| 26 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

লুইস গ্লিক: কবিতায় আত্মজীবন । ফয়জুল লতিফ চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

‘বহুকাল আগে আমি ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলাম।
প্রত্যুত্তরে আমি বাঁচতে শিখেছিলাম
পৃথিবীর সান্নিধ্য ব্যতিরেকে।
তোমাকে বলি:আমি বেঁচে ছিলাম
একটা যন্ত্রের মতো যা শুনতে পায়।
অজড় নয় অবিচল।
এক টুকরো কাঠ। এক খণ্ড পাথর।’

[প্যারাডোস: আরারাত, ১৯৯০]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে মার্কিন কবিতায় যে মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা হয় তাকে সামগ্রিকভাবে উত্তর-আধুনিকতা অভিধায় চিহ্নিত করা সমস্যাবহুল। রোমান্টিক কবিতাধারার ক্রমিক অবসানের মধ্য দিয়ে যে কবিতার জন্ম হলো তাকে কিঞ্চিৎ সুবিধাজনকভাবেই ‘নতুন কবিতা’ বলা যেতে পারে কেননা এর মধ্যে প্রত্যক্ষ হয় বিভিন্ন অভিমুখ ও অদৃষ্টপূর্ব প্রবণতাউত্তর-আধুনিকতা যার মধ্যে অন্যতম কিন্তু একমাত্র নয়। নতুন মার্কিন কবিতার সঙ্গে বাংলাভাষী পাঠকের চেনা-পরিচয় সীমিত। এর কারণ হলো ত্রিশের দশকে সূচিত হয়ে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে যে কাব্যসংস্কৃতি ক্রমশ জমাট বেঁধেছিল এবং জীবনানন্দ-অধ্যুষিত যে কাব্যরুচি প্রাধান্য লাভ করেছিল, তা ক্রমবিকশিত হয়ে আধুনিক বাঙালি পাঠকের কাছে কবিতার সর্বজনীন কষ্টিপাথর হিসেবে স্বীকৃত হয়ে গেল। এই কাব্যসংস্কৃতির প্রধান পরিচয় এককথায় জীবনানন্দীয় আধুনিকতা যা বিষয়বস্তুর বিচারে আত্মজৈবনিকতায় প্রোথিত, প্রকরণের দিক থেকে গদ্যছন্দে আশ্রিত আর উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প নানাবিধ অলংকারে সমৃদ্ধ।

সমাজ ও আত্মোপলব্ধির মিথস্ট্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কবিদের চিন্তা ও মননের জগৎ গড়ে উঠেছিল। আজও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ দাশচ্ এই তিন মহাজনের প্রভাব নানা আঙ্গিকে বিকশিত হয়ে চলেছে। নতুন মার্কিন কবিতা এই কাব্যভুবনের বাইরে।

এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কার লাভ করে লুইস গ্লিক নতুন করে মার্কিন কবিতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ‘নতুন করে’ কেননা মার্কিন কবিতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে আধুনিক বাংলা কবিতার গোড়াপত্তনের কথা যদি আমরা বিবেচনা করতে যাই, তবে এলিয়ট-পাউন্ড-ইয়েটস-এর কথা অনিবার্যভাবে স্মরণযোগ্য হয়ে ওঠে। টি. এস. এলিয়ট, যিনি ইংরেজি কবিতায় আধুনিকতার অন্যতম জনক এবং যার ‘এ লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ এবং অনিবার্যভাবে ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ যার পঠন আধুনিক বাঙালি কবির কাব্যসংস্কৃতি ও আধুনিক বাঙালি পাঠকের কাব্যরুচির শিলান্যাসে প্রগাঢ় ভূমিকা রেখেছে। তাঁর জন্ম ১৮৮৮ সালে এবং মৃত্যু ১৯৬৫ সালে। অন্য আরেকজন মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড, যাকে আমরা অধ্যয়ন করেছি প্রগাঢ় অভিনিবেশে। তাঁর জন্ম ১৮৮৫ সালে আর মৃত্যু এই সেদিন ১৯৭২ সালে; যদিও জীবনের শেষ বছরগুলো কেটেছে করুণ অসামর্থ্যে। আমরা ই. ই. কামিংসকেও (১৮৯৪-১৯৬২) সযত্নে অধ্যয়ন করেছি। রবার্ট ফ্রস্ট, এ তল্লাটে যার জনপ্রিয়তা প্রভূত পরিমাণ, তাঁর জন্ম ১৮৭৪ সালে, মৃত্যু ১৯৬৩ সালে। অডেন (১৯০৭-১৯৭৩) যতটা ইংরেজ ততটাই মার্কিনি; তাকে আমরা আস্বাদন করেছি ভালোভাবে। আধুনিক বাঙালি চিত্রকরের কাছে অমৃতা শেরগিল (১৯১৩-১৯৪১) হয়তো ততটা আপন কেউ নন, কিন্তু একজন বিদগ্ধ বাঙালি কবিতা পাঠকের কাছে সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩) ঘনিষ্ঠ এক কবিসত্তা: জীবনের প্রথমার্ধে আত্ম-অবসান বেছে নিয়ে দু’জনে সগোত্রীয় হয়েছেন। আরও স্মর্তব্য, আমরা যেমন নোবেল বিজয়ী ব্রিটিশ কবি শেমাস হিনিকে সমাদর করেছি, তেমনি টেড হিউজকেও (১৯৩০-১৯৯৮) সমাদর করেছি নির্দি্বধায়। আর অ্যালেন গিন্সবার্গ (১৯২৬-১৯৯৭), যিনি ১৯৭১ সালে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ লিখে আমাদের আত্মীয়তা বরণ করেছেন, তাঁর কবিতা আমরা পাঠ করেছি আগ্রহে।

এতদ্‌সত্ত্বেও মোটের ওপর মার্কিন কবিতা সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা খি তই থেকে যায়; কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে, যদিও মনে করার বিশেষ কোনো কারণ নেই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটা মার্কিন কাব্যের অভিমুখ বদলে দেওয়ার জন্য বিশেষ কোনো ঘটনা। মার্কিন কবিতার মানচিত্র যারা গঠন করেছেন, তাদের কারো সঙ্গেই এ যাবৎ আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় গড়ে ওঠেনি।

বলা যেমন কঠিন ভারত বিভাগোত্তর কালে বাংলাদেশের দশজন বড় কবি কে? যদিও আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমানকে নিয়ে দ্বিমত করার মানুষ কম; তেমনি নিঃসংশয়ে বলা দুরূহ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বের মার্কিন কবিতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে হলে কাদের কবিতা আবশ্যিকভাবে পাঠ করা দরকার। সচরাচর যে ক’জনের নাম পুরস্কারপ্রাপ্তি ও সমালোচকদের আলোচনার কারণে গুরুত্ববহ প্রতীয়মান হয়, তাদের মধ্যে অন্তত যে পাঁচজনের নামোল্লেখ কারো ভ্রু কুঁচকে দেবে না, তারা হলেন জন অ্যাশবেরি, অ্যান্থনি হেকট, কে রেয়ান, ডব্লিউ এস মারভিন এবং লুইস গ্লিক। বলা হয় জন অ্যাশবেরি উত্তরাধুনিক কবিতার প্রধানতম গুরু, তিনি কবিতায় আধুনিক শিল্পসুলভ বিমূর্ততা অনুপ্রবিষ্ট করেছেন, তথাপি তার কোনো অনুরাগী বাংলায় নেই। সত্য তো এই যে, এদের কারোর সঙ্গেই আমাদের কহতব্য কোনো পরিচয় গড়ে ওঠেনি, সৃষ্টি হয়নি আদান-প্রদানের কোনোরূপ সুড়ঙ্গপথ।

একমাত্র ব্যতিক্রম নিউইয়র্ক প্রবাসী শামস আল মমীন সম্পাদিত ও ২০০৯ সালে ঢাকায় প্রকাশিত ‘সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা’ শিরোনামীয় কবিতা সংকলন। এ সংকলনে ২৫ জন আধুনিক মার্কিন কবিকে পাওয়া যায় বঙ্গানুবাদের মধ্য দিয়ে। লুইস গ্লিক এই কবিকুলের অন্যতম একজন। শামস আল মমীন লুইস গিল্গকের দুটি কবিতা গ্রহণ করেছছেন।

লুইস গ্লিক (জন্ম ১৯৪৩) সমসাময়িক কালের মার্কিন প্রধান কবিদের একজন হিসেবে স্বীকৃত। জন অ্যাশবেরির মতো সবগুলো না হলেও ক্রমে ক্রমে অনেকগুলো শীর্ষস্থানীয় পুরস্কার তিনি অর্জন করেছেন। তার ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’ কাব্যকে ১৯৯৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। ২০১৪ সালে তাঁর ‘ফেইথফুল অ্যান্ড ভারচুয়াস নাইট’ লাভ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুকাঙ্ক্ষিত ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড। শেষোক্তটি তাঁর অদ্যাবধি প্রকাশিত বারোটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে সর্বশেষ। লক্ষণীয়, ইতোমধ্যে ছয়টি বছর অতিবাহিত হয়েছে; ফলে সংগতভাবেই আশা করা যায় নতুন আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশের লক্ষ্য নিয়ে তিনি পাণ্ডুলিপি সাজিয়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন।

বাঙালি পাঠকের জন্য এ কথা স্বীকার নেওয়া সুবিধাজনক যে, একুশ শতাব্দীর উষালগ্নে লুইস গ্লিক মার্কিন কবিতারসিকদের কাছে তাঁর দৃঢ়মূল অস্তিত্ব নিয়ে উপস্থিত একজন কবি। নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউয়ে কবি স্টিফেন্স ডোবিন্স লিখেছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন কবিদের মধ্যে লুইস গিল্গকের চেয়ে ভালো আর কেউ লেখে না। আমাদের স্বভাবের এত গভীরে নিয়ে যেতে পারেন এ রকম আর কেউ নেই।’ কবি রবার্ট হ্যাস লিখেছেন, ‘এ রকম বিশুদ্ধ, এ রকম চৌকস গীতিকবি আমেরিকায় আর নেই।’ আমেরিকান পোয়েট্রি রিভিউয়ে অ্যানা উটেনের পর্যবেক্ষণ এ রকম, ‘গ্লিক তার পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেন, পাঠককে অভিভূত করেন।’

লুইস গ্লিকের কবিতা দাবি করে পাঠকের মমতাপূর্ণ অভিনিবেশ। তার কবিতা পাঠে মনে হয় তিনি একজন ধ্যানস্থ মানুষ, যার মগ্নচৈতন্য থেকে উঠে এসেছে কিছু পর্যবেক্ষণ, কিছু দর্শনবাক্য, জীবনের অচিহ্নিতপূর্ব কিছু অভিজ্ঞান; যা তিনি সাজিয়ে দিয়েছেন কবিতার অবয়বে :

তোমাকে একটা কথা বলি: প্রতিদিন মানুষ মরছে। কিন্তু সেটা সূচনা মাত্র।

প্রতিদিন ফিউনেরাল হোমে জন্ম নিচ্ছে নতুন বিধবা, নতুন এতিম।

তারা হাত ভাঁজ করে বসে থাকে, ভাবে নতুন জীবনটা কী রকম হবে।

পরবর্তী গন্তব্য সমাধিক্ষেত্র: অনেকের জন্য এই প্রথম আসা:

কারো ভয় পাছে কান্না চলে আসে; কারো ভয় না যদি হয় অশ্রুপাত।

কেউ ঝুঁকে এসে বলে দেয় এখন কী তাদের করণীয়: হয়তো

বলতে হবে কিছু; হয়তো কবরে দিতে হবে মাটি

তারপর সবাই বাড়িতে প্রত্যাগমন করে: বাড়িটা সহসা মানুষে ভরে ওঠে

বিধবা কাউচে যথোচিৎ উপবিষ্ট, তার কাছে যাওয়ার জন্য মানুষেরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়

সে প্রত্যেককে কিছু বলে, আসবার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে।

কিন্তু তার মন চায় সবাই বিদায় হোক:

সে ফিরে যেতে চায় সমাধিক্ষেত্রে

[ফ্যান্টাসি]

২.

২০১২ সালে আমেরিকান একাডেমি অব অ্যাচিভমেন্টস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে লুইস গ্লিক জানিয়েছিলেন, তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন নিছক ছেলেবেলায়। প্রথমত, শারীরিক ও দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্যের অভাবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির জন্য নিয়মিত অধ্যয়নের পথে যেতে পারেননি। অন্যদিকে কবিতার আকৈশোর আকর্ষণ তাকে কবিতাবিষয়ক অধ্যয়নে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি পড়েছিলেন প্রথমে সারাহ লরেন্স কলেজে, পরে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জেনারেল এডুকেশনে। মার্কিন কবিসভায় তার আনুষ্ঠানিক পদার্পণ ১৯৬৯ সালে, প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফার্স্টবর্ন’-এর মধ্য দিয়ে। পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে তিনি আরো ১১টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। অদ্যাবধি প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।

কৈশোর থেকেই গ্লিক-এর পরিচয় মৃত্যু, জীবনসংগ্রাম ও নৈরাশ্যের সঙ্গে; পরিচয় মানসিক বৈকল্য ও চিকিৎসার সঙ্গে। তার জীবন বেঁচে থাকার সংগ্রাম আর কবিতা হচ্ছে সেই সংগ্রামের অভিলেখাগার। তার অনেক কবিতায় যাপিত জীবনের অনুরণন তরঙ্গায়িত : ‘বহুকাল আগে আমি ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলাম/প্রত্যুত্তরে/আমি বাঁচতে শিখেছিলাম/পৃথিবীর সান্নিধ্য ব্যতিরেক।’ তিনি বেঁচেছিলেন পৃথিবী ও জীবনের প্রতি নিখাদ নিস্পৃহতা নিয়ে।

শৈশবে তিনি উইলিয়াম ব্লেইকের কবিতা পড়েছিলেন: উইলিয়াম ব্লেইকের (১৭৭৫-১৮২৭) কবিতা তাকে উদ্বেলিত করেছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ব্লেইকের ‘The Little Black Boy’  কবিতাটির তাকে আচ্ছন্ন করেছিল। এ কবিতায় একটি কৃষ্ণকায় বালকের বয়ানে আমরা শুনতে পাই আত্মপরিচয় আর ঈশ্বরকে চেনার কথা। বালক বলে :

মা আমাকে জন্ম দিয়েছিল দক্ষিণের অরণ্যে

তাই আমি কালো, কিন্তু ওহো, আমার আত্মাটা সাদা

ইংরেজ ছেলেটি দেবদূতের মতো সাদা

অথচ আমি কালো, যেন আমার জন্যে কোনো আলো

অবশিষ্ট নেই।

মা ওকে ঈশ্বরের কথা শুনিয়েছিল; বলেছিল: তার কালো চামড়াটা মেঘ; ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা হলেই তা মিলিয়ে যাবে। ছেলেটা ভাবে, কালো চামড়াটা মিলিয়ে গেলেই শ্বেতকায় ইংরেজ ছেলেটি তাকে ভালোবাসবে। কৃষ্ণবালকের এহেন আত্মানুসন্ধান লুইস গ্লিককে তাড়িত করে চলেছে। এই আত্মানুসন্ধিৎসা কার্যত মানবপ্রকৃতির রূপ নির্ণয়ের প্রশ্ন। মানুষকে তিনি চিনেছেন, তিনি লিখেছেন:

কখনো ছেড়ে দেবে না তুমি,

কখনো সন্তুষ্ট হবে না।

তুমি কুঁকড়ে যাবে,

ক্ষতচিহ্নে ভরে যাবে

তবু ক্ষুধার্থ হতে থাকবে।

তোমার শরীর বৃদ্ধ হয়ে যাবে।

তবু তোমার চাহিদা ফুরাবে না

তুমি পুরো বিশ্বটা চাইবে,

চাইবে বিশ্বেরও অধিক।

তার এ চেনায় কোনো ভর্ৎসনা নেই, দোষারোপ নেই, হাহাকার নেই। বরং তার দৃষ্টিভঙ্গিতে রয়েছে নিরাবেগ প্রসন্নতা যা সর্বোপরি অটল ও অবিচল। যখন তিনি বলেন ‘তোমাকে একটা কথা বলি: প্রতিদিন মানুষ মরছে’ তখন তিনি নিজেকেই সম্বোধন করেন। যখন বলছেন, ‘কখনো ছেড়ে দেবে না তুমি’, তখনও তিনি নিজেকেই উদ্দেশ করেছেন। এই স্বগতোক্তি তার কাব্যশৈলীর নির্ণায়ক স্বাক্ষর।

৩.

পাঠক লক্ষ্য করবেন লুইস গ্লিকের কবিতা যেন অবিরল আত্মসংলাপ;- নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া, আত্মনিরীক্ষার অবিরত প্রচেষ্টা। ‘দ্য মিথ অব ইনোসেন্স’ কবিতার শুরু এইভাবে:

এক গ্রীষ্ফ্মে সে মাঠে গিয়েছিল যেমন সে যায়

পথে দাঁড়িয়ে চিল একখণ্ড জলাশয়ের পাশে

যেখানে সে প্রায়শ:

নিজ প্রতিবিম্বে দেখে নেয়

কোনো পরিবর্তন এসেছে কি-না।

সে দেখে অপরিবর্তিত কায়া,

জঘন্য কন্যাসুলভ আদিখ্যেতা এখনো

লেপ্টে আছে শরীরে।

পানিতে সূর্যের প্রতিফলন। সূর্যটাকে খুব আপন মনে হয়। সে ভাবে, ঐ আমার কাকু, নজরদারি করে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে যা কিছু আছে সবই কোনো না কোনো ভাবে আত্মীয়। সে ভাবে, আমি কখনো নিঃসঙ্গ না। নিছক ভাবনা নয়- এ তার প্রার্থনা। তখনই মৃত্যু উদয় হয় যেন তার প্রার্থনার উত্তর।

পরিবার তার কবিতার প্রিয় মোটিফ। বিভিন্ন কবিতায় নানা অনুষঙ্গে এসেছে পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের কথা কৌতূহলোদ্দীপক তাৎপর্য নিয়ে। একটি কবিতায় গ্লিক লিখেছেন:’আজ রাতে অন্ধকার জানালায় নিজে দেখতে পেলাম/যেন আমার পিতার প্রতিমূর্তি যার সারাটা জীবন/এভাবেই অতিবাহিত হয়েছে/মৃত্যুর কথা ভেবে, যা কিছু ইন্দ্রিয়শীল/সবকিছু বাদ দিয়ে/ফলে সময় ফুরালে তার জন্যে/সহজ ছিল জীবনটা ছেড়ে যাওয়া,/ কারণ এতে কিছুই ছিল না, এমনকি/আমার মায়ের কণ্ঠস্বর পারেনি/পারেনি তাকে বদলাতে কি ফেরাতে/তিনি বিশ্বাস করতেন/তুমি যদি আরেকজন মানুষকে ভালোবাসতে না পারো/এ পৃথিবীতে কোনো স্থান নেই তোমার।’

‘প্রথম স্মৃতি’ কবিতায় আমরা পড়ি : ‘বহু আগে আমি আহত হয়েছিলাম। আমি বেঁচেছিলাম বাবার প্রতিশোধ নেয়ার খাতিরে/এ জন্যে নয় যে, তিনি কী/বরং আমি কেমন সে জন্যে/সেই সময়ের আদিতে/ছেলেবেলায় আমি ভাবতাম/আমাকে কেউ ভালোবাসে না/তার মানে হলো আমি ভালোবাসতাম। [ফার্স্ট মেমোরি, আরারাত, ১৯৯০]

গ্লিকের আরেকটি কবিতা এ রকম : ‘আমার বোনটা এই পৃথিবীতে কাটিয়ে গেল গোটা একটা জীবন/সে জন্মেছিল, সে মরে গেলো/তার মাঝখানে/না একটা সতর্ক দৃষ্টি, না কোনো বাক্যব্যয়/বাচ্চারা যা করে থাকে তাই করেছে সে/সে কেঁদেছিলো কিন্তু খাবারের জন্য নয়।’ [হারানো ভালোবাসা]

জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘কবিতা নানা রকম’। আমরা ভিন্নমত পোষণ করি না। স্বীকার করে নিতে হবে যে লুইস গ্লিকের কবিতা অনুসরণ করেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রচনাশৈলী যা আমাদের কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে। তার গদ্যকবিতা নিছকই গদ্য, আমাদের বহু পরিচিত রূপবন্ধ থেকে পৃথক। ছন্দ, অন্ত্যমিল, উপমা ও চিত্ররূপময়তার সঙ্গে ধ্বনি মাধুর্যের সম্মিলনে যে রসসিক্ত কবিতা পড়তে আমরা অভ্যস্ত, লুইস গ্লিকের কবিতার ধাঁচ তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার রচনা অনাড়ম্বর, সম্পূর্ণ অংশে নিরাভরণ; এমনকি শব্দ নির্বাচনেও এমন কোনো বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় না যা আমাদের চঞ্চল করে তুলতে পারে।

অন্যদিকে তার রচনার একচ্ছত্রে আধিপত্য করে আত্মজৈবনিকতা। সেখানে পাঠক প্রত্যক্ষ করবেন একধরনের মৃত্যুচেতনা, মানব অস্তিত্বের অসহায়ত্ব ও নিয়তিলাঞ্ছনা আর একটি আত্মগত কণ্ঠস্বরের ঘনিষ্ঠ প্রক্ষেপণ। যা তার চোখ দেখে তাই তিনি তুলে ধরেন গদ্যের বুননে, কখনো হয়তো কোনো মন্তব্য জুড়ে দেন। কবিতায় তার কণ্ঠস্বর মৃদু, কখনো ভয়ার্ত, অনিশ্চিত, দ্বিধাভারাক্রান্ত। ‘তুষারকণা’ কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে:

টিকে যাবো আশা করিনি

মাটির চাঁইয়ের নিচে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম।

ভাবিনি জেগে উঠবো আবার,

কাদামাটিতে অনুভব করবো

শরীরের স্পন্দন পুনর্বার; মনে পড়বে

এতকাল পর কী করে

আড়মোড়া ভাঙতে হয়,

দ্রুতাগত বসন্তের

নিরুত্তাপ আলোয়।

[‘তুষারকণা’]

এ রকম আত্মগত উচ্চারণই লুইস গ্লিকের কাব্যভাষার স্বকীয়তা: নির্ভুল সিগনেচার স্ট্যাম্প। গ্লিকের আত্মসত্তা নিজের সঙ্গেই কথোপকথন করে চলে। অন্তর্গত অনেক অনুমান ও ভাবনারাজি অনুচ্চারিত থেকে যায়। বাদ পড়ে যায় পারিপার্শ্বিক তথ্যাবলি। বক্তব্যে পরিলক্ষিত হয় সুসান সনটাগের মতো উল্লল্ফম্ফন যা তার কবিতাকে দুরধিগম্য করে তোলে।

লুইস গ্লিকের কাব্যভাবনায় প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের ক্ষুধা ও আর্তি, জীবনসংগ্রাম ও ট্রমা, কামনা ও যৌনচেতনা। এই বিষয়গুলো তার কবিতায় উপর্যুপরি উচ্চারিত হয়। তার আত্মজৈবনিক ন্যারেশনের মধ্য দিয়ে মানব অস্তিত্বের ভঙ্গুরতা, নিয়ন্ত্রণাতীত জীবনপ্রবাহ, অনিশ্চিত ভবিতব্য ও প্রতিকারহীন অসহায়ত্ব বারবার প্রক্ষেপিত হয়েছে। অনেকের কাছে তার কবিতা দুঃখ ও বিষাদের হতাশাকর গাথা। ১৯৯২ প্রকাশিত ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরস’ তার সপ্তম কবিতা সংকলন। এই গ্রন্থের শুরুতে তিনি লিখেছেন :

আমার কথায় কান দিও না, আমার

হৃদয় ভাঙা

কোনো কিছুই আমি আর বস্তুনিষ্ঠতার

সঙ্গে দেখতে পারি না।

আমি তো নিজেকে জানি। আমি

শিখে গেছি একজন মনস্তত্ত্ববিদ

যেভাবে রোগীর কথা শোনে।

আর যখন কথা বলি গভীর আবেগে

তখন আমার বিশ্বাসযোগ্যতা

নূ্যনতম।

লুইস গ্লিকের কবিতা কখনো বর্ণনা, কখনো নিজের সঙ্গে কথোপকথন। তার কবিতার নিরাভরণ শরীরে পাঠক প্রত্যক্ষ করবেন এক মৃদুভাষী, মিতবাক কথককে, যিনি ঠিক যেন তার অভিজ্ঞতা সমষ্টিকে সজোরে ফুটিয়ে তুলতে পারছেন না। তিনি জানেন না মানুষ ভালোবাসে ছন্দ ও সংগীত; তার কাছে উপমা ও চিত্রকল্প অপব্যয় মাত্র। এমনকি, কখনো কখনো মনে হবে, তার অভিধানটি এত ক্ষুদ্র যে, নিজেকে প্রকাশ করার উপযুক্ত শব্দগুলোও তাতে নেই। এই কঠিন মিতব্যয়িতা গিল্গকের মানসিক গঠনেরও পরিচায়ক। একটি কবিতায় আমরা লুইস গিল্গককে বলতে শুনি:

সচেতনতার নৈঃশব্দ্যে আমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম

কেন আমি জীবনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম?

এর উত্তর আমি দিতে পারি:

পৃথিবী আমাকে পরাভূত করে ফেলে।

[ল্যান্ডস্কেইপ]

‘দ্য মিস্ট্রি’ কবিতায় গ্লিক লিখেছেন : ‘আমার জীবন আমাকে নিয়ে গেছে বহু ঘাটে যার অনেকগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। নিয়ে গেছে আমার বিনা সম্মতিতে। আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে।’

আরেকটি কবিতায় লিখেছেন :’আনন্দ শব্দটা ধুলোচাপা শব্দের মতো অতীতে হারাল। অনেক দিন তাকে খুঁজে পাই না।’

‘দ্য রিপ্রোচ’ কবিতায় তার স্বগতোক্তি :’সারাটা জীবন আমি আরাধনা করেছি ভুল দেবতার’।

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ট্রায়াম্প অব অ্যাকিলিস’ কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখেছেন :

আমি বলি শোনো

চাঁদের আলো,

এই উঠোন আলোকিত করে রেখেছে

এই পুষ্পরাজি।

আমি ওদের ঘৃণা করি।

যেমন ঘৃণা করি সঙ্গম

আমার শরীরে

পুরুষের ছোপ ছোপ মুখচুম্বন

[মক অরেঞ্জ]

৪.

১৯৫৩ সালে টি. এস. এলিয়ট ন্যাশনাল বুক লীগের বার্ষিক বক্তৃতা হিসেবে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তাতে তিনি বলেছিলেন প্রতিটি কাব্যে একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের অস্তিত্ব আবিস্কার করা যায়; কবিতার বিষয়বস্তু ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী কণ্ঠস্বর বিভিন্ন হয়ে থাকে। কাব্যের বিষয়বস্তু এবং উদ্দিষ্ট শ্রোতা অনুযায়ী কণ্ঠস্বর বেছে নেওয়াই কবির জন্য শ্রেয়। এলিয়টের বিবেচনায়, প্রথমত, কবি কেবল নিজেকে উদ্দিষ্ট করে কবিতা লিখতে পারেন, কোনো শ্রোতা বা পাঠকের কথা বিবেচনা না করে। হতে পারে না তার শোনাবার মতো কিছু আছে, না শুনবার মতো কেউ আছে। যদি কেউ শোনে তাকে স্ব-উদ্যোগে আড়ি পেতে শুনতে হবে। দ্বিতীয় কণ্ঠস্বরটির প্রধান লক্ষ্য শ্রোতা বা পাঠক: কবি তার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ, আবেগ ও অনুভূতি অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে আগ্রহী। অধিকাংশ কবি এই অভীপ্সা নিয়েই কাব্যচর্চায় ব্রতী হয়ে থাকেন। তাদের ঔৎসুক্য থাকে তাদের রচনা পাঠকের মননে ও হৃদয়ে কীভাবে অভ্যর্থনা পেল সে বিষয়ে। তৃতীয় কণ্ঠস্বরটি নৈর্ব্যক্তিক। এ কণ্ঠস্বর কবির ব্যক্তিরূপের প্রতিফলন নয়, বরং কবি একটি কল্পিত চরিত্র আরেকটি চরিত্রের সঙ্গে সংলাপে নিরত হয় যা আমরা সচরাচর কাব্যনাট্যে প্রত্যক্ষ করি।

আমাদের সিদ্ধান্ত লুইস গিল্গকের কবিকণ্ঠ এলিয়টের প্রথমোক্ত শ্রেণির পর্যায়ভুক্ত। তার রচনার মূল প্রণোদনা পাঠকের কাছে পৌঁছানো নয়, বরং আমরা দেখি নিজের সঙ্গে দার্শনিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যাপিত জীবনের নির্যাস তিনি অবধারণ করতে চেয়েছেন কবিতার চৌহদ্দিতে। ফলে একদিকে তার কবিতা নিজস্ব বিশ্বাসের সমষ্টি, অন্যদিকে আত্মসংলাপের কারণে তা প্রবলভাবে সংকুচিত, নিরেট। সবগুলো কবিতা মিলিয়ে তিনি রচনা করেছেন স্বীয় অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্বাসের এক মৃণ্ময় স্থাপত্য যার তুলনা সহসা নজরে আসে না। এহেন কাঠামো তার কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছে প্রশান্ত ধ্যানগাম্ভীর্য। তার কবিতার মনোপীঠে অনুভূত হয় একরূপ নিরালম্ব শূন্যতা ও অন্ধকার; অনুচ্চকণ্ঠ হতাশা ও হাহাকার। তার কবিতাসমষ্টির ধীকেন্দ্রে প্রত্যক্ষ হয় এক নিঃসক্ত ভাবুকের অনুৎফুল্ল সত্যানুসন্ধিৎসা। কবিতাগুলো লুইস গ্লিকের চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে মঞ্জরিত হয়ে একতন্ত্রী পরিধির দিকে বিন্যস্ত।

লুইস গ্লিকের কবিতা স্বীয় যাপিত জীবনের প্রমার্জিত প্রতিফলন। আশৈশব জীবনসংগ্রাম যে উপলব্ধি আর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তা-ই তিনি উপজীব্য করেছেন কবিতা লিখতে বসে। তার উচ্চারণ দাবি করে পাঠকের সমবেদনা, দাবি করে সংবেদনশীল পাঠক। তিনি বলেন সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার কথা, অমোঘ বার্ধক্য ও মৃত্যুর কথা, পরিবারের সঙ্গে অনপনেয় মিথস্ট্ক্রিয়ার কথা। নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা জারিত করে তিনি প্রকাশ করেন শব্দ ও বাক্যবন্ধে। কখনো কখনো উদ্দিষ্ট অর্থ পুরো কবিতা না পড়ে ওঠে পর্যন্ত শেষ হয় না। তার পূর্বজ কবি ট্রান্সটোমার, যিনি ২০১১ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার সঙ্গে লুইস গ্লিকের সাযুজ্য এখানে যে, দু’জনই মানুষের অস্তিত্বের ও পলায়নাতীত ভবিতব্যের প্রতি পোষণ করেন সমবেদনাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।

কৃতজ্ঞতা: কালের কেয়া

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত