ভীড়ের ভেতর রুকুর মেসোর দরাজ গলায় শোনা গিয়েছিল, “পাগলা, ক্ষীর খা!” অমনি ঘর ফাটিয়ে যত এয়ো, আর অন্যান্য মেয়ে-মহিলা নানা ঢংএর হাসির ফুলঝুরি ছড়িয়ে দিয়েছিল ঘরময়। রুকুর মেসো শিবতোষ খুব রসিকজন, হৈচৈ করতে ভালোবাসেন। রুকুর বিয়ের দিন ভোরে ক্ষীর খাওয়ার অনুষ্ঠানে তিনি থাকায় ভোরটাও খুব চনমনে হয়ে উঠেছিল মনে হয়।
যদিও বিয়ের দিন ভোরে দধিমঙ্গল সাধারণ বাঙালী রীতি, তবে প্রসাদবাবুদের বংশে দইখইএর বদলে ক্ষীরভক্ষণই রেওয়াজ। ক্ষীরভক্ষণ আসলে পায়েস খাওয়া। রুকুর পায়েসপ্রীতি কাছের মানুষদের জানা ছিল বলেই শিবতোষ মজা করে কথাটা বলেছিলেন। জন্মদিনগুলোতেও রুকু কেক কাটার বদলে পায়েসেই খুশি হত। চেটেপুটে ভোরবেলায় একবাটি পায়েস খেয়েও ছিল। খুব আনন্দের একটা বিয়েবাড়ি ছিল সেটা।
আরো পড়ুন: গল্প: ডুবচান । যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা
বাড়ির একমাত্র সন্তানের বিয়ে বলে কথা! আত্মীয় বন্ধুদের আগমনে গমগম করছিল, ঝলমল করছিল আনন্দ আর খুশিতে। রুকুও খুব খুশি। সম্বন্ধ করে বিয়ে হলেও পাত্রের বাড়ির লোকজন খুব বন্ধুসুলভ ব্যবহার করে চলেছেন বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়া থেকেই। কোনো দাবিদাওয়াও নেই তাঁদের। মোটকথা কোথাও কোন খুঁত ছিল না সেদিনের বিবাহ অনুষ্ঠান ঘিরে।
দ্বিরাগমনে রুকু বাপের বাড়ি এসেছিল বরের সঙ্গে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রসাদবাবুর যেন মনে হলো বিয়ের বাসি ফুলের মালার মতো মলিন হয়েছে মেয়ের চেহারাখানা। পঁচিশ বছরের সুঠাম চেহারার তরতাজা মেয়েটিকে বড্ড ক্লান্ত আর আনমনা দেখাচ্ছে।
প্রসাদবাবুর স্ত্রী শারদা সুযোগ মতো জিগ্যেস করলেন, “হ্যাঁ রে, কী হয়েছে তোর? শ্বশুরবাড়ি ভালো হয়নি? ও বাড়ির লোকজন কি তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে?”
“না তো! শুভমের বাবা মা খুবই ভালো মানুষ, আমায় বেশ ভালোবাসেন। শুভমের দাদা বৌদি গতকাল নাগপুর ফিরে গেলেন, ওরাও বেশ ভদ্র”।
“আর শুভম কেমন?”
রুকু অন্যমনস্কভাবে বলে, “একটা মানুষকে এই দু-চারদিনে চিনব কীকরে, মা?”
“তা বটে!” শারদা অপ্রস্তুত হন।
রুকুর নতুন বর যখন দিবানিদ্রা দিচ্ছে, রুকু তখন বারান্দায় বসে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ খুলে বসে আছে। রুকুর মা শারদা একটা সরকারী প্রাইমারি স্কুলে পড়ান, বেশ কিছু প্রাপ্য ছুটিই তাঁর জমে আছে। সুতরাং একমাত্র মেয়ের বিয়েতে ক’দিন ছুটি নেবার পরও মেয়ের দ্বিরাগমন উপলক্ষ্যে আরও দু-চারদিন ছুটি নিতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। খেয়াল করছিলেন মেয়ে জামাইএর ভেতর যেন ঠিক মাখোমাখো ব্যাপারটা নেই। জামাই হাসিখুশি রয়েছে, কথাবার্তাও স্বাভাবিক। বরং মেয়ের কথা না বলার ফাঁকগুলো নতুন জামাইএর পূরণ করে দেবার একটা বাড়তি চেষ্টা লক্ষ্য করলেন প্রসাদবাবু ও তাঁর স্ত্রী।
মেয়ের সামনে চেয়ারে শারদা বসে পড়লেন। বললেন, “কী পড়ছিস? – দেনাপাওনা গল্পটা আগে পড়িস নি! আবার –”
তাঁর কথা শেষ করার আগেই রুকু তেড়িয়াভাবে বলে উঠল, “নিরুপমাদের ঝাড় যে শেষ হয় না, মা! তাই এই গল্প পড়ার আগে পরে বলে কিছু নেই, তুমি জানো না?”
“নিরুপমা নিজেদের পারিবারিক অবস্থার উর্ধে গিয়ে পড়ায় দু’তরফেই মিলে যাওয়ায় আর মিলিয়ে নেওয়ায় ঘাটতি ছিল। তোর কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“আশ্চর্য! আমাকে এর সঙ্গে মেলাচ্ছ কেন? আমি কি তোমায় কোনো সমস্যার কথা বলেছি? ভাবছ কেন অত? আমি ঠিক আছি,” বলে রুকু নিজের ঘরে ঢুকে গেল, যেখানে তার বর ঘুমাচ্ছে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজার দিকে তাকিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হন শারদা। একবার মনে হয়, তাঁর চোখের ভুল, কোথাও সমস্যা নেই। হয়তো রাত্রি জাগরণের কারণে মেয়ের মধ্যে ক্লান্তি জমেছে, যতই হোক নতুন বিয়ে বলে কথা। একথা ভেবে মনে মনে একটু হাসেন। কিন্তু পরেই যেন মনে একটা কাঁটা খচখচ করে উঠল।
বিয়ের পর রুকু তেমন আসতে চাইত না। প্রসাদবাবুরা নিশ্চিন্ত হলেন, যাক গে, শ্বশুরবাড়িতে মন বসেছে মানে সব ঠিক আছে।
মাস ছয়েক পর রুকু একা এলো। মেয়ে যেন আরও শুকিয়ে গেছে। চেপে ধরলেন মা। এবার মেয়ে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল তাঁর কাছে।
“শুভমের পরকিয়া সম্পর্ক আছে। সে বলেছে, ‘মেনে নাও, থাকো। তোমার কোনো সমস্যা হবে না, কোনো অসুবিধা হতে দেব না তোমার। আমি তাকে বিয়ে করব না ঠিকই তবে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়’’, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল রুকু।
মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি আর ওখানে থাকব না, মা! আমি আর বারাসাত ফিরে যাব না”।
শারদা কাঠের পুতুলের মতো মেয়েকে জড়িয়ে বসে থাকেন, কোনো কথা বলতে পারেন না। রাতে প্রসাদবাবু বাড়ি ফিরে সব শুনলেন। মেয়েকে ডেকে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “একটু চেষ্টা করে দ্যাখ না, মা! যদি শুভমের মনটাকে ঘোরাতে পারিস! ছেলেটা তো খারাপ নয়!”
রুকু বাবার কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে নিল। বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে গেল। এই বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক, কথার চাপানউতোর ও চাইছিল না। রাগ হচ্ছিল নিজের উপর। কোনো চাকরির চেষ্টা সে করেনি কেন এতদিন? নিজের পথ নিজে চলবার মতো সামর্থ্য তার থাকা উচিত ছিল না কি? তাহলে আর অসম্মানের ভেতর একটা সাজানো পুতুল হয়ে কোনো বাড়িতেই থাকতে হতো না।
শুভমের সঙ্গে তার মানসিক সংযোগ তৈরি করতে পারছে না, কিছুতেই শুভমের জীবনে অন্য এক নারীর নিবিড় সম্পর্ক ভুলতে পারে না সে। শুভম দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করলেও মানসিকভাবে রুকুকে সে জড়িয়ে নেয়নি। বিছানায় শুয়ে এক একদিন শুভম শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে। দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনের দ্যোতনাই তার কারণ। মনের সম্পর্ক ছাড়া শরীরী মিলন হয়তো সম্ভব, কিন্তু বিষয়টার মধ্যে শুভমের যে নিজেকে ক্লিনচিট দেবার ও রুকুর প্রতি একপ্রকার করুণাসুলভ মনোভাব রয়েছে তা রুকু মেনে নিতে পারে না, তার গা ঘিনঘিন করে। সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, আর শুভমকে লুকিয়ে অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়ে। তবু মানিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা, এও ভাবে সে, হয়তো এভাবেই একদিন তার প্রতি শুভমের সব মনোযোগ উপস্থিত হবে, যেমনটা বাবা ভেবেছেন। এই অবস্থায় শুভমকে বিমুখ করলে সে বিরক্ত হবে নিশ্চয়ই। তবু অভিমান আর অপমানবোধ তাকে কোনঠাসা করে দেয়। কাঠের পুতুলের থেকে কি তৃপ্ত হওয়া যায়? ফলে শুভম বিরক্ত হয়ই। রুকু বোঝে, শরীর ব্যাপারটা যেন ললিপপ দিয়ে ভোলানো, কিংবা একটা সান্ত্বনা পুরস্কার! ছিঃ, সে কি জীবন্ত একটি মানুষ নয়?
মা চিরকাল বলে এসেছেন, “এত খুঁটিয়ে সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ জীবনের আনন্দ নষ্ট করে, দৈনন্দিন ভালো থাকার জন্য অনেক কিছু থেকে চোখ বুজে থাকতে হয়। তুই তোর টুকু বুঝে নিবি, ব্যস! তা না – তোর এটা বাতিক!”
কে জানে, হয়তো সত্যই বাতিক! শুভম তাকে বলেছে যে, সব সম্পর্ক একরকম হয় না, প্রেম থাকলেই তাকে বিয়ে করতে হবে নাকি? আহা! তাহলে কি বিবাহিত সম্পর্কে প্রেম থাকে না, শুভম? তুমিও ওভাবেই থাকতে পারতে, বিয়ে করার দরকার হলো কেন তোমার? আমার প্রতি তোমার দায়িত্ব আর কর্ত্যব্য পালন আছে ঠিকই, একফোঁটা প্রেমও কি থাকতে নেই?
কিন্তু করণীয়ই বা কী, রুকু বুঝতে পারে না। ওই অসম্মানের শৌখিন আস্তাকুঁড়ে ফিরে যেতে গিয়ে তার মন তাকে বারবার পা ফেলতে বাধা দেয়।
বাবা মাকে সে সবটা দোষ দিতে পারে না। তাঁদের প্রজন্ম সামাজিক অসম্মানের কথা ভেবে আরও কিছুটা মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টার কথা বলেন। তবু বাবা-মার উপর তার অভিমানও কম নয়। কতদিন শ্যাওলার মতো ভেসে থাকবে সে? তার জায়গা থেকে বাবা মা একবারও ভাবলেন না বলে তার এ বাড়িটাও হঠাৎ অসহ্য ঠেকতে লাগল তার।
দুদিন পর ও বারাসাত ফিরে যাবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিল। কষ্টের যেখানে লাঘব নেই, সেখানে না থেকে বরং কষ্টের ভেতর গিয়ে নিজেকে আরও যন্ত্রণা দেবে। পরের দিন সকালেই ফিরে যাবে। সন্ধ্যেয় মা পায়েস বানিয়ে নিয়ে এসে তার সামনে রাখলেন। ঘন দুধে খোয়া ক্ষীর, কাজু কিসমিস মেশানো গোবিন্দভোগ চালের পায়েসের সুন্দর গন্ধ উঠেছে।
তাকে চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে মা বলল, “কীরে! নে, শুরু কর! পায়েস দেখলে তুই তো স্থির থাকতে পারিস না, একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়িস -!”
মা এত সাধ করে বানিয়েছে, ফিরিয়ে দিতে খারাপ লাগল রুকুর। অল্প খেয়ে বলল, “দুপুরের খাবার এখনও সবটা হজম হয়নি, মা! আর খেতে পারব না।”
রুকুর মন উদাস হয়ে মেঘ ঘনিয়ে এলো। সবাই দুঃখ পাবে বলে তাকে সবার সব দাবি মানতে হবে, অথচ তার দুঃখের কথা কে ভাবছে? মনে মনে কৌতুক বোধ করল, ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসির মতো ফুটে উঠল।
আগের দিন রাতে খাবার পর বাবা মা তার কাছে এসে বসেছিলেন কথায় কথায় তাঁরা বললেন, “দ্যাখ মা, তোর কোথাও ভুল হচ্ছে না তো শুভমকে বুঝতে? অকারণেই সন্দেহ করে ফেলছিস না তো?” বলে ফেলেই খেয়াল হলো রুকু তাঁদের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। তাড়াতাড়ি বাবা ম্যানেজ করার চেষ্টা করলেন, “না মানে, সম্ভাবনার কথা বলছি। তুই রাগ করিস না!”
রেগে উঠতে গিয়েও রুকু সামলে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বলেছিল, “শুভম নিজে বলেছে, বাবা! তাছাড়া আমি কবে সন্দেহবাতিক ছিলাম?”
পরের দিন সকালে শুভম ফোন করে গাড়ি পাঠাবে কিনা জানতে চাইলে সে বলল যে, সে নিজের মতো করে ঠিক পৌঁছে যাবে। গাড়ি পাঠানোর কোন দরকার নেই। তারপরও শুভম কিছু বলতে যাচ্ছিল, রুকু লাইন কেটে দেয়।
ওবাড়ি ফিরে যাবার পর একদিনও রুকু নিজে থেকে বাবা মাকে ফোন করেনি। একদিন বাবা মার ফোন পেয়ে কথায় কথায় জানাল, কোনও এক শপিংমলে সেলসগার্লের চাকরি পেয়েছিল, কিন্তু শুভম ও তার বাবা মার তা পছন্দ নয়।
আরও দু’মাস পর ভোর বেলা খবরটা এল প্রসাদবাবুর কাছে।
তাঁদের একমাত্র সন্তান রুকু, যে পায়েস খেতে বড়ো ভালবাসত। বিয়ের দিন ভোরে চেটেপুটে পায়েসের বাটি সাফ করেছিল! সেই পায়েসেই বিষ মিশিয়ে খেয়ে তার জীবনের যাবতীয় ভালোবাসাকে সে ঘেন্না জানিয়ে গেছে।
পূর্ব বর্ধমানের দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের অজ পাড়াগাঁয়ের ধুলোবালিতে জীবনের অনেকটা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতার বৃত্তি। কবিতা প্রথম প্রেম। প্রকাশিত কবিতার বই এখনও পাঁচটি। গদ্যের বই তিনটি গদ্যগ্রন্থের মধ্যে ‘দক্ষিণ দামোদর জনপদ’ উপন্যাস, যেটি সাম্প্রতিক কালে ‘সাজি’ পত্রিকা কর্তৃক অজিত রায় স্মৃতি সম্মাননা লাভ করেছে।