| 7 অক্টোবর 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

মানিক সাহার একগুচ্ছ কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ ০৩ মার্চ কবি মানিক সাহার শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

আসলে তুমি হাসতে চেয়েছ

আসলে তুমি হাসতে চেয়েছ। গানের তালে
গাইতে চেয়েছ গান।
বলতে চেয়েছ সুখের কথা, ঝরনার জলে স্নান
করতে চেয়েছ। কিন্তু তোমার
পায়ের কাছেই মানবতা পড়ে আছে
যুবতীর দেহ, ছিন্ন অঙ্গ, আর্তনাদের রবে…

তুমি এইসব যত্নে সরিয়ে ফুল ফোটাচ্ছো টবে;
ভাবছো, যেখানে যা হচ্ছে হোক, সুখে তো থাকতে হবে!

মূক হয়ে আছে দশের দেবতা। মূক হয়ে আছে প্রাণ!
সুখ চাইছো? কিন্তু তাতে জীবনের আঘ্রাণ
নাই যদি থাকে, তবে সে জীবন যাপন কেবলই ভ্রম।
আসলে আমরা মৃতদেরই নিয়ে বাড়াচ্ছি সম্ভ্রম!

ঝরনা তখনো গান গাইছিল মগ্ন দুচোখ বুজে।
মেঘ চেয়েছিলে।
মেঘ এলো হেসে তোমারই গন্ধ খুঁজে।

 

 

শ্রাবণ মেঘ

তুমি আঁচল ভর্তি শ্রাবণ নিয়ে এলে
তোমায় আমি কোথায় রাখব বলো
দু’হাত দিয়ে দুঃখ ঢেকে রাখি
স্বপ্ন ছাড়া কিছু নেই সম্বলও

মেঘের ঠোঁটে মেঘ জমেছে মৃদু
চোখের কোণে শানাচ্ছ বিদ্যুৎ
ঈশান কোণে অশ্রু জমে কালো
হাত পেতে নিই প্রাপ্তি কী অদ্ভুত!

আঁচল ভরে শ্রাবণ এনে দিলে
আমার দু’হাত আঁজলা ভরে রাখা
তোমার অনেক গল্প জমে আছে
আমার মনও শ্রাবণ মেঘে ঢাকা!

 


আরো পড়ুন: মানিক সাহার কবিতা

কবিতা ১০

প্রতিদিন ভুল রঙের জামা পরে একটি সকাল
আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ে

ঘুম ভাঙার শব্দে সে হেসে ওঠে

তাকে দেখিয়ে দিই
কোথায় লুকোনো আছে পূণ্য-কলস
মেঘ ধুয়ে রাখা কপালের উজ্জ্বল টিপ
আর কিছু পুরোন প্রদীপ, যার আলো দিয়ে বহুদিন
তোমাকে এঁকেছি…

 

 

কবিতা ১১

আমার ঘর বুনো ছায়ায় ভরে গেছে
তবে কি তুমি বরফ নিয়ে এসেছ?

আজ আর তোমাকে বিরক্ত করবো না
তুমি যেমন করে যেতে চাও
চলে যেতে পারো….

তোমার করুণা থেকেই আমার এই কবন্ধ উৎসব
পাখিডাক, ঝরনা, উপত্যকায় ফেলে যাওয়া রঙিন ঝিনুক…
আজ সব সমাপ্তির দিন
খুলে ফেলেছ পাতার মুকুট, কন্ঠহার, শঙ্খের চুড়ি কিন্তু

স্পর্শটুকু খুলতে পারছো না…

 

 

ভ্রম

আমাদের বিষন্নতা মানে ভেঙে যাওয়া চশমার কাচ।
মেঝেভর্তি ছড়িয়ে থাকা রুমাল-চুরির স্মৃতি।
এই অস্তগামী সূর্যের পৃথিবীতে তুমি আর কার কাছে যাবে!
যে সীমান্ত দিয়ে নদী বয়ে যায়, যার ছায়ায় ধানের
ছরা, ঘরমুখী পরিযায়ী প্রাণ, তার বাদামী বর্ণ দেহে
গাছের অক্ষর লেগে আছে। তাকে মুছে দিতে চেয়ে
কত মানুষের রক্ত বইয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রনায়কেরা।
সেইসব কথা থাক।
সত্য যত কম বলা যায় তত নিরাপদ।
অথচ এই অস্থির সময়েও প্রেমিকার কথা ভাবতে
ভালো লাগে। তার বেইমানি, মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ভালো
সেজে থাকার নাটক— ভালো লাগে। যতবার মুখোমুখি
হই এত অমায়িক হাসি ফুটে ওঠে, সব ভুলে যাই।
শুধু মনে থাকে, আমাদের যৌবন একদিন শেষ হয়ে
যাবে অথচ বার্ধক্য কোনোদিনই আসবে না।

 

গানের মুদ্রাদোষ

এই পূতিগন্ধময় দেহ। হবিষ্যান্নে লুব্ধ দৃষ্টি রাখা
অদৃষ্টের কাক। এদের অবকাশ বলে কিছু নেই।
যতদিন আমাদের স্বপ্নের বিনিময় নিয়ে রাহাজানি
কারবার চলবে, ততদিন সুন্দর বলে কিছুই নিরাপদ নয়।
যাকে চোর বলে পিটিয়ে মেরেছ একদিন, তার
রক্তস্রাব আজও তোমাদের মোহিত করে। অশ্বত্থের
ডালে আজও তার ছেঁড়া কৌপীন চাঁদের আলোয়
মায়াবী হয়ে ওঠে। তার ভূত ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমরা
ছড়া লেখো, গান লেখো। গানের প্রাচীন এক মূদ্রাদোষ—
যা-কিছু মায়াবী তাকে আরও বেশি মায়াময় করে।
এই হত্যা, রক্ত, অবিশ্বাস, ধর্মের জটল ঘেরাটোপ
ধীরে ধীরে গান হয়ে গেলে ভালো হত।

 

 

জ্বর

গালে স্পর্শ পাই। ডুবে যেতে থাকি জ্বরে। আমার কিশোর বয়স। পুটিদি ভরা নদী হয়ে পাশে বসে থাকে। ওর বাঁকগুলি দেখে মনে হয় বাঁশঝাড়ের আড়াল। মনে হয় নির্জন এক কোনে লুকিয়ে রাখা নৌকা। তোমার ঐ নৌকায় আমাকে চড়তে দেবে, কোনদিন বলতে পারিনি। অথচ আমার মাঝি হওয়ার ইচ্ছে ছিল ষোলোআনা।
একদিন স্নানের সময় ওকে লুকিয়ে দেখি। কোমড়ে কালো সুতো। বাজুতে কালো সুতোয় বাঁ্ধা মাদুলি। একটা সাপ আমার পা বেয়ে উঠতে থাকে। তার ফোঁস করা শুনতে পাই। আমার শিরশিরানি শুরু হয়। পা কাঁপতে থাকে। তখন নগ্ন নারী বলতে টাইটানিকের কেট। রোমাঞ্চকর সমুদ্র লুকিয়ে রাখা তার শরীরে। ভয় করে। আমি আর চোখ নামাতে পারিনা, যেখানে পদ্মফুল, মধু, অগরু আদি জমা হয়ে থাকে। আমার ভীতু চোখে আগুন জ্বলতে থাকে। জ্বালা করে।

পুটিদি কপাল টিপে দেয়। ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরতে। ওর ভারী হয়ে ওঠা বুক থেকে কয়েকটা পাখি উড়ে যায়। আমি তাদের খাঁচায় ধরতে চাই। তাদের পোষ মানাতে চাই। গান শেখাতে চাই।
অথচ সব পাখি গান গাইতে পারেনা। সারারাত ধরে তারা শুধু মাথার ভেতর দিয়ে আকাশের পর আকাশ অতিক্রম করে। তাদের ডানায় রোদ। তাদের ডানায় মেঘেদের গুড়ো। আমি ডাক দিই, পুটিদি….
পুটিদি আমার মাথায় জলপট্টি দেয়। গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমি বলি, পাখি পুষবো, পুটিদি। পাখি পুষতে দেবে? পুটিদি আমাকে চুপ করিয়ে দেয়। ঘুমিয়ে পড়তে বলে।

 

 

লবঙ্গদি

দাঁতে ব্যাথা হলে লবঙ্গদির কাছে যেতাম। দিদি জামার হুক খুলে বলতো, নে, মুখে দে। মুখে দিলেই এক রহস্য খেলা শুরু করতো সারা শরীরে। ব্যাথা কমে যেত। মনে হত লবঙ্গদি একটা গাছ। আমি বেয়ে বেয়ে উঠতে চাইতাম।

কোন কোনদিন গভীর জঙ্গলের গন্ধে ভরে উঠতো দিদির শরীর। আমি তিনটে বাড়ি দূরে থেকেও তা টের পেতাম। রাতের বেলা একটা নেউল ঘুরে বেড়াত। তার গা থেকে ভুরভুর করে ভোগ আতপের গন্ধ আসতো। এত গন্ধ আমার ভালো লাগতো না। আমি স্নানের আছিলায় জলে ডুবে মরার গল্প করতাম।

ভোরের দিকে আমার জ্বর আসতো। সারা শরীর কম্প দিয়ে জ্বর। মনে হত আমার দাঁতগুলি ঠুকাঠুকি করে ভেঙ্গে যাবে।

আমার ভয় করে। লবঙ্গদি ডাক দেয়। কী রে, দাঁতে ব্যাথা আছে? আমি মুখ খুলি। লবঙ্গদি হুক খুলে দাঁড়ায়।

 

সংখ্যা

এখন আর আমাদের ঘুম আসবে না। এই অনন্ত রাত
কীভাবে কাটাবো তা-ই ভাবি—

আজ দেবযান শেষ হল। বিভূতির।
অথচ এই ছলনা ও ভ্রমের জগৎ তবু ভালো লাগছে।
এই মৃদু ও জটিল নশ্বরতা মনোরম ও প্রিয় মনে হয়।

এখন আর দিন নেই। সন্ধ্যাও জমে গিয়ে রাত হয়ে গেছে
সারারাত টিভি চলে। পর্দায় মৃতের সংখ্যা ভাসে

সংখ্যা সংখ্যা সংখ্যা
আমাদের অস্তিত্ব এই সংখ্যায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়

 

গন্তব্য

অতঃপর আমরা বিভ্রান্তির দিকে হাঁটতে শুরু করি।
আমাদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। মাথার
উপর থেকে মেঘের চাঁদোয়া। আমরা প্রব্রাজকের মুখে
নিষেধাজ্ঞা শুনেছি। অথচ মানিনি কোনোদিন।

এই যাত্রার অন্তহীনতা কাউকে তেমন ক্লান্ত করে না
অথচ প্রত্যেকের বুকের ভেতর থেকে মাটির
পুতুলগুলি হারিয়ে গিয়েছে

এখানে বন ও বনান্তের মাঝে সূক্ষ্ম এক নদী বয়ে
যায়। তার জলের রং পান্ডুর। তার উৎসের দিকে
যেতে যেতে আমাদের চোখ পুড়ে গেছে। সারা দেহে
ভষ্ম মেখে নিজেদের আড়াল করতে চেয়েছি। আর
প্রতিটি চিকন আলো বিদ্ধ করেছে এই জাগতিক ভ্রম।

বিষয় আশয় নিয়ে বেশ সুখে আছি ভেবে চরম
বিভ্রান্তির দিকে আমরা যাত্রা শুরু করি। ক্ষুধা ও মৃত্যু
আমাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে পাশাপাশি হাঁটে।
মাথার উপর কালরূপী গৃধ চক্রাকার পরিক্রমন করে।
আমাদের গন্তব্য হারিয়ে যায়।

 

শান্তি

কোনো কোনো বিষণ্ণ সন্ধ্যায় ছাদে উঠে যাই। দেখি—
নিচে— একটু দূরে— দুঃসময়ের আগুন নিয়ে যুবকের দল খেলা করছে
আরও একটু দূরে— টাওয়ারের মাথায় লাল আলো জ্বলছে টিমটিম করে।
ওই আলো, আগুন, নিয়ম ভেঙে রাস্তায় বেরনো যুবকের দল
আর ওই— ঝিম মেরে থাকা কোয়ারেন্টাইন সেন্টার—
সকলের সম্ভাব্য গন্তব্য এক

বিষন্ন সন্ধ্যায় তারাদের মনোরম মনে হয়
ইচ্ছে করে
পৃথিবীর সমস্ত কৃত্রিম আলো নিভিয়ে দিয়ে
চাঁদ ও তারাদের নীলচে আলোয় গাছ আর মানুষের বিবাহ দিয়ে দিই
আমি পুরোহিত হব, আমিই সম্প্রদান করব
আমারই আদ্যশ্রাদ্ধে পৃথিবীর আদি পুরুষের শান্তি লিখিত হবে

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত