তাঁর পুরো নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ। কিন্তু বিশ্বের অসংখ্য মুক্তিকামী ও প্রতিবাদী মানুষের কাছে তার পরিচয় তাদের প্রিয় নেতা লেনিন। ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল জন্ম নেওয়া এই মহান নেতা তাঁর জীবদ্দশায় মুক্তিকামী মানুষের জন্য করেছেন অনেক কিছু। জন্ম রাশিয়ায় হলেও সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেই তাঁর সমান মর্যাদা। মুক্তিকামী সব মানুষের প্রিয় এই নেতা ছিলেন অক্টোবর এবং মহান নভেম্বর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান এবং লেনিনবাদ তত্ত্বের প্রবক্তা। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন— জিয়াউদ্দীন চৌধুরী।
বিপ্লবের মঞ্চে
১৮৮৭ সালে কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ার সময় ছাত্রদের বিপ্লবী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করে। এ সময় পুঁজিবাদ দ্রুত বিকাশ পাচ্ছিল, যান্ত্রিক টেকনোলজি ও হাজার হাজার মজুর নিয়ে চালু হচ্ছিল কল-কারখানা। সে সময় জারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ‘নারোদবাদী’রা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। নারোদবাদ হচ্ছে মেহনতিদের শ্রমমূল্য প্রতিষ্ঠার জন্য জার পুঁজিপতিদের হত্যা করা। জারের বিরুদ্ধে হলেও লেনিন নারোদবাদীদের বিরুদ্ধে ছিলেন সবসময়। তিনি হত্যাযজ্ঞ এবং সন্ত্রাসকে কিছুতেই মানতে পারেননি। লেনিন সবসময় মার্কস এবং এঙ্গেলসের ধারণা ও তত্ত্বকে গুরুত্ব দিতেন। ১৮৮৯ সালে তিনি সামারায় যান এবং স্থানীয় মার্কসবাদীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৮৯১ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাস করে সামারাতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ চলে আসেন এবং শিগগিরই সেখানকার মার্কসবাদীদের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এখানেই লেনিন ক্রুুপস্কায়া’র সঙ্গে পরিচিত হন। ক্রুপস্কায় শ্রমিক এবং কৃষকদের মধ্যে সাম্যবাদ এবং বিপ্লবী আদর্শের প্রচারে ব্রতী ছিলেন। এ সময় নারোদবাদীরা লেনিনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মাঠে নামে এবং তার নীতিকে ভিত্তিহীন বলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানা প্রচারণা ও ব্যাখ্যা চালাতে থাকে। শুধু নারোদবাদীরাই নয়, তথাকথিত ‘বৈধ মার্কসবাদী’রাও তার বিপক্ষে মাঠে নামে। এই বৈধ মার্কসবাদীরা ছিল বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী। তারা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত পত্রপত্রিকায় লিখত এবং মার্কসবাদকে বুর্জোয়াদের স্বার্থের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করত। লেনিন এই নারোদবাদী ও বৈধ মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে মেহনতি মানুষকে বোঝাতে থাকেন এবং বড় বড় কল-কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘বিপ্লবী মার্কসবাদী পার্টি’ গড়ে তোলার জন্য।
জার সরকার ১৮৯৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি লেনিনকে ৩ বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে। এখানে থাকা ভ্লাদিমির ইলিচের পক্ষে সহজ ছিল না। রেললাইন থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে এক অজো পাড়াগাঁ সাইবেরীয় গ্রাম। তবু তিনি ভেঙে পড়েননি।
১৯১৪ সালের প্রথমার্ধে রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলন ক্রমেই ব্যাপক হয়ে উঠল এবং পনেরো লাখ শ্রমিক ধর্মঘটে অংশ নেয়। অর্থনৈতিক ধর্মঘটের সঙ্গে রাজনৈতিক ধর্মঘট জড়িয়ে পড়েছিল। এ বছরই ইউরোপে দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে শুরু হয় লড়াই। যা বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়। এদের এক দলে জার্মানি ও অস্ট্রো হাঙ্গেরি এবং অন্য দলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া। দুদলই অনুসরণ করছিল রাজ্যগ্রাসী নীতি। পরে যুদ্ধে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অন্যান্য রাষ্ট্র। যুদ্ধের সময় অস্ট্রিয়ার সরকার জার সরকারের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে লেনিনকে গ্রেফতার করে। তবে লেনিনের সমর্থকদের বিক্ষোভের কারণে দুই সপ্তাহ পর তিনি ছাড়া পেয়ে সুইজারল্যান্ড চলে যান। বিভিন্ন স্থানে গোপনে রাজনৈতিক কাজ করে প্রায় ১০ বছর পর ১৯১৭ সালের ৩ এপ্রিল রাতে লেনিন রাশিয়ায় পৌঁছতে সক্ষম হন। সেখানে শ্রমিক শ্রেণি ও গরিব কৃষকদের ক্ষমতা দখলের জন্য বিপ্লব ব্যবহারিক প্রস্তুতির কর্তব্য, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য তৈরি হওয়ার জন্য জোর দেন। ভ্লাদিমির লেনিন বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান, প্রলেতারীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানালে তা সমর্থন করে দেশে ২৫০টির বেশি সোভিয়েত। ১ অক্টোবরের পত্রে লেলিন আর বিলম্ব না করে অভ্যুত্থানে এগুতে বলেন। ২৪ অক্টোবর রাতে পেত্রগ্রাদের ফাঁকা রাস্তাগুলোয় যখন কসাক ও ইউঙ্কার বাহিনী টহল দিচ্ছিল তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লেলিন স্মোলনি আসেন এবং অভ্যুত্থান পরিচালনায় সরাসরি নেতৃত্ব দেন।
লেনিন ও বলশেভিক পার্টির নেতৃত্ব শ্রমিক, লালরক্ষী, সৈন্য ও নাবিকদের আত্মোৎসর্গী সংগ্রাম ও বীরত্বের ফলে বিশ্ব ইতিহাসে এক মহাসাফল্যের ঘটনা ঘটে— জমিদার ও পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়। ২৫ অক্টোবর সকাল ১০টায় পেত্রগ্রাদ সোভিয়েতের অধীনস্থ সামরিক বিপ্লব কমিটি লেনিনের বিবৃতি প্রকাশ করে ঘোষণা দিল— ‘যে আদর্শের জন্য জনগণ লড়ছিল তা সফল হয়েছে।’ পরদিন সন্ধ্যায় স্মোলনিতে শুরু হয় দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেস। এতে নানা অঞ্চল থেকে ৬৫০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন, যার মধ্যে ৪০০ জনই বলশেভিক।
২৬ অক্টোবর কংগ্রেসে লেনিনের বক্তৃতাকে অভিনন্দিত করে প্রতিনিধিরা। কংগ্রেসের প্রতিনিধি এ এ আন্দ্রেয়েভ তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘লেলিন যেই মঞ্চে এলেন অমনি সমস্ত সভাকক্ষ উঠে এগিয়ে যায় লেনিনের দিকে। অবিরাম করতালি আর লেনিন জিন্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত প্রাঙ্গণে তিনি বহুক্ষণ বক্তৃতা শুরু করতে পারেননি।’ এভাবেই যাত্রা শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সোভিয়েত জনগণ যে বিরাট রূপান্তর সাধন করেছে, তার মধ্যে রয়েছে মার্কস-লেনিনবাদের বিজয়। লেনিন ১৯১৭ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ছদ্মনামে…
লেনিন তার আসল নাম নয়। তার প্রকৃত নাম ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ। রাশিয়ান স্যোশাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি গঠনের সময় তিনি ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। সাইবেরিয়ার লেনা নদীর নামানুসারে তিনি নিজের নাম রাখেন লেনিন। লেনিন ১৮৭০ সালে ২২ এপ্রিল জার শাসিত রাশিয়ার সিমবির্স্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। লেনিনের বাবা ইলিয়া নিকোলায়েভিচ উইলিয়ানভ ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। যিনি অসাধারণ মেধা আর অধ্যবসায়ের ফলে পরবর্তীতে শিববির্স্ক গুবেনিয়ার স্কুল পরিচালক হন। গণশিক্ষার ব্যাপারে অনেক কিছু করেন— গ্রামাঞ্চলে স্কুল খোলেন, শিক্ষকদের সাহায্য করেন, অরুশীয় অধিবাসীদের শিক্ষা বিস্তারের দিকে তার খুবই নজর ছিল এবং গণতন্ত্রবাদের কট্টর সমর্থক ছিলেন। তার মা মারিয়া আলেক্সান্ড্রানভা উইলিয়ানভা ছিলেন নামকরা চিকিৎসকের বিদুষী কন্যা এবং একজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা। লেনিনের মা মারিয়া আলেক্সান্দ্রানভা পড়াশোনা করেন বাড়িতে। কয়েকটি বিদেশি ভাষা জানতেন, সাহিত্যে তার ভালো দখল ছিল আর ভালোবাসতেন সংগীত। ইলিয়া ও মারিয়া উইলিয়ানভ পরিবারে ছেলেমেয়ে ছিল মোট ছয়জন আন্না, আলেক্সান্দর, ভ্লাদিমির, ওলগা, দিমিত্রি এবং মারায়া। বাবা-মা তাদের জন্য বহুমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। চেয়েছিলেন তাদের সৎ, বিনয়ী, পরিশ্রমী, জনগণের অভাব অনটনের প্রতি সজাগ করে তুলতে। পিতা-মাতার বিচার বিবেচনা, লেনিন এবং তার ভাইবোনদের মধ্যে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তার দাদা আলেক্সান্ডারকে জার হত্যার ষড়যন্ত্রের অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয়। বিপ্লবী অ্যানা ইলিচনিনা ছিলেন লেনিনের বোন এবং সহযোদ্ধা। পাঁচ বছর বয়সেই ভ্লাদিমির পড়তে শেখেন, নয় বছর বয়সে ভর্তি হন সিমবির্স্ক জিমনেশিয়ামের প্রথম শ্রেণিতে। পড়াশোনায় ভ্লাদিমির ছিলেন খুবই মনোযোগী। মেধা আর পাঠের প্রতি গুরুত্ববোধে তাকে আলাদা করে চেনা যেত। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বিভিন্ন ধরনের বই পড়তেন লেনিন। তার পছন্দের সাহিত্যের মধ্যে একটা বড় অংশজুড়ে ছিল বিপ্লবী গণতন্ত্রী লেখকরা। এরা ছিলেন বেলিনস্কি, হেতসের্ন, চের্নিশেভস্কি, দব্রলিউবভ ও পিসারেভের রচনা। এদের অনেকের লেখা তখন নিষিদ্ধ ছিল, তবু ভ্লাদিমির তা বাদ দেননি। ১৮৮৭ সালে সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। লেনিনের বৈচিত্র্যেভরা জীবনে প্রেমের সুবাতাস বইয়ে দেন আরেক মার্কসবাদী স্কুলশিক্ষিকা নাদিয়া। ১৮৯৪ সালে নাদিয়ার সঙ্গে পরিচয় ঘটে লেনিনের। তখনো দুজনের কেউই জানতেন না মার্কসবাদ আর বিপ্লবের আড়ালে দুজনের মনে ভালোবাসার সৃষ্টি হচ্ছে। এর পরপরই ১৮৯৮ সালে নাদিয়াকে বিয়ে করেন লেনিন। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত তাদের সুখী দাম্পত্যজীবন অক্ষুণ্ন ছিল।
নির্বাসিত জীবনে লেনিন
প্রত্যক্ষ বিপ্লবী কর্মকাণ্ড থেকে বিছিন্ন হলেও তিনি পুরোদমে পড়াশোনা ও লেখালেখি শুরু করেন। লেনিন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’ নির্বাসিত জীবনেই লিখে শেষ করেন। ১৮৯৯ সালে তা প্রকাশিত হয়। বইটি মূলত কার্ল মার্কসের ‘পুঁজি’ বইটির সরাসরি পূর্বানুসরণ। ১৯০০ সালের ২৯ জানুয়ারি নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হয়। ১৯০০ সালে নির্বাসন থেকে মুক্তি লাভ করে একটি সংবাদপত্র (বিপ্লবী প্রচারপত্র) প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে লেনিন বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় শহর (মিউনিখ ১৯০০-০২, লন্ডন ১৯০২-০৩, জেনেভা ১৯০৩-০৫ ) সফর করেন।
এ সময় তিনি জুলিয়াস মার্টয়-এর সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশের বাইরে থেকেই ‘ইস্ক্রা’ (স্ফুলিঙ্গ) নামক একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি সর্বহারা শ্রেণির অধিকার প্রভৃতি নিয়ে কিছু পত্র-পত্রিকা ও বই রচনা করেন। ১৯০২ সালে তিনি ‘আমাদের কী করতে হবে’ শীর্ষক একটি পুস্তক রচনা করেন, যাতে বলা হয়, ‘বিপ্লবের নেতৃত্ব এমন এক অনুশাসিত দলের হাতে থাকা উচিত, যাদের প্রধান কাজ হবে অধিকারের জন্য লড়াই করা’। নির্বাসনে থাকাকালীন লেনিন ৩০টি বই রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’, যা মার্কসবাদী দর্শনের ওপর ভিত্তি করে রাশিয়ার অর্থনীতি সম্বন্ধে বিচার-বিশ্লেষণ করেছিল। লেনিনের রচনাসমূহ তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ— অর্থশাস্ত্র বিষয়ক রচনা, ‘কৃষক জীবনে নয়া অর্থনীতির বিকাশ’, ‘বাজার প্রসঙ্গ’, ‘নারোদবাদের অর্থনৈতিক মর্মবস্তু’, ‘অর্থনৈতিক রোমান্টিকতাবাদ’, ‘যে উত্তরাধিকার আমরা পরিত্যাগ করি’, ‘জনগণ বন্ধুরা কী ও তারা কীভাবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে লড়াই করে’, ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’, ‘নয়া অর্থনৈতিক নীতি’ এবং ‘প্রলেতারীয় একনায়কত্বের যুগের অর্থনীতি ও রাজনীতি’। দ্বিতীয় ভাগ— রাজনীতি বিষয়ক রচনা, যথা— ‘কী করিতে হইবে’, ‘এক কদম আগে দু’কদম পিছে’, ‘গ্রামের গরিবদের প্রতি’, ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির দুই রণকৌশল’ ‘সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’, ‘এপ্রিল থিসিস’, ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’, ‘কমিউনিজমে বামপন্থার বাল্যব্যাধি’ এবং ‘প্রলেতারীয়ান বিপ্লবের কর্মসূচি’। তৃতীয় ভাগ— দর্শনবিষয়ক রচনা, যথা— ‘মার্কসবাদের তিনটি উৎস ও তিনটি অঙ্গ’, ‘বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষবিচারবাদ’, ‘দ্বন্দ্বতত্ত্ব ও সংগ্রামী বস্তুবাদের তাত্পর্য’।
এ সময়েই তিনি রাশিয়ার শোষিত শ্রমিক এবং সর্বহারা গোষ্ঠীকে নিয়ে একটি দল গঠনে উদ্যোগী হন। সব কল-কারখানা থেকে ব্যক্তি মালিকানা প্রত্যাহার করে সেগুলোতে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। তিনি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়নের যে অর্থনৈতিক তত্ত্ব দেন, তা ‘লেনিনের নতুন অর্থনৈতিক নীতি’ নামে পরিচিত। তার ভাবধারাকে
‘লেনিনবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়— যা মার্কসবাদের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত।
বিপ্লবের কর্ণধার
১৯১৭ সালের মহান নভেম্বর বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন লেনিন। নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিংশ শতাব্দীর মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম দিকচিহ্নকারী ঘটনা হলো নভেম্বর বিপ্লব। এই বিপ্লব শোষণভিত্তিক সমাজের অবসান সূচিত করল। পুঁজি ও মুনাফার স্বার্থে নয়, শোষিত-বঞ্চিত জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তার প্রথম প্রতিফলন ঘটল। বিপ্লব সফল করা, শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সমস্ত ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ থেকে রক্ষা করা এবং একটি পশ্চাত্পদ পুঁজিবাদী দেশে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার কাজ এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ছিল লেনিনের অসাধারণ নেতৃত্ব। পুঁজির শোষণ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও যুদ্ধ— এ সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সংগ্রামকে সম্পূর্ণ নতুন স্তরে উন্নীত করার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ
মার্কসীয় মতবাদকে নানাভাবে বিকশিত করলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। সে জন্যই তার মৃত্যুর পর বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, এই মতবাদকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হিসাবে অভিহিত করাই হবে সঠিক। তারপর থেকেই সমগ্র বিশ্বে এই মতবাদকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হিসাবে অভিহিত করা হয়। মার্কসবাদী মতাদর্শকেও সমৃদ্ধ করলেন লেনিন সমগ্র জীবন ধরেই বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্যে নিয়োজিত ছিলেন লেনিন। লেনিনের মধ্যে প্রকৃত মার্কসবাদী হিসাবে তত্ত্ব ও কর্মের অসাধারণ সমন্বয় ঘটেছিল। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে এই মহান বিপ্লবী নেতার জীবনাবসান ঘটে। সমগ্র জীবন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যাপৃত থাকার সঙ্গে সঙ্গে মার্কসবাদী মতাদর্শ আত্মস্থ করা ও তাকে আরও সমৃদ্ধ করার কাজেও তিনি ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন।
ছবি: সংগৃহীত
কৃতজ্ঞতা:বাংলাদেশপ্রতিদিন