মাহ্নবির লাল বিকেল

Reading Time: 4 minutes

অনেকদিন আমার মনে হয়েছিলো মাহ্নবিকে নিয়ে তো একটা গল্প লেখা যায়। কিন্তু গল্পের শেষটা নিয়ে তেমন ভাবতে পারিনি। তাই লেখা হয়ে উঠেনি। কিন্তু গত শনিবারে অকস্মাৎ তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো আমার। প্রায় সতেরো বছর পর। দেখেই ধাক্কা খেলাম প্রথমে। তারপর মনে হলো এইতো হতে পারে গল্পের শেষ।

আজকে লিখতে বসে মনে হলো মাহ্নবিকে নিয়ে আসলে গল্প লেখার দরকার নেই। তার জীবনের সত্য কাহিনি বললেই তো একটা গল্পের দ্যোতনা তৈরি হয়। তাই ভাবলাম আপনাদের কাছে তার সত্য কাহিনিগুলিই একটানে বলে ফেলি। ঠিক আছে!

মাহ্নবি ছিলো আমার প্রাইমারি ইশকুলের সহপাঠি। একই ক্লাসে আমরা পড়তাম। বাড়িতে কয়েকবছর আব্বার কাছে পড়াশোনার পর একদিন আমাদের গ্রামের প্রাইমারি ইশকুলে আমি সরাসরি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হই। ভর্তি না, যাওয়া আসা শুরু করি। পরে ফাইনাল পরীক্ষায় ভালো করার পর স্যাররা আমাকে ভর্তি করে নেন। তারমানে আমি ক্লাস থ্রি থেকে মাহ্নবিকে চিনি। আমাদের ক্লাসের সবচে’ বয়স্ক, লম্বা এবং মোটাসোটা ছেলেটা ছিলো মাহ্নবি। ওর নাম আসলে মাহ্নবি ছিলো না। ও নাম ছিলো মোহাম্মদ নবী। সে বই আর খাতার ওপর লিখতো মোহাং নবী। কিন্তু সবাই ওকে ডাকতো মাহ্নবি। ওর বাবা ছিলো তেলিপাড়া মসজিদের ইমাম। তেলিপাড়া আমাদের ইশকুলের কাছেই ছিলো কিন্তু তেলিপাড়াকে আমাদের অনেক দূরের দেশ মনে হতো। কারণ মাহ্নবি প্রতিদিনই দেরি করে আসতো। এসেই আমাদের ধরে ধরে মারতো। টান দিয়ে ছেলেদের লুঙ্গি খুলে দিতো আর ঠা ঠা ঠা ঠা হাসতো। আমাদের ক্লাসের সবাই লুঙ্গি পরে আসতো। কেবল আমি হাফপ্যান্ট পরে যেতাম। কারণ আমি লুঙ্গি পরতে পারতাম না। হাঁটতে গেলে পায়ে জড়িয়ে পড়ে যেতাম। তাই আমাকে মারতো লুঙ্গি পরতাম না বলে; বলতো, ‘লাটের বেটা হইছোস না!’

মাহ্নবি শুধু মারতো না আমাদের ক্লাসের ক্যাপ্টেন সাইফুলকে। কারণ সাইফুলের নালিস স্যাররা শুনতো। আর সে বেশি মারতো হিন্দু ছেলেদের। হিন্দু ছেলেদের ডাকতো ডেঁড়া, ডান্ডি এইসব। কারণ ব্রাহ্মণদের প্রত্যেকের মাথায় একটা করে টিকি থাকতো। ওইটাকেই মনে হয় ডান্ডি বলতো। এবং টিকি ধরে টানতো। কথায় কথায় ইন্ডিয়া পাঠাতো। লুঙ্গি খুলে দিয়ে শিশ্নের দিকে আঙুল তাক করে বলতো, ‘ফুলশার্ট ফুলশার্ট’। আর ঠা ঠা ঠা করে হাসতো। ফুলশার্ট এর বিষয়টা বুঝতে আমার সময় লেগেছিলো।

শনিবার সকালটা আমাদের জন্য ছিলো ভয়াবহ অপেক্ষার। কারণ এর আগের দিন সুরবিতান হলে মাহ্নবি সিনেমা দেখতো এবং পরদিন ইশকুলে দরজায় যাকেই পায়, যে ক্লাসেরই হোক ধরে মারতো, নতুন কায়দায়, আগের দিন সিনেমায় দেখা একটা মারপিটের দৃশ্যেই যেনো সে অভিনয় করছে এমন ভাব।

সেইরকম এক শনিবার সকাল দশটায় আমার স্পষ্ট চোখে ভাসছে এখনো সেই দৃশ্য। আমি দরজা দিয়ে ঢুকছি ক্লাসে আর অকস্মাৎ মাহ্নবি কোথা হতে উড়ে এলো টেরই পেলাম না। সামনে দাঁড়িয়েই, ‘রুবেল আমার নাম’ বলে আমার নাকে মারলো একটা দেড়কেজি ওজনের ঘুষি। আমার বুকে হাতের ভাঁজ থেকে ছিটকে পড়ে গেলে ছয়টা বই আর সাতটা খাতা। আমি থর থর কাঁপছি আর দেখছি গল গল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আমার বুকে। শাদা শার্ট হয়ে যাচ্ছে রক্তজবা। আর আমার মাথা ঘুরছে। তারপর আর জানি না। আমার জ্ঞান ফিরলে দেখি হেডস্যারের রুমে একটা বেঞ্চে শুয়ে আছি।

এরপর আরো একবছর গেলো। তখন ফাইভে উঠেছি। মাহ্নবি পাশটাস করতে পারেনি। সে ফোরেই আছে। তারপরও আমাদের ওপর তার অত্যাচার থেমে থাকেনি। দিন যায়। একদিন দেখি মাহ্নবি কয়েকদিন ধরে আসে না। আমরা তাকে মিস করতে থাকি। ছেলে কীসব কানাঘুষা করে আমি বুঝি না ঠিক। জিজ্ঞেস করে জানবো সেই উপায়ও নাই। কারণ আমার তেমন কোনো বন্ধু ছিলো না। আমি সবার সঙ্গে সহজ হতে পারতাম না। একজন মোটামুটি ব›ধু ছিলো রবিন। তারও আমার মতোই অবস্থা। যাই হোক, ব্যাপারটা জানতে পারলাম আরো দুইদিন পর যেদিন মাহ্নবি ইশকুলে এলো এবং এসেই চিৎকার করে সাইফুলকে বললো, ‘খানকির পোলা, তর মায়েরে চুদি! আইজকা তরে মাইরা তক্তা বানামু…।’
বলতে বলতেই সাইফুলকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেললো। সাইফুল আমাদের ক্যাপ্টেন তিনবছর ধরে। তাকে মারা মানে বড় কিছু একটা কারণ আছে। জানতে পারলাম সাইফুল কী একটা কথাকাটাকাটিতে মাহ্নবিকে ‘গরুচোদার পোলা’ বলেছে। এর মানে কী? জানতে পারলাম, কয়েকদিন আগে মাহ্নবির বাবা সিদ্দিক হুজুরকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশ ডলা দিয়েছে। কারণ তিনি পাশের বাড়ির গোয়ালঘরে ফজরের নামাজের পর একটা গরুর সঙ্গে হাতে নাতে ধরা পড়েছেন। একদিন পর পুলিশকে পঞ্চাশহাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ওনাকে থানাহাজত থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে। ওনি কি গরু চুরি করতে গিয়েছিলেন? তখনো ব্যাপারটা বুঝিনি; বুঝেছি হাই-ইশকুলে ভর্তি হওয়ার পর।

হাই-ইশকুলে মাহ্নবির সঙ্গে আর দেখা হয়নি। কারণ পর পর বেশ কয়েকবছর ফেল করে পড়াশোনায় ছেড়ে দিয়েছিলো সে। তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হতো সুরবিতান সিনেমা হলে। আমরা ইশকুল পালিয়ে একদিন বৃষ্টির ভিতর দেখতে গেলাম সালমান শাহ আর শাবনূরের ‘স্বপ্নের ঠিকানা’। টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি মাহ্নবি টিকিট বিক্রি করছে। আমাদের ফ্রি টিকিট দিলো। আমাদের তিনজনকে দুইটা ঠান্ডা ফান্টার বোতলও দিলো। সেদিন থেকে মাহ্নবির প্রতি আমাদের এক ধরনের মায়া জন্মালো।

আমি এইটে যখন পড়ি আব্বার বদলির চাকরির কারণে শহরের একটা ইশকুলে ভর্তি হয়ে যাই। ওখান থেকেই মেট্রিক পাশ করি। ফলত চারপাঁচ বছর আর মাহ্নবির কোনো খবর জানতাম না। খবর নেয়ার কথাও মনে আসেনি। ইশকুল পাশ করার পর আমি গ্রামের কলেজেই ভর্তি হই। সেকেন্ড ইয়ারে একদিন জাকেরের ওষুধের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে শুনি মাহ্নবির চৌদ্দবছরের জেল হয়ে গেছে। অপরাধ শিশু ধর্ষণ। হাসপাতালের বাগানে স›ধ্যার পর একটা ছয়বছরের মেয়েকে হাসপাতালের রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে, পরে রাস্তার লোকজন দেখে তাকে ধরে ফেলে এবং প্রচণ্ড মারধোর করে। শেষে পুলিশ খবর পেয়ে এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তারপর তার জেল হয়। মেয়েটাকে অবশ্য বাঁচানো যায়নি।

গত শনিবার অকস্মাৎ রাস্তায় মাহ্নবির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো আমার। প্রায় সতেরোবছর পর। দেখেই ধাক্কা খেলাম। তার পরনে একটা সুতাও নাই। মাথাটা সুন্দর করে কামানো, শুধু একগোছা টিকি ঝুলছে পিঠ পর্যন্ত। তার শিশ্নস্থানে তেমন কিছু নেই, কালো কুচকানো একদলা মাংস মনে হলো। গলায় কালো ঘুনশি দিয়ে একটা হাড় ঝুলানো, ছাগল কিংবা কুকুরের মনে হলো। আমাকে দেখে হাসি হাসি মুখে হাত পাতলো। কিন্তু চিনলো না। আমি জাকেরের কাছে ফোন দিলাম। ওর বাড়ি মাহ্নবির বাড়ির পাশে। কাহিনি শোনার পর কেন জানি অবাক হলাম না।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মাহ্নবির বিয়ে হয়। বেশ কয়েকবছর সব ঠিকঠাক মতো চলে। দুইটা ছেলেমেয়েও হয় পর পর। কিন্তু হঠাৎ একদিন দুপুরে পাশের বাড়িতে বেড়াতে আসা একটা নয়বছরের বাচ্চা-মেয়েকে দেখে তার কী যেনো হয়ে যায়। টেনে নিয়ে খড়ের গাদায় মেয়েটাকে চেপে ধরে। মেয়েটার চিৎকার শুনে মাহ্নবির বউ ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বউকে দেখে সে মেয়েটাকে ছেড়ে দেয়। এবং হন হন করে বাজারের দিকে হেঁটে চলে যায়। রাতে ঘরে ফিরলে বউ কিছু বলে না। মাহ্নবিও চুপচাপ। গভীর রাতে বউ ঘুমন্ত মাহ্নবির শিশ্নটা ব্লেড দিয়ে কেটে নেয় শুধু। আর জান্তব আর্তচিৎকারে রাত কাচের মতো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে ভোর হয়ে যায়। বউটাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আর মাহ্নবি সুস্থ হওয়ার পর কারো সঙ্গে কথা বলে না। একা একা একটা ভয়ার্ত ভাব নিয়ে ঘরের এককোণায় বসে থাকে।

একদিন দুপুরে বাজারের লোকজন দেখে সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, আর ঠা ঠা ঠা হাসছে। পরনে একটা সুতাও নেই। পাড়ার লোকজন ঠিক করে তাকে শহরে ছেড়ে দিয়ে আসবে। এই হলো মাহ্নবির শেষ কাহিনি।

আমি ফুটপাথ থেকে লালকাচের একটা চশমা কিনে মাহ্নবির চোখে পরিয়ে দিয়ে হাসলাম। প্রত্যুত্তরে সেও দাঁত বের করে হাসলো। তারপর একটা ভিড়াক্রান্ত চলন্ত বাসে দৌড়ে উঠে পড়লাম। আমার পেছনে পড়ে থাকলো মাহ্নবির অন্তহীন লাল বিকেল।

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>