| 8 অক্টোবর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: মহানগর ও কলকাতা ৭১ সময়ের ক্যানভাস । শৌনক দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

বাংলায় চলচ্চিত্রের সূচনা ১৮৯০ সাল থেকে যখন কলকাতার থিয়েটারে বায়োস্কোপ দেখানো হতো। একদশকের মধ্যেই ইন্ডাস্ট্রির বীজবপন করেন হীরালাল সেন। তিনি রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে কলকাতার স্টার থিয়েটার, মিনার্ভা থিয়েটার, ক্লাসিক থিয়েটার ইত্যাদিতে জনপ্রিয় শো দেখাতেন। একটি লম্বা বিরতির পর হাল ধরেন ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি। তিনি ইন্দো-ব্রিটিশ ফিল্ম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন যা বাঙালি মালিকানার প্রথম কোম্পানি (১৯১৮)। প্রথম বাংলা ফিচার ফিল্ম ছিল বিল্বমঙ্গল যেটি ১৯১৯ সালে মদন থিয়েটারের ব্যানারে নির্মিত হয়। “বিলাত ফেরত” ছিল আইবিএফসি’র প্রথম প্রযোজনা (১৯২১)। মদন থিয়েটারের জামাই ষষ্ঠী ছিল প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র এবং প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত দেনা পাওনা চলচ্চিত্রটি ছিল বাংলার প্রথম সবাক চলচ্চিত্র। তারপর অনেক ইতিহাস হলো, তারমধ্যে সত্যজিৎ রায়মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটক এবং অন্যান্য নির্মাতারা তাদের স্থান সুপ্রতিষ্ঠিত করে বাংলা চলচ্চিত্রকে অনেকদূর অগ্রসর করেন। কলকাতা শহর নিয়েও চলচ্চিত্র হয়েছে অনেক কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কলকাতা নগর কেন্দ্রিক জীবনের সিনেমা বললে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে সত্যজিৎ রায়ে মহানগর ও মৃণাল সেনের কলকাতা ৭১।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga special Mahanagar Calcutta 71

মহানগর

সত্যজিৎ রায়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার। শুধু চলচ্চিত্রকার নয়, তিনি শিল্প-সাহিত্যের সক্রিয় সারথি, বহুমুখী ব্যক্তিত্বের প্রতিভূ। কালান্তরের চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, লেখক, সঙ্গীত স্বর লিপিকার, সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদ শিল্পী। বাংলা চলচ্চিত্র তো বটেই এমনকি পুরো উপমহাদেশের চলচ্চিত্রকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।চলচ্চিত্র শিল্পে সত্যজিৎ রায়ের যাত্রা শুরু ‘পথের পাঁচালি’ সিনেমা নির্মাণের মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি একের পর এক অসাধারণ সব সিনেমা নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের ছিল বহুমুখী সৃজনশীলতা। তার কাজের পরিমাণ বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। 

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ গল্প অবলম্বনে ১৯৬৩ সালে ‘মহানগর’ নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বলতে গিয়ে এ সমাজের রূঢ় বাস্তবতাগুলোকে অত্যন্ত নিপুণ আঁচড়ে তিনি এ চলচ্চিত্রে পরিস্ফুটিত করেছেন। নগরায়নের ফলে ষাটের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে সৃষ্ট নানা জটিলতা এবং তাদের মানসিক জগতের পরিবর্তন সত্যজিৎ রায় ‘মহানগর’ এ রূপায়িত করেছেন। বাঙালি গৃহবধূর চাকরিজীবী হয়ে ওঠার সামাজিকভাবে সংকটপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি অসামান্য দক্ষতার সাথে চিত্রিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga special Mahanagar Calcutta 71


‘মহানগর’ ছবির পটভূমিতে ফুটে উঠেছে রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ আরতি মজুমদার। কিন্তু, স্বামীর আয়ে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। তাই বাড়ির সবার অমতে সব রক্ষণশীলতাকে দূরে সরিয়ে যোগ দেয় চাকরিতে। ধীরে ধীরে নিজের টাকা ও স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে শুরু করে। হয়ে ওঠে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যা। ১৯৬৩-তে দাঁড়িয়ে এমন এক নারীচরিত্রকে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন সত্যজিৎ। আর এই চরিত্রে অনবদ্য হয়ে উঠেছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। আরতির চরিত্রটি কোমল ও কঠোরে মেশানো, যে সমাজের প্রচলিত নিয়মের বাইরে পা বাড়িয়ে নতুন পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। আবার নীতি-আদর্শের প্রয়োজনে ভবিষ্যৎ সাফল্যকে পায়ে ঠেলতেও সে দ্বিধা করে না। আরতি সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি একটি অনন্য নারী চরিত্র। বৃদ্ধ পিতা-মাতা পুত্র সুব্রতের (অনিল চট্টোপাধ্যায়) সংসারে থাকেন। সুব্রতের স্ত্রী আরতি। পাশাপাশি তাদের পুত্র সন্তান এবং সুব্রতের ছোট বোন বাণীও (জয়া ভাদুড়ি) এ পরিবারের অংশ। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অসচ্ছলতা দূর করতে এবং স্বামীর উপর চাপ কমানোর জন্য চাকরির সন্ধান শুরু করে আরতি। খুব দ্রূতই একটি নিটিং মেশিনের কোম্পানিতে সে সেলস গার্লের চাকরি পায়। দ্রূততম সময়ে সে এ চাকরিতেই সে আপন যোগ্যতায় ভাল করতে শুরু করে এবং চাকরির মাধ্যমে অর্জিত অর্থনৈতিক ও মানসিক স্বাধীনতাকে সে উপভোগ করতে শুরু করে। এক সময় তার স্বামীর চাকরি চলে যায়। তখন সে-ই সংসারের হাল ধরে। তার এই স্বাধীনতা এবং স্বামীর বেকারত্ব থেকে সংসারে নানা সংকট তৈরি হয়। সাংসারিক জীবনের এই সংকটময় মুহূর্তেও সে তার নীতিগত জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সহকর্মী এডিথকে তার বস অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করলে সে প্রতিবাদ জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সাংসারিক দূরবস্থা সত্ত্বেও চাকরি ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga special Mahanagar Calcutta 71


নগর জীবনের টুকরো বিষয়গুলোর রূপায়ন, পোশাক পরিকল্পনা, অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, চিত্রগ্রহণ- সবকিছুতেই এ চলচ্চিত্রে একটি আলাদা স্বাতন্ত্র্যের ছাপ বিদ্যমান। শ্বশুর-শাশুড়ী অথবা ননদের সাথে আরতির সম্পর্ক, তাদের প্রতি তার ভালবাসা দর্শকের মধ্যে পারিবারিক জীবন সম্পর্কে একটি ইতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেবে। স্বামী সুব্রত ও আরতির প্রেম-ভালবাসা, একজন আরেকজনকে বোঝার প্রচেষ্টা, নানা সংকটে আক্রান্ত হয়ে তাদের মধ্যে মানসিক দূরত্বের সৃষ্টি অথবা মায়ের চাকরি করতে যাওয়ায় পুত্রের অভিমান, তার খেলনার প্রতি আগ্রহ- প্রতিটি সূক্ষ্ম ঘটনার দৃশ্যায়নের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকারের গভীর জীবন দর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আরতির বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক শ্বশুরের তার ছাত্রদের প্রতি স্নেহ থেকে জন্ম নেওয়া প্রত্যাশা এবং ছাত্রদের বৃদ্ধ শিক্ষকের প্রতি অবহেলার অংশটুকু জীবনের জটিলতাকে দেখানোর পাশাপাশি করুণরসে দর্শক হৃদয়কে সিক্ত করবে।

এই সিনেমা এতটাই আধুনিক যে কালের হিসেবে তা আজো সমসাময়িক। আর সেখানেই এই সিনেমার বিজয়। চলচ্চিত্রটির একেবারে শেষ অংশটি প্রতিটি দর্শককের চিন্তাজগতে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। আরতির সহকর্মী এডিথকে যখন তার বস অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করে, তখন আরতি এডিথের পক্ষ নিয়ে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক তীব্র চাপের মাঝেও নিজের সততা ও আত্মমর্যাদার শক্তিতে সে প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। বসের সামনে পদত্যাগপত্রটি দিয়ে কোনো রকমে বিল্ডিংয়ের নিচে পৌঁছালেই স্বামী সুব্রতর সাথে তাঁর দেখা হয়ে যায়। স্বামীর চাকরি নেই, এ অবস্থায় সে নিজেও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। অসহায় পরিবারটির ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কাছে মনে হয় সে ভুল করেছে। কিন্তু তার স্বামী তাকে সাহস দেয়। সুব্রত বলে ওঠে,তুমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছ, সেটা কি ভুল? তুমি যা করেছ, আমি তা করতে পারতাম না। আমার সাহসে কুলোত না। রোজগারের তাগিদে আমরা ভীতু হয়ে গেছি, আরতি। কিন্তু তুমি তো হওনি। এটা কি কম হলো?


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga special Mahanagar Calcutta 71


রোজগার, স্বার্থপরতা এবং সুবিধাবাদের শৃঙ্খল ভেঙে একদল মানুষ আপন সত্যে বলীয়ান হয়ে সকল বাধা তুচ্ছ করে মহানগরের পথে নেমে আসবে, তার যথার্থ দৃশ্যায়নের মাধ্যমে পরিচালক আমাদের মাঝে গভীর আশাবাদ সৃষ্টি করেছেন। ‘মহানগর’ নগরজীবনের গভীর থেকে উৎসরিত অনন্য এক চলচ্চিত্র। নগরের এই গল্প চিরকালীন, তাই এই চলচ্চিত্রটির আবেদন কখনোই ফুরিয়ে যাবে না।

সিনেমার একদম শেষে দেখা যায় সময় এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা সুব্রত ও আরতির মাঝে এক দেয়ালের সৃষ্টি করেছিল, এমন এক সংকটের মাঝে নিমজ্জিত হয়ে মুহূর্তেই সেই দেয়াল ভেঙে পড়ল। দুজন একসাথে হয়ে তারা নতুন করে এক আলাদা শক্তি অনুভব করল। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়েও তারা ভেঙে পড়ল না। ফলে আরতি যখন সুব্রতকে জিজ্ঞেস করল, “এত বড় শহর, এত রকম চাকরি। দুজনের একজনও কি পাব না একটা?” 

সুব্রত উত্তর দিল, “চেষ্টা তো করি। আমার বিশ্বাস দুজনই পাব। শুধু চরিত্র দুটোর মধ্যে নয়, দর্শকদের হৃদয়েও গভীর আশাবাদের সৃষ্টি করে এ চলচ্চিত্রের সমাপ্তি ঘটেছে।

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga special Mahanagar Calcutta 71

কলকাতা ৭১

১৯৭১ সালের কলকাতা, কলকাতার ঝকঝকে উজ্জ্বল তরুণ প্রজন্ম ঘোষণা করেছিল ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’। আর এই মুক্তি আসতে পারে একমাত্র ‘সশস্ত্র বিপ্লব’-এর মাধ্যমে। সেই সময়টা ধরা আছে সাহিত্যে, সিনেমায় খণ্ড খণ্ড চেহারায়। তার অনেকটাই অনেকে পড়ে জেনেছেন, কেউ শুনে জেনেছেন, আর কেউ নিজের চোখে দেখেছেন। একদিকে তরুণ প্রজন্মের লড়াই আর তার কাউন্টারে পুলিশের নির্মম অত্যাচার, যা শুনলে শিউরে উঠতে হয়, ভাবলে পেটের মধ্যে হাত-পা সেঁধিয়ে যায়। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা এবং আশঙ্কার এক রক্তাক্ত ইমেজ যেন লেপ্টে রয়েছে ১৯৭১ এর কলকাতার শরীরে।

 সেই সময়ের জহর সরকার, যিনি পরবর্তী সময়ে সরকারি আমলার লেখা  ‘ইন আ ক্যালকাটা গ্রিপড উইথ নকশাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড পুলিশ ব্রুটালিটি…’তে লেখক ১৯৭১ সালে তাঁর প্রেসিডেন্সি-জীবন তুলে এনেছেন লেখায়। নৃশংস পুলিশি অত্যাচারে প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার সন্তান, ভাই এবং বন্ধু, তারই ইতিবৃত্ত এই লেখা। তিনি লিখছেন, ‘গতরাতে পুলিশ এক বন্ধুর দাদাকে তার বাড়ির কাছেই গুলি করে মেরেছে। তাই বেশিরভাগ ছাত্রই সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। শহরকে যেন ঢেকে ফেলেছে এক অঘোষিত কার্ফুর হুমকি। শহরের কোনও কোনও এলাকায় বাড়ির মা-ঠাকুমারা প্রার্থনায় বসে ঠাকুরঘরে যাতে বাড়ির ছেলেটা সাবধানে বাড়ি ফেরে, আর তারা বাড়ি ফিরলেই দরজা-জানলা সব বন্ধ। কোনও কোনও জায়গায় আলো পর্যন্ত নিভিয়ে রাখা। আর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসছে পুলিশের গুলি এবং নকশালপন্থীদের পাল্টা বোমার আওয়াজ।’

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga special Mahanagar Calcutta 71

নকশালপন্থীদের দমন করতে রাষ্ট্রশক্তির হাতিয়ার সেন্ট্রাল রিজার্ভড পুলিশের অত্যাচার ছিল নজিরবিহীন। ১৯৭০ সালের ১৯ নভেম্বর কুখ্যাত বারাসাত কিলিং-এ পুলিশের গুলিতে ১১ জন তরুণের মৃত্যু। ১৯৭১ সালের ১২ আর ১৩ অগাস্ট, বরানগর-কাশীপুরে দুদিন-দুরাত মিলিয়ে শতাধিক তরুণকে হত্যা করে পুলিশ। প্রায়শই ময়দানে পিঠে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তরুণ এবং প্রবীণ মানুষের নিষ্প্রাণ দেহ। কলকাতা এবং শহরতলির রাস্তায় প্রায় রোজ পড়ে থাকত কোনও না কোনও তরুণের গুলিবিদ্ধ মৃত শরীর। এমন উদাহরণ অজস্র। নকশাল উচ্ছেদের নামে পুলিশের অত্যাচার এমন একটা পর্যায়ে চলে যায় যা এই শহরটাকে রূপান্তরিত করেছিল এক ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’-তে। মৃতের নগরীতে। কবে যে কে লাশ হয়ে যাবে এই ভয়ে গোটা শহরটা ছিল কম্পমান।

১৯৭১ সালের এমন দিনে এক তরুণ পুলিশের তাড়া খেয়ে নকশালপন্থী যুবকদের মতো পিঠে গুলি খেয়ে ময়দানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। যুগযুগ ধরে সমস্ত শোষিত মানুষের প্রতিনিধি সে। সেই যুবকটি চলচিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন। মোট পাঁচটি ছোট গল্পের কোলাজ নিয়ে তৈরি করলেন একটি সিনেমা কলকাতা ৭১। ১৯৩৩ থেকে ১৯৭১ গল্পগুলির সময়সীমা। শুরুতেই আগের ছবি ‘ইন্টারভিউ’-এর কন্টিনিউয়েশন, যার নাম ‘বিচারালয়’। দ্বিতীয় গল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আত্মহত্যার অধিকার’। তৃতীয় গল্প ‘অঙ্গার’। লেখক প্রবোধ কুমার সান্যাল। চতুর্থ গল্প ‘এসমাগলার’। সমরেশ বসুর গল্প। পঞ্চম গল্প অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘অভিজাতদের পার্টি’।  মৃণাল সেন-এর মতে, ‘এই ছবিটা হল ক্রোধের ধারাবাহিক ইতিহাস।’ শোষণের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস, দারিদ্রের ইতিহাস নিয়ে ‘কলকাতা ৭১’ হল মৃণাল সেনের প্রথম সরাসরি রাজনৈতিক ছবি। সেই ছবির ৫০ পূর্তি আর কিছু দিনের মধ্যেই।

কয়েক বছর (প্রায় ৫বছর) কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাকে ক্যামেরাবন্দি করেন। দারিদ্রে্র ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস, শোকের ইতিহাস এসব নিয়েই কলকাতা-৭১।  এই চলচ্চিত্রটি ১৯৭২ সালে মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রতে অভিনয় করেছেন-মাধবী মুখার্জি; গীতা সেন; বিনয় রায়; রঞ্জিত মল্লিক; উৎপল দত্ত; অনুভা গুপ্ত; করুনা ব্যানার্জি; সুচিত্রা রায় চৌধুরী; অজিতেশ ব্যানার্জি; সুভাষ দত্ত; সত্য ব্যানার্জি। এই ছবিতে পলিটিকাল এনকাউন্টার হচ্ছে, পলিটিকাল কিলিং হচ্ছে। খেয়াল করার মতো, যে এগুলিকে উনি সরসরি নিজের এই ছবিতে আনতে পেরেছেন। এর জন্য যথেষ্ট সাহস লাগে। কারণ সেই একই সময়ে কলকাতা থেকে চলচ্চিত্রকাররা পালাচ্ছেন। কিংবা অন্যরকম ছবি করার কথা বাধ্য হয়ে ভাবছেন, যে ছবি সাধারণ সম্পর্কের কথা বলে ইত্যাদি। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ‘কলকাতা ৭১’ করে দেখালেন মৃণাল সেন।

মৃণাল সেনের অন্য ছবির মতো কলকাতা ৭১ সিনেমাটিও চলচ্চিত্রের বিষয়-কাহিনি ব্যষ্টিকে দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তাতে সমাজের সমষ্টির অন্যান্য প্রসঙ্গও এসে গেছে। বস্তুত ব্যষ্টিসত্তার দ্বন্দ্বকে এক বিশেষ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করেই সমাজের সার্বিক মুক্তির উপায়ের সন্ধান তিনি করে গেছেন তাঁর এই সিনেমায়।

এই প্রবণতাই তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক-প্রতিবাদী চলচ্চিত্রের প্রবক্তা হিসেবে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে।বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কাহিনির কারণেই মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের আঙ্গিক সতত নিরীক্ষাপ্রবণ। তাঁর চলচ্চিত্র নির্মিতির ধাঁচে ইতালীয় নব্যবাস্তববাদের অভ্যন্তরীণ উপকরণ ও ফরাসি নবতরঙ্গের প্রভাব পড়েছে; চেখভ্-ব্রেখট্-চ্যাপলিনের গল্প-নাটক-চলচ্চিত্র উপস্থাপনের রীতির উপস্থিতিও টের পাওয়া যায়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga special Mahanagar Calcutta 71


উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজবাস্তবতায় মানবদরদি শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি নিজের অজান্তেই স্ব-সময় ও সমাজের কথক হয়ে উঠেছেন। এই চলচ্চিত্রের শেষে কোনো একক সমাধানের সন্ধান মেলে না। তিনি দর্শকের ওপর ছেড়ে দেন সমাধান খুঁজে নেওয়ার ভার। এক বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি দর্শককে যুক্ত করেন নির্মিত চলচ্চিত্রের সঙ্গে; দর্শক পরিণত হন চলচ্চিত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। এই প্রক্রিয়ায় দর্শক তাঁদের ভাবনাবলয়ের আদলে নানামুখী সমাধানের কথা ভাবার সুযোগ পান। ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবন বিপন্ন হলে সমাজ জীবনে নেমে আসে সংকট, সেই সংকটকালীন মুহূর্তেই সবচেয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় মানুষ- ঠিক এ রকমই একটি দার্শনিক মতবাদ এই সিনেমায় তিনি ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করতেন মধ্যবিত্ত শ্রেণিই রাজনৈতিক আন্দোলনের নিয়ন ও নেতৃত্বদানকারী। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা এই চলচ্চিত্রের বিষয় হলেও তিনি কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির চেতনালোককেও বুঝতে চেয়েছেন, তাঁরাও যে নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বে ভূমিকা রাখবে, এ কথায় বিশ্বাস রেখেছেন।

মৃণালের দায় শুধু সমাজের প্রতিই নয়, শিল্পের প্রতিও। নিজস্ব শিল্পভাবনার আলোকে নব চলচ্চিত্রাঙ্গিকের সন্ধানে সর্বদাই তাই নিরীক্ষামুখর। তাঁর চলচ্চিত্রে চিহ্ন-প্রতীকের উপস্থিতি প্রবল। নান্দনিক সৌকর্যের প্রলেপ দিয়েই তিনি সমাজসত্যের স্বরূপ প্রকাশ করেছেন তাঁর এই চলচ্চিত্রে। তিনি সর্বদাই কাহিনির কৃত্রিম কাঠামো ভেঙে দিয়েছেন। বিষয়ের ভিন্নতার কারণে চলচ্চিত্রাঙ্গিক বদলেছেন। তাঁর চলচ্চিত্রে কাহিনির চেয়ে বক্তব্য ও চরিত্রের মনোজগৎ প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। টুকরো টুকরো বাস্তব দৃশ্য ও শব্দ দিয়েই বক্তব্যকে প্রকাশ করেছেন। মৃণাল সেন সময়ের তাড়া খেয়ে নিজেকে বদলে বদলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে করতে এগিয়ে গেছেন। তাঁর কলকাতা ৭১ চলচ্চিত্রের সময়কাল থেমে গেলেও তাঁর এই চলচ্চিত্রের চর্চা কখনো থামবে না।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত