মাছ মিশালি (পর্ব-১)
পর্ব- ১
বাঙ্গালীর মাছ নিয়ে আদিখ্যেতা সর্বজনবিদিত। আর পয়লা বোশেখ এলে এই আদিখ্যেতা লাগামহীন আকার নেয়। যেন বাঙ্গালী শুধু বছরের প্রথমদিনেই মাছ খেতে পছন্দ করে আর বাকীদিন নিরামিষ খায়। আসলে মাছ শুভ এবং মাছের সঙ্গে বাঙ্গালীর সংযোগ এতটাই বেশী যে নতুন বছরের অনুষঙ্গে মাছ প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। এখন সেই মাছ কনজিউমারিজমের অবিছেদ্য অঙ্গ তাই দুর্মূল্যও বটে। মাছ এখন রীতিমত পণ্য। তাই ইলিশ চিংড়ি থেকে তপসে কিম্বা কাঁকড়া বেশ মহার্ঘ্য বাজারে। আম বাঙ্গালীর পছন্দের ম্যাগাজিনে পয়লা বোশেখের হট টপিকে মাছের ঠাঁই তাই মাছের দাম বাড়তির দিকে। পয়লা বোশেখের ধনেখালি শাড়িতেও সুতোয় বোনা মাছ। অ্যাপ্লিকে মাছ, ফেব্রিক পেইন্টে মাছ, কাঁথা স্টীচে মাছ, পটচিত্রে মাছ । এমনকি শ্রাদ্ধ শেষেও মাছ নিবেদিন হয় পারলৌকিক আত্মার উদ্দেশ্যে। তাই পয়লা বোশেখ বাদ যাবে কেন?

কীর্তণে কানু বিনে গীত নাই আর বাঙালীর মত্স্য বিনে গতি নাই। তাই বুঝি শয়নে, স্বপনে, জাগরণে মাছ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবার জো নেই।
মাছ শুভ। মাছ পুণ্যতার প্রতীক। তাই বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশনের তত্ত্বে মাছকে তেল, হলুদ, সিঁদুর লাগিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে তত্ত্বের তালিকায় রাখা হয়। এমনকি শ্রাদ্ধের পিন্ডদানের পরেও মৃতের আত্মার রসনা তৃপ্তিতে কলাপাতার ওপরে এক টুকরো মাছ ভেজে দেওয়ার রীতিও দেখেছি। যেন তাঁকে নিবেদন করে অশৌচের পর বাড়ির লোকজন আবার মৎস্যমুখী হতে পারে।
বিশ্বের সর্বত্র ডিমের স্বাদ, মাংসের স্বাদ একরকমের কিন্তু মাছের স্বাদ বাংলায় যেমন তেমন আর কোথাও নয়। বিজয় দশমীর বিসর্জনের আগে মন্ডপে দুটি সিঁদুরমাখা পুঁটির দিকে তাকাতেই হয়। বধুবরণের মূহুর্তে ল্যাঠামাছ ধরা? অথবা দ্বিরাগমনে মাছের রকমারি পদ?

এই মাছ ব্যবহারের কারণ হল বাকী আর পাঁচটি মাঙ্গলিক দ্রব্য অর্থাৎ ধানদুব্বো কিম্বা পান-সুপারির মতোই। যেগুলি প্রচুর পরিমাণে ফলে। বস্তুত এসব বংশবৃদ্ধির প্রতীক। মাছের ডিম থেকে অসংখ্য চারামাছ জন্মায় তাই বিবাহের মত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ভাবী দাম্পত্য জীবনকে ফলবতী এবং সফল রূপে দেখতে চাওয়ার সূক্ষ্ম ঈঙ্গিত রয়েছে সেখানে।
শুধুই নদীনালায় নয়। বাঙালীর চিন্তনে, মননে, শিরায় উপশিরায় স্থায়ী আবাস মাছের। বাংলার বাইরে তবুও বাঙালীর অন্যতম পরিচয় “মছলি খাতা হ্যায়” বলে। অথচ সারা ভারতে বাঙালী ছাড়া কত মানুষই মাছ খায় তৃপ্তি করে তবুও বাঙালীর মেছো বদনাম আর এ জন্মেও ঘুচল না। মনে মনে বলি, ভাগুন বাপু, এই বাঙালীর মাছে আর মশাই ভাগ বসাবেন না। বাঙালীর চোখ ভালো থাক। বাঙালীর মেধা বিকশিত হোক। হৃদয় প্রসারিত হোক।

অবাঙ্গালীরা যারা লুকিয়ে লুকিয়ে রেস্তোরাঁয় গিয়ে মাছ কিনে খায় আর বাঙ্গালীর রান্নাঘরে ঢুকে বেশ ঘেন্না ঘেন্না চোখে বলে, “মছলি কা স্মেল আরাহা হ্যায়” তাঁদের এই হিপোক্রিসি কে পয়লা বোশেখে ধিক্কার জানাই। তারা আবার কথায় কথায় বাঙালী বেশ জব্দ হবে সেই ভেবে আর বাঙ্গালীকে ছোট করবে বলে বলে “ও ফিশ!” মনে মনে বলি রে মূর্খ! বাংলায় এসে ব্যাবসা ফাঁদিস তোরা, নারায়ণের মৎস্য অবতারের পায়ে ফুল দিস আর যত ঘেন্না বাঙ্গালীর মৎস্য প্রীতিতে?
এই পয়লা বোশেখে তাঁদের মাথায় পড়ুক বাজ!

তাদের ঘটা করে কালীঘাটে পুজো দেবার হিড়িক দেখে মনে মনে ভাবি, তারা বোধহয় জানেনা যে মা কালীর নিত্য সেবাতেও মাছ ভোগ নিবেদিত হয়। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় এবং কোথাও কোথাও সরস্বতী পুজোতে জোড়া ইলিশের বিয়ে বঙ্গকুলে সর্বজনবিদিত।
বাঙাল বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে দেখেছি ধানদুব্বো, তেল-সিঁদুর মাখিয়ে বরণ করে নতুন শাড়ি পরিয়ে জোড়া ইলিশের পুজোর পর জমিয়ে ইলিশমাছ ভোগ দেওয়া হয়।

বাংলাভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন চর্যাপদেও পাওয়া যায় এই মাছের উল্লেখ।
।। অগ্গরঅ ভত্তা রম্ভঅ পত্তা / গাইকো ঘিত্তা দুগ্ধ সযুত্তা / মোইনি মচ্ছা নালিতা গচ্ছা / দিজজই কান্তা খায় পুনবন্তা।।
যার অর্থ হল
গরম ভাত কলাপাতায়, গরুর দুধের ঘি সঙ্গে, মৌরলা মাছ, নালতে শাক, স্ত্রী পরিবেশন করে, পুণ্যবান পুরুষ খায়
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই মৎস্য বিলাস বহু প্রাচীন। তা সে বরিশালের বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল কিম্বা কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিতাতেই হোক। বিজয় গুপ্তের লেখায় পূর্ব বাংলার মধ্যযুগীয় রান্নার চিত্র।
‘মৎস্য কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে নলতার আগ
মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ গাছা।
ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুন মাছ
ভিতরে মরিচ গুঁড়ো বাহিরে জুড়ায় সুতা।
তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা
ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল ’
অথচ বাঙ্গাল বিজয় গুপ্তের লেখায় ইলিশের নাম গন্ধ নেই।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখাতেও সেই মাছ রাঁধার অনুপান ‘কৈ ভাজে গণ্ডাদশ মরিচ গুঁড়িয়া আদারসে’।

এছাড়া গোসানীমঙ্গলের লৌকিক আখ্যানেও শোলমাছ নিয়ে গল্প আছে। যেখানে গোসানী চণ্ডী দেবীকে স্মরণ করতেই রাজা কান্তেশ্বর কাজিলীকুড়ার বিরাটদহে বিশাল শোলমাছ ধরেন জাল ফেলে।
কখনো আবার গ্রাম বাংলায় ইলিশমাছ এসেছে ধাঁধা হয়ে।
‘রূপোর পাতে মারে ঘা, পানির বুকে ফেলল পা।’
ময়মনসিংহ গীতিকায় মাছের রাণী ইলিশের স্থান এক অমূল্য পণ্য হয়ে
‘সেই ইলিশের দাম হইল সোনায় একুশ ভরি মাছ ইলিশারে’
গত শতাব্দীর কবি ঈশ্বর গুপ্ত তো লিখেই ছিলেন
‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙ্গালি সকল
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’
ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘ইলশেগুঁড়ি’ কবিতায় পড়েছিলাম
‘ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম।’

এখন কিন্তু শুধু বাঙ্গালীই নয় এই স্বাস্থ্যকর জলজ শস্যটির স্থান সারা পৃথিবীই জুড়েই। স্বাস্থ্যের কারণে আর হৃদয় ভালো রাখার জন্যে সবার এখন মাছ ভক্তি অথচ বাঙ্গালীদের প্রতি অ-বাঙ্গালীদের কত রঙ্গ, ব্যাঙ্গ, পরিহাস এই মাছ নিয়ে। এসব দেখেশুনে লোকমুখে প্রচলিত একটি ছড়া মনে পড়ে।
“বোস্টুমী বোস্টম, হাঁড়ির ভিতর কাঁকড়া নিয়ে চলে বৃন্দাবন”
ঈশ্বর গুপ্ত তদানীন্তন সাহেবদের আরাধ্য তপসে মাছকে তোল্লাই দিয়ে সেই যে লিখলেন
‘এমত অমৃত ফল ফলিয়াছে জলে, সাহেবরা সুখে তাই ম্যাঙ্গো ফিস্ বলে ’
তপসে মাছে রূপে গুণে মুগ্ধ গুপ্ত কবি আরও লিখলেন সেযুগে,
‘কনককান্তি কমনীয় কায়, গালভরা গোপদাড়ি— তপস্বীর প্রায়’
আর সত্যিই তো তপস্বী বা তাপসের মতো চেহারার কারণেই এর নাম তপসে।
যেকোনো মূল্যে এই মাছের কদর করলেন সাহেবরা। সাহেবসুবোর খিদে মিটল, কবির লেখায় প্রাণ জুড়োল। বাজারে তপসে দুর্মূল্য হল।
ব্যয় হেতু না হয় কাতর
খানায় আনায় কত করি সমাদর
ডিস ভরে কিস লয় মিসি বাবা যত
পিস করে মুখে দিয়ে কিস খায় কত।
তাদের (সাহেবদের) পবিত্র পেটে তুমি কর বাস
এই কয় মাস আর নাহি খায় মাস (মাংস)
আর বহুল প্রচলিত একটি লোকছড়া শুনেছেন ইলিশকে নিয়ে?
‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি
বৈশাখ মাসের এক তারিখ, আইসো আমার বাড়ি’।
কিম্বা ইলিশ নিয়ে শিশুতোষ ছড়ায় পড়া সেই ছড়া?
‘সোনার নাচে কোণা, বলদ বাজায় ঢোল
সোনার বউ রেঁধে রেখেছে ইলিশ মাছের ঝোল।’

রবিঠাকুরের সহজপাঠ প্রথমভাগে বাংলাসাহিত্যে প্রথম মাছের সঙ্গে হাতেখড়ি। জলে থাকে মাছ। ডালে আছে ফল। মাছ জলে খেলা করে। খালে বক মাছ ধরে … এই করতে করতে সহজপাঠ দ্বিতীয়ভাগে মাছের সঙ্গে আলাপ অনুস্বর অধ্যায়ে। “কাংলা, তোর ঝুড়িতে কী? ঝুড়িতে আছে পালং শাক, পিড়িং শাক, ট্যাংরা মাছ, চিংড়ি মাছ। সংসারবাবুর মা চেয়েছেন”
এরপর ঔকারের অনুপ্রাস, যেখানে সৌরিদিদি ভাত নিয়ে ব’সে আছে। ঐ-যে জলে, যেখানে জেলে মৌরলা মাছ ধরে।
এর ফাঁকে ফাঁকে ঠাম্মাদের মুখে ছেলেভুলানো ছড়া
দুই দিকে দুই কাৎলা মাছ ভেসে উঠেছে
অথবা
মাছ ধরতে ক্ষীরনদীর কূলে। ছিপ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে, মাছ নিয়ে গেল চিলে
অথবা রবিঠাকুরের লোকসাহিত্যের ছেলে ভুলানো ছড়া?
ওরে আমার সোনা
এতখানি রাতে কেন বেহন-ধান ভানা।
বাড়িতে মানুষ এসেছে তিনজনা।
বাম মাছ রেঁধেলি শোলমাছের পোনা॥
পরে আবারো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় সেই মাছ।
“খেঁদুবাবুর এঁধো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে
পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে।’
জানেন কি? রবিঠাকুরের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল পান্তাভাত আর চিংড়িমাছ ভাজা। তাঁর লেখা কবিতাতেও প্রচুর পাই এমন চিংড়ির কথা।
তিমি ওঠে গাঁ গাঁ করে
চিঁ চিঁ করে চিংড়ি
ইলিস বেহাগ ভাঁজে
যেন মধু নিংড়ি।
অথবা
মাছ এল সব কাৎলাপাড়া, খয়রাহাটি ঝেঁটিয়ে ,
মোটা মোটা চিংড়ি ওঠে পাঁকের তলা ঘেঁটিয়ে ।

তাঁর গল্পগুচ্ছের অন্যতম গল্প “রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা”র শুরুতেই আছে চিংড়িমাছের ঝালচচ্চড়ির কথা।
“যাহারা বলে, গুরুচরণের মৃত্যুকালে তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের সংসারটি অন্তঃপুরে বসিয়া তাস খেলিতেছিলেন, তাহারা বিশ্বনিন্দুক, তাহারা তিলকে তাল করিয়া তোলে। আসলে গৃহিণী তখন এক পায়ের উপর বসিয়া দ্বিতীয় পায়ের হাঁটু চিবুক পর্যন্ত উত্থিত করিয়া কাঁচা তেঁতুল, কাঁচা লঙ্কা এবং চিংড়িমাছের ঝাল-চচ্চড়ি দিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পান্তাভাত খাইতেছিলেন”
ক্রমশ…

উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।