| 27 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে প্রবন্ধ সাহিত্য

মধুসূদনকে আজীবন দগ্ধ করেছিলেন উপেক্ষিতা রেবেকা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও নাট্যকার তথা বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। আজ ২৫ জানুয়ারী তার শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।


 

 

তরুণ বয়সে মধুসূদনের ‘আত্মবিলাপ’ কবিতা পড়ে খুব রাগ হত রেবেকার উপর। মনে হত প্রেমের ছলাকলা্য় কবিকে ভুলিয়ে শেষে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তিনি। রেবেকা রূপসী ছিলেন কিনা, হেনরিয়েটার চেয়ে তাঁর রূপ বেশি ছিল না কম ছিল, আমরা জানি না। জানার কোন উপায়ও নেই।
বাবার সম্বন্ধ-করা বিয়ে এড়াবার জন্য কিংবা বিলাত যাবার সুযোগের জন্য মধুসূদন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন হঠাৎ। তারপরে বিশপস কলেজে পড়তে পড়তে চলে গেলেন মাদ্রাজ। মাদ্রাজ মেইল আ্যন্ড ফিমেইল অরফ্যান আ্যসাইলাম আ্যন্ড বয়েজ ফ্রি ডে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন মধুসূদন। মাইনে ৪৬ টাকা। রেবেকা থাকতেন ফিমেইল আ্যসাইলামে আর লেখাপড়া করতেন অরফ্যান আ্যসাইলামে। তখন প্রায় অনাথ রেবেকা। আলাপ হল মধুসূদনের সঙ্গে। তরুণ বয়েস থেকে মধু যে নীলনয়নার স্বপ্ন দেখতেন, তাকে খুঁজে পেলেন রেবেকার মধ্যে। সমবেদনা ও সহমর্মিতা অচিরেই পরিণত হল প্রেমে । আত্মীয়-বান্ধববিচ্যুত মধুসূদনের নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য একজন আন্তরিক বন্ধুর প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে রেবেকাও আকৃষ্ট হয়েছিলেন মধুসূদনের প্রতি তাঁর পাণ্ডিত্য ও হৃদয়াবেগের জন্য, ইংরেজ না হয়েও ইংরেজের মতো চালচলন ও বাগব্যবহারের জন্য। বন্ধুজনের আপত্তি থাকলেও রেবেকা রাজি হয়ে গেলেন বিয়ের প্রস্তাবে।
রেবেকাকে মধু যে ভালোবেসেছিলেন তার প্রমাণ আছে চিঠিপত্রে। প্রমাণ আছে কবিতায়। ‘ম্যাড্রাস সার্কুলেটর’ পত্রিকায় টিমোথি পেনপোয়েম ছদ্মনামে বিয়ের একবছরের মধ্যে চারটি কবিতা লিখেছিলেন মধুসূদন, সেসবই প্রমাণ।
বিয়ের পরে সংসার। সংসারের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে বোহেমিয়ান মধু দিশেহারা। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে কখনও। কখনও বদল করতে হচ্ছে বাসা। সেসব মানিয়ে নিচ্ছেন রেবেকা। তাঁর প্রেম. মমতা আর সহনশীলতা প্রমত্ত মধুর জীবনে দেখা দিচ্ছে প্রলেপ হয়ে। বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি। কাব্য রচনায় উৎসাহিত হচ্ছেন মধুসূদন। লিখে ফেললেন ‘ক্যাপটিভ লেডি’। সে কাব্যের বন্দনা অংশে আছে রেবেকা বন্দনা। রেবেকাই তো তাঁর মধুর স্বপ্ন, রেবেকার স্নিগ্ধ দৃষ্টিই তো তাঁর প্রেরণা, রেবেকাই তো তাঁর জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছে দান।
বিয়ে হল। তারপরে সন্তান। একের পর এক বার্থা, ফিবি, জর্জ। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। বাড়তি আয়ের জন্য মধু ‘আ্যথেনিয়াম’, ‘ম্যাড্রাস ক্রনিকল’ এসব পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। চাকরি পেয়েছেন মাদ্রাজ স্কুলে। স্ত্রীর প্রতি, সন্তানদের প্রতি অভাব নেই ভালোবাসার। সেই ভালোবাসা শক্তি দিচ্ছে রেবেকাকে। শেখাচ্ছে আরও সহনশীল হতে। এর মধ্যে মধু ‘রিজিয়া’ নাটক লিখেছেন। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঘুরে এসেছেন কলকাতা থেকে।
আবার এরই মধ্যে মধুসূদনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে হেনরিয়েটার সঙ্গে। কি ছিল বিধাতার মনে। জর্জ জাইলস হোয়াইটের বড় মেয়ে আ্যমেলিয়া হেনরিয়েটা সফাইয়া। সদ্য মাকে হারিয়েছে হেনরিয়েটা। ঠিক মধুর মতো। কালবিলম্ব না করে হেনরিয়েটার বাবা হাঁটুর বয়েসি একটি মেয়েকে বিয়ে করে এনেছেন। এও ঠিক মধুর বাবার মতো। ‘বংশরক্ষার’ তাগিদে রাজনারায়ণও তাই করেছিলেন। তাহলে হেনরিয়েটা তো মধুর মতো হতভাগ্য। সমবেদনা থেকে অনুরাগ। মধুকে দগ্ধ করছে বিবেক। তবু মধু আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যুক্তি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁর প্রিয় রোমান্টিক কবিদের জীবনে কি ঘটেছিল! একাধিক প্রেমিকা ছিল কবি বায়রনের। বিবাহিতা স্ত্রী হ্যারিয়েটকে ফেলে রেখে কবি শেলি ছুটেছিলেন মেরি গডউইনের সঙ্গে। আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি সাজান মধু। রেবেকা ভালো মেয়ে, সহনশীলা। কিন্তু তাঁর কাছে কি intellectual companionship পান মধুসূদন? রেবেকা স্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু সহধর্মিনী হতে পেরেছেন কি মধুসূদনের?
রেবেকা স্বামীর পদস্খলনের খবর পেলেন। তীব্র তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ । হইচই করলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন নীরবে। জোর করে আটকেরাখবেন না স্বামীকে। যাহা যায় তাহা যাক। কোন দাবি করবেন না স্বামীর কাছে। ততদিনে তাঁর চতুর্থ পুত্র মাইকেল জেমস এসে গেছে। চার-চারটি নাবালক সন্তানের ভরণ-পোষণের সমস্যা আছে। তা থাকুক, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করবেন রেবেকা। স্বামীর প্রেমহীন সহানুভূতির ভিক্ষা চান না তিনি। চলে যান মধু। কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদ তিনি দেবেন না।
পৈত্রিক সম্পত্তি উদ্ধারের অজুহাতে মধুসূদন চলে এলেন কলকাতায় । জাহাজে এলেন তিনি মি. হোল্ট ছদ্মনামে। কেন এই ছলনা? রেবেকা যাতে না জানতে পারেন, তার জন্য এই ব্যবস্থা? আর কোনদিন ফিরে যান নি মধুসূদন। কোন খোঁজখবর নেন নি স্ত্রী-পুত্রের । বছর ছয়েক পরে বিলেত যাবার সময় তাঁর জাহাজ তিন দিন মাদ্রাজ বন্দরে দাঁড়িয়েছিল। মধু নামেন নি জাহাজ থেকে। দশ মাসের পুত্র মাইকেলের মুখ কি তাঁর মনে পড়ে নি? কে জানে!
তাই বলে কি মধুর মনের আয়না থেকে চিরকালের মতো মুছে গিয়েছিল রেবেকা ও তাঁর সন্তানরা? নয়ন সম্মুখে না থাকলেও নয়নের মাঝখানে কি ঠাঁই নেয় নি? প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। পরোক্ষ প্রমাণ লুকিয়ে আছে তাঁর কাব্য-কবিতায়।
‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য রাধার বিলাপ যেন ঠিক মানবী রেবেকারই বিলাপ:
কে তুমি শ্যামেরে ডাক রাধা যথা ডাকে
হাহাকার রব?
কে তুমি কোন যুবতী ডাক এ বিরলে, সতি
অনাথা রাধিকা যথা ডাকে গো মাধবে?
‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের একাধিক পত্রে স্বামীবিচ্যুতা নারীর উক্তিতে ফুটে ওঠে রেবেকারই মনোভাব। রাজা দশরথ যৌবনবতী কৈকেয়ীকে ভোগ করার বাসনায় দিয়েছিলেন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি। কৈকেয়ীর কণ্ঠে বেজে উঠেছে রেবেকারই কথা :
কাম মদে মাতি যদি তুমি
বৃথা আশা দিয়া মোরে ছলিলা, তা কহ-
নীরবে এ দুঃখ আমি সহিব তাহলে।
কামীর কুরীতি এই শুনেছি জগতে,
অবলার মনঃ চুরি করে সে সতত
কৌশলে, নির্ভয়ে ধর্মে দিয়া জলাঞ্জলি
শূর্পনখার যন্ত্রনাকাতর উক্তিতে আমরা রেবেকার কথাই শুনতে পাই : প্রেম-উদাসীন যদি তুমি গুণমণি,
কহ কোন যুবতীর (আহা, ভাগ্যবতী রমাকুলে সে রমণী)- কহ শীঘ্র করি, কোন যুবতীর নবযৌবনের মধু বাঞ্ছা তব ?
এখন যেন আমাদের মনে হয় ‘আত্মবিলাপ’ কবিতার চতুর্থ স্তবকে কবি হেনরিয়েটার কথাই বলেছেন । স্ত্রী ও সন্তান থাকতেও কবি পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিয়েছিলেন হেনরিয়েটার প্রেমে। ‘না দেখিলি না শুনিলি এবেরে পরাণ কাঁদে’। হেনরিয়েটা কবির জন্য অনেক করেছেন, এ কথা ঠিক। কিন্তু রেবেকার কোন দোষ তো ছিল না। তাই মধুসূদনের অন্তরের গভীরে ক্রমে ক্রমে জমে উঠেছিল অনুশোচনার পাহাড়। সে বেদনা প্রকাশ করতে পারেন নি তিনি। সে বেদনার কোন অংশীদার ছিল না। তিল তিল দগ্ধ হয়েছেন তিনি। দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত