| 29 মার্চ 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

সহজ ভাবনার বাউল পথ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 বাউল নিয়ে নানাজনের নানা মত। তবে বিশ্বাসীরা এই মতবাদকে একটু বিকৃতভাবে প্রচার করে থাকেন। যুগ-যুগ ধরে এই ধারাবাহিকতা লক্ষ্যণীয়। যে কারণে বেশিরভাগ পরিবারে এই মত নিয়ে নেতিবাচক ভাবনা লক্ষ্য করা যায়। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে।

নানা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিরোধের মাঝেও বাউল সমাজ গড়ে উঠেছে। সংখ্যায় কম হলেও তাদের সৎভাব, ন্যায়-নিষ্ঠা, পরোপকার এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার সু-খ্যাতিও আছে। ধর্মীয় মতাদর্শে ভিন্নমত একদিকে যেমন তাদের কোনঠাসা করেছে, তেমনি বাউল মতাদর্শিরা সমাজে অনাচারী বা ক্ষতিকর নয়,তাও প্রমাণিত। তাই বিশ্বাসীদের মধ্যে উদারপন্থীরা বাউলদের অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণও করেছে। সেই নমুনা আমরা লক্ষ্য করে থাকি- বাউল উৎসব, সাধুসঙ্গ থেকে শুরু করে গানের আসরেও তাদের অংশগ্রহণ। যা এই মত অগ্রসর হওয়ার পথে তাদের এক ধরনের সমর্থন।

বিদ্বেষ থাকলেও বাউল গান সব পরিবারে জায়গা করে নিয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপারটি হলো- যারা বাউল মত ও এই পথের মানুষগুলোকে ঘৃণা করেন।নানাভাবে বিদ্রুপ এবং গালি দেন।তারাও বাউল গান বেশ মনোযোগের সঙ্গে শোনেন। অনেকে কণ্ঠও মেলান। এছাড়া অধিকাংশ মানুষের কাছে এই গান প্রিয় হয়ে ওঠায় এখন প্রকাশ্যে বিরূপ মন্তব্য শোনা যায় না বললেই চলে। অথচ একটি সময় বাউল নিয়ে ফতোয়া জারি থেকে শুরু করে আন্দোলনও হয়েছে। আউল-বাউলদের অনেকে নানা অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রকৃতিতে বিলিনও হয়েছেন অনেকে। এরপরও বিধ্বংসী বা আগ্রাসী হওয়ার নজির নেই এই সম্প্রদায়ের মানুষের।

সুরের আবেশ এবং দেহ কেন্দ্রীক ভাবনার মানুষগুলো নিয়ে বিশ্বাসীদের আগ্রহের শেষ নেই। তাদের সাধনা এবং আহার-নিদ্রা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবন নিয়ে উন্মুখ সবাই। অথচ বাউলরা আপন মনে খুঁজে ফেরেন অপার সাঁইকে। তারা কারো মুখাপেক্ষি বা কারো সমালোচনায় থাকেন না। আপন কর্মে আপনাকে চেনার চেষ্টা তাদের সারাক্ষণ। তবে বাউলদের নিয়ে নাগরিক সমাজে প্রশ্নের শেষ নেই। কারা বাউল, কেন বাউল, কখন বাউল, কীভাবে বাউল- এমন অজস্র প্রশ্নের সমাধান পেতে চায় তারা। বাউলও যেমন সহজ নয়; তেমনি সহজভাবে তারা উত্তরও পেতে চায় না। আবার বাউলদের মতো দৃঢ় প্রত্যয়ে অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে খুঁজে ফেরার বাসনাও তাদের নেই। কিন্তু জানতে চায়। তবে এটা দোষের নয়। এরআগে অবশ্য একটা বিষয় জানতে হবে- বাউলদের কিছু বিষয় কেবল বাউলরাই জানতে পারে। অন্যরা নয়। অনেকের কাছে মনে হতে পারে- এ আবার কেমন মত। সবাই জানতে পারবে না। অবশ্য, জানতে পারবে না তা নয়; বাউলপথে নিজেকে সমর্পন না করলে জানা যাবে না। বিষয়টি আরো একটু পরিস্কার করা দরকার- মনে রাখতে হবে ‘বাউল’ গুরুবাদী মতবাদ। এই পথে শুধু সমর্পন করলেই হবে না। যখনই গুরু মনে করবেন আপনি জানার যোগ্যতা অর্জন করেছেন- তখনই কেবল জানবেন; ‘যে যোগে জগৎ সৃষ্টি, নিগুঢ় বিধান ভাব-অচারী, কাম আর কর্ম এক সাথে নয়; মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’। নিরন্তর সত্যের এই উপলব্ধি আপনাকে দেখাবে বাউলপথ। যে পথ দুর্গম এবং কঠিন এক সাধনার। এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে বাউল কী বা বাউল কী কোনো ধর্ম ?

যে বাউল নিয়ে এতো কৌতুহল। সেই বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়েই রয়েছে নানা মত। কেউ বলেন- বাউল শব্দটি ‘বাতুল’ থেকে এসেছে। যার অর্থ পাগল। অনেকে আবার ‘ব্যাকুল’ শব্দটিও বলে থাকেন। বাউলদের আত্মানুসন্ধানে ব্যাকুল থাকার বিষয়টি এখানে প্রাধ্যান্য পেয়েছে। তবে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে বাউল শব্দের প্রয়োগ আছে। আর পনেরো শতকে শাহ মোহাম্মদ সগীরের ইউসুফ জুলেখা, মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়, ষোল শতকের বাহরাম খানের লায়লী-মজনু এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে বাউল শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতক কিম্বা তার আগ থেকেই বাংলায় বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে, পারস্যে অস্টম-নবম শতকের সুফি সাধনা প্রবর্তনের সময় ‘বা’আল’ নামে সুফি সাধনার একটি শাখা গড়ে ওঠে। তারা ছিল- সঙ্গীতাশ্রয়ী এবং মৈথুনভিত্তিক গুপ্ত সাধনপন্থী। মরু ভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে তারা গান গেয়ে বেড়াতো। অন্য সুফি সাধকদের মতো তারাও এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। বলা হয়ে থাকে, যখনধর্ম-জাতি-বিভেদ নিয়ে এক অস্থির সময় পার করছিলেন ভারতবর্ষের মানুষেরা।তখন মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করে এক শ্রেণীর মানুষ।সেই অন্বেষনেই সহজিয়া, সুফিবাদ ও বৈষ্ণব সহজিয়া মতের সংমিশ্রনে বাউল মতবাদের উদ্ভব।তবে এই মত প্রবর্তনের পেছনে ধর্মজিজ্ঞাসা ও আধ্যাত্মজ্ঞান অন্বেষনের পাশাপাশি সামাজিক শোষন-অবিচার-বৈষম্য এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও জাতি ভেদের মতো বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার অস্তিত্ব ও ছিল।যা এখন ও বর্তমান। আর একারণেই সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য একটি শাস্ত্রাচারহীন উদার ধর্মমতের সন্ধান অত্যন্ত স্বাভাবিক ওঠে। এই সহজিয়া সাধনার প্রতি আকৃষ্ট মানুষগুলোই সময়ের পরিবর্তনে ‘বাউল’ নামে পরিচিত হয়েছেন। তবে এই পরিবর্তনের ধারা চলে আসছে মধ্যযুগ থেকে। তাদের সমন্বিত ধর্ম চেতনা সে যুগের মরমী সাধকদের উদ্বুদ্ধ করেছে। যেখানে তাদের চিন্তা ও প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রদায়িক ধর্মের বাইরে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাউল হয়েও তাঁরা খুঁজেছেন মুক্তির পথ। অখন্ড মানবধর্মের জয়গানও তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। ভাববাদী লৌকিক ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভক্ত-অনুসারীদের মাঝেতাঁরা সামগ্রিকভাবে বিশুদ্ধ শিল্প প্রেরণা যুগিয়েছেন। পাশাপাশি আধ্যাত্ম-সাধনার গূঢ়-গুহ্য পদ্ধতি গুরু-শিষ্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে গানের মাধ্যমে। কোনো শাস্ত্র বা গ্রন্থনা থাকায় বাউল সম্প্রদায়ের সাধনভজনের একমাত্র মাধ্যম বাউল গান। যা ভাব-ভাষা ও ছন্দ-অলঙ্কার বিচারে এই গান খুব দ্রুত সমাদ্রিত হয়েছে নাগরিক সমাজেও। আর জাত-ধর্মের উর্দ্ধেঅখণ্ড মানবধর্মের পক্ষে নিবন্ধিত হয়েছে। তাই মনের মানুষকে পাওয়ার শুদ্ধ ভক্তের যে আকুতি, তা অনুসারীদের মধ্যে খুব সহজে প্রকাশও পেয়েছে।

সনাতন শাস্ত্র-আচার ও প্রচলিত সমাজ-ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাউলরা তুলে ধরেছে মানবতাবাদী এই ঘরানা। যা সম্প্রদায়ধর্মের সংকীর্ণ প্রাচীর ভেঙে উদার মিলন ময়দানের সন্ধান দিয়েছে।যেখানে কেবলই মানব প্রেম আর মানুষ ভজনার রীতি এক হয়ে মিশেছে।এছাড়া একতারা হাতে দেহ কেন্দ্রীক সাধনার মাঝেই সাঁইকে খুঁজে ফেরেন বাউলরা।

বাউলদের কোনো ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস নেই। এছাড়া মূর্তিপূজা, বর্ণবৈষম্য বা জাতিভেদেও তারা বিশ্বাসী নয়। মানবতাবাদী আচারের এই মানুষগুলো সংসার ত্যাগী এবং বাধা-বন্ধনহীন।তাদের বিশ্বাস, জন্মগতভাবে কেউ বাউল নয়; গুরুর দীক্ষা নিয়েই বাউল হতে হয়। আর এই পথ নারী-পুরুষের যুগল সাধনার। তাদের মতে,পরমারাধ্য বাউলদের মনের মানুষ। যার অবস্থান মানবদেহে। বাউলরা তাঁকে সাঁই, মুর্শিদ বা গুরু বলে থাকেন।

বাউলদের দু’টি শ্রেণী আছে- গৃহত্যাগী বাউল ও গৃহি বা সংসারী বাউল।তবে বর্তমানে গৃহি বাউলদের সংখ্যা বাড়ছে।নাগরিক সমাজের নানা ঝঞ্ঝাটে অনেকেই বাউল সমাজে আশ্রয় নিচ্ছেন। প্রথম অবস্থায় দেহ মুক্তি আর শান্তির সন্ধানে বাণী নির্ভর বাউল গানের ভাব অন্বেষনে মত্ত হচ্ছেন তারা। পাশাপাশি এই মত ও পথের সহজ ভাব-ভাবনা মনে প্রাণে ধারণ করছেন।যা শুরুতে গোপন থাকলেও আগ্রহ আরভাব-আচারে দৃশ্যমান হয়ে পড়ছে।তবে পরিবার ও বন্ধুমহলে এরকোনো প্রভাবই পড়ছে না।এই গৃহি বাউলদের মধ্যে বড় একটি অংশ নারীরা।বন্ধন, নিয়ম আর দায়িত্বের বোঝা তাদের কে মানসিকভাবে অস্থির করে তুলেছে।সেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা আশ্রয় নিচ্ছেন বাউল পথে।যেখানে সেবা-শান্তি আর ভাব-বিনিময়ে মুক্তির পথ খুঁজে ফিরছেন তারা।

ভাব-আরাধ্যের অপার সাঁইকে খুঁজে পেতে প্রবীণ বাউল সাধু-গুরুদের কাছে জড়ো হন ভক্ত-শিষ্যরা। তারা জানেন, এই পথে আরাধ্যের সব যজ্ঞ ভাব গানের ভেতর। তাই দেহের মাঝে নিজেকে খুঁজে ফেরা, আর সব যোগ-অনুযোগের হিসেব কসতে একতারার আশ্রয় নেন বাউলরা। এই বাদ্য আর গান যেন অবিচ্ছেদ্য। দু’য়ে মিলে তাদের কাছে এক-একটি গান সাধনসঙ্গীত। তবে এই পথে দেহমুক্তি আর ভক্তির পথ দেখান গুরু। যেখানে নিরামিষ ভোজন এবং মানব প্রেম সবচেয়ে বড় সত্য। যার উপর ভিত্তি করেই গুরু-পরম্পরায় দীক্ষায় প্রতিষ্ঠিত বাউল আচার।

বাউলদের প্রধান গুরুদের নামানুসারে ঘর নির্দিষ্ট রয়েছে।যেমন- লালনশাহ, পাঞ্জুশাহ, দেলবারশাহ, পাঁচুশাহ, এবং কর্তা ভজাবাসতী মায়ের ঘর।তবে কর্তা ভজাবাসতী মায়ের ঘরের বাউলরা বৈষ্ণবপন্থী।এছাড়া অন্যদের মধ্যে সুফি এবং সহজিয়ার সাধন-ভজনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য রয়েছে।আছে পোশাকেও পার্থক্য।এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়- বাউল পথে যারা নিজেদের সমর্পন করেছেন, তাদের অবশ্যই এই পাঁচ ঘরকে মানতে হয়। তা-নাহলে গুরুর অনুস্মরণীয়  ঘরে তিনি পরিপূর্ণ ভক্তের মর্যাদা পান না। এছাড়া গুরু পরম্পরার বাউল আরাধ্য তার জন্য নয় বলেই বিবেচিত।একারণে প্রাজ্ঞ গুরুদের সাধু সঙ্গে পাঁচ ঘরের ঘট স্থাপন করে বিশেষ ব্যবস্থায় স্মরণ করা হয়।

বাউলদের আরাধনা স্থল নির্জন এবং গোপনীতার জালে ঢাকা থাকে।যে সাধনায় সঙ্গিনী যেমন থাকা চাই; তেমনি দেহ কেন্দ্রিক এই সাধনার কিছু রীতি মেনে চলা অনিবার্য। নিরামিষ ভজনায় আসে নিয়ন্ত্রণ; আর দেহের মাঝে দমের খেলা করার যোগ-অনুযোগ ভক্তের হিসেবের দরজা খুলে দেয়।যেখানে কেবল তাঁরাই প্রবেশ করেন,যাঁরা সাধনায় রসিক বনে গেছেন। তারা বুঝতে পারেন-স্পর্শ আর পরশের লীলা। এই সাধনার মূলমন্ত্র- ‘টলে জীব, অটলে ঈশ্বর’। এ কারণে রপ্ত করার বিকল্প কিছু নেই। তবে গুরুর বাণী অনুস্মরণই একমাত্র কৌশল।যেখানে শত পথের দেখা মেলে। উন্মুক্ত হয়- ভক্তি-ভাব আর মুক্তির পথ।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত