পরশ পাথর
সক্কাল সক্কাল জয়িতার ফোন। দেখেছিস, আজকের কাগজটা? জয়িতা এরকমই, অল্প-স্বল্প কিছু হল কি না হল, সঙ্গে সঙ্গে ফোন । মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্ত লাগে। কিছু বলা যায়না, সেই কবেকার, প্রায় ভুলে যাওয়া কলেজ জীবনের বন্ধু। তিরিশ বছর পেরিয়ে বন্ধুতা যে অটুট আছে, সে শুধু জয়িতার-ই জন্য। ওর প্রকৃতিটা বেশ একটু ন্যাগি, তবু ওর মত খাঁটি মানুষ তৃষিতা সারাজীবনে ক’টা আর দেখল! বিপদে আপদে, না বলতেই হাজির। তখন যেচে সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে না চাপালে ওর যেন শান্তি নেই।
জয়িতা এক নাগাড়ে বলে চলেছে, ইস! কী নোংরা খবর একটা। এসব পড়লে… নাহ! কাগজ-ওয়ালারাও তেমনি হয়েছে। যত্ত পারে মুখরোচক খবরের ভান্ডার সাজিয়ে বসে আছে, শুধু দরকারি খবরের বেলায় রাজ্যের কিপ্টেমো। ওরে শোন তিষু, খবরটা… ও বাবা! এ কী! সব কাগজেই যে ফ্রন্ট পেজে আজ বেরিয়েছে। এইতো, দিনের খবর, সুখবাজার, সংবাদের দুনিয়া, নিত্যসংবাদ…। দ্যাখ, দ্যাখ, নিজের চোখেই দ্যাখ। আচ্ছা, আমি এখন রাখছিরে, কাজের মাসি চলে এসেছে, পরে কথা বলব ।
তৃষিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভাগ্যিস ওর কাজের মাসি এসে পড়েছিল! জয়িতাকে যখন কথা পায়, তখন অন্য কারুর দরকারের কথা ও মাথাতেই রাখবেই না। তৃষিতার জন্য তো মোটেই নয়। ভাবে হয়তো ঝাড়া–হাত-পা একা মহিলা, করলোইবা একটা চাকরি, তা বলে জয়িতা কথা বলতে চাইলে তৃষিতা কাজের ব্যস্ততা দেখাবে কেন? কিন্তু তৃষিতা যা পারে, অন্যরা তা মানবে কেন? সবারই ঘর–সংসার আছে। অন্যরা বিরক্ত হয়, রেগে যায়, এই করে অনেক বন্ধুই আজকাল ওর ফোন ধরেনা। তৃষিতা পারেনা। বুড়ো বাবা ছাড়া ওর আর তেমন কাছের মানুষ কে আছে! মা নেই, দাদা পঁচিশ বছর ধরে বিদেশে। ছোটভাই দিল্লীতে থাকে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। চিরকাল ভীষণ কেরিয়ারিস্ট। ওর জগতে পারিবারিক সম্পর্কের তেমন দাম নেই। বাবার সঙ্গে শেষ কবে দেখা করেছে তৃষিতা মনেই করতে পারেনা। বাবার প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি, রিটায়ারমেন্টের পর এককালীন কিছু টাকা সম্বল নিয়ে বিদায়-অভিনন্দন পেয়েছিলেন। তার অনেকটাই গেছে বাড়ি সারাতে, দাদার বিদেশ-যাত্রায়। দাদা মাঝেসাঝে কী পাঠায় বাবাকে ঠিক জানেনা তৃষিতা, শুধু ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার পর থেকে নামতার মত মাথায় গেঁথে রেখেছিল, বাবা, মা , ছোটভাইএর পড়াশুনর দায়িত্ব শুধু তার একার। আত্মীয়–স্বজন যে যার মত আছে। বছর সাতেক আগে মা চলে যাওয়ার পর বাবা বইপত্র নিয়েই থাকেন, মাঝে মাঝে একে ওকে ফোন করে খবর নেন। কলেজ জীবনের গোটা সাত আট ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া তৃষিতার খবর কে আর তেমন করে রাখছে! জয়িতা চিরকাল ওকে জোর করেছে, দরকারে নির্দয় বকুনি দিতে কসুর করেনা। শুধু একবার কথা বলা শুরু করলে ওকে থামানো মুশকিল। রূপের জোরে বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে, শ্বশুরবাড়ি্তে জয়েন্ট–ফ্যামিলির গৌরব আর নেই, তার জন্য ওর কী আফশোস! সবার জন্য খুব ভাবে। ওর সরলতা, সততা, আগ বাড়িয়ে সীমাহীন সাহায্যের পাশাপাশি ওর দাবিও বড় প্রবল। সে দাবি বহুবছর আগের বন্ধুত্বের, দিনে দিনে যা শুধু সুদে বেড়েছে। জয়িতাকে এড়ানো যায়না। যাক গে , এখন অফিসের তাড়া। পরে না হয়, অফিসেই এক ফাঁকে কাগজে চোখ বুলোবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ডেপুটি ম্যানেজার তৃষিতা, বন্ধুতার কারণে অফিসে লেট হতে রাজি নয়।
দুপুর আড়াইটার পর এয়ারকন্ডিশন্ড অফিসের শীতল বাতাবরণে একটু নিভৃত এলানো ভাব আসে। এ সময় কাস্টমারের ভিড় প্রায় থাকে না। ক্ষণ মুহূর্তের বিলাসিতা কফির কড়া গন্ধে উধাও করার চেষ্টায়, বেয়ারাকে ডেকে চাহিদার কথা জানাল তৃষিতা, তারপর আলগোছে খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখে। তখনি জয়িতার কথা মনে পড়ে যায়। বেশি খুঁজতে হলো না। প্রথম পাতার বাঁদিকে সরু কলাম জুড়ে সেই খবর। পড়েই গা ঘিনঘিন করছিল তৃষিতার, কিন্তু শুধুই কি নিখাদ ঘৃণা? না তার সঙ্গে চোরা একটা কষ্টও ছিল। খুব পুরোনো, বাতিল, রঙচটা একটা কষ্ট। কাগজটা ভাঁজ করে অন্য কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই সীমার ফোন এল,” তৃষি, এখন তো তোর লাঞ্চ টাইম, কথা বলতে পারবি? সীমা একটা কলেজে পড়ায়, তাই কথা বলার আগে এইটুকু সৌজন্য দেখায়। তবে কেন এখন ফোন করেছে সে কথা অনুমান করেই তৃষিতা আগ বাড়িয়ে বল্ল, কি বলবি বল? ধ্রুবর খবরটা তো?
ওপারে সীমার উত্তেজিত গলা, দেখেছিস? কী সাঙ্ঘাতিক। মানছি কলেজ- লাইফে প্রচুর উলটো-পালটা জোকস করত আমাদের সঙ্গে, কিন্তু ওই ফিজিক্যাল ব্যাপারটা? ওই চৈতালি মেয়েটা কি সব সত্যি বলছে?”
তৃষিতা ঠান্ডা গলায় একটাই বাক্য কেটে কেটে বলে, “জানি না সীমা, তাছাড়া মাত্র একজনের কথা শুনে কোন সিদ্ধান্তে কি আসা যায়?”
ঘন্টা দেড়েক বাদে চয়নিকার ফোন, “তৃষি-রে! জানি এখন অফিসে আছিস, সন্ধ্যেবেলায় কথা বলব একটু তোর সঙ্গে। না, আজ শাড়ি নিতে বলছি না।
চয়নিকা একটা বুটিক চালায়, ইন্সটমেন্টে পেমেন্ট নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বন্ধুদের শাড়ি জোর করে গছায়, কিন্তু এখন কি সে কারণে-তৃষিতা গম্ভীর গলায় বলে, সন্ধ্যেবেলায় কেন? এখনি বল, শুনছি।
-না, লাস্ট কবে আমরা গেট-টুগেদার করলাম বলতো? সেদিন কিন্তু ধ্রুবকে খুব জোভিয়াল লেগেছিল। ওর বৌ রুমেলা মেয়েটিকেও তো বেশ সুখী মনে হল, আগেও যতবার দেখেছি! তাহলে কাগজে এসব কি আবোল-তাবোল লিখেছে বলত? হ্যাঁ ও অবশ্য আমাদের ড্রেস-সেন্স নিয়ে প্রচুর বোগাস কমেন্ট করে, কিন্তু তা বলে ফিজিক্যাল-রিলেশন? সিম্পলি মানা যাচ্ছে না রে”।
সারাদিন ধরে কলেজের সব ঘনিষ্ঠ পুরোনো বন্ধুরা- কিছু না কিছু মতামত দিল। ধ্রুবর মজলিশি -আড্ডা জমানো, টেবিল বাজিয়ে গান করা, কত বছরের বন্ধুত্বের কত কথা! এখন জীবন যার যেমনই কাটুক, বছরে দুবার গেট-টুগেদার না হলে কেউ ভাল থাকে না। বিপদে আপদে কেউ অন্তত পাশে দাঁড়াবেই। আর ধ্রুবর এ ব্যাপারে তুলনা নেই। ডাক্তারের আপয়েন্টমেন্ট, ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজে ভর্তির সমস্যা, সবকিছুতে ওর উদার সাহায্য। কিন্তু নিউজ-পেপার অফিসের চিফ-রিপোর্টার ধ্রুব সেনের বিরুদ্ধে তারই অফিসের মহিলা সহকর্মী চৈতালি রাহা ওয়ার্ক-প্লেসে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট নিয়ে এমন অগ্নিগর্ভ অভিযোগ এনেছে কেন? এরপর অফিসের কাজের ফাঁকেফাঁকে কাগজের রিপোরটিংটায় বারবার চোখ চলে গেছে তৃষিতার। রুমেলার সঙ্গে দেখা করবে? রুমেলা বাড়িতেই একটা গানের-স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। মন্দ গায় না। ধ্রুব ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, এ সব কথা তৃষিতার নিখুঁত মনে আছে। প্রথম যেদিন রুমেলাকে নিয়ে তৃষিতার পড়ার ঘরে এসে বলেছিল, তুই মত দে তৃষি, তবেই এই সম্পর্কে এগোব। রুমেলা তখন ধ্রুবর কাছে বায়োলজি পড়তে আসত। সেদিন ধ্রুবর বলার ভঙ্গীতে যতই ফাজলামো থাকুক, ওর চোখে একটা প্রচ্ছন্ন অনুনয় আর অপরাধ-বোধ কেন যে চোখে পড়েছিল! তৃষিতা সেদিন নিজের ঠোঁটকে নির্মম ভাবে শাসন করেছে। নিভৃতে আয়নায় চোখ রেখে নিশ্চিত হয়েছে, এখনো সে সুন্দরী, রুমেলার যতই আলগা চটক থাক। রুমেলাকে নিয়ে ধ্রুব সুখী হয়েছে। দুই ছেলে মেয়ে, সুন্দর পারিবারিক ঘেরাটোপ। স্বামীর চরিত্র বদল স্ত্রী-রা অনেক আগে টের পায়। বিয়ে না করলেও তৃষিতা সে কথা জানে। না থাক, রুমেলাকে প্রশ্ন করা যাবে না। ও লজ্জা পাবে। তাহলে কি কাগজের অফিসে গিয়ে ওই চৈতালি মেয়েটিকে? কিন্তু সেই বা দেখা করবে কেন? অবসন্ন লাগে তৃষিতার।
সন্ধ্যেবেলায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলেও চৈতালি সরাসরি অভিযোগ করল । তাহলে কি ধ্রুবকেই জিগ্যেস করবে? সারাসন্ধ্যে ছটফটানি যায়না। অনেক রাতে বাবা ও বলে ফেললেন, তিষু রাত হয়েছে, আর কতক্ষণ কাগজ পড়বি?
ঘড়িতে এখন সাড়ে এগারোটা। রাতের শহর ঘুমিয়ে পড়ছে। ধ্রুব নিশ্চয় এখনো অফিসে নতুন নতুন নিউজ স্টোরি করতে ব্যস্ত। ওর ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র আভেরী মেয়েটিকে চেনে তৃষিতা। সন্ধ্যেবেলায় ওকে ফোন করে জেনেছে, আজ ধ্রুবর নাইট ডিউটি। কত দিন ওর সঙ্গে আলাদা করে দেখা হয়নি। শেষ কবে একা দেখা হয়েছিল? সেই হলুদ রঙের বিকেলে আউট্রাম ঘাটে, যেদিন ও বলেছিল, “আমার জীবনে স্পেশাল একজন এসে গেছে রে তিষু, ভীষণ ভাল গান করে।”
একটা সময় ছিল, কলেজের অনুষ্ঠান, বা বিশেষ কোন কারণে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেলে ধ্রুব বাস থেকে নেমে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে যেত। আপত্তি করলে শুনত না, দরাজ গলায় হাসতো,” নারে এ আমার মধ্যবিত্ত বাবা মায়ের শিক্ষা।”
-শুধুই তাই?
তৃষিতার আকুল প্রশ্নে হা হা করে হাসত ধ্রুব, তাছাড়া আবার কি? কেন?
– না, এমনি বলছিলাম।
এমন অনেকদিনই তৃষিতার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত ধ্রুব, তারপর একটু থেমে বলে উঠত, নারে! আমার অনেক দায়-দায়িত্ব, তাই ভুল করেও ভাবিস না তোর প্রেমে পড়ে গেছি। প্রেমে তুই হয়তো পড়িসনি ধ্রুব, আমিই পড়েছিলাম, তুইও সে কথা জানতিস, কতবার ভেবেছি, একটি বার যদি নিভৃতে আমায় ক্ষণ-মুহূর্তের জন্যও স্পর্শ করতিস! সুযোগ পেয়েও কোনদিন করিসনি! আমিও সারাজীবন সেই সুযোগ আর কাউকে দিইনি, দিতেই পারিনি।সবাই জিগ্যেস করেছে, বাবা –মায়ের দায়িত্ব বিয়ে করে কি সামলানো যায় না, আমরা করছি না? আমি কাউকে উত্তর দিতে পারিনি।
কিন্তু তুই এটা কি করলি ধ্রুব? এই বয়সে! আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে সেই চেনা নম্বরে ডায়াল করে তৃষিতা। ওপারে এক সফল কনফিডেন্ট এক্সিকিউটিভের গলা,” ইয়েস বস! কী কী দরকার বলে ফেলো, অলয়েস অ্যাট ইয়োর সার্ভিস।”
ফোনের এপারে কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপর অনেক বছরের গোপনে জমানো সাহস জড়ো করে ফিসফিস করে তৃষিতা– “সত্যি দিবি , যা চাই?”
-হ্যাঁরে, বল না। কোনদিন তোর কোন রিকোয়েস্ট রাখিনি বল? কোন পিসতুতো দাদার ছেলের স্কুলে ভর্তি, কোন কলিগের মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ নেওয়া, কোন মামাতো বোনের বরের জন্য হাসপাতালে বেডের ব্যবস্থা! শালা এত কিছু করে যাচ্ছি, তাও রাতদুপুরে ন্যাকামি করছিস, সত্যি দিবি কি না বল? হ্যাঁরে, মেসোমশাই ঠিক আছেন তো? বুড়ো কিন্তু দিব্যি ব্যাটিং করে যাচ্ছে, যাব একদিন, ওনাকে বলে রাখিস।
-নারে, বাবা ঠিক আছেন, এখনো কোন তেমন সমস্যা নেই।
-তাহলে? তোর কিছু হল নাকি? মেয়েলি রোগফোগ এ বয়সে শুনি আকছার হয়। কাকে দেখাতে চাস, বলিস, আপয়েন্টমেন্ট করে দেব।
-ওসব কিছু না। হলেও তার জন্য তোকে বিরক্ত করব না। আমার শুধু জানতে ইচ্ছে করছে, কৌতুহল নয় কৈফিয়ত বলতে পারিস…।
– ও হো তাই বল! আজকের কাগজের ওই বোগাস খবরটা? আরে ওসব ফালতু গসিপ। ভাবিস না। এর জন্য তুই ফোন করে আমার মুখ থেকে জানতে চাইছিস! এত বছর পরেও! পাগলী একটা। শোন! কারুর সঙ্গে হেসে দুটো কথা বলে, হাত ধরলে বা গাড়িতে লিফট দিতে চাইলে, একটু কাঁধে হাত রাখলে যদি… এই মেয়ে সাংবাদিকগুলোর ঢ্যামনামো যদি জানতিস!
-না রে, আমি ওসব নিয়ে একটাও প্রশ্ন করতাম না। তুই ভুলে গেলেও আমি তো টের পাই আমার বুকের ভেতরে তুই আজো কতটা রয়ে গেছিস। তাই বলছিলাম, তুই যদি এই বয়সে এমন বেলাগামই হলি, তবে একটি বারের জন্য প্রতীক্ষায় থাকা আরেকজনের সঙ্গে একটু আধটু অসভ্যতা কোনদিন একটিবারের জন্য তাকে ছুঁয়েও দেখলি না। কেনরে? আমি… কি এতই…?
শিক্ষক,কথাসাহিত্যিক