দেবী’কে লেখা কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি
২০ জীবনকৃষ্ণ মিত্র রােড
দত্তবাগান।
বেলগাছিয়া
২৭শে মাঘ, ১৩৪২
শ্রীযুক্তা ‘_______’ দেবী১
নমস্কার।
আপনার পত্র আমাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছে। একদিন একঘণ্টার পরিচয়ে আপনার মধ্যে অনুভূতির যে গভীরতা আবিষ্কার করেছিলাম, আপনার চিন্তাধারার যে মৌলিক বৈশিষ্ট্য আমার কাছে ধরা পড়েছিল, আপনার পত্রের ছত্রে ছত্রে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে আবার তারই সন্ধান পেলাম। আমার কাছে ঋণী হয়ে রইলেন লিখেছেন ২। আমার সৌভাগ্য। আপনি রিক্ত একথার জোরালাে প্রতিবাদ করি, কিন্তু ঋণী যদি হয়ে থাকতে চান বারণ করব না, বরং প্রার্থনা করব ঋণ সুদে বাড়ুক। বই তাে মলাট নয়, কাগজ নয়, সাজানাে সীসার অক্ষরের ছাপা নয়,—চিন্তা ভাব অনুভূতি আবেগ প্রভৃতির সমন্বয় করা একটা ডালি। আপনার মনের বিচিত্র চিন্তাধারার কতটুকুতে আমার বই-এর ঋণ শােধ হয়ে যেতে পারবে আমার তাই শুধু ভয়। মেয়ে-পুরুষ অনেকের সঙ্গেই আমাকে পরিচিত হতে হয়, দেখি যে সব প্রায় এক ছাঁচে ঢালা—অবােধ, অগভীর, অনাবশ্যক, অর্থহীন, রক্তমাংসের বিকৃত যন্ত্র। আপনার মধ্যে যে নূতন অন্তর্জগতের আভাস আমি পেয়েছি সে জগতকে ভাল করে জানবার বুঝবার সুযােগ পাবার আগেই যদি আপনি বলে বসেন, হে লেখক মানিক, তােমার বইএর ঋণ শােধ হল, ওর চেয়ে ঢের বেশি যােগ্যতর প্রতিদান দিলাম, এবার ঋণী হলে আপনার মনে কত আছে? তুমি—তাতে আমার ভয় হবে না? সত্যের দাঁড়িপাল্লায় ওজন করলে মনের এক একটি গভীরতম ভাব জগতের সমস্ত বইএর চেয়ে ভারি হবে। কে জানে এমন ভাবসম্পদ।

হঠাৎ ভাগলপুর চলে যাবেন শুনে বড় দুঃখিত হয়েছিলাম। পরদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনলাম বেলা দশটায় আপনারা চলে গেছেন। আমার ধারণা ছিল গাড়ি রাত্রে। আগে যাই নি বলে এখন আপশােষ হচ্ছে। না-যাওয়ার একটা ছিলাম। প্রায়-অবিশ্বাস্য কৈফিয়ৎ দিই। যাওয়ার আগ্রহ একটু বেশী প্রবল ছিল, তাই চুপচাপ ছিলাম।
আমার মনে হয় আপনার মধ্যে বাংলার বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা কবি লুকিয়ে আছেন ৩। আপনি যে লিখেছেন আপনার অন্তরের স্নেহপ্রেম দয়ামায়ার মাঝে কোন এক উদাসী অহােরাত্র বসে বাঁশী বাজায়- এ বাঁশীর সুর কি আপনি সকলকে। শােনাবেন না? আপনার মনে যে কবিতা আছে আপনার বাইরের কবিতায় আজও তার স্ফুরণ হয় নি। আপনার কবিতার প্রতি ছত্রের ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ পায় নি এমন কত অপূর্ব সম্পদ যে আমি আবিষ্কার করেছি! আপনি ইচ্ছা করলে ছমাস এক বছরের মধ্যে কি আশ্চর্য্য কবিতাই যে লিখতে পারবেন ভেবে এখন থেকে আমি উৎসাহিত হয়ে উঠেছি। যদি অধিকার দেন আপনাকে আমি সাহিত্য-ক্ষেত্রে টেনে। আনব। আপনি শুধু লিখবেন—বাকী ভার আমার।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
৩
৫
.
