[আমাদের পুরাণগুলিতে, মহাভারতে, কৃষ্ণকথা আছে। রাধাকথা এসেছে আরও অনেক পরে। তবে কী কৃষ্ণ নিছক পৌরাণিক চরিত্র? সম্পূর্ণ কাল্পনিক? আমার তা মনে হয় না। রামায়ণের উপর কাজ করতে গিয়ে আমার সে কথা মনে হয়েছে। ময়মনসিংহের গৌরব, ‘সৌরভ’ পত্রিকা সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারের ‘রামায়ণের সমাজ’ বইটি সম্পাদনা করতে গিয়ে সে দিকে আমার দৃষ্টি পড়ে। কলকাতার এডুকেশন ফোরাম আমার সে বই প্রকাশ করেছেন। কেদারনাথই বলেছেন, তিন/চার হাজার বছর আগে মানুষের মৌলিক কল্পনাশক্তি এত প্রখর ছিল না, যাতে পূর্ণাঙ্গ রামকাহিনি লেখা যায়। অন্যদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক শ্লীম্যান প্রমাণ করেছেন যে হোমারের লেখা মহাকাব্যের বস্তুভিত্তি আছে, যখন ট্রয়ের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেল। নিরপেক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হলে রামকথা ও কৃষ্ণকথারও বস্তুভিত্তি পাওয়া যেত বলে আমাদের ধারণা। দুঃখের বিষয়, আমাদের গবেষণাক্ষেত্রেও ঢুকে গেল রাজনীতি; বাল্মীকির ‘পুরুষোত্তম রাম’ হয়ে গেলেন বিষ্ণুর অবতার, তারপর তিনি হয়ে গেলেন হিন্দুত্ব প্রচারের হাতিয়ার। কৃষ্ণকথাও একদিন রাজনীতির হাতিয়ার হবে। আমরা শুনেছি সমুদ্রগর্ভ থেকে দ্বারাবতীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। তারপরের কাজ আর এগোয় নি। যাঁরা রামচন্দ্রকে মানুষ হিসেবে দেখতে দেবেন না, তাঁরাই এরপরে কৃষ্ণকে নিয়ে পড়বেন, তাঁর মানবত্বকে আড়াল করে দেবত্ব প্রচার করবেন।
আমাদের এই কৃষ্ণকথায় আমরা মানুষ কৃষ্ণকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তাই পরে পরে গড়ে ওঠা নানা অলোকিক প্রসঙ্গের লৌকিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো। ‘ইরাবতী’র পাঠকরা লেখাটি পড়ে মতামত দিলে খুব ভালো লাগবে। নিন্দা বা প্রশংসা নয়, আমি সমালোচনার ভক্ত বরাবর।]
মর্মান্তিক এক সংবাদ কানে এল কৃষ্ণের।
কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডব অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। কৃষ্ণ জানতেন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা পাণ্ডবদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ। কিন্তু এ ভাবে যে তাঁরা পাণ্ডবদের প্রাণনাশ করবেন, সে কথা কল্পনা করতে পারেন নি কৃষ্ণ।
ঘটনার বিবরণ শুনলেন তিনি।
কৌরবরা বারণাবতে এক জতুগৃহ নির্মাণ করেছিলেন। লাক্ষা, গালা প্রভৃতি দাহ্যবস্তু দিয়ে সে গৃহ নির্মিত। কিন্তু বাহিরের দিক থেকে দেখলে মনে হবে সে এক সুরম্য শান্তির নীড়। শিব চতুর্দশীর উৎসব উপলক্ষে ধৃতরাষ্ট্র সেখানে প্রেরণ করেন পাণ্ডবদের। পাণ্ডবরা এ সব ষড়যন্ত্রের বিন্দু বিসর্গ জানতেন না। সে গৃহে রাত্রিকালে পাণ্ডবরা নিদ্রিত হলে পরিকল্পনামতো পুরোচন অগ্নি সংযোগ করেন। সেই অগ্নিতে কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডব দগ্ধ হয়ে যান।
বিবরণ শুনলেন কৃষ্ণ। মর্মাহত হলেন। কিন্তু তাঁর মনে একটা সংশয় দেখা দিল। কি করছিলেন পাণ্ডববন্ধু বিদূর ? তিনি কি কিছুই জানতেন না? জানলে প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করেন নি কি! প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য কৃষ্ণ তাঁর গুপ্তচর প্রেরণ করলেন।
অনতিবিলম্বে গুপ্তচর প্রকৃত ঘটনার বিবরণ হাজির করল।
বিদূর দুর্যোধনদের পরিকল্পনার কথা অবগত হয়ে সে কথা গোপনে পাণ্ডবদের জানান। শুধু তাই নয়, তিনি জতুগৃহ থেকে সংগোপনে পলায়নেরও পরিকল্পনা করেন। তদনুযায়ী অগ্নি সংযোগের দিন রাত্রিকালে পুরোচনকে একটি কক্ষে অবরুদ্ধ করে রেখে, গৃহে অগ্নি সংযোগ করে গুপ্তপথ দিয়ে পলায়ন করেন পাণ্ডবরা। কিন্তু তাঁরা জানতেন না যে সেদিন এক ব্যাধ রমণী তাঁর পঞ্চপুত্রকে নিয়ে জতুগৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
ব্যাপারটা শাপে বর হয়। কারণ কৌরবরা ছয়টি ভস্মীভূত দেহ দেখে সিদ্ধান্ত করেন যে কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডব নিহত হয়েছেন জতুগৃহে।
আরো পড়ুন: রাধাকৃষ্ণপ্রেমের দ্বিতীয় কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (পর্ব-৫)
এদিকে পাণ্ডবরা ছদ্মবেশ ধারণ করে একচক্রপুরের এক ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখান থেকে তাঁরা যান এক কুম্ভকারের গৃহে। এ কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন কৃষ্ণ। ছদ্মবেশী পাণ্ডবদের সঙ্গে তাঁর নাটকীয়ভাবে দেখা হল দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায়।
দ্রৌপদী হলেন পাঞ্চালরাজ যজ্ঞসেনের কন্যা যাজ্ঞসেনী। দ্রুপদ নগরে তাঁর স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেছেন তাঁর পিতা যজ্ঞসেন। স্বয়ংবরের শর্ত বড় কঠিন। মাটির উপরে এক স্ফটিকপাত্রে আছে জল। ঠিক তার উপরে এক ঘূর্ণায়মান চক্রের ভিতরে আছে একটি মৎস্য। জলে তার ছায়া দেখে শর নিক্ষেপপূর্বক যে মৎস্যটির চক্ষু বিদ্ধ করতে পারবে, সেই লাভ করবে যাজ্ঞসেনীকে।
ধনুর্বিদ্যায় সবিশেষ পারদর্শিতা ব্যতীত এ কাজ সম্ভব নয়।
চতুর কৃষ্ণের মনে হল এই কঠিন প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাই তিনি দাদা বলরাম ও কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে হাজির হলেন দ্রুপদে। সভায় ঢুকে তিনি সতর্ক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন চারদিক। ব্রাহ্মণদের মধ্যে দু জনকে দেখে সন্দেহ হল। মনে হল এঁরাই বোধ হয় ভীম আর অর্জুন।
শুরু হল স্বয়ংবর সভা।
একে একে লক্ষ্যভেদের জন্য অগ্রসর হতে লাগলেন সদস্যরা। কিন্তু ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে লাগলেন। যাঁরা লক্ষ্যভেদ করতে আসছিলেন, দ্রৌপদীর ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। এভাবে কর্ণ এসে দাঁড়ালেন রঙ্গমঞ্চে। কিন্তু দ্রৌপদী জানিয়ে দিলেন যে সুতপুত্রকে তিনি বরমাল্য দিতে পারবেন না, তার চেয়ে বরং মৃত্যুই কাম্য তাঁর। সে কথা শুনে কর্ণ শরাসন ত্যাগ করে ফিরে গেলেন।
আর কোন ক্ষত্রিয় অংশগ্রহণ করতে চাইলেন না।
তখন ডাক পড়ল ব্রাহ্মণদের । উঠে দাঁড়ালেন ছদ্মবেশী অর্জুন। তাঁকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ক্ষত্রিয়রা তিরস্কারের বন্যা বইয়ে দিল। অবিচলিত অর্জুন ধীরেধীরে মঞ্চে উঠে গ্রহণ করলেন শরাসন। কৃষ্ণ তখন অভিনিবেশ সহকারে তাকিয়ে আছেন সেই ব্রাহ্মণের দিকে। জীর্ণ পোশাকের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। এই দৃপ্ত ভঙ্গিমা অর্জুন ব্যতীত আর কারোর হতে পারে না। এবার নিঃসংশয় হলেন কৃষ্ণ।
চক্ষু বিদ্ধ হয়েছে মৎস্যের। কিন্তু উপস্থিত রাজন্যবর্গ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এক সামান্য দরিদ্র ব্রাহ্মণ লাভ করবে বরমাল্য। এ যে মর্কটের গলায় মুক্তার হার! কিন্তু দ্রৌপদী সেই ব্রাহ্মণের গলায় দিয়েছেন বরমাল্য।
এ যে অসহনীয়!
তাঁরা তখন বলপূর্বক দ্রৌপদীকে হরণ করতে চাইলেন। তাঁদের শান্ত করলেন কৃষ্ণ। তাঁদের তিনি বোঝালেন ব্রাহ্মণ কোনভাবেই দায়ী নন, কোন অন্যায় তিনি করেন নি, নিয়মের পথেই তিনি জয় করেছেন, এর মধ্যে কোন ছল–চাতুরি ছিল না।
সমাপ্ত হল স্বয়ংবর সভা।
বীর্যশুল্কে লব্ধা দ্রৌপদীকে নিয়ে চলে গেলেন অর্জুন। একবার বোধহয় তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হল কৃষ্ণের। কি ছিল সেই দৃষ্টিতে? কৌতুক? তাহলে এই পাঁচ ব্রাহ্মণই পঞ্চপাণ্ডব? কৃষ্ণ আরও নিশ্চিত হতে চান। তিনি তাঁর এক দূতকে পাঠালেন গুপ্তভাবে ব্রাহ্মণদের অনুসরণ করতে।
দূত এসে খবর দিল কৃষ্ণের অনুমান সঠিক। ভার্গব নামে এক কুম্ভকারের গৃহে আশ্রয় নিয়েছেন পাণ্ডবরা।
দাদা বলরামকে নিয়ে কৃষ্ণ এলেন ভার্গবের গৃহে। দেখা হল পিতৃস্বসা কুন্তী ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে। দ্রৌপদীকে নিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, সে কথা কুন্তী জানালেন কুন্তীকে। অর্জুন লাভ করেছেন দ্রৌপদীকে ; কিন্তু জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির ও ভীম যে অবিবাহিত। তাছাড়া নকুল আর সহদেবের কথাও ভাবতে হবে।
কৃষ্ণ দেখলেন এক নারীকে কেন্দ্র করে বিনষ্ট হতে পারে ভ্রাতাদের সংহতি। তাই তিনি উল্লেখ করলেন আঞ্চলিক রীতির কথা। এক পরিবারের একাধিক সহোদরের এক পত্নীর স্বামীত্বলাভের রীতির কথা। কুন্তী সম্মত হলেন। তাঁর সন্তানরাও সম্মতি জানালেন।
কৃষ্ণ ফিরে গেলেন দ্বারাবতীতে।
[ ক্রমশ]
গবেষক