| 15 মার্চ 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা অনুবাদ গল্প: স্নেহবন্ধন । মালতী জোশী

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট


মালতী জোশীMalti-Joshi
প্রখ্যাত হিন্দি গল্পকার মালতী জোশীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ৪ জুন, ঔরঙ্গাবাদে। হিন্দি ও মরাঠি দুই সংস্থা থেকেই তাঁকে একাধিকবার সম্মানিত ও পুরস্কৃত করা হয়েছে। তাঁর বহু কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে হিন্দি ধারাবাহিক। ‘সাত ফেরে’ এবং ‘কিরদার’ তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৮ সালে তাঁকে ভবভূতি অলঙ্করণ সম্মানে সম্মানিত করা হয়। ভারত সরকার দ্বারা সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় ২০১৮ সালে। তাঁর অজস্র গল্পগ্রন্থের মধ্যে ‘পরাজয়’, ‘মধ্যান্তর’, ‘শাপিত শৈশব তথা অন্য কহানিয়া’, ‘এক ঘর সপনো কা’, ‘বিশ্বাসগাথা’, ‘স্নেহবন্ধ তথা অন্য কহানিয়া’ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম।
মালতী জোশীর জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে মধ্যপ্রদেশের ভোপাল শহরে। অতি সম্প্রতি ২০২৪ সালের ১৫ মে এই জনপ্রিয় গল্পকারের জীবনাবসান হয়।

ইরাবতীর পাঠকদের জন্য মূল হিন্দি থেকে অনুবাদ করেছেন স্বপন নাগ


 

 

মা, এ হল মিতু – মৈত্রেয়ী।’

ধ্রুব মেয়েটিকে পরিচয় করিয়ে দেবার পর আমি দেখতেই থাকি। ছোটখাটো চেহারা, মাথার চুল ছোট করে কাটা, গগলসে ঢাকা দুটো চোখ। পরনে নেভি ব্লু জিন্স আর হলুদ রঙের পুলওভার। পুলওভারের সামনের দিকের কাজটা এত সুন্দর যে অন্য কেউ হলে এক্ষুনি পাশে বসিয়ে ডিজা়ইনটা তুলে নিতাম। কিন্তু ‘এ যে মিতু, মানে মৈত্রেয়ী’ মনের মধ্যকার প্রতিক্রিয়াকে আড়াল করে খুব স্বাভাবিক স্বরে বললাম, ‘তোরা ড্রইং রুমে গিয়ে বস, তোর পাপাকে ডেকে পাঠাচ্ছি।’

ধ্রুবর পাপা বাগানে ইজ়িচেয়ারে আধশোয়া হয়ে পেপার পড়ছিলেন। ঐ তো চার পাতার পেপার, তাও পড়তে পড়তে সকাল থেকে সন্ধে করে দেন। সমস্ত বিরক্তি গিয়ে পড়ল তারই ওপর। বললাম, ‘শুনছো, বৌমা এসেছে, দেখো গিয়ে।’

‘বৌমা !’ চমকে উঠলেন প্রথমে। তারপর চোখ থেকে চশমা নামিয়ে সরাসরি চোখ রাখলেন আমার দিকে। বললেন, ‘বৌমা এসেছে তো তোমার স্বর এত কর্কশ কেন ?’

এক দুদিন তো নয়, আঠাশটা বছর কেটে গেছে একসাথে আমাদের। আমার মেজাজের এক একটা স্তর ওনার ভালো রকমেরই চেনা। তবুও আমি নীরবই থাকি, খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চা বানাবার জন্যে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াই।

আধা পৌনে ঘন্টার মধ্যে যখন চা-নাস্তা সাজিয়ে বাইরে নিয়ে আসি, ততক্ষণে ড্রইং রুমের আসর জমজমাট। এরই মধ্যে শিবও কলেজ থেকে ফিরে এসেছে, আর শিবের চুটকিতেই চলছে হাসির হল্লা। আমাকে দেখেই শিব তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ট্রে হাতে নিয়ে নিল। ধ্রুবও চটপট টেবিল থেকে এটা ওটা সরিয়ে জায়গা করে দিল। জলের জাগ আর আচারের শিশি রান্নাঘরেই ফেলে এসেছি। ট্রে খানা টেবিলে রেখেই দৌড়ে তাও নিয়ে এল শিব। খুব স্বাভাবিকই চলছিল সবকিছু। যতদিন থেকে সবিতা শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে, ছেলেরা এভাবেই মায়ের কাজে মদত করে এসেছে। কিন্তু কেন জানি না, আজ এ সব একদম ভালো লাগছে না। একটু সবুর করতে তো পারত ! আমিও তো দেখে নিতে পারতাম মিতু নামের এই মেয়েটার চালচলন আদব কায়দা ! ঘরের বৌ হয়ে আসতে চলেছিস, এখনও হোসনি যদিও, রান্নাঘর অব্দি অন্তত ঢুকে পড়। সত্যি মিথ্যে যা-ই হোক, একটু মদত করার কথা অন্তত বল্। তা নয়, লাট সাহেবের মত বাইরেই বসে রইল ! ওদিকে বেচারা ছেলেগুলো ছোটাছুটি করে মরছে !

নাস্তায় গরম গরম সিঙাড়া বানিয়েছি, সুজির লাড্ডু আর ঘরে চিঁড়ে ভাজাও ছিল। নাস্তার আইটেম দেখে সবাইকে বেশ খুশিই মনে হল।

‘ওহো মা, আপনি ঘরেই বানিয়েছেন এ সব ?’ মিতু হাসিমুখে বলতে থাকল, ‘আমি তো বিলিভই করতে পারছি না। রোজ এত রিচ নাস্তা দেন ওদের ?’ একটু থেমে টিপ্পনী কাটল, ‘এ জন্যেই আপনার দুই পুত্রের চেহারাই বেশ নাদুসনুদুস।’

‘অ্যাই, একদম নজর দেবে না’, মজার স্বরে ধ্রুব বলল, ‘আমাদের জন্যে এ সবই মায়ের জীবনভরের সাধনা।’ কৃত্রিম গম্ভীরতার আড়ালে শিব বলল, ‘তুমি জানো, মা-ই আমাদের খাইয়ে দাইয়ে এমন বানিয়েছে। যত খিটখিটে বৌ-ই আসুক এ ঘরে, আমরা ঠিক যুঝে নেব। ময়দান ছেড়ে পালাবার কেউ নই।’

আর এক প্রস্থ হাসির রোল উঠল। আমার কিন্তু মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিল। আমার ছেলেদের মোটা চেহারা নিয়ে বলার অধিকার ওকে কে দিয়েছে ? এখনও তো ঘরে আসিসনি, এর মধ্যেই এত তেজ ! এ কোনো কথা হল ? তোর মা-বাপ যদি তোকে না খাওয়ায় তো আমি কী করব ? তোর রাজ শুরু হলে না-হয় দু’বেলা পাউরুটি খাইয়ে খাইয়ে এদের রোগা করে তুলিস !


‘চলি মা।’ তন্দ্রায় চোখ জুড়িয়ে এসেছিল। তাকিয়ে দেখি, সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। মিতু হাত তুলে নমস্কার করল। গেট অব্দি ওদের ছেড়ে দিয়ে আসি। ধ্রুব মিতুকে ঘর অব্দি ছাড়তে গেল।

ঘরে আসতেই ওদের পাপা শুরু করে দিলেন, ‘প্রথম
বার এলো, একে-ওকে তো কতকিছু দাও, মেয়েটাকে এভাবে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলে !’

কোন জবাব দিলাম না। খালি কাপ প্লেটগুলো তুলে রান্নাঘরে চলে গেলাম। হুঁ ! প্রথম বার এল ! তো আমি কী করব ? রীতি রেওয়াজের সব দায় কি আমারই নাকি !  ও-ও কি একবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে পারত না ? এলেন আর গেলেন, যেন ইংরেজ !

সমস্ত সন্ধেটা রান্নাঘরেই কাটল। আমি জানি, আমার প্রতিক্রিয়া জানবার জন্যে সব্বাই উৎসুক হয়ে আছে। আমি কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছি না। শিবও দু’একবার ঘুরপাক খেয়ে গেছে, সব জেনে বুঝেও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি কাজে।

রাতে খাবার টেবিল জুড়েও অব্যক্ত একটা উৎকণ্ঠা ছিল। দু’একটা চুটকি শুনিয়ে ওদের পাপা সেই উৎকন্ঠাকে হালকা করতে চেয়েছিলেন, তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। খাবার পরেও কাজ আর শেষ হয় কোথায় ! সবক’টা দরজা জানলা ঠিকমত বন্ধ হয়েছে কিনা দেখা, সব ঘরের লাইট নেভানো, দুধ দইয়ের বাটি মিটসেফে রাখা, উঠোনে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় তুলে আনা … একটা একটা করে কাজ গুটিয়ে আনতে আনতে দেখি ধ্রুব নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়াল। ‘মা’, কাঁপা স্বরে ডাকল সে।

‘কী ?’, তোয়ালে ভাঁজ করতে করতে জিজ্ঞেস করি।

‘তোমার… মিতুকে তোমার কেমন লাগল মা ?’

‘আমার লাগায় কী আসে যায় ! তোর পছন্দ হলেই হল।’

‘না মা, তোমার পছন্দটাও জরুরি। তোমার আর পাপার।’

সন্ধে থেকে যে-ঝড় উঠেছিল মনে, ধ্রুবর প্রশ্নে সে যেন আরও তীব্র হয়ে উঠল।

‘তুমি কিন্তু উত্তর দাওনি মা।’

‘একটা কথা বল্, ও কি জানত, ওকে তুই কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস ?’, প্রশ্ন করলাম।

‘হ্যাঁ, কেন ?’

‘তাহলে তো একটু ভালো পোষাক পরে আসতে পারত। অন্তত তুই তো ওকে…’

‘বলেছিলাম মা।’

‘তাহলে ?’

‘বলল, আমি যেমন, তেমনই দেখতে দাও। খামোখা নাটক করে লাভ কী ?’ একটু থেমে ধ্রুব বলল, ‘যাক্, ছাড়ো ওই পোষাকের কথা। এমনিতে মিতুকে তোমার কেমন লাগল, বলো না।’

এতই আকুলতা ছিল ধ্রুবর কন্ঠস্বরে, ওকে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে হল না। একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কথা শেষ করলাম, ‘ভালোই।’

সত্যি বলতে মিতুকে আমি ঠিকঠাক দেখিওনি। প্রথম নজরেই মেয়ের হাবভাব দিয়েছিল মেজাজটাকে বিগড়ে। হবু বৌমাকে নিয়ে কল্পনায় কতই না স্বপ্ন ছিল। সব ছাই হয়ে গেছে প্রথম দর্শনেই। রাগ তো হচ্ছিল নিজের ছেলেরই ওপর। কে জানে, প্রেম করার সময় কি এরা ঘাসে মুখ দিয়ে বেড়ায় ! কত সুন্দর সুন্দর সম্বন্ধ আসছিল, কিন্তু কপালে যে লেখা আছে সার্কাস সুন্দরী। দীর্ঘশ্বাস উঠে আসছে।


শুধু সহমতি পাওয়াটুকুরই যা অপেক্ষা ছিল। বাকি কাজ তো তারপর ফটাফট চলতে লাগল। মিতুর বাবা স্বয়ং আমাদের বাড়ি এলেন। প্রথামাফিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দিলেন। পুত্রবধূ হিসাবে মিতুকে স্বীকৃতি দিতে জোড়হাতে নিবেদনও করলেন। জানালেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে মেয়ে তার হস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করেছে। হস্টেলও তাঁদের ঘর থেকে অনেক দূরে। ছেলের বিয়ে দিয়েছেন বছর দুই আগে। হস্টেলে থাকার কারণেই অনেককিছু শিখে উঠতে পারেনি তাঁর মেয়ে। তা নিয়ে তাঁর ভয়ও ছিল খুব। এও জানালেন, ধ্রুব তাঁকে আশ্বস্ত করেছে, মা খুব স্নেহময়ী এবং সহনশীল, তিনিই গড়েপিটে নেবেন।

জবাবে ধ্রুবর পাপাও তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। আমরাও তেমন প্রাচীনপন্থী লোক নই যে আর্কিটেক্ট মেয়ের মধ্যে ষোলো শতাব্দীর বধূ খুঁজে বেড়াব।’

বেশ সৌজন্যপূর্ণ পরিবেশে পরিচয়পর্ব শেষ হল। ধূমধাম করে হল এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান। মন খুলে খরচা করল দু’পক্ষই। দেনাপাওনার ব্যাপার ছিল না, ফলে এ নিয়ে কোনো তিক্ততারও অবকাশ ছিল না। তা সত্ত্বেও সবার আড়ালে বেয়াই মশাইয়ের হাতে আমি একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছিলাম। প্রথম ছেলের বিয়ে। নমস্কারি তো দেওয়া চাই-ই। নিজের মেয়েকে তো সব বাবাই কিছু দেয়, সারা জীবনেও যে দেনা শোধ হবার নয়। কিন্তু বাকি লোকেদের সুযোগ তো বিয়েশাদিতেই জোটে।

একটা লিস্ট ধরিয়েছি ধ্রুবকেও। লিস্ট আর কী ! বৌমার জন্যে একটা আচার সংহিতা বলা চলে : মিতু একমাত্র বিয়ের পরই এ বাড়িতে আসবে, ভবিষ্যতে ও আর চুল কাটতে পারবে না, চুড়ি পরা অভ্যেস করতে হবে, বিয়েতে ঘোমটা দিতে হবে, যতদিন ঘরে অতিথিরা থাকবেন ততদিন শাড়ি পরতে হবে, লোকজনের সামনে ধ্রুবর নাম নিয়ে ডাকা চলবে না…

বেশ বড়সড় একটা লিস্ট। একটা একটা মনে পড়েছে আর তা লিস্টে জুড়ে দিয়েছি। ফাজিল শিব তো নাম দিয়েছে বিশসূত্রী কার্যক্রম। উঠতে বসতে সে ধ্রুবকে খেপায় – দাদাভাই, ভাবীকে ক’টা সূত্র মুখস্থ করিয়েছিস ? কখনো বলত, ভাবীকে বলিস ফার্স্ট ডিভিশন হোক বা না-হোক পাশমার্ক যেন ওঠে।

এ সব খেপানো যে নিছক মজার ছলে, তা কিন্তু নয়। এর পিছনে ছিল অব্যক্ত এক আক্রোশ – মায়ের জন্যেই যেন তাদের ইমেজ পুরনোপন্থী হয়ে উঠছে। ধ্রুব মুখে কিছু বলত না, কিন্তু তাকে খেপালে যেরকম উদাস হাসি সে হাসত, তাতেই স্পষ্ট হত সবকিছু।

একদিন আমি বলেই বসলাম, ‘দেখ শিব, এ সব কিন্তু হাসি মজার বিষয় নয়।’ ভুল কিছু বলিনি। বিয়েবাড়িতে কিছু লোক আসেই, যারা শুধু দোষ খুঁজে বেড়ায়। সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হয় নবপরিণীতা মেয়েটিকে। আর মিথ্যে কী-বা বলি, এহেন চর্চায় আমিও সামিল হয়েছি কয়েকবার। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে যত বৌ এসেছে প্রত্যেককে নিয়ে কিছু না কিছু বলার মত আমারও আছে। সুরেশের বৌ তো রান্নাঘর অব্দি চপ্পল পরে ঘুরে বেড়ায়, মহেশের বৌ ন’টার আগে বিছানাই ছাড়ে না, আবার রান্নাঘরে উঁকি দেবার অভ্যেসটুকুও নেই রাজনের বৌয়ের। ওদিকে আলোকের বৌ চব্বিশ ঘণ্টা বরের নাম জপ করতেই ব্যস্ত, শ্বশুর ভাসুরদের প্রতি কোনো খেয়ালই থাকে না। নিখিলের বৌ আবার এককাঠি উপর – সবজান্তা তীরন্দাজ। পতিদেবকে দু’চারজনের সঙ্গে হাসিগল্প করতে দেখলেই বাচ্চাকে কোল থেকে ছুঁড়ে সামনে বসিয়ে গজরাতে থাকবে ‘এই বাচ্চা আমার একলার নয় যে দিনভর বয়ে বেড়াব।’ শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার জোগাড়। পিসি তো একদিন বলেও দিল, ‘বৌমা, সবাই জানে, বাচ্চা একা একা কারোর জন্মায় না, তা বলে এ ভাবে ঢাক পিটিয়ে বলার কোনো মানে হয় না।’

এই সব নমুনাই আমার চোখের সামনে দেখা। আর সেজন্যেই মনের মধ্যে আদর্শ এক বৌমার ছবি কল্পনায় আঁকা ছিল। ভেবেছিলাম আমার ধ্রুবর জন্যে যে মেয়ে ঘরে নিয়ে আসব, সে সবার থেকে হবে আলাদা, একেবারে অন্যরকম। কিন্তু হায় ! নিজের ভাবনা আর সত্যি কোথায় হয় !

ধ্রুব একদিন আমার গলা জড়িয়ে ধরে খুব আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার সমস্ত শর্ত যদি মেনে নেয়, তাহলে তোমার ভালো লাগবে তো, মা ?’ ঠিক সেই সময় আমার মনে সন্তুষ্টি এসেছিল এই ভেবে যে, ছেলেটা আজও তার মাকে সত্যি সত্যিই চায়। চারপাশের পরিবেশ দেখে একজন মায়ের কাছে সেটুকু কিছু কম পাওনা নয়।


সাড়ম্বরে বিয়ে হয়ে গেল। প্রথম বিয়ে। অনেক অতিথি এসেছিল। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে তো ফোড়ন কাটার মত কিছু না পেয়ে একপ্রকার হতাশ হতে হয়েছিল। আমি নিজেও ছিলাম খুব ভয়ে ভয়ে। এক তো মেয়ের মা নেই। কর্তাধর্তা বলতে মেয়ের বড় বোন। আমেরিকায় থাকে, কর্তাগিন্নি দু’জনেই ডাক্তার। আর দাদাবৌদি তো নতুন, ছেলেমানুষ। তবু আপ্যায়ন আতিথেয়তা খাওয়াদাওয়ায় কোনরকম ত্রুটি বা অব্যবস্থা ছিল না। মিতুর বাবাও বেশ অমায়িক মানুষ, এমনকি তাঁর বোন-ভগ্নীপতি, ভাই-ভাইবৌ, কাকা-জেঠা  সৌজন্য ও ভদ্রতায় অসাধারণ। বধূবরণের সময় যখন মিতুকে দেখি, আহা দু’চোখ জুড়িয়ে গেল। এই রূপ-লাবণ্য এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল মেয়েটা ! ঝলমলে লাল বেনারসিতে মোড়া যেন ফুটফুটে একটা পুতুল।

ইন্টারকাস্ট বিয়ে নিয়ে শুরু শুরুতে মনের মধ্যে একটা খিঁচ ছিল বটে, এখন সেটা উধাও। এ নিয়ে ননদরাণী খানিক কুটকচালি বাঁধানোর চেষ্টা করেছিল। এখন তো মাথা উঁচু করে বলতে পারব, আমরা তো মেয়ের রূপ গুণ দেখেছি শুধু, বিদ্যা বুদ্ধি দেখেছি, ঘর পরিবার দেখেছি। ব্যাস্, জাতপাত আর কে দেখে আজকের দিনে ?

আট দশ দিন ধরে ঘরে যেন মেলা বসেছিল। যে দু’চারদিন ছিল মিতু, ননদদের মধ্যে বেশ রয়েসয়েই ছিল। তাদের বাচ্চাদের আদর করত। তাদের ছোটখাটো বায়নাও সামলে নিত। সম্পর্কে শাশুড়ি বড়শাশুড়ি ছিল যারা, তাদের সঙ্গেও বেশ শিষ্টতার সঙ্গে মানিয়ে ছিল। সব্বাই প্রশংসাই করেছিল মিতুর। ফিরে যাবার আগে সব অতিথিই শুভেচ্ছাও জানিয়েছিল।

বিয়ের আট দশ দিন পর ওরা মুসৌরি বেড়াতে গেল। ওদের ফিরে আসা অব্দি সবিতাকে আটকে রাখলাম। ভাবলাম ননদ-জা কয়েকটা দিন একসাথে কাটাক। একদিন ব্যস্ত আছি রান্নাঘরে, সবিতা ফিসফিস করে নালিশ করল, ‘মা, তোমার আদরের বৌরাণীকে দেখো একবার।’ দেখি, বড় বড় ফুল ছাপা হলুদ রঙের একটা ম্যাক্সি পরে মিতু টেবিলে প্লেট সাজাচ্ছে। আমি আর সবিতা দু’জনেই দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এ নিয়ে কথা কে তোলে ! তুললেও কীভাবে ? আমি তো আজকাল ছেলেদের কাছেই ঘাবড়ে থাকি, কিন্তু সবিতার আর কী ! ও তো ওদের কাউকে পাত্তাও দেয় না। হনহন করে বাইরে গেল সে, বলল, ‘মিতুরাণী, আজ এটা তুমি কী পরেছো ?’

‘ঘরের পোষাক দিদি’, অত্যন্ত নিরুদ্বিগ্ন উত্তর দিয়ে সবিতার প্রশ্নার্থক দৃষ্টি টের পেয়ে বলল, ‘মায়ের আদেশ ছিল অতিথিদের সামনে শাড়ি পরার, এতদিন এজন্যেই শাড়ি পরেছি, কিন্তু শাড়িতে বড্ড অস্বস্তি হয় দিদি।’

‘ও, আমাকে তাহলে অতিথি মনে করো না, তাই তো ?’

‘তুমি তো ঘরের লোক, নিজের দিদি।’

অন্য কোনো সময় হলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, কিন্তু এখন সমস্যা বেশ গুরুতর। তবু আগ বাড়িয়ে বললাম, ‘বেটা, ঘরে এখন যখনতখন তোমাকে দেখতে যে-কেউ চলে আসতে পারে।’

‘কিন্তু মা, শাড়ি একদম কমফোর্টেবল লাগে না। আর শাড়ি পরে তো কাজ করতে পারব না। ব্যাস্, পুতুলের মত সেজে বসে থাকতে পারি।’

‘কাজ করার জন্যে তো সারাটা জীবন পড়ে আছে। তাছাড়া এখন আমি তো আছি।’

‘বেশ। কিন্তু মা,অফিসেও শাড়ি পরে যাওয়া জরুরি নয় তো ? তাহলে কিন্তু আমি গাড়ি চালাতে পারব না।’

গাড়ি মানে লুনা, মোপেড। এই লুনাও আর এক কাঁটা। বিয়েতে লুনা দেখে বৌদি ফিক করে হেসে দিয়েছিল, ‘বাঃ ধ্রুবজী, ভালোমানুষির সীমা ছাড়িয়ে গেছ দেখছি। আজকাল বাজাজ সুপারের কমে কোনো কথাই চলে না। অন্তত তুমি তো …’

কথা থামিয়ে দিয়ে ধ্রুব বলেছিল, ‘মা, এটা আমার নয়, মিতুর গাড়ি। মিতু ওর বাবাকে বলেছিল, গয়না দাও আর না দাও, একটা গাড়ি কিন্তু আমাকে দেবে।’

তার মানে, সবকিছু নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছে। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। যদি স্কুটারই নিত, কী ক্ষতি ছিল ! বাজাজ প্রিয়া হলে শিবেরও কাজে লাগত। দরকারে দু’জনেই স্কুটারে যেতে পারত। তখন আর এই শাড়ির কথাও আসত না।

শেষমেশ আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি, অফিসে সালোয়ার কামিজ পরেও যেতে পারবে। কিন্তু সমস্যা তো শুধু ঘরের মধ্যে পোষাক পরা নিয়েই নয়, সারা ঘর জুড়ে খোলামেলা পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানো, দিনরাত হাহা হিহি, কথায় কথায় গলা ধরে ঝুলে পড়া বড্ড চোখে লাগে। শ্বশুরমশাইকেও রেয়াত করা নেই, সকালে যখন পেপার পড়ে ওদের পাপা, মিতুও তাঁর চেয়ারের হাতলে বসে পেপারে চোখ বুলোতে থাকে। ঘরে থাকলে সারাটা দিন পাপার আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। নিজের উৎসাহেই এটা ওটা খাওয়ায়। এমনকি সময়মত ওষুধ না খেলে বকাবকিও করে। বিকেলে হেঁটে ফিরলে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পৌঁছে যাবে সোজা বাগানে, সেখানে ছোট একটা পিঁড়িতে বসে ঘন্টা ধরে বকবক করতে থাকে। দেখেশুনে মাথা গরম হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে যা চলছে তা না-হয় ঠিক আছে, বাইরে এসব লোক দেখানোর কী দরকার ? আশপাশের ঘরগুলোর জানলা থেকে তো কয়েক জোড়া চোখ ওঁৎ পেতেই আছে।

কিন্তু মুশকিল হল, এ নিয়ে ছেলেদের কিংবা ওদের পাপার কোনো বিকার নেই। সবকিছু যেন সহজ স্বাভাবিক। একদিন তো বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। রোজ দিনের মত দু’জনে দুপুরের চা নিয়ে বসেছি, এমন সময় ঝড়ের গতিতে মিতু এসে বলতে লাগল, ‘আরে আজ এত তাড়াতাড়ি !’ হাত দুটো পিছনে মোড়া, আব্দার ধরল, ‘আগে তোমরা চোখ বন্ধ করো, প্লীজ় !’

‘কী ব্যাপার ?’

‘আগে চোখ বন্ধ।’

চোখ বন্ধ করতেই দু’জনের গলায় দুটো মালা পরিয়ে দিয়ে হাততালি দিতে থাকল, ‘মেনি হ্যাপি রিটার্নস অব দ্য ডে।’

‘আরে, ব্যাপারটা কী ?…’ বলতে গিয়েও সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, আজ তো বারো ডিসেম্বর, আমাদের বিবাহবার্ষিকী। নানান এত কাজে জড়িয়ে পড়েছিলাম যে ভুলেই বসেছি। একঝলক মুখের দিকে তাকিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরল মিতু, ‘ধরা পড়ে গেছো, তাই না ? ভেবেছিলে চুপচাপ থেকে সস্তায় সেরে নেবে। তা হবে না। পাপাজী, তিন চারটে কড়কড়ে নোট রেডি রাখুন। আজ আমাদের ইরাদা কিন্তু একদম ভালো নয়, বলে রাখলাম।’

ওদের পাপা হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু বেটা, তুমি কী করে জানলে ? আমার তো মনেই থাকে না।’

‘লাঞ্চের সময় ধ্রুবর ডায়েরি ওল্টাচ্ছিলাম, তখনই নজরে পড়ল’, একটু থেমে বলল, ‘দাঁড়াও, ধ্রুবকেও দেখাচ্ছি। এত ইম্পর্ট্যান্ট একটা দিন, সেও ভুলে গেল ?’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘ধ্রুব কোথায় ?’

‘শিবকে আনতে কলেজে গেছে। আজ ওকেও ধোঁকা দিচ্ছি, আজ ওকে আর পড়তে দেব ? আজ তো শুধু হাঙ্গামা হবে হাঙ্গামা !’

একটু পরেই ওরা দু’জন ফিরল। তারপর তিনজনে মিলে প্রথমে বরণ, তারপর পা ছুঁয়ে প্রণাম আর শেষে দু’জনকে দুটো গিফট প্যাকেট। তখনই নির্দেশ এল দুটো প্যাকেটের মোড়ক খুলে উদ্ঘাটনের। খোলা হল – আমার জন্যে খুব সুন্দর একটা পিওর সিল্কের শাড়ি আর ওদের পাপার জন্যে একটা পুলওভার। এর পর আমেরিকা থেকে উপহার পাওয়া ক্যামেরায় তোলা হল রঙিন ছবি। দল বেঁধে যাওয়া হল ‘ফেমাস স্টুডিও’য়। একটা গ্রুপ ফটো তোলানো হল সেখানে। পারম্পরিক বধূবেশে সেজেছিল মিতু, আমারই পিছনে আঁচলে মাথা ঢেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। শিবও ওর ভাবীকে খেপাতে কসুর করেনি। ফটো তোলা শেষ হলে ‘আঙ্গুর’ সিনেমার ফার্স্ট শো দেখলাম সবাই। তারপর ‘ব্লু ডায়মন্ড’-এ খাওয়াদাওয়া। শেষে ‘কোয়ালিটি’র আইসক্রিম আর ‘বেনারস পানবালে’র দোকান থেকে পান খেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা। শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তবু এই ক্লান্তিও যেন অনেক মধুর।

‘বাপরে ! হাঁপিয়ে গেছি। সত্যি সত্যি ওরা হাঙ্গামাই করল। এই বয়সে আর এত লম্ফঝম্ফ সহ্য হয় না ‘, রাতে হাসতে হাসতে বললাম। কোনো উত্তর না দিয়ে ওদের পাপা কিন্তু চুপ করে থাকল। রাগী চোখে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে।

ঘাবড়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল ?’

‘মেয়েটা মা মা করে মরছে, আর তুমি ?’

‘আমি কী করলাম ?’ আমিও রেগে জানতে চাইলাম। মুহূর্তের মধ্যে সারা খুশিই যেন উবে গেল।

‘আমাকে কী জিজ্ঞেস করছো ? নিজেকেই জিজ্ঞেস করে দেখো, কী করোনি তুমি ! ও বেচারি মা-হারা একটা মেয়ে।’

‘মা-হারা তো আমি কী করব ?’ রাগে ফেটে পড়লাম। সারা বিকেল জুড়ে মমতার একটা স্রোত ঝরে ঝরে পড়ছিল। ধীরে ধীরে জমা হচ্ছিল। ‘মা নেই ওর তো কী করব বলো ? কোলে করে ঘুরব না ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে শোনাবো ?’

কোনো জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শুলেন। খুব রাগ হল। এও বেশ এক কায়দা, জবাব না থাকলে কথাই থামিয়ে দাও, ব্যাস্।

‘আচ্ছা মুশকিল তো’, আমি গজগজ করতেই থাকি, ‘দিনভর হাহা হিহি চলতে থাকবে, ছোটবড় কোনো জ্ঞান থাকবে না। তাতেও আমার শান্তি নেই। পরের মেয়ের জন্যে এত দরদ, ন’মাস ছ’মাসে যখন নিজের মেয়েটা ঘরে আসে, কই তখন তো এত দরদ দেখি না ! আদর যত্ন ছাই করব ? ও তো তোমার আস্কারাতেই বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে। আজ অব্দি আমার সঙ্গে কোনওদিন মন খুলে কথা বলেছে ও ?’

এবার আমার চুপ করে থাকার পালা।


জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই জার্মানিতে ছ’মাসের একটা ট্রেনিংয়ের অর্ডার এসে হাজির ধ্রুবর। এই খবরে ঘরের সবাই বেশ খুশি। কয়েক শ’ লোককে ডিঙিয়ে ধ্রুবর এই সিলেকশনে আমাদের গর্বের শেষ নেই। জার্মানি যাবার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। আমার মন কিন্তু দমে গেল। এই প্রথম এত দূর যাচ্ছে ছেলে, বিদেশে, তাও নতুন বিয়ে-করা বৌকে ফেলে রেখে। কথাটা তুললেন ওদের পাপা, ‘মিতুকেও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিস না কেন ? ঘুরে আসত।’  মিতুই প্রস্তাবের বিরোধিতা করল। বলল, ‘খামোখা খরচা বাড়িয়ে কী লাভ পাপা জী ? ধ্রুবর খরচা না-হয় কোম্পানি দেবে, আমার খরচ তো আমাদেরই দিতে হবে, না ! পরে আমারও কখনও চান্স আসবে।’ ঘুরেই শিবকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তাই না শিব ?’

সবসময় হাসিমুখে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেত মিতু। কিন্তু লক্ষ্য করেছি মাঝে মাঝে কখনো সখনো উদাস মনমরা হয়ে যেত। স্বাভাবিক। আমার কিন্তু দুঃশ্চিন্তা বাড়তে থাকল। ধ্রুবকে একদিন বললাম, ‘বেটা, তোর ফিরে আসা অব্দি যদি মিতু ওর বাবার কাছেই থাকে তো কেমন হয় ?’

‘যেখানে খুশি থেকে যাবে মা। ছ’মাসের তো ব্যাপার। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকে, তেমন হলে না-হয় ফিরবার দিন পনেরো কুড়ি আগে ওকে ডেকে নেব। ঘুরে আসবে।’

ও তো খুব সহজেই সমাধান বাতলে দিল, আমার কিন্তু দুঃশ্চিন্তা কমছে না। ওদের পাপার শরীরও আজকাল ঠিক থাকে না। মিতুও যদি মনখারাপ করে থাকে, বেয়াই মশাই তাহলে আমাকেও জড়িয়ে নেবেন। ভেবে ভেবে ভয় ক্রমশ বাড়তেই থাকল।


শিব আর মিতু ধ্রুবকে ছাড়তে বোম্বাই অব্দি গেল। ফিরে এসে মিতুও চলে গেল ওর বাবার কাছে। ওর বৌদির ছেলে হয়েছে, মাসখানেকের জন্যে সেও বাপের বাড়ি চলে যাওয়ায় ঘর দেখাশোনার জন্যে মিতু যেতে চেয়েছিল। আমিও আপত্তি করিনি। সত্যিই ওদের ঘর এখন একদম শুনশান।

ওদের পাপা ধ্রুবর চেয়ে মিতুকেই বেশি মিস করছিলেন। আট দশ দিন পর পরই পৌঁছে যেতেন বেয়াই মশাইয়ের কাছে। কখনো সখনো আমাকেও টেনে নিয়ে যেতেন। বেয়াই মশাইও মজা করতে ছাড়তেন না, ‘আপনার মেয়ের জন্যে কেমন দৌড়ে দৌড়ে চলে আসছেন। এই গরিবটার দিকে তো কোনো খেয়ালই রাখেন না দেখছি।’ আজকাল শিবও ঘরে ফেরে দেরি করে। কখনো বৌদির সঙ্গে শপিং করা, কখনো বৌদিকে নিয়ে মুভি দেখা, লেগেই আছে। মিতুও আসে মাঝে মাঝে, কিন্তু আগের মত সেই ঝোড়ো মেজাজটা যেন হারিয়ে গেছে। হাসিমজা চলে কিন্তু পুরনো উচ্ছলতায় কেমন ভাটা পড়েছে।  এসব দেখে ওদের পাপা বলতেন, ‘বলেছিলাম সঙ্গে চলে যাও। তখন মানোনি, পয়সার কথা ভেবেছিলে। এখন মনে মনে মরে আছো।’


মার্চের শেষ সপ্তাহ হবে বোধহয়। এক রাতে ওদের পাপার পেটে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হল। জানি না, কতক্ষণ থেকে কষ্ট পাচ্ছেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, পেট চেপে বসে আছেন। যন্ত্রণায় মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চাই, ‘কী হয়েছে ? পেটে ব্যথা হচ্ছে ?’

জবাব দিলেন না। উঠে জল গরম করলাম। তুলোয় হিঙের ডেলা জড়িয়ে আগুনে পোড়ালাম। একটা প্লেটে জোয়ান বিটনুন হিং আর গরম জল নিয়ে পাশে বসলাম। উনি নিষেধ করছিলেন। বারবার জিজ্ঞেস করায় বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সেরকম ব্যথা নয় গো।’

‘তাহলে ?’

‘দুপুর থেকে আমি বাথরুমে যাইনি।’

‘আর এখন বলছো ?’ রাগে তাকিয়ে থাকি ওঁর দিকে।

শিবের পরীক্ষা চলছিল। অনেক রাত অবধি পড়ে এখন বোধহয় ঘুমোচ্ছে। ওকে জাগালাম। অত রাতেও ডাক্তার শুক্লাকে ডেকে আনা হল। সবকিছু দেখে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই প্রবলেম আপনার কতদিন ধরে চলছে ?’

‘পনেরো কুড়ি দিন ধরে কষ্ট পাচ্ছি ডাক্তারবাবু।’

শুনে এত রাগ হল আমার ! এতদিন ধরে চুপ করে থাকার কী মানে ? শিব বলল, ‘এটা রাগ করার সময় নয় মা। আগে সমস্যাটা সামলানো দরকার, পরে যা বলার ব’লো।’

কোনক্রমে রাতটা কাটল। ভর্তি হতে হল সকালে। প্রোস্টেটের প্রবলেম, অপারেশন মাস্ট। প্রথমেই আদেশ জারি করে দিলেন উনি, প্রাইভেট নার্সিং হোমে যাবেন না। এমনকি সরকারি হাসপাতালের প্রাইভেট ওয়ার্ডও নেবেন না। জেনারেল বেডে থাকবেন।

এমন অপারেশনের পর ভালো নার্সিংয়ের খুব দরকার। প্রাইভেট ওয়ার্ডে কেউ বড় একটা যায় না। দশবার ডাকাডাকি করতে হয়।

ওনার কথা না মেনে উপায়ও ছিল না। টাকা পয়সা সব ওঁর কাছে। ধ্রুব থাকলে অন্য কথা ছিল, কিন্তু অত দূর থেকে ওকে আসতে বলারও কোনো মানে হয় না।

একটা মাত্র রাত কেটেছে জেনারেল ওয়ার্ডে। উফ্, সারাজীবন মনে থাকবে। এই অবস্থায় ওঁর ঘুমের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। চারপাশে দমবন্ধ পরিবেশ। সকালে উঠে মনে হল আমিই না অসুস্থ হয়ে যাই ! এখনো সেই দুর্গন্ধের কথা মনে পড়লে গা গুলিয়ে ওঠে। সকালে শিব কোথা থেকে যেন চা এনেছিল আমার জন্যে, এক চুমুক চাও গলা দিয়ে নামাতে পারিনি।

‘নমস্তে বহেন জী।’ চমকে দেখি, মিতুর বাবা।

‘আপনি তো কোনো খবরই দিলেন না। এতই কি পর আমরা ?’ ওনার কন্ঠস্বরে আক্রোশ ছিল, অভিযোগও।কী জবাব দেব এর ?

‘কী দরকারে যেন মিতু ও বাড়িতে গিয়েছিল। আপনাদের প্রতিবেশী মেহতা সাহেবের কাছ থেকে খবর পেয়েছে।’

‘না মানে, আসলে এত দ্রুত সবকিছু ঘটে গেল যে..’ অপরাধী স্বরে জবাবদিহি করতে থাকি, ‘শিব বেচারাও একদম একা হয়ে পড়েছে, সব জায়গায় তো ও-ই দৌড়াদৌড়ি করছে।’

‘এ কথাই তো বলছি, ওর একা দৌড়ানোর কী দরকার ? আমরা আছি কিসের জন্যে ? কাল ধ্রুব শুনলে কী বলবে ভাবুন তো !’

ওনাকে কী বলবে, সে চিন্তা ওনার। ধ্রুব আমাকে কী বলবে ? নিজের ওপরই খুব রাগ হচ্ছিল। ওদিকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ওদের পাপা। জেনারেল ওয়ার্ডে থাকবেন ! ওখানে ভালো নার্সিং হয় ! হুঁ ! এখন ওনাকে সেই নরকে নিয়ে যেতে কেমন লাগবে ! এইসব হাজারো দুঃশ্চিন্তায় জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেলাম, মিতু কোথায়।

সাড়ে এগারোটায় অপারেশন থিয়েটারের পাশের কামরায় ওদের পাপাকে রাখা হয়েছে। এমন সুস্থ সবল হাসিখুশি লোকের এই অসহায় দশা দেখে আমার কান্না আসছে। মিতুর দাদা নরেশ আমাকে ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিল। অসহায়ের মত বসে রইলাম।


দু’ঘন্টা পরে ওয়ার্ডে নিয়ে যাবার পারমিশন দিয়েছে। এই দুটো ঘন্টা আমার কাছে যেন দুই যুগ। ওয়ার্ডে ফেরার সময় দেখি অনেক লোকের ভিড়। পরিবারের লোকজন ছাড়াও ছিল হসপিটালের অনেক স্টাফ। অনেক শিশি বোতল ওপরে তুলে ধরে স্ট্রেচারের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল সবাই।

‘মা, তুমি সিঁড়ি দিয়ে এসে যাও, লিফটে তোমার অসুবিধে হবে,’ শিবের কথামত সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ওপরে উঠলাম। স্ট্রেচার ততক্ষণে বোধহয় ওয়ার্ড অবধি পৌঁছে গেছে। লম্বা করিডোর ধরে হাঁটতে থাকি। কোনদিকে যাওয়ার রাস্তা কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এগিয়েছি , নরেশজীর গলা শুনতে পেলাম, ‘মা জী, এদিকে আসুন।’

নরেশজীর পিছন পিছন চলতে চলতে করিডোরের শেষ প্রান্ত অব্দি পৌঁছে যাই। ডিলাক্স রুমের দরজা খোলা, বাইরে খালি স্ট্রেচার, সবাই দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠি, ‘এই কামরা !’

আমার অস্বস্তিকর পরিস্থিতি দেখে শিব ফিসফিস করে জানাল, ‘ভাবী বুক করিয়েছে।’

‘এ সব মিতুর পক্ষেই সম্ভব’, মিতুর বাবা গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘সুপারিন্টেনডেন্টের সঙ্গে রীতিমত তর্ক জুড়ে দিয়েছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রুম অ্যালোট করিয়েছে। বরাবরই খুব একগুঁয়ে আমার মেয়ে।’

মিতুর দিকে তাকাই। পালঙ্কের পাশে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।

‘ঘরে তো কুটোটাও নাড়ে না’, ফুট কাটল নরেশ, ‘আর এখানে এসে দেখো, সাফসুতরোতেই লেগে আছে। এরই মধ্যে তো ও ঘরে তিন তিনবার চক্কর লাগিয়েছে।’

স্নেহসিক্ত স্বরে বেয়াই মশাইও যোগ করলেন, ‘এ হচ্ছে শাশুড়ি মাকে খুশি করার ফর্মুলা।’

কামরা সত্যি সত্যিই ঝকঝকে পরিষ্কার ছিল। পাশাপাশি দুটো পালঙ্কে পাতা হল ঘর থেকে আনা কাচা পরিষ্কার চাদর, সঙ্গে বালিশ। পাশে গুছিয়ে রাখা হল আমার আর ওঁর কিছু জামাকাপড়। চা চিনি কাপ প্লেট ম্যাচিস – কিচ্ছু ভোলেনি মিতু। বাথরুমে বালতি মগ তোয়ালে ছোট্ট চৌকি – সবকিছু জায়গামত। খানিক পরেই স্টোভের শোঁ শোঁ আওয়াজ শুরু হল, দেখি মিতু চা বানাচ্ছে।

‘মা, চা খান’, চায়ের কাপ হাতে সামনে দাঁড়িয়ে। কামরায় ঢুকে এই প্রথম কথা বলল মিতু। তার কন্ঠস্বরে নেতৃত্বের দাপট – ভূমিকাহীন, সরাসরি।

‘চা ! এখানে ?’, বোকার মত প্রশ্ন করে ফেলি।

‘তো কোথায় খাবেন ? পাপাকে এই অবস্থায় এখানে ফেলে ঘরে যাবেন ?’

ওর কথায় যুক্তি ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ওজন। চুপচাপ ঠোঁটে তুললাম কাপ। চা নিতেই অন্যরা সবাইও যেন স্বস্তি অনুভব করল। ক্লান্ত ছিল সবাই। আনমনেই কাপ হাতে নিয়েছিলাম, কিন্তু সত্যি বলতে চা খাবার পর বেশ হালকা লাগল নিজেকে। সকাল থেকে মাথাটা ধরেছিল। এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে।

পাঁচটা নাগাদ ওদের পাপার সামান্য হুঁশ এল। পাশেই বসেছিল মিতু। এত যন্ত্রণাতেও মিতুকে দেখে হালকা একটা হাসি খেলে গেল ওঁর চোখেমুখে। বড় যন্ত্রণায় কাটছিল দীর্ঘ একটা সময়, না হলে অপারেশনের আগে অব্দি একবারও মনে পড়বে না আদরের বৌমার কথা !


মিতু স্পষ্ট শব্দে নির্দেশ দিল, ‘বাবা, তুমি আর দাদা এখন ঘরে যাও। আমার আর মায়ের রাতের খাবার দাদা নিয়ে আসবে। তুমি কাল সকালে আসবে।’

‘আমি যা খুশি খেয়ে নেব’, মৃদু প্রতিবাদ করলাম।

আমার দিকে না তাকিয়েই মিতু জানাল, ‘আপনার জন্যে ঘরের খাবারই আসবে।’

‘বহেন জী না-হয় আমার সঙ্গে গিয়ে…’

‘প্লীজ় বাবা’, সমস্ত পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে ওদের দু’জনকেই ঘরে পাঠিয়ে দিল। তারপর শিবের সঙ্গে বসে অনেকক্ষণ ধরে সমস্ত বিল কাগজপত্রে চোখ বুলিয়ে নিল। শিবকে পাঠাল ওষুধ কিনে আনার জন্য, নিজে পালঙ্কের পাশে একটা টুল এনে বসে রইল।

অন্য পালঙ্কে চুপচাপ পড়েছিলাম আমি। কিছু বলার মত শক্তি কিংবা সাহস কোনটাই ছিল না আমার। টানা দু’রাত জাগা, তার ওপর ক্লান্তি আর উৎকণ্ঠা। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি, বুঝতে পারিনি। মিতু রাতের খাবার নিয়ে ডাকতে জেগে চোখ মেললাম।

বেয়াই মশাই থাকতে পারেননি, নিজেই খাবার নিয়ে এসেছেন। তার বদলে অবশ্য মেয়ের বকুনিও খেতে হয়েছে বেচারাকে। শিবের জন্যেও খাবার এনেছিলেন, কিন্তু মিতু তাকে হাসপাতালে খেতে দেয়নি। ‘তুমি বাবার সঙ্গে ঘরে যাবে। সকালে পরীক্ষা দিয়ে তবেই এখানে আসবে, বোঝা গেল ?’

‘কিন্তু ভাবী, এখানে..’ মিনমিন করছিল শিব।

‘এখানকার চিন্তা ছাড়ো। এখানে আমি আছি, মা আছেন, দাদা আছে।’

শিব অনেকক্ষণ ধরে গাঁইগুঁই করছিল, কিন্তু তাকে যেতেই হল। ওদের ছাড়তে নিচ অব্দি গেল নরেশজী। নরেশকে দিয়েই আমার জন্যে পান আনিয়েছিল মিতু। আজ পুরো দিন পান ছাড়াই আমার কেটে গেছে, মনেও আসেনি। অথচ কী আশ্চর্য, মিতু কেমন করে জানল যে খাবার পর আমার পান খাবার নেশা চাগাড় দেয় !

খাওয়াদাওয়ার পর মিতু আমার বিছানার চাদর ঠিক করে দিল। বাথরুমে গিয়ে ধুয়ে ফেলল সমস্ত প্লেট গ্লাস। দুধ আর একবার গরম করে শোয়ার ব্যবস্থা করতে লাগল।

‘দাদা, বারোটা অব্দি আমি বরং একটু ঝিমিয়ে নিই, তারপর ডিউটি শুরু হবে। তার পর থেকে না-হয় বাকি রাত তুমি ঘুমিয়ে যেও’, বলেই মিতু ইজিচেয়ারে মাথায় হাত রেখে আধশোয়া হয়ে পড়ল। পালঙ্কের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে রইল নরেশজী। আমার বিশ্রামের যাবতীয় আয়োজন করে নিজেরা ডিউটি করতে তৎপর হয়ে উঠল দুই ভাইবোন। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। মিতুকে আদর করে বললাম, ‘তোমার দাদা ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়ুক, তুমি এই পালঙ্কে এসে যাও না। সারাটা দিন তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাটালে।’

জানি না, কী ছিল আমার কথায়, কোনো প্রতিবাদ করেনি মিতু। চুপচাপ আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল।

‘ঘুমনোর আগে আমায় কিন্তু জাগিয়ে দিও দাদা’, বলেই মিতু চোখ বন্ধ করল। পালঙ্কের পাশে ইজিচেয়ার টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল নরেশও। কোলাহলহীন সমস্ত কামরা জুড়ে নেমে এল আশ্চর্য এক শান্তি।

মিতুকে দেখলাম। ওকে দেখে কেন জানি না, সবিতার কথা মনে পড়ল। সবিতা এখন দু’বাচ্চার মা, সময় সময় এখনো সে শিশুর মত হয়ে যায়। মায়ের কাছে শোবার জন্যে জেদ ধরে। সেই মুহূর্তে একদম ছোট্ট সবি হয়ে যায় যেন।

আমার পাশে এখন শুয়ে আছে ছোট্ট একটা মেয়ে। সবির মত ওরও তো কখনো কখনো এমন ইচ্ছে করে ! কোন্ আঁচলে মুখ লুকোবে তখন ? বড় দিদি আছে বটে, সেও তো থাকে সাত সমুদ্দুর পার দূরে। আর বৌদি, সে নিজেও তো একটা ছোট মেয়ে।

আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়েছিল মিতু। নিস্পন্দ। সালোয়ার কামিজ ছেড়ে নাইটি পরেছে একটা। ছোট্ট একটা বাচ্চার মত লাগছে ওকে। দিনভর দাপিয়ে বেড়ানো উগ্র সেই চেহারার মিতু এখন একেবারে নিরীহ নিষ্পাপ শিশুর মত শুয়ে আছে। বড় মায়া হচ্ছিল মেয়েটার জন্যে, ইচ্ছে হচ্ছিল বুকে জড়িয়ে ধরি। সংকোচে পারিনি। ওর পিঠে মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকি। আমার এই বাৎসল্যের উদ্রেক টের পাচ্ছে না মেয়েটি, নিস্পন্দ পড়ে আছে শুধু। হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে হঠাৎই খেয়াল করি ওর চোখে জল।

‘কী হয়েছে বেটা ?’, আদর করতে করতেই প্রশ্ন করি।

কিছু বলল না সে। শুধু কান্না আটকাতে চেপে ধরল পাতলা ঠোঁট দুটোকে।

‘পাপাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কিসের ? ডাক্তার তো বলেইছে, সবকিছু ঠিক আছে। অপারেশন ভালো হয়েছে। ব্যাস্, দু’একদিনেই উঠে বসবে, দেখো। এমনই তো বলছিলেন, না ?’ সান্ত্বনা দিচ্ছি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমিও শঙ্কাকুল হয়ে উঠছি।

পাশ ফিরল মিতু। কিছুক্ষণ দেখল আমায়। তারপর আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে লাগল, ‘তার আগে বলো, আমাকে কেন খবর দিলে না ? এত অসুস্থ পাপা, আর আমার কথা তোমাদের কারো মনে পড়ল না ?’

তাই তো ! কাঠগড়ায় নিজেকেই দাঁড় করিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকি – মিতুর কথা কেন মনে পড়ল না আমার ? নিজের মেয়েকেই আমি ভুলে গেলাম কী করে ?

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত