| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

ভগবান আসছেন । স্বপ্নময় চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

চাইবাসা স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। জিপ। জিপের গায়ে লেখা ছিল CAP। ক্যাপ আমার সংস্থার নাম। কেয়ার ফর পিপ্‌ল। একটা এন.জি.ও.। গাড়ির সামনে দাঁড়াতেই মাথায় ক্যাপ পরা একটি ২৪/২৫ বছরের ছেলে আমাকে বলল – আপ চক্রবর্তী সাহাব? ছেলেটি নিজের পরিচয় দিল। ধরম মুন্ডা। ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমি ফিল্ড অফিসার। হিঙ্গলগঞ্জে ছিলাম। এখন বান্দোয়ানে বদলি করেছে। শুনেছিলাম ওইসব অঞ্চলে প্রচুর হো আর মুন্ডা থাকে। কিছু বীরহোড়ও আছে। জঙ্গল এলাকা। কলেজে পড়ার সময় বেতলা গিয়েছিলাম। দারুন লেগেছিল। এই পোস্টিংটা আমি অ্যাকসেপ্ট করেছিলাম।

কল্যাণ বলল – তিন সি.ডি.-র পথ। প্রথমে বুঝিনি, সি. ডি. চালিয়ে দেওয়ার পর বুঝলাম। গাড়িতে সি.ডি. প্লেয়ার লাগানো আছে। ওই পথটুকু যেতে তিনটে সি.ডি. শেষ হয়ে যাবে। প্রতিটি সি.ডি. আশি মিনিট করে চলে। হিঙ্গলগঞ্জে হেঁটে চলা মজুরদের কাছে শুনতাম কচুখালি থেকে মুগবেড়ে দশ বিড়ির পথ।

বন্দগাঁও হল, ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূম জেলায়। চাইবাসা থেকে রাঁচি যাওয়ার পথে হিরনি ঝরনা পেরিয়ে বন্দগাঁও, ওটা একটা ব্লক। একটা থানাও আছে। প্রাইমারি হেলথ সেন্টারও আছে। ওই হেল্‌থ সেন্টারের সাহায্য নিয়েই আমরা কাজ করি – ধরম মুন্ডা বলল। ধরম মুন্ডার চোখে কালো চশমা, গলায় লকেটে ক্রশ, আমি জিজ্ঞাসা করলাম – তুমি খ্রিস্টান বুঝি? ও বলল – ইয়েস।

আমি প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটাই বলছি, চাইবাসা স্টেশন থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে জিপে উঠলাম। একটা নদী পার হল। ধরম বলল – রোরো। এটাই সেই রোরো? শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় রোরো নদীর কোথা আছে। কবি সুবোধ সরকার ওর ছেলের নাম রেখেছে রোরো। কোনও কাগজে পড়েছিলাম। কিন্তু ওই শীর্ণ রুগ্ন নদীটার গায়ে কোনও কবিতা লেখা ছিল না। গদ্যময় বদ্ধ জলে দুটো মানুষ শুচু করছিল, এবং কয়েকটা শুয়োর স্নান করছিল, আর কয়েকটা পাথর অলস পড়েছিল ঝা ঝা রোদ্দুরে।

সরাইকেলা পার হওয়ার পর টোবো ঘাঁটিতে ঢুকল আমাদের গাড়ি। পাহাড় কাটা রাস্তা। আকাশে দু-চার ছিল্‌কা মেঘে মোহ রয়েছে, কিন্তু বৃষ্টি নেই। পাহাড়ের গায়ে হালকা মেঘ সানস্ক্রিন লোশনের মতো লেগে রয়েছে, কিন্তু গাছেদের পাতাদের গায়ে লেগে আছে তৃষ্ণা।  

কী রকম কবি কবি কথা বলছি দেখছেন? আমি কিন্তু ওসব লাইনে তেমন নেই। আমি মানুষের গু ঘাঁটি, জিয়াডিয়ার জীবাণু দেখি, ক্রিমির লার্ভা দেখি, পেচ্ছাপের বাইল পিগ্‌মেন্ট কিংবা ইউরিক অ্যাসিড দেখি। না, আমি ডাক্তার নই, ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান, কিন্তু প্রমোশন পেয়ে আমি এখন ফিল্ড ম্যানেজার। বান্দোয়ানে আমাদের একটা প্যাথোলজিক্যাল ইউনিট আছে।

গাড়ি যাচ্ছিল। কতরকমের গাছ। এইসব গাছের নাম আমি জানি না। কতরকমের পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছ। জঙ্গলের একটা নেশা ধরানো গন্ধ আছে, নেশা ধরানো ছায়া আছে, আর এই নেশা ধরানো রাস্তা।

সামনেই একটা মিছিল দেখলাম। না, কোনও ঝাণ্ডা নেই, ধরম মুন্ডা বলল – দেখুন স্যার, দাঃ পরব। বৃষ্টির জন্য প্রেয়ার। এ বছর এখনও বৃষ্টি নামেনি তো … গাড়িটা থামালাম।

তিরিশ/পঁয়ত্রিশ জনের মতো মানুষ, একটু পরই বুঝলাম – ওরা সবাই মহিলা। পুরুষের পোশাক পরেছে। ফুল প্যান্ট, শার্ট, লুঙ্গি, কারুর প্যান্ট খুব ঢলঢলে। দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। কেউ টুপি পরেছে, কালো চশমা-ও কেউ। ওদের সবার হাতেই একটা করে গাছের ডাল। শালগাছের। শালগাছের পাতা তো চিনি। ওরা একটা গান গাইছে।

ধরম বলল – ওরা গান গাইতে গাইতে হিরনি ঝরনা পর্যন্ত যাবে। ওই ঝরনায় স্নান করবে, ওই গাছের ডালগুলো জলে ভাসাবে, তারপর আবার গান গাইতে গাইতে অন্য পথে গ্রামে ফিরবে। একটা কম বয়সের মেয়ে, পরনে ছেঁড়া জিন্‌স গেঞ্জি, মাথায় টুপি। কাপড়ে বাঁধা সন্তান ঝুলিয়ে রেখেছে পিঠে। ধরমকে বললাম – তোমরা বোধহয় এসব রিচুয়াল করো না। ধরম বলল, আমরা তো খ্রিস্টান হয়ে গেছি, ওরা করে। ধরমকে জিজ্ঞাসা করলাম যে গান ওরা গাইছে তার মানেটা। ধরম বুঝিয়ে দিল – হে জলের দেবতা, জল দাও, কী করে খেতি বাড়ি হবে, কি করে দু’টো ভাত দেব পেটে।

একেবারে যেন সেই আল্লা, ম্যাঘ দে, পানি দে। মুন্ডারি ভাষায়।

ওই মিছিলের সবার পিছনে একজন মহিলা, সাদা লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবি পরা। পেটটা উঁচু। মনে হয় যেন গর্ভবতী। ওকে ঘিরে রেখেছে দু-তিন জন। ওর গলায় কি একটা পাতা দিয়ে গাঁথা মালা।

দুই

আমাদের অফিস বাড়িটা দোতলা, উপরের একটা ঘরে আমি থাকি। বিরাট আকাশ, আকাশের চারদিকে পাহাড়ের পাড়। হাওয়ায় গাছগুলো মাথা দোলায়। রাত্রে তারা ভরা আকাশ। বর্ষাও আসে। আকাশ জুড়ে মেঘ আর বিদ্যুতের খেলা। বর্ষা ভেজা গাছেদের  গা থেকে আলাদা গন্ধ বের হয়। যা হিঙ্গলগঞ্জের নোনা গন্ধ থেকে আলাদা।

এসব ভাল বর্ণনা করতে পারেন বুদ্ধদেব গুহ। আমি এই ব্যাপক বনবৃত্তান্তের কথা বোঝাতে পারব না। বন কথাটা লেখার পর বনরাজি লিখতে ইচ্ছা করছে। আর মহিমা কথাটাও বেশ ভাল। শুধু বলতে পারি ওই বনরাজির মহিমায় আমি ইয়ে। ফিদা। ধ্যুৎ। ফিদা এখানে মানায়?

যে রাস্তাটা রাঁচির দিকে চলে গেছে, ওই রাস্তায় কলকাতা বা টাটা থেকে ট্রাক ভর্তি ডিটারজেন্ট, কসমেটিক, গারমেন্টস, ইলেকট্রনিক্স, এইসব কত কিছু যায়। বন্দগাঁও সেই দ্রুত ধাববান শকটগুলির হাওয়া পায় শুধু, কালো ধোঁয়া পায়, এইসব লে ল্যান্ড, মাহিন্দ্র, টাটা, টয়োটোদের জন্যই এই জঙ্গলে পাকা রাস্তা। এরা গোঁ গোঁ করতে করতে রাঁচি, হাজারিবাগ, রৌরকেল্লার দিকে ছোটে যখন, এদিকের পথচলতি মানুষেরা ভয়ে জঙ্গলের ধারে, পাহাড়ের গায়ে সরে যায়। ওরা শুধু কালো ধোঁয়া পায়, যন্ত্রশব্দ পায়। আর রাতে বুনো ফল পিচ রাস্তায় পড়ে গেলে সকালের ট্রাকের টায়ার ওগুলোকে তো পিষে দেবেই। আমরা ভেবে করব কী …।

বন্দগাঁওতে কয়েকটা দোকান আছে। চা, সিঙ্গারা, পকোড়া, গজা, ধোস্‌কা এসব পাওয়া যায়। ধোস্‌কা হল চাল আর ডাল বেটে গোলা করে তেলের মধ্যে ভাজা। গরম গরম বেশ লাগে। একটা হোটেলও আছে। ট্রাক ড্রাইভাররা খায়। এখানে শনি-মঙ্গলবারের হাট বসে। তরি-তরকারি খুব সস্তা। ভাগা করে বিক্রি করে অনেকেই। দাঁড়িপাল্লা কেনার পয়সাটাও খরচ করতে পারে না অনেকে। আমি তো রান্না করেই খাই, তাই হাটে যাই।

সাদা ধুতি আর গলায় পৈতে পরা একজন লোক কাঁঠালের বিচি বিক্রি করছিল। দু’টাকা ভাগা। দু’টাকায় অনেকটা, যদিও কাঁঠাল-বিচি খেতে ভালবাসি। কিন্তু একা লোক, এত কি হবে? শুকিয়ে যাবে, ফাঙ্গাস পড়ে যাবে। আমি দু’টাকাই দিলাম। কিন্তু ভাগের অর্ধেক নিলাম। ও বলল – এক টাকায় বিক্রি নেই, ভাগটাই নিতে হবে। আমি বোঝালাম আমি দু’টাকাই দিচ্ছি। টাকা আমি কম দেব না, দু’টাকাই দেব, কিন্তু নেব অর্ধেকটা। ও রাজি হল না। জোর করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল। ভাঙা হিন্দিতে বোঝাবার চেষ্টা করল অধর্ম করতে পারবে না।

ওর গলায় পৈতে দেখে আমি ওকে ব্রাহ্মণ ভেবেছিলাম, এই আদিবাসী এলাকায়, এই জঙ্গলে কাঁঠালের দানা বেচা এই দরিদ্র সরল ধার্মিক ব্রাহ্মণকে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম – আপ ব্রাম্‌হণ হ্যায়?

ও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। যেন ব্রাহ্মণ শব্দটা শোনেনি। আমি ওর পৈতেটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – ব্রাম্‌হণ? ব্রাম্‌হণ? ও বলল, নেহী জী, হাম বিরসাইত।

তিন

বিরসাইতরা হল বিরসা মুন্ডার … কী বলব? অনুগামী? টর্চ বেয়ারার? ফলোয়ার? ঠিক বোঝাতে পারছি না। বিরসাইতরা বিরসা মুন্ডাকে ভগবান বলে মানেন। এবং মনে করেন মুন্ডাদের মুক্তির জন্য তিনি মুন্ডাদের কাছেই ফিরে আসবেন।

বিরসাইত কথাটা প্রথম শুনলাম আমি এখানে। তবে বিরসা মুন্ডার নাম তো কবে থেকেই জানি। মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরন্যের অধিকার’ নামে একটি বইয়ের কথা জানি। বিরসাকে নিয়ে লেখা। পড়িনি। এখানে এসে দেখছি স্থানীয় বাসের গায়ে লেখা বিরসা ভগোয়ান। একটাই ওষুধের দোকান আছে, বিরসা ফার্মেসি। এখানে দু-একজনের গলায় বিরসা গান শুনেছি – “উলিহাতুরে জনম নেলা বিরসা ভগোয়ান”। তাঁর বীরত্ব গাঁথা নিয়ে এখনও এ অঞ্চলের মানুষ গান গায়।

ধরম মুন্ডার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি। একবার রাঁচি গিয়েছিলাম, ওখান থেকে কুমার সুরেশ সিং-এর লেখা একটা বই কিনে নিয়েছিলাম। বিরসার জীবন কথা। বইটা পড়ে নিলাম। বুঝলাম আমি এখন যেখানে আছি, এটাই ছিল বিরসার কর্মক্ষেত্র। এই বন্দগাঁওকে কেন্দ্র করে তিরিশ-চল্লিশ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিরসা কাজ করেছিলেন। মানুষের মুখে গান শুনেছি, বিরসা উলিহাতুতে জন্মেছিলেন, চালকাদে বড় হয়েছিলেন, ডোম্বারুবুরুতে লড়াই করেছিলেন, আর ভগবান হয়েছিলেন বন্দগাঁও-এ। বিরসা ভগবানের সৈন্য-সামন্তরাই হল এই বিরসাইয়ত।

এই জায়গাটা কোলহান ক্ষেত্র। মানে কোলদের এলাকা। এখানে গ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করে গাঁয়ের মাঝি এবং এর সঙ্গে কয়েকটা গ্রামের নিয়ন্ত্রক মানকি। এই মাঝি-মানকি প্রথায় অনেকদিনের। গ্রামের অনেকটা জমিই থাকত যৌথ মালিকানায়। ব্রিটিশরা এই নিয়মকে ভেঙে দিল। ব্যক্তিগত খাজনার নিয়ম করল। মিডলম্যান এল, নানা ধরনের কর্মচারী এল বাইরে থেকে, বিভিন্ন আড়কাঠিগুলো চা-বাগান, সুন্দরবন এসব এলাকার কাজের জন্য শ্রমিক জোগাড় করে বাইরে পাচার করতে লাগল। এই সময় বিরসার জন্ম হয়। ১৮৭২ সালে।

আমার প্রজেক্টের কাজে অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়। উলিহাতুতে গেলাম। উলি মানে আম, হাতু মানে বসতি। এখন ওখানে তেমন আম গাছ নেই আর। উলিহাতু ছিল বিরসার পৈতৃক বাড়ি। ওখানে একটা মন্দির মতো করা আছে, বিরসার মূর্তি আছে। মূর্তির তলায় লেখা বিরসা ভগোয়ান। মন্দিরের উদ্ধোধক এক মন্ত্রীর নাম বিরসার নামের চেয়েও বড় হরফে লেখা। একজন পাহান রোজই ধুপধুনো দিয়ে বিরসা ভগবানের পুজো করে।

কুমার সুরেশ সিং-এর বই থেকে জেনেছিলাম বিরসার বাবা সুগনা মুন্ডা এই গ্রাম ছেড়ে চলে যান চালকাদ। বিরসার মা তখন গর্ভবতী। চালকাদের কাছে বামবা গ্রামে বিরসার জন্ম হয়। বিরসার মা তখন জঙ্গলে কিছু কুড়োতে গিয়েছিলেন। ওখানেই গর্ভযন্ত্রণা এবং প্রসব। জন্মনাড়ীসমেত বিরসাকে পাতায় জড়িয়ে নিয়ে আসে চালকাদে। নাড়ি কাটা হয়। বিরসার জন্মনাড়ি যেখানে মাটিতে পোঁতা হয়েছিল, সেখানে একটা পাথর রাখা আছে দেখেছি। একা, কিন্তু উদ্ধত।

চালকাদ থেকে উলিহাতুতে ফিরে আসে বিরসার পরিবার। বিরসার বাবা খ্রিস্ট ধর্ম নিলেন। বিরসাকে লেখাপড়া শেখাতে চাইলেন। উলিহাতুতে স্কুল ছিল না। বিরসার মামাবাড়ি আয়ুবহাতুতে চলে এলেন বিরসা। ওখানেই স্কুলে ভর্তি হলেন, ওই স্কুলটা আমি দেখেছি। ওই স্কুলের টালির চাল ধারন করার জন্য শাল কাঠের আড়া আছে। ওটা বিরসাই নাকি উপরে উঠিয়েছিলেন দশ বছর বয়সে। এরকম গল্প তো তৈরি হতেই পারে। বিরসার মামাবাড়িতে যখন গিয়েছিলাম, কয়েকটা লোক রুগড়া পরিষ্কার করছিল। রুগড়া হল এক ধরনের ছত্রাক। সুস্বাদু। ভিটেতে শুয়োর চরছে। খুব উদাসভাবেই বলেছিল – আমরা হলাম পান্ডু মুন্ডার নাতি। পান্ডু মুন্ডা ছিল বিরসার মামা।

এরপর তো বিরসা চাইবাসার জার্মান মিশনারি স্কুলে ভর্তি হলেন। কোনও এক মিশনারি সাহেব বলেছিলেন আদিবাসীরা অসৎ। সেই মিশনারিকে আক্রমণ করেন বিরসা। যেন ওই ওটেন সাহেব এবং নেতাজি। ফলে ওই স্কুল থেকে বিতারিত হলেন বিরসা। এরপর উলিহাতুতে কিছুদিন থাকেন, তারপর চলে আসেন বন্দগাঁওতে। ১৮৯১ সালে।

বন্দগাঁও-এর রাজার মুন্‌সি ছিলেন আনন্দ পাঁড়ে। বিরসা তার সঙ্গে দেখা করেন। সেই সময় মুন্ডাদের এইট পাশ খুব কমই ছিল। বিরসা ওর সেরেস্তায় একটা চাকরি পেয়ে যান। আনন্দ পাঁড়ের সঙ্গে থেকে বিরসা রামায়ন-মহাভারত-পুরাণ-বৈষ্ণব শাস্ত্র এসব পড়েন, বোঝার চেষ্টা করেন। বিরসা এবার ব্রাহ্মণদের মতো পৈতে নিলেন, তুলসি পুজো করতে থাকলেন। আদিবাসী মুন্ডারা তাকে সমীহ করতে থাকল। উনি ক্রমশ ধর্মগুরু হয়ে পড়লেন। কিছুটা খ্রিশ্চিয়ানিটি, কিছুটা শরনাধর্ম – মানে মুন্ডাদের প্রাচীন ধর্ম, কিছুটা হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ মিলেমিশে বিরসা ধর্ম তৈরি হল। এই ধর্মে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখাটাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হল। সেবা ধর্ম, সংঘবদ্ধ প্রার্থনা, অনুতাপ করা এসব খ্রিস্টধর্ম থেকে পাওয়া। শুদ্ধ জীবনযাপন, মদ খাওয়া নিষেধ করলেন। বাড়িতে তুলসিগাছ লাগাতে বললেন। এসব হিন্দু ধর্ম থেকে নিলেন। পরিশ্রমী হতে বললেন। এই নতুন বিরসা ধর্ম অনেকেই মানতে শুরু করল। এরাই বিরসাইয়ত। বিরসাইয়তরা বিরসাকে খ্যাত করল ‘ধরতী আবা’ বলে। মানে বিশ্বপিতা।

এখানে আসার আগে বিরসা সম্পর্কে আমার একটা ওয়ারিয়র ইমেজ ছিল। যোদ্ধা। কিন্তু এখানে এসে মনে হল বিরসা যতটা যোদ্ধা, তারচেয়ে বেশি ধর্মগুরু।

বিরসাকে কেন্দ্র করে নানা অলৌকিক গল্প আছে। স্পর্শে রোগারোগ্য অন্ধের দৃষ্টি ফেরানো – যিশুর মতো এরকম কিছু অলৌকিক গল্প ওর নামে প্রচলিত আছে। এমন কিছু ভবিষ্যৎবাণীও করেছিলেন, যা ফলে গেছে। বিরসা ভগোয়ান যা বলবেন, তাই সত্যি হবে এমন একটা বিশ্বাস তৈরি হয়ে গেল ১৮৯৫/৯৬ সালে মুন্ডাদের মধ্যে।

মুন্ডা সর্দারদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। মাঝি মানকি নির্ভর প্রশাসন আক্রান্ত হচ্ছিল। বিরসা বললেন – আংরেজ তাড়াও, দিকু তাড়াও, আমরাই জিতব। মুন্ডারাজই কায়েম হবে। বিরসা ভগোয়ান বলেছেন সুতরাং মুন্ডারাজ আসবেই – এই বিরসা-বিশ্বাসে লড়াই শুরু হয়ে গেল। বিরসা ঘোষণা করে দিলেন – আমিই রাজা।

এরপরের ঘটনা সবাই জানেন। ১৮৯৯ সালে ডোম্বরুবুরুতে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ। প্রচুর মুন্ডা মারা যায়, ১৯০০ সালে বিরসা ধরা পড়েন রোগত নামে একটি গ্রাম থেকে।

পাঠক ভাবছেন, এতক্ষন তো বিরসার জীবনকাহিনী বলা হল। গল্প কোথায়? বলব।

চার

সরকারি হাসপাতালের তথ্য থেকে জানতে পেরেছিলাম যে কয়েকটা গ্রামে পাল্‌স পোলিও প্রোগ্রাম ফেল করেছে। পোলিও টিকা খাওয়ানো যায়নি। গ্রামের মানুষ আপত্তি করেছে। একদিন ঠিক করলাম রোগত যাব। ধরমও সঙ্গে যাবে।

বন্দগাঁও থেকে ১৫ কিলোমিটার দুরে রোগত। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কাঁচা রাস্তা। ওই রাস্তা বেয়ে মাথায় কাঠ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গুলে মানুষ। বন্দগাঁও-এর হোটেলে বিক্রি করবে। একটা মানুষ খুব বেশি হলে কুড়ি কেজি কাঠ বইতে পারে। কুড়ি কেজি কাঠের দাম কুড়ি-পঁচিশ টাকা। এজন্য কত বোঝা নিয়ে এতটা পথ যেতে হয়।

রোগত পৌঁছালাম। ছেঁড়া-খোঁড়া গ্রাম। ভেঙে যাওয়া বাড়ি-ঘর, গাঁয়ের মানুষের পরনে সাদা কাপড়। মেয়েরাও সাদা শাড়ি পড়ে আছে। বিরসাইতদের গ্রাম।

ধরম গাঁ মুন্ডার খোঁজ করে নিয়ে এল। গলায় পৈতে, হাঁটুর উপর সাদা কাপড়, বয়স মনে হল পঞ্চাশের ওপর। সেই কাঁঠাল দানা বেচা লোকটা না? আমি জিজ্ঞাসা করলাম – বন্দগাঁও হাটে কাঁঠাল দানা বিক্রি করতে গিয়েছিলে? চিনতে পারছ? ধরম অনুবাদ করে দিল মুন্ডারিতে। লোকটা চিনতে পারল। বলল, জোহার, জোহার।

আমাদের জিপ গাড়ি গাঁ পর্যন্ত যেতে পারেনি। একটু দুরেই ছিল। কয়েকটা বাচ্চা ওদিকে ভিড় করেছে। একটা সাহসী ছেলে একবার হর্ন টিপে দিয়েই অপরাধ করেছে ভেবে ছুটে পালাল।

আমরা একটা বাড়ির উঠানে। উঠানের এক কোণে একটা বেদিতে তুলসিগাছ। একটা মরাগাছের ভেঙে পড়া ডালের উপরেই বসেছি। গাঁ মুন্ডা জিজ্ঞাসা করল আমাদের আগমনের হেতু কী? ধরম ওদের সঙ্গে মুন্ডারি ভাষাতেই কথা বলছে। মাঝে মাঝে ও আমাকে সেই কথাবার্তার অংশ বলে দিচ্ছিল। ওইসব কথাবার্তা থেকে যা বুঝলাম, তা এলোমেলো ভাবে এরকম – এই গ্রামটা একদিন বিখ্যাত হবে। কারণ ধরতী আবা এই গ্রামেই জন্ম নিচ্ছেন আবার। বিরসা বলেছিলেন – আমি এক শুদ্ধ পবিত্র গ্রামেই ফিরে আসব।

আমরা সবাই শুদ্ধ। পবিত্র। আমরা নেশা-ভাং করি না। আমরা সাদা কাপড় পরি। গলায় পৈতে রাখি। আমরা হাটে গিয়ে কোন কুখাদ্য খাই না। নিজেরা সঙ্গে করে খাবার নিয়ে যাই, নইলে চিড়ে মুড়ি খাই। আমাদের বাচ্চাদেরও সেই শিক্ষা দিই। আমরা আমাদের শিশুদের পোলিওর টিকা খাওয়াই না।

এটা শুনে আমি চমকে যাই। প্রশ্ন করি পোলিওর টিকা কী দোষ করল?

ধরম অনুবাদ করে দিচ্ছে।

উত্তর শুনলাম পোলিওর টিকা কোন দোষ করেনি। কিন্তু কে খাওয়াচ্ছে, কোন জাতের লোক খাওয়াচ্ছে তার কোনও ঠিক আছে?

চমকে যাই। কী বলছে? কোথায় ঢুকেছে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র? এভাবেই এঁরা নিজেদের উত্তরণ ঘটাচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদের কাছাকাছি এসে?

জিজ্ঞাসা করি তোমরা কি নিজেদের ব্রাহ্মণ মনে করো?

উত্তর আসে, না। আমরা নিজেদের বিরসাইয়ত মনে করি। ধরতী আবার প্রজা। ধরতী আবার আদেশ পালন করি। এই তো তুলসিগাছ। সব ঘরে ঘরে তুলসিগাছ আছে। গ্রামে কোনও ভাটিখানা নেই। এই যে আমাদের সাদা কাপড়। মাথায় পাগড়ি এখন নেই অবশ্য। কিন্তু বৃহস্পতিবার দিন মাথায় পাগড়ি পরি। ওটা শুক্রবার। ওই দিন আমাদের গুরু বিরসা মহারাজ পৃথিবীতে এসেছিলেন। পবিত্র দিন। এই দিনে আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করি। এই দিন সাড়া সপ্তাহের পাপের জন্য অনুতাপ করি। ওই যে বড় শালগাছটা, ওই শালগাছের তলায় দাঁড়াই আমরা। অনুতাপ করি। তারপর ধরতী আবার পুজো করি। না, ফুল বেলপাতায় নয়, ধ্যানে। বিরসা ভগোয়ানকে ডাকি। বলি হে ভগবান, এসো, আমাদের রাজা হও। আমাদের মুন্ডারাজ কায়েম হোক। না, বিরসার কোনও ফটো নেই আমাদের কাছে। একটা ফটো ছিল চেট্টি মুন্ডার কাছে। উঁইপোকা লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা বিলাস করি না। বিলাস করব যেদিন ধরতী আবা ফিরে আসবেন। বান্দোয়ানের রাজার উপর আমাদের খুব রাগ। ওই ভাঙ্গা রাজবাড়িটার দিকে পাথর ছুঁড়ি আমরা। কারণ বান্দোয়ানের রাজাই আমাদের রাজাকে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

ধরতী আবা ধরা পরেছিলেন দুরের ওই পাহাড়টায়। ধরা পড়ার পর আমাদের আদেশ দিয়েছিলেন। দশ আদেশ।

কাজ কর।

সৎপথে চলো।

মদ খেও না।

চুট্টা তামাক বিড়ি খেও না।

ব্যাভিচার কর না।

প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাব রাখ।

একসঙ্গে প্রার্থনা কর।

পাপ স্বীকার কর।

তুলসিগাছ পুজো কর।

আমার উপর বিশ্বাস রাখ।

আমরা বিরসাইয়ত। রাজার আদেশ পালন করি। বিরসাইয়তরা সবাই স্বর্গে যাবে। ধরতী আবা সমস্ত বিরসাইয়তদের স্বর্গে নিয়ে যাবে। আমাদের রাজা আসছেন। আমাদের প্রার্থনার মন্ত্র হল হে ধরতী আবা, আমাদের পথ দেখাও। তোমার আদেশের অপেক্ষায় বসে আছি হে। সেগুন গাছ, শাল গাছগুলো বুড়ো হয়ে গেল, এখনও তোমার দেখা পেলাম না। তুমি এসো, তুমি এসো। তুমি এসো ……!

ধরতী আবা আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন। তিনি আসছেন। এই গ্রামেই তিনি আসছেন।

কাঁঠাল বিক্রি করা সেই খালি গায়ের গাঁ মুন্ডা এবার দু’হাত তুলেছিল আকাশের অলৌকিকে। তারপর চোখ বুঁজে কিছু বলল।

ধরম আমায় বলল – ও বলেছে, বিরসা মুন্ডা আসছেন তার স্ত্রীর গর্ভে। যিশু যেমন জন্মেছিলেন বিনা সঙ্গমে। ওর স্ত্রী এখন গর্ভবতী। বিরসা স্বপ্নে বলেছেন তিনি এখানেই আসছেন। তাঁর স্ত্রীর গর্ভে।

লোকটা বলল – জানি না তোমারা বিশ্বাস করবে কিনা। একদিন আকাশ থেকে বৃষ্টি হল। সেই বৃষ্টির জলে সুগন্ধ। সেই রাতেই একটা আশ্চর্য আলো নামল আমার ঘরে। তাঁর কিছুদিন পরেই আমার স্ত্রী গর্ভবতী হল। আর স্বপ্নে ধরতী আবা আমাকে বললেন – দেখতে চাও, দেখতে চাও আমার পুণ্যবতী স্ত্রীকে?

ধরম বলল – চলুন। আমরা হাতজোর করে গাঁ মুন্ডার ঘরে ঢুকলাম। মাটির ঘর। বাঁশের গায়ে মাটি লেপে দেওয়াল তৈরি। ওখানে একটা খাটিয়ায় শুয়ে আছেন এক মহিলা! পেটটা বেশ বড়।

মুখটা চেনা লাগল, দেখেছিলাম। বৃষ্টির জন্য প্রার্থনার মিছিলের সেই মহিলা, দু-আড়াই মাস আগে যাকে দেখেছিলাম।

পাঁচ

বান্দোয়ানের প্রাইমারি হেলথ্‌ সেন্টারেই তখন আমি ছিলাম, যখন মাচা করে একটা রোগিণী এল। ভিতরের গ্রাম থেকে এভাবেই রোগী আসে। দেখলাম রোগত গ্রামের সেই গাঁ-মুন্ডা এবং তাঁর কয়েকজন সঙ্গী। মাচায় ওর স্ত্রী। একটা চাদরে ঢাকা। চাদরে রক্ত।

হাসপাতালে ভর্তি করা হল। খুব ব্লিডিং হচ্ছে। ডাক্তার বললেন মনে হচ্ছে টিউমার। ইউটেরাসে। এখানে কিছু হবে না। রাঁচি পাঠানো দরকার।

অ্যাম্বুলেন্স খারাপ ছিল। আমাদের জিপে করেই কোনওরকমে রাঁচির সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হল। ধরম মুন্ডাও সঙ্গে গেল। ধরমের স্ত্রী রাঁচির সরকারি হাসপাতালেরই নার্স।

অপারেশন হয়েছিল। বিরাট এক মাংসপিণ্ড বের করা হয়েছিল। অপারেশনের পর জ্ঞান ফেরেনি আর মহিলার।

এই ঘটনার পর আরও তিন মাস কেটে গেছে। একদিন তিনজন সাদা পোশাকের মানুষ এল আমাদের হাসপাতালে। রোগত গ্রামের সেই গাঁ মুন্ডা, সঙ্গে দু’জন পাহান। আমরা তখন বেরোচ্ছিলাম। জিপে বসেছিলাম। গাঁ মুন্ডা হাতজোড় করে ধরমকে কিছু বলল। ধরম খুব উত্তেজিত হয়ে কিছু বলল। মুন্ডারি ভাষা কিছুই বুঝি না আমি। মিনিট দশেক ধরে কথাবার্তা হল। তারপর ওরা জোহার বলে চলে গেল।

ধরম মুন্ডা আমাকে বলল – বুঝলেন স্যার, একেবারে বাইবেল থেকে উঠে এসেছিল লোকগুলো। জ্ঞানী পুরুষ। আমাকে বলল, আমার স্ত্রীর গর্ভেই নাকি ধরতী আবা আসছেন। মুন্ডাদের সুসময় আসছে এবার। আর আপনাকে বলা হয়নি, আমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। স্যার, আমি এখন গাড়ি চালাতে পারব না স্যার। আমার কেমন যেন করছে। কেমন যেন হর্নের শব্দ শুনতে পাচ্ছি চারপাশে।

আপনি পাচ্ছেন স্যার?

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত