| 8 মে 2024
Categories
ইতিহাস

মার্ক্সের খোঁজে

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

দ্বিজেন শর্মা

অনেক বছর আগের কথা। কলকাতার সিটি কলেজে পড়ার সময় থাকতাম ব্যারাকপুর, ফিরতে প্রায়ই সন্ধে হয়ে যেত। দেখতাম, স্টেশনের লাগোয়া বস্তির শ্রমিকেরা ধুনি জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে পোহাতে গলা ছেড়ে গাইছেন ‘আয়েগা মার্কস বাবাকো জমানা’। সবে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিয়েছি। বসে পড়তাম তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা জানেন না, মার্ক্স কোথাকার মানুষ, কী কী বই লিখেছেন তিনি। তবে ভালোই জানেন, মার্ক্স বাবার জমানায় গরিবের রাজত্ব কায়েম হবে, ধনীর ঠাঁই হবে না সেখানে, আর সেই রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে রাশিয়ায়, হবে এখানেও।

স্বপ্নেও ভাবিনি, আমিও একদিন যাব রাশিয়ায়, থাকব অনেক দিন, দেখব সেই জমানার সুদিন ও করুণ পতন। ১৯৭৪ সালে মস্কোয় অনুবাদকের একটি চাকরি জুটে যায়, থাকি ২০০০ সাল পর্যন্ত। মার্ক্সের কিছু লেখাও অনুবাদ করি এবং বিস্ময়ে ভেবেছি, একজন মানুষের লেখা কীভাবে শত শত বছরের একটা টেকসই সমাজকে টলিয়ে দিতে পারে। ব্যারাকপুরের শ্রমিকদের কথাও মনে পড়ত। হ্যাঁ, মার্ক্সস বাবার জমানা ঠিকই কায়েম হয়েছে রাশিয়ায়। ধনিক শ্রেণী নেই, উচ্চপদাসীন ও হাতুড়িপেটা মজুর নির্বিশেষে সবারই সাজপোশাক, বাড়িঘর, চলাচল অভিন্ন। বরং বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় শ্রমিকদের উপার্জন কিছুটা বেশি এবং অন্যান্য কিছু বিষয়ে তাঁরা অধিক সুবিধাভোগী। পরে অবশ্য বুঝেছি, এ ব্যবস্থাও অসংগতিমুক্ত নয়, ধনী না থাকলেও ধনী-হতে-ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা অনেক, আর বিত্ত সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষা কতটা দুর্মর।

রাশিয়ায় ১৯৯১ সালে সমাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটলে লোকে যখন মার্ক্সের রচনাগুলো আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করছিল, তখন একদিন আমার কর্মস্থল প্রগতি প্রকাশনে গিয়ে দেখি, বিগত অর্ধশতক কালে অনূদিত বইপত্র নিয়ে বড় বড় গাঁট বাঁধা চলছে, গন্তব্য কাগজকল। বড়ই হতাশ হই। কয়েক দিন পর আমেরিকা থেকে জনৈক বন্ধুর পাঠানো সেখানকার নামী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি কাটিং পাই, তাতে ছিল রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের জন্য মার্ক্সকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং তাঁর শিক্ষার অবমূল্যায়ন অযৌক্তিক; মার্ক্স একজন মনীষী, তাঁর আবিষ্কারগুলো চিরায়ত মূল্যধর এবং গোটা মানবজাতির সম্পদ। তারপর দুই দশক অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই দেখা দেয় আরেকটি বিশ্বমন্দা এবং সেই সঙ্গে আসন্ন পরিবেশবিপর্যয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ। লোকে আবার মার্ক্সকে খুঁজতে শুরু করে, এমনকি পরিবেশবাদীরাও, কেননা তিনি মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষণ এবং মানুষ কর্তৃক প্রকৃতি শোষণের সমাধান পেয়েছিলেন কমিউনিজমে।

আমি ২০০০ সালে দেশে ফিরি, নানা কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, কিন্তু রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের ভাবনা থেকে রেহাই মেলে না। যত সব লেখা পড়ি, আলোচনা শুনি, সবই মনে হয় অঙ্গসংস্থানিক শারীরবৃত্তীয় নয়। মোটা দাগে এমন ধারণাও জন্মেছিল যে সিআইএ নয়, বিশ্বপুঁজিই এই পরিবর্তন ঘটিয়েছে আমাদের অজ্ঞাত কোনো নিয়মে। মনে পড়ত, বিবিসি একসময় প্রায়ই প্রচার করত যে নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এলেই রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন ঘটবে। ঘটলও তাই। এই বিবিসিতেই কয়েক মাস আগে ডেভিড হার্ভের একটি সাক্ষাৎকার দেখলাম। তিনি মার্ক্সবাদ নিয়ে গবেষণা করছেন, অতি সম্প্রতি তাঁর দি এনিগমা অব ক্যাপিটাল বইটি প্রকাশিত হয়েছে। যেটুকু মোটামুটি মনে আছে, তা এরূপ—

পুঁজিতন্ত্র আর কত দিন টিকবে, এই প্রশ্নের জবাবে হার্ভে জানান, মহাপ্রলয়ের দিনক্ষণ অনুমান করা গেলেও পুঁজিতন্ত্র বিলুপ্তির কাল নির্ণয় মোটেও সম্ভব নয়। পুঁজিতন্ত্রের বর্তমান সংকটের হেতু সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা, আগামী ৫০ বছর অব্যাহত ৩ শতাংশ কম্পাউন্ড গ্রোথ রেট টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। জ্বালানির প্রচুর চাহিদা, বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশের চাপ এবং নানা সামাজিক কারণে পুঁজিতন্ত্র একসময় অচল হয়ে পড়বে, প্রবৃদ্ধির হার শূন্যের কোঠায় পৌঁছাবে।

প্রশ্নকারীর জিজ্ঞাসা, কিন্তু কোনো আন্দোলন হচ্ছে না কেন? লোকজন তো নিশ্চিন্তই আছে, আরও সুখের স্বপ্ন দেখছে। হার্ভে বললেন, সবই সত্য। কিন্তু এ সুখ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এখনই চিন্তাভাবনার সময়, কাজ শুরু করা প্রয়োজন। প্রশ্ন: আপনি কি কমিউনিজম চান? উত্তর: অবশ্যই, তবে রাশিয়ার মডেল নয়। চাই বিকেন্দ্রীকরণ, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নানা ধরনের কাজের স্বাধীনতা। প্রশ্ন: পুঁজিতন্ত্র কি সর্বদাই অনিষ্টকর? উত্তর: না, একদা অবশ্যই সৃজনশীল ছিল, বিরাট একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু এখন চলছে অর্থ দিয়ে অর্থ বাড়ানোর খেলা। প্রশ্ন: তা হলে সভ্যতার ভবিষ্যৎ কী? উত্তর: পুঁজিতন্ত্রের পতন ঘটবে, জ্ঞাত ধরনের বাইরে অন্যতর কোনো এক ধরনের কমিউনিজমের জন্ম হবে।

হার্ভে ছিলেন টিভিপর্দায়, আমি আমার ঘরে, তাই তাঁকে দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসার কোনো সুযোগ ছিল না। জিজ্ঞাসা দুটি: ১. চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানির মতো এককালের বিকশিত পুঁজিতান্ত্রিক শিল্পোন্নত দেশে রুশ সমাজতন্ত্রের মডেল চাপিয়ে না দিলে কি সেসব দেশে টেকসই সমাজতন্ত্রের কোনো মডেল জন্মায়? ২. পুঁজির মজ্জাগত স্বভাব কি এই যে, সে নির্বিশেষ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আবদ্ধ থাকে না, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হওয়াই তার গন্তব্য? জানি না, হার্ভের লেখা বইগুলোয় এসবের উত্তর আছে কি না।

কৃতজ্ঞতা : প্রথম আলো

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত