারটায় কলকেতা টেক্কা দিতে পারে নি উত্তরভারতকে। সেখানে বড় বড় মাতা আচেন, তাঁরা ধম্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিলিয়ে চমৎকার ককটেল তৈরি ফেলেছেন, আর তাবৎ মানুষ তাই গিলে মাতাল হচ্চেন।
হুতোম কলকেতার এক বাবুর কতা বলেচেন যিনি মস্করামো দেখাবার জন্যে এক ভাঁড় রেখেচিলেন। সে ভাঁড় নতুন নতুন ভাঁড়ামো করে বাবুমশায়ের মনোরঞ্জন করত। এমনি করে কিছুদিন যাবার পরে ভাঁড় আর নতুন ভাঁড়ামো খুঁজে পায় না। তখন সে একদিন ঝাঁকামুটে ভাড়া করে তার উপর চড়ে বসে বাবুমশায়ের কাচে হাজির, বলে , বাবুমশায় কেমন লাগল আজকের এই ভাঁড়ামো? তখন ভাঁড়ামো উপভোগের বস্তু ছিল। এখন উপযোগের বস্তু হয়েচে । বাবুদেরও কালে কালে অনেক পরিবর্তন হয়েচে। পোশাকে পরিবর্তন, রীত আর ব্যাভারে পরিবর্তন। মিনস অফ ক্যাপিটেল আর পোলিটিক্যাল পাওয়ার নিয়ে এঁরা নব্য বাবু । ভাঁড় বা মোসেহেবের নতুন নাম হয়েচে চামচে। শিল্পপতির চামচে, বড়লোকের চামচে, নেতার চামচে, বিধায়ক আর সাংসদের চামচে, মন্ত্রীর চামচে….। চামচের ছড়াছড়ি। চামচেকে এড়িয়ে আসল লোকের কাছে যাওয়ার সাধ্যি কী ! হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে চামচেরা । তাদের কিছু কিছু দক্ষিণা না দিয়ে পরিত্রাণ নেই। বাচ্চার বার্থসার্টিফিকেট, নামি স্কুলে ভর্তি, চাকরির সুপারিশ, বাড়ির প্ল্যান বা মিউটেশন, দোকানের লাইসেন্স,-যা আপনার দরকার, তার জন্য চামচের হাতে কিছু গুঁজে না দিলে কিছুই হবে না । চামচেদের এই লীলাখেলা হুতোম কিন্তু দেখে যেতে পারেন নি। আপশোশ।
হুতোমের যুগে মদ আর মেয়েছেলে ছিল যুবকদের মুন্ডু ঘুরিয়ে দেবার অস্ত্র। আলালের ঘরের দুলালকে আমরা দেখেচি, দেখেচি নিমচাঁদকে। একালে ছেলেছোকরাদের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেবার অস্ত্র রাজনীতি আর যৌনতা। রাজনীতির কত যে লীলাখেলা কলকেতা দেখেচে , তা বলার কতা নয়। লাল, নীল, সবুজ, গেরুয়া কত রকমের দলের মিছিল যে দেকা যায় কলকেতায় তার ইয়ত্তা নাই। এসব দলের নানা আদর্শ, নানা বুকনি। প্রতিশ্রুতির বাহার বা কী। পঙ্গু যাতে গিরি লঙ্ঘন করে, বন্ধ্যা জননীর যাতে সন্তান হয়, অপুষ্টিজর্জর শিশুর মুখে যাতে কোলগেটের হাসি ফুটে তারা এব্যবস্থা দল করে দেবে। দলের বল অসীম। তার সঙ্গে আছে ছল আর কৌশল। কেউ বলে কলকাতাকে লণ্ডন বানিয়ে দেবে, কেউ বলে সোনার বাংলা গড়ে দেবে ক্ষমতায় এলে। দলের জন্য কর্মী চাই। ছেলে-ছোকরা কর্মী হলে ভালো হয়। কর্মী জোগাড় করার পরে মন্ত্রগুপ্তি হয়। দল যা বলবে তাই শুনতে হবে । দল যা বলবে তাই করতে হবে। তক্ক করা চলবে না। নেতা বলে দেবেন, মামেকং শরণং ব্রজ। আমাকে অনুসরণ করো। আমি যা করি তা করো না, আমি যা বলি তা শোনো। ছেলেছোকরারা চাকরির জন্য হাপিত্যেশ। সেই আশায় তারা দলে ঢুকে পড়ে। আদর্শের বুলি কপচায়। প্রতিপক্ষকে ঢুঁ মারে। সারা বছর ধরে এসব রগড় চলে। তাদের মাতা ঘুরিয়ে দেবার জন্য যৌনতার পসরা খুলে বসে। পুস্তকে, সিনিমায়, ইউটিউবে যৌনতার ছড়াছড়ি।
দিনে দিনে কলকেতার মর্ম দেখি চমৎকার। দেখতে দেখতে অস্ত গেলেন সুয্যিদেব। কলকেতার আকাশে জ্বলে উঠল হরেকরকম আলো। যেন রাতের বেলায় দিনের নিম্মান। রাস্তায় বাস-ট্র্যাম-ট্যাক্সি-লরির গর্জন । তার সঙ্গে রাস্তার পাশে দোকানগুলির ভেতরকার বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ । কলকেতা সরগরম। আপিসবাবুরা পিলপিল করে বেরিয়ে আসচেন, কেউ কেউ গড়ের মাঠে হাওয়া খাচ্চেন, পার্কে ভিড়, রেস্তোরাঁয় ভিড়, থেটারে ভিড়; গলির মোড়ে নেক্সট জেনারেশন নরক গুলজার করচেন, রাস্তায় সমোত্ত মেয়ে দেখলে শিশ দিচ্চেন, ভিকিরিরা ভিক্কের আশায় বসে আচেন রাস্তায়, পকেটমাররা নতুন কৌশল সন্ধান করচেন। কে বলবে মৃতনগরী কলকেতা! এর মতো জীবন্ত আচে কী আর কোন নগরী! হেতা ভদ্রলোক চোরের বড় উৎপাত । তাঁদের দেকে কে বলবে ভেতরে ভেতরে এমন অভিসন্ধি। তাঁরা পুকুরচুরি করেন হাসতে হাসতে, গলা কাটেন নাচতে নাচতে । উকিল মোক্তাররা তাঁদের হয়ে সওয়াল করেন। ভদ্রলোককে চোর বলা! আস্পদ্দা তো কম নয়। এই ভদ্রলোক চোরেরা আপিস –আদালতে আচেন, ইস্কুল-কলেজে আচেন, রাজনীতি আর ধম্মনীতির ময়দানে আচেন । এঁরা আবার কতা কন বাংলিশ ভাষায়। বেওয়ারিস লুচির ময়দা বা তইরি কাদা পেলে নিষ্কম্মা ছেলেরা একটা না একটা পুতুল তৈরি করে খ্যালা করে, এঁরাও তেমনি বাংলা ভাষাকে বেওয়ারিশ মনে করে তাই দিয়ে যা মনে করা যায়, তাই করেন।
হুতোম অবশ্য আশা দিয়ে গেচেন, সময় কারও হাত ধরা নয়। সময় জলের ন্যায়, বেশ্যার যৌবনের ন্যায়, জীবের পরমায়ুর ন্যায়। জোচ্চুরি চিরকাল থাকে না। দশদিন চোরের তো একদিন সেধের। তাই জিনিসিদ্ধ হোসেন খাঁ একদিন ধরা পড়বেনই। তখন কোথাও ঠোনাটা ঠানাটা, কোথাও কানমলা, প্রহার পযন্ত বাকি থাকবে না।
গবেষক