| 9 অক্টোবর 2024
Categories
শিশু-কিশোর কলধ্বনি

লকডাউন ও শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য 

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

কোভিড-১৯ মহামারীর এই দীর্ঘ লকডাউনের সময়ে শিশুর শারীরিক সুস্থতার সাথে সাথে তার মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখছেন কি?  

কোভিড-১৯ এর আঘাতে বিশ্বে অন্তত ৬০%  দেশে চলছে লকডাউন,  এরমধ্যে ১.৫ বিলিয়ন বাচ্চাদেরই স্কুল এখন বন্ধ। অভিভাবক হিসেবে শিশুর বাড়তি যত্ন রাখাটা এই সময়ে বেশ চ্যালেঞ্জিং।  দীর্ঘ ছুটি, বাড়ির বাইরে মুক্ত বাতাস নিতে মানা, স্কুল বন্ধ, বন্ধুদের সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগহীনতা,  হরেক রকম মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ না হওয়া এবং একই সাথে কোভিডের আতঙ্ক, সবকিছু মিলে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এই নতুন পরিবেশ বেশ ব্যতিক্রম।

সাধারনত শিশু কিশোররা হয় দুরন্ত, বিনোদনপ্রিয় এবং বন্ধুসুলভ। তারা চায় মুক্ত ভাবে ছুটোছুটি করতে,  বন্ধুদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠতে কিংবা স্কুলের শাসনে আদরে বড় হতে হতেই তারা হয়তো নিজেদের জীবনের প্রতি একঘেয়ে হয়ে যায় না। এই দীর্ঘ বন্ধে এবং কোভিডের ভয়াবহতায় তাই এই বিচিত্র মানসিক চাপে বিভিন্ন শিশুর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে ; বিষন্ন হয়ে থাকা,  নিজেকে গুটিয়ে রাখা,  অল্পতেই রাগ করা,  মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া বা ভয় পাওয়া।  যার ফলস্বরূপ বিভিন্ন শিশুর মধ্যে দেখা যাচ্ছে সেল্ফ হারম এর বিভিন্ন শংকা। 

সাধারণত এই সময়ে শিশু চায় পরিবারের সদস্যদের থেকে বাড়তি মনোযোগ এবং সহযোগিতা। তাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আচরন, একটু বেশি যত্নই রাখতে পারে শিশুকে কোভিডের সময়ে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


আসুন জেনে নেই কোভিডের এই সময়ে বাড়ির শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যর উন্নয়নে আমাদের করনীয় সমূহ:

১. শিশুকে কোভিড সম্পর্কে অন্ধকারে রাখবেন না।  বরং শিশুকে নিয়ে বসে তাকে মহামারীর প্রকৃত তথ্য বুঝিয়ে বলুন। শিশুকে আশ্বস্ত করুন করোনার ভাইরাস কি? এর প্রতিকার ও এর প্রতিরোধ সম্পর্কে। শিশুকে অভয় দিন যাতে সে বুঝে যে আপনি তার পাশে আছেন। 

২. শিশুকে শিক্ষা দিন বন্ধু বান্ধব হতে পাওয়া বা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা বিভিন্ন তথ্য সত্যি নাও হতে পারে। যেকোন তথ্য দেখেই তা বিশ্বাস করে বিচলিত না হয়ে সে যেনো বাড়ির বড়দের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে এ ব্যাপারে বুঝিয়ে বলুন। 

৩. আপনার বাড়িতে স্কুলপড়ুয়া শিশু এবং একই সাথে কোভিড রোগী আছে?  বা আপনিই  কোভিডে আক্রান্ত? শিশুকে আশ্বাস দিন (নিজে কোভিড (+) হলে ভিডিও কলে) যাতে সে দুশ্চিন্তা না করে নিজের যত্ন এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে।  মনে রাখবেন এই অসুখে বেশিরভাগ মানুষই ভালো হয়ে যায়। তাই অবশ্যই এই মনোবল থাকতে হবে যে, ‘আমি ভালো হয়ে যাবো।’

৪. শিশুকে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সচেতন করুন। অনেকে মনে করেন বাইরে যাওয়া হচ্ছে না, তাই হয়তো একদিন পরপর গোসল করলেই হবে। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য প্রত্যেকদিন গোসল আবশ্যক। তাই শিশুকে প্রত্যহ দুপুর ১টার ভেতরে গোসল করানোর অভ্যাস করান।  যদি শিশুর ঠান্ডা লাগার সমস্যা থাকে তবে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন। কারণ গোসলের মাধ্যমেই মানুষ সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে আবার সতেজ হয়। 

৫. শিশুকে স্যানিটাইজার এর সঠিক ব্যবহার, ২০ মিনিট পরপর সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া,  হাঁচি কাশি দিলে কনুই বা রুমাল ব্যবহার করা  ইত্যাদির ব্যাপারে সঠিক ধারণা দিন।  

৬. এ সময় মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশের জন্য প্র‍য়োজন নিজেকে ব্যস্ত রাখা। তাই শিশুর মধ্যে গল্পের বই পড়ার,  ছবি আকার, বা নাচ/ গান আগের থেকে করে থাকলে তা রুটিন অনুযায়ী চর্চা করার বা  নতুন কোন অভ্যাস যেমন: গিটার/ ভায়োলিন শিখার, নতুন কোন ভাষা শেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন। অনলাইনে ইদানিং বিভিন্ন পেইড আনপেইড কোর্স আছে যার মাধ্যমে শিশু নতুন কিছু গুণ আয়ত্ত করতে পারে। মোট কিথা চেষ্টা করুন শিশু যাতে তার দিনের বেশিরভাগ সময় টিভি,  ভিডিও গেইমস,  ইন্টারনেটে না দেয়। 

৭. শিশুর সাথে সময় কাটান।  তার সাথে ছাদে হাটাহাটি করুন, ঘুড়ি ওড়ান বা বাগানের পরিচর্যা করুন। শিশুরা প্রায়ই চায় তাদের সাথে বড় কেউ খেলুক। এই লকডাউনে শিশুর খেলার সাথি হোন আপনি নিজে। ক্যারাম, লুডু,  দাবা,  মনোপলি এর মতো ইন্ডোর গেইমস বা বরফপানি,  ক্রিকেট,  লুকোচুরি এর মতো আউটডোর গেইমস ছাদে খেলতে পারেন, যা আপনার শিশুর সাথে সাথে আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের  বিকাশেও ভূমিকা রাখবে।   

৮. শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। কখনোই শিশুকে ভাবতে দিবেন না যে সে ছোট বলে তার মতামতের বা তার কথার গুরুত্ব নেই। কারণ শিশুর মনের এই ধারনা থেকেই শিশু হতে পারে ডিপ্রেশনের স্বীকার কিংবা ভুগতে পারে অস্তিত্বহীনতায়। শিশুর কথা শুনে তার পয়েন্ট অফ ভিউ বুঝার চেষ্টা করুন।  আপনার কাছে যদি তার কোন মতামত ঠিক না লাগে তবে তাকে উদাহরণ দিয়ে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন।  সে বুঝবে। 

৯. আপনার নিত্যদিনের কাজে শিশুকে ছোটখাট সাহায্য করতে শেখান। এতে শিশু সারাক্ষণ শুয়ে বসে না থেকে শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে ঝরঝরে রাখবে। ফার্নিচার মোছা, খাবার টেবিল গোছানো,  নিজের বিছানা গোছানো, ঘর গোছানো ইত্যাদি কাজে সাহায্য করতে উৎসাহ দিন। 

১০. শিশু কোন ভূল করলে তার ভূল তাকেই সমাধান করতে চেষ্টা করতে বলুন।  যেমন,  ধরুন সে খেলতে খেলতে রুম অগোছালো করে ফেলেছে। আপনি তাকে বলুন তার নিজের রুম নিজে পরিষ্কার করতে,  তাকে সাহায্য করুন। কিন্তু আসল কাজটি তাকেই করতে দিন।  এভাবে সে নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস আউত্ত করবে      

১১. শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য প্রত্যক্ষভাবে তার খাবারের সাথে জড়িত। তাই অবশ্যই শিশুর প্রতিদিনের খাদ্য যেন সুষম হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখুন। আমিষ, শর্করা, স্নেহ এর সাথে প্রচুর শাকসবজি এবং ফল খাওয়ানোর অভ্যাস করুন। সাথে নূন্যতম ৮ গ্লাস পানি এবং পর্যাপ্ত ভিটামিন এ, সি, ডি এবং জিঙ্ক। 

১২. শিশুর জন্য একটি দৈনিক রুটিন করুন। এতে তার স্কুলের কাজ, ব্যায়াম,  খেলাধুলা,  সাহিত্য চর্চা, খাবার, গোসলের সময় নির্ধারন করে দিন। 

১৩. শিশুকে উৎসাহিত করুন। ছোট বা বড় যেকোন কাজের সাফল্যেই তাকে প্রশংসিত করুন। এতে শিশুরা দ্বিগুণ উৎসাহে কাজটি করবে পরবর্তিতে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় যেই কাজগুলো বর্জনীয়:

১. শিশুর সামনে যেকোন খারাপ সংবাদ, মৃত্যু সংবাদ দেখা হতে বিরত থাকুন৷  এতে শিশুরা ভয় পেয়ে যায়। বরং তাকে সাথে নিয়ে দেশ বিদেশের বিজ্ঞান-সংস্কৃতি- খেলাধুলা নিয়ে টিভির আয়োজনগুলো দেখতে পারেন।

২. শিশুকে বকা দিবেন না । কোন কাজে ভুল করলে তাকে ধৈর্যের সাথে বুঝিয়ে বলুন। মনে রাখবেন আপনি যত বকা দিবেন তার মেজাজ হবে তত খিটখিটে। 

৩. শিশুর সামনে ঝগড়া করবেন না। একজন আরেকজনকে অসম্মান করবেন না এবং গালাগালি করবেন না। এতে কোমলমতি শিশু মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। 

৪. শিশুর গায়ে কখনোই হাত তুলবেন না। আপনি প্রথমবার মারার পর হয়তো সে ভয় পাবে কিন্তু এরপর থেকে তার আপনার প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মাবে ধীরে ধীরে। 

৫. শিশুকে কখনোই অন্য কারো সাথে তুলনা করবেন না। কারণ এই ব্যাপারটিতে শিশুরা ভীষণ সংবেদনশীল।  তারা ধীরে ধীরে নিজেদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। 

৬. শিশুর যখন যা আবদার তাই মেটাবেন না। বরং তাকে অপেক্ষা করান এবং বুঝতে শেখান যে কোন কিছু পেতে হলে তা কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। 

৭. শিশুকে ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার করতে দিবেন না।  শিশুর সার্চ ইঞ্জিনে সিকিউরিটি রাখুন।  শিশু কি কি কন্টেন্ট দেখছে তা মনিটর করুন।      

আপনার শিশুর মানসিক সুস্থতার দায়ভার আপনার নিজের। শিশুর প্রতি আপনার ব্যবহার ও যত্নই পারে শিশুকে এই মহামারীর সময়ে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে।      

 

 

 

 

 

 

 

     

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত