মঈনুল আহসান সাবের-এর গল্প বৃত্ত
মশারির একদিক উঠিয়ে ফিরোজা নেমে গেছে ভোর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে। নেমে যাওয়ার আগে তাকে একবার ঠেলেছিল আলমের খেয়াল আছে। তার ঘুম ভাঙাল দুটো চড়ুই পাখি। রোদ পুরো জানালা গলিয়ে এসেছে ঘরের ভেতর। রোদ পড়ায় ময়লা মশারির একাংশ অতি উজ্জ্বল। চড়ুই, পাখি দু’টো থেকে চোখ সরিয়ে সেদিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। ছেলে দু’টো পড়ছে বারান্দায় বসে। মশারির মধ্যে উঠে বসতে-বসতে সে বারান্দায় বড়টির মাথা সামনে-পেছনে দুলছে দেখতে পায়। শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে সে অনেক সময় নেয়। সারাটা দিনের মধ্যে এই সামান্যক্ষণটুকুই আনন্দের। এইটুকু সময় সে নিজের ইচ্ছেমতো ফুরাতে চায়। একবার বিছানা ছেড়ে ওঠার পর আর কোনও ফুরসৎ নেই। বিছানা ছেড়ে সামনের দেয়ালে বাঁধানো ছোট স্নান আয়নায় নিজেকে দেখে একপলক । কোনও দুঃখ ঘাই খেয়ে ওঠার আগেই সে চোখ সরিয়ে নেয়। কিন্তু ওই একপলকের মধ্যেই অনেক কিছু ধরা পড়ে গেছে। দু’চোখের নীচে কালি, গাল ভেঙে গেছে, ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জি । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে ব্ৰাশে পেস্ট নিতে-নিতে সে আপন মনে হাসে।
রান্নাঘরের পাশে কলতলায় বসার সময় ফিরোজা তাকে একপলক দেখে। আলম তাকে বড় ভালোবাসে। বিয়ের পর দশবছর ধরে শুধু ক্লান্তি বেড়েছে, ভালোবাসার অনেক কিছুই সে ফিরোজাকে দেখাতে পারেনি। কলতলা এই গ্ৰীষ্মের দিনেও কাদায় একাকার। কোথাও কালচে শ্যাওলা প্রায় জমে উঠেছে। ক্ষয়ে যাওয়া দেয়ালে নোনা আস্তর; ফেটে যাওয়া সিমেন্ট বাঁধাইয়ের ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে এসেছে চারাগাছ। আরও একটু সামনে বেশ বড় একটা গাছ। কলতলায় বসলে সেই গাছের কালো-কঠিন গুড়ি পর্যন্ত নজর চলে। আলম এসব দেখতে-দেখতে মুখ ধুয়ে নিল। ততক্ষণে ফিরোজার নাস্তা তৈরি শেষ। আটার রুটির সঙ্গে ভাজি কিংবা গুড়, গতরাতের তরকারি থাকলে তার কিছু। পেছনের বারান্দায় যে-দিকটায় সকালের রোদ এসে পড়েছে সেখানে পুরনো একটা ছোট টেবিল। তারা চারজন কোনওমতে বসে। কতকিছু আলগা হয়ে গেছে দশ বছরের অভাবের সংসারে । কিন্তু এই দীর্ঘদিনেও নিয়মটা ভাঙেনি আলম, এসময় ফিরোজা তার পাশে বসবেই। নাস্তার এই সামান্য সময়টুকুয় ক্ষণিকের জন্যে হলেও একটা বন্ধন গড়ে ওঠে। আর ফিরোজা পারেও বটে। একটু পরেই কাজের চাপ বেড়ে যাবে তাই এই সময়টুকু মাতিয়ে রাখে সে। নোটন-টোটনকে নাস্তা এগিয়ে দিয়ে সে আলমকে বলল-আজকে অফিসে যাওয়ার আগে তোমার কী-কী কাজ, জানো? আলম খুব গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ে, না তো। তবে শোনো ফিরোজা আঙুল ওঠায়, এক, বাজারে যেতে হবে, দুই, রেশন আনতে হবে, তিন, নোটন-টোটনকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে । আলম মাথা নোয়ায়, জো হুকুম, হয়ে যাবে। রেশন সপ্তাহে একদিন, বাকি কাজ দুটো রোজাকার। কিন্তু প্ৰায় এইভাবে প্রতিদিন আরম্ভ করে তারা।
নাস্তা শেষ করে বাজারের ব্যাগ হাতে বের হতে-হতেই এই আনন্দের রেশটুকু চলে যায়। পয়সা খরচ করার ক্ষমতা তার কত কম-রোজ এসময় তার মনে পড়ে যায়। বাজার বাড়ির সামান্য দূরে। এটা একটা বড় সুবিধা, নইলে বাজার থেকে ফিরেই তাকে অফিসে ছুটতে হত। অনেক সময় নষ্ট হয় বাজারে । এক জিনিসের দাম বহুবার জিজ্ঞেস করে আবার ঘুরে-ফিরে আসে। কেনার ইচ্ছেটুকু বাদে আর কোনও ক্ষমতা নেই তার—এই চিন্তা খুব ক্ৰোধ জাগিয়ে দেয়। কিন্তু কিছু করার নেই, কম পয়সায় পঁচা-বাসি জিনিস কিনে সে বাড়ি ফিরে আসে। তখন বসবার সময় নেই। সে বাজারের ব্যাগ নামিয়ে রেখে রেশনের ব্যাগ-কার্ড নিয়ে বেরিয়ে যায়। রেশন দোকানে লম্বা লাইন। তার মতো অনেক অফিসযাত্রীরা লাইনে। এই সামান্য সময়েই লাইনের মধ্যে দ্রব্যমূল্য, রাজনীতি, সামাজিক অবক্ষয় বাদামের খোসার মতো ভেঙে-ভেঙে যায়। তার সময় আসতে দেরি হয়। বাড়ি ফিরে সে গোসল সেরে নেয়। তাড়াতাড়ি। এখনও পৌনে এক ঘণ্টা বাকি অফিসের । বহুদিনের অভ্যেসে সে এসব ব্যাপারে অত্যন্ত অভ্যস্ত। ঘড়ির কাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোয়। অফিসে পৌছতে দেরি হয় না। সে গোসল সেরে বারান্দার তারে কাপড় মেলে দিতে-দিতে দেখে নোটন-টোটন স্কুল-ড্রেস পরে খাবার টেবিলে বসে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি খেতেও পারে আলম। ফিরোজা প্রতিদিন বারণ করে–দুটো মিনিট দেরি হোক অফিসে, এমন কিছু এসে যাবে না, তুমি ভাত মাথায় তুলছ কেন?
ভাত বেড়ে দিতে-দিতে ফিরোজা বলে—তুমি বড় শুকিয়ে গেছ, দিনরাত এত খাটছি। অভাব আর ক্লান্তির নীচে কত ভালোবাসা চাপা পড়ে গেছে, এইসব মুহূর্তে তা ঘাই খেয়ে ওঠে । এ-জন্যেই ফিরোজাকে বড় ভালো লাগে আলমের। খুব একটা ভেবে চিনতে বলেনি হয়তো ফিরোজা, আর এটুকু বলা ছাড়া আর কিছু করার নেই ফিরোজার, কিন্তু আন্তরিকতাটুকু টের পায় আলম। এ-সময় একসঙ্গে খেতে বসে না ফিরোজা। তার অনেক কাজ। চুলোর আগুনে তেতে-যাওয়া-মুখে ভাত বেড়ে খাইয়ে আলম আর নোটন-টোটনকে বিদায় করে সে ঘর গুছাবে, বাকি রান্না সারবে, কাপড় ধোবে, এভাবে তার সারাটা দিন চলে যায়। দুপুরের পর-পর ফিরে আসে নোটন-টোটন, সন্ধ্যার আগে-আগে আলম।
আলমের একটা পুরনো মোটরসাইকেল আছে। বিয়ের পরপরই ধার করে কিনে ফেলেছিল। এখনও খুব কাজ দিচ্ছে। মোটরসাইকেলটা গত পরশু ওয়ার্কশপে দিয়েছে; আজকাল প্রায় ট্রাবল দেয়। চেনা-জানা ওয়ার্কশপ বলে মাসের মধ্যে দু-তিনবারও অল্প খরচে সারিয়ে নিতে পারে। নোটন-টোটনকে স্কুলে পৌছে দিয়ে সে অফিসে যাবে। দরজায় দাঁড়ানো ফিরোজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা রাস্তায় নামে।
আলম একটা রিকশা নেয়। রিকশা নেয়া তার পোষায় না। কিন্তু মোটরসাইকেল নষ্ট, এই অফিস আওয়ারে বাসের জন্যে দাঁড়ানো ও অর্থহীন-আলম এইসব ভেবে ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলে।
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে আলম সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। নোটন-টোটন স্কুলের গেট পেরিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলে সে ফুটপাতে উঠে এল । এখনও পনের মিনিট বাকি অফিস আরম্ভ হওয়ার । এই সময়ের মধ্যে হেঁটে সে দিব্যি পৌছে যাবে।
অফিসে পাঁচ-দশ মিনিট দেরি হলে কোনও ক্ষতি নেই। কোনও জবাবদিহির সম্মুখীন হওয়ারও ভয় নেই। অন্য অনেকের এ-রকম পাঁচ-দশ মিনিট দেরি হরদমই ঘটছে। অফিস ছুটি হওয়ার আগে বেরিয়ে পড়াও চলে। কিন্তু আলম পারে না। ঠিক সময়ে অফিসে পৌছানো এক শক্ত রুটিনের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। অত নৈতিকতার ধার ধারে না সে, এ-কথা ঠিক, অফিসে ঠিক সময়মতো না-পৌছলে ফাকি দেয়া হবে এ-কথাও তার মনে আসে না। কিন্তু সময়মতো অফিসে পৌছানোর রুটিনটুকু সে এড়াতে পারে না ।
অফিসে তখন যারা এসেছে তারা নিজেদের চেয়ারে বসে গল্পে ব্যস্ত। আসিফ ছোকড়া অল্পদিন হল পেছনের দরোজা দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে। নিজের দায়-দায়িত্ব ছাড়া কাঁধের ওপর আর কোনও চাপ নেই, তার গলা রোজকার মতো আজকেও জোরাল শোনাচ্ছে। নিজের চেয়ারে বসে রুমালে মুখ মুছে সামান্যক্ষণ কান পাতল সে, আসিফের দেখা গতকালের বিদেশী সিনেমার গল্প। একটু পরেই এ গল্প চাপা পড়ে যাবে সে জানে। রোজকার ব্যাপার। এরপর জিনিসপত্রের দাম, বিশ্ব রাজনীতি, রাস্তা-ঘাট, হাসপাতাল কিংবা যাতায়াত ব্যবস্থার দুরবস্থা, বাসের ভিড়, মুদ্রাস্ফীতি, রিকশাআলাদের অভদ্রতা ক্রমান্বয়ে ঘুরে-ফিরে আসবে।
সারা সকালে জুড়ে কী ক্লান্তি জড় হয়েছে, চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলেই সে টের পায়। ব্যাপারগুলোর একটাও তার পক্ষে এড়ানো সম্ভব নয়। বাজার, রেশন, নোটন-টোটনকে স্কুলে নিয়ে আসা, বাসায় নিয়ে যাওয়া সব তাকেই করতে হবে। কিন্তু এই সামান্য বিশ্রামের সময় ক্লান্তি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লে সে বুঝতে পারে, কী দ্রুত সে নিজেকে ক্ষয় করে ফেলছে। সামনে রাখা গতকালের অসমাপ্ত ফাইল টেনে নিয়েও সে মন থেকে কথাগুলো ঝেড়ে ফেলতে পারে না। কী দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে সময়, তার আগে কী দ্রুত ফুরিয়ে গেছে তার যৌবন। ফিরোজার ভালোবাসাটুকু তাকে ধরে না রাখলে সে সব ছেড়ে এতদিনে হাঁটতে-হাঁটতে সেই কোথায় চলে যেত। এই একঘেয়ে জীবন, মাঝে-মাঝে কী একটা ভীষণ ইচ্ছে করে চিৎকার করে ওঠার। অথচ সে-জন্যে প্রয়োজনীয় সাহস আর শক্তিটুকুও তার নেই। তার আর ফিরোজার সময় পেরিয়ে গেছে, মাত্র দশবছর পরেই এ-রকম মনে হয়, কিন্তু এই চিন্তার মধ্যে বুদ্বুদের মতো জেগে ওঠে দুঃখ-মাত্র দশবছরেই ফুরিয়ে গেলাম! অভাব আর ক্লান্তির খোলস ক্রমশ পুরু হয় আর গায়ের সঙ্গে আরও সেঁটে বসে। খুব একটা ইচ্ছে করে হঠাৎ করে কিছু করে বসার, একটা ভীষণ রকম অনিয়মের। কিন্তু হঠাৎ করে একটা সাধারণ ফ্যামিলি পিকনিক কিংবা একদিন শখ করে বড় হোটেলে খাওয়া-এই আয়াসসাধ্য কাজগুলোও হয়ে ওঠে না। সে টের পায়, এসব তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। হঠাৎ করে করে ফেলার সাহসটুকুও যদি তার থাকত!
লানচের সময়টুকুতেও অবসর নেই। নোটন-টোটন স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে ছুটির পর । এ-সময় লাঞ্চের পরও দশ-পনের মিনিট নিদ্বিধায় চুরি করে আলম। নোটন-টোটনকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় পৌছে খেয়েদেয়ে সময়মতো অফিসে ফেরা সম্ভব নয়। নোটন-টোটন স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। আলমকে দেখে এগিয়ে আসে। এ সময় তাদের বাড়ির দিকের কিছু খালি বাস পাওয়া যায়। বাসায় ফিরে আরেকবার গোসল সারে আলম। বাথরুম থেকে সে চেঁচায় ছিল—ফিরোজা খাবারের কতদূর? দু’এক ঘণ্টা লাগবে আরও—ফিরোজা উত্তর দেয়। আলম বের হয়ে দেখে টেবিলে খাবার তৈরি । নোটন-টোটন কালতলাতেই গোসল সেরে নিয়েছে। নোটন বলে-বাবা জানো, আজকে ক্লাস টেস্টে আমি ফাস্ট হইনি। আলম বলে—সামনের বার হোয়ো, হবে তো? নোটন মাথা নাড়ে ।
সিগারেট খায় না আলম । খাওয়ার পর এক খিলিপান এগিয়ে দেয় ফিরোজা । এখান থেকে বাস-স্ট্যান্ড সামান্য দূরে। সোজাসুজি রাস্তা হলে ফিরোজা তাকে বাস-স্ট্যান্ডে দেখতে পেত। কিন্তু রাস্তা বাঁক নিয়েছে। এই বাঁকে এসে একবার ফিরে তাকায় আলম। ফিরোজা এই দশবছর পরেও দরোজায় দাঁড়িয়ে । হঠাৎ করে হাত নাড়ার ইচ্ছে জাগে আলমের। চারপাশে তাকায় সে, কেউ দেখছে না দেখে সামান্য হাত তোলে। ফিরোজা বোধ হয় বুঝতে পারে না, কিংবা লজ্জা পায়, কিন্তু পাশে দাঁড়ানো নোটন-টোটন দু’হাত তুলে নাড়ে।
দিন দুই পর অফিস ছুটি হলে আলম ওয়ার্কশপে যায়। তার মোটরসাইকেল ঠিক হয়ে আছে। পরিচিত মিস্ত্রি বলে-আলম বাই, যন্ত্রটা বেঁচি দেন। আলম মাথা নাড়ে-হু, তুমি বললে আর আমি বেচে দিলাম, যে সার্ভিস দিচ্ছে। মিস্ত্রি বলে-নতুন একটা কিনি লন। আলম বলল-টাকা তুমি দেবে? মিস্ত্রি তখন হাসে।
বাড়ি ফিরে সে দেখতে পায় ফিরোজা শাড়ি-ব্লাউজের কাপড়ের ফেরিঅলাকে দরোজায় ডেকে শাড়ি উল্টে-পাল্টে দেখছে। পাশে দাড়ানো নোটন-টোটনের উৎসাহ আরও বেশি। এই দৃশ্যটাই হঠাৎ মন খারাপ করে দিল আলমের। এ-সময় শাড়ি-অলাকে কেন ডেকেছে ফিরোজা? এ-সময় এসব কেনাকাটা সম্ভব নয় ফিরোজা এই দশবছরে টের পায়নি? এসময় নিজের অক্ষমতাটুকুও টের পায় আলম, তার রাগ আরও লাফিয়ে উঠে। সে আর একবারও সেদিকে তাকিয়ে দেখে না। মোটর-সাইকেল রেখে উদাসভাবে ভেতরে ঢুকে যায়। ফিরোজা তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে, সে বুঝতে পারে, কিন্তু সে প্রশ্রয় দেয় না। শোবার ঘরে বসে জামা-কাপড় পাল্টানোর পর খুব পুরনো একটা পত্রিকা দেখতে-দেখতে বাইরে সে সামান্যক্ষণ মৃদু কথাবার্তা শোনে । ফিরোজা কতক্ষণ পর ঘরে ঢোকে । আলম ভাবে টাকার কথা বলবে এখন । কিন্তু ফিরোজা পাশে বসে বলে-তুমি অত গম্ভীর কেন? আলম কথা বলে না। ফিরোজা আবার বলে—কী হল, কথা বলছ না কেন? আলম পত্রিকা থেকে চোখ তোলে না— শাড়িঅলা ডেকেছিলে যে বড়, পয়সা কোথায়? ফিরোজা হেসে ফেলে-বারে, আমি কিনলাম নাকি!
কেনার জন্যেই তো ডেকেছিলে । পছন্দ হল না। তাই কিনলে না | পছন্দ হলে কিনতে না? এ-সময় এতগুলো টাকা ।
ফিরোজা রাগে না-কে বলেছে তোমাকে আমি কিনতাম, পাগল, আমি শুধু দেখলাম ।
কিনবে না তো ডেকেছিলে কেন?
আহা, বললামই তো দেখতে, আমি শাড়িগুলো দেখলাম, দরদাম জিজ্ঞেস করলাম-ব্যাস আর কিছু নয়।
আলমের রাগ এরপর কমে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু সে উল্টো চেচিয়ে উঠে-তুমি তো জানোই এ-সময় শাড়ি কেনা সম্ভব নয়, তবু ডাকবে কেন?
বারে, না-হয় নাই কিনলাম, তাই বলে দেখতেও পারব না?
না।
কেন?
এ-সময় সামান্য উষ্মা উঠে আসে ফিরোজার কথার সঙ্গে ।
অত কথা কেন, আমি বলছি তুমি কিনবে না-ব্যাস।
খুব শান্ত গলায় ফিরোজা বলে-শেষ শাড়িটা কবে কিনে দিয়েছে তা তো ভুলেই গেছি, শুধু দু’একটা শাড়ি দেখব তাও তুমি দেবে না?
এ-সময় তোমার শাড়ি কেনার শখ হওয়াও উচিত নয় ।
কেন-ফিরোজা এবার চেঁচিয়ে ওঠে-কোন শখ হবে না, ক’টা শাড়ি তুমি কিনে দিয়েছ আমাকে?
আমার কাটা জামা-কাপড় তুমি জানো?
আমি বলছি তোমার অনেক বেশি, কিন্তু আমার যা থাকা উচিত ছিল তার অর্ধেকও নেই।
ও-রকম খোটা দিও না। নেই তো নেই, এখন কী করতে হবে?
কী করবে। আবার, কিনে দেওয়ার মুরোদ নেই, আমার যা ইচ্ছে করব।
চুপ-আলম চেচায়-বেহায়া মেয়ে, আমি সারাদিন কী খাটছি পাগল হওয়ার দশা, অফিস থেকে ফিরতেই তুমি বকবক আরম্ভ করলে?
আরম্ভ তো করলে তুমি, আর শুধু তুমিই খাটছ, আমি কিছু করছি না? সারাদিন আমি পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকি?
সে-রকমই তো । তুমি কী জানো আমার কী খোঁজ রাখো, বাজার রেশন, নোটন-টোটনকে স্কুলে পৌছে দাও, বাসায় নিয়ে আসো; তার ওপর অফিসে একগাদা কাজ। তুমি কোনওদিন এসব নিয়ে আমাকে কিছু বলেছ?
বলিনি না, তুমি বলছ আমি বলিনি, বেশ তুমি আমার জন্যে কী করেছ, তুমি কবে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছ, সারাদিন এত কিছুর পরেও এই অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকি, কোনওদিন তো বলনি-চল বেড়িয়ে আসি, তুমি কোন খোঁজটা রাখো আমার মনের?
আলম সে-সব কথা উড়িয়ে দেয়-আরে রাখো, আমন আলগা ফ্যাচফ্যাচ করো না।
ফিরোজা আর কথা বাড়ায় না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে চৌকাঠে একবার থামে, আঁচলে চোখ মোছে। সন্ধ্যার আগে নোটন-টোটন সামনের ছোট মাঠ থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসে। আলম সে-ঘরেই বসে থাকে, সেই পুরনো পত্রিকাই উল্টেপাল্টে পনেরবার দেখে। সন্ধ্যার পর ফিরোজার আওয়াজ পাওয়া যায় রান্নাঘরে। তবে বোধ হয় রাগ করেনি- আলমের মনে হয়। অর্থহীন এক ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলেছে সে; এখন বেশ বুঝতে পারছে। তবে ফিরোজা এখন রান্নাঘরে, তবে ফিরোজা রাগ করেনি—এ-রকম মনে হতেই আলম বেশ উৎফুল্ল বোধ করে। নিজের দোষ আর লজ্জাটুকু ভোলার জন্যে সে আরও কতক্ষণ অপেক্ষা করে। পত্রিকাটা হাতে নিয়েই সে আস্তে-আস্তে রান্নাঘরের দরোজায় এসে দাঁড়ায়। ফিরোজা মুখ খুব নিচু করে চাল বাছছে। আলম আস্তে ডাকে-ফিরোজা। একটু চমকে উঠেছিল ফিরোজা, ডাকটা আলমের বুঝতে পেরেই শক্ত হয়ে যায়। আলম আরও একটু এগিয়ে যায়, পাশে বসবে কি বসবে না ভাবে, দাঁড়িয়ে থেকেই বলে।–তুমি রাগ করো না ফিরোজা, অফিস থেকেই হঠাৎ মন খারাপ, কথা বলবে না ফিরোজা ? ফিরোজা মাথা গুজে থাকে, কোনও সাড়া-শব্দ করে না, চাল বাছা হাতও আগের মতো দ্রুত চলছে না। আলম আবার ডাকে । ফিরোজা ঝট করে মুখ ফেরায়, কিন্তু কথা বলতে সময় নেয়—তুমি কথা বলো না আমার সঙ্গে, যাও । খুব কেঁদেছে ফিরোজা, দু’চোখ খুব লাল, এখনও জলের পরল পড়ে আছে। ফিরোজার কথা শুনে একটুও রাগে না আলম, ভেজা লাল দু’চোখ দেখে সে দমে যায়। নিজের অন্যায় বোধটুকু আবার তার জেগে ওঠে । এখন হবে না বুঝতে পেরে সে রান্নাঘর থেকে সরে আসে।
ফিরে এসেও তার ভালো লাগে না। কতক্ষণ নোটন-টোটনের বই-খাতা উল্টেপাল্টে দেখে । শেষে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে ঘুরে বেড়ায় । বাসস্ট্যান্ডের উল্টোদিকে একটা মাঠ আছে। সেখানে গিয়ে বসে থাকে। মাঠে অনেক লোকজন বাতাস গায়ে মেখে গল্প করছে। আশেপাশে কখনও বাদাম অলা, এই রাতেও কখনও আইসক্রিম, কখনও দু’একজন সন্দেহজনক লোক । সে মাঠের এককোণে হু-হু বাতাসের মধ্যে বসে থাকে। চারপাশের হইচই সে লক্ষ্যই করে না। মাথা গুজে বসে থাকতে-থাকতে হঠাৎ তার কান্না পায়। সে খুব চেষ্টা করে রুখে রাখার। এই বয়সে কান্না, তার লজ্জা লাগে । স্বামী-স্ত্রীর এ-রকম ছোটখাটো ঝগড়া হবেই, তার জন্যে কাঁদবে কেন সে? কিন্তু ক্রমশ সে বুঝতে পারে শুধু আজকের বিকেলের ঘটনার জন্যে তার কান্না পাচ্ছে না, আসলে অনেকদিন ধরে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে, অনেকদিন ধরে কান্না তৈরি হয়েছে তার ভেতর । সব এখন বেরিয়ে যাবে বলে উঠে আসছে গলা ছাড়িয়ে । বাতাসের মধ্যে সে কেঁপে ওঠে ।
বহুক্ষণ পর চোখ তুলে সে দেখল মাঠ অনেক ফাঁকা। লোকজন, বাদাম অলা প্ৰায় সবাই চলে গেছে। নিজেকে খুব হালকা মনে হল তার। কত দুঃখ তার একসঙ্গে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে চলে গেছে। তখন শুধু ফিরোজার প্রতি সামান্য অভিমান । রাত হয়েছে সে বুঝতে পারে। ফিরোজা আর নোটন-টোটন বাড়িতে একা, সে উঠে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় । বাসস্ট্যান্ডের আগের বাকিটা ঘুরলেই সে বাড়ির দরোজা দেখতে পায়, একপাশে এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আলো-ছায়ায়। আলম ক্রমশ আরও এগোলে সেই মূর্তি দরোজা থেকে সরে যায়। ঘরে ঢুকতেই পাশের ঘরের জানালায় মুখ এনে নোটন বলে-আমরা সবাই খেয়েছি, মা বলেছে তোমাকে খেয়ে নিতে। আলম দ্বিরুক্তি করে না। ফিরোজার দৃষ্টি আকর্ষণের কোনও চেষ্টা না-করে সে খেয়ে নেয়। নিজেই বাসন-কোসন গুছিয়ে রাখে । শেষে পেছনের বারান্দার এককোণে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। অনেক দিন পর রাতের আকাশের দিকে চোখ পড়ে তার। আকাশে অনেক তারা, পশ্চিম দিকে একটু হেলে পড়া সম্পূর্ণ চাঁদ। সামনে যে বড় গাছ, বাতাসে তার পাতার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ভেতরের দু’ঘরের আলো নিভে গেছে। ফিরোজা কি শুয়ে পড়েছে, ভেবে তার আরও অভিমান হয়। তার ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু ফিরোজার পাশে গিয়ে সে এখন কীভাবে শোবে ভেবে তার লজ্জাও করছে। এ-সময় ফিরোজা বারান্দায় আসে। পেছনে দরোজায় মৃদু আওয়াজ হতেই সে চোখ ফিরিয়ে দেখে ; ফিরোজা তার পিছনে এসে দাঁড়ায় । আলম চুপ করে কালো-কঠিন গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফিরোজা বলে—শোনো, তুমি আমার সঙ্গে বিকেলে ঝগড়া করলে কেন?
আশেপাশে কারও জেগে থাকার কোনও সাড়াশব্দ নেই। আলম নাগালের মধ্যে দাঁড়ানো ফিরোজাকে ঝটিতি টেনে এনে উদভ্ৰান্তের মতো চুমু খায়। চুম্বনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত শক্ত ছিল ফিরোজা, পরমুহূর্তে সে উদভ্ৰান্ত না-হলেও সহজ হয়ে ওঠে। পরে সে আলমের মাথায় হাত রেখে উঠে দাঁড়ায়, বলে-আমার খুব খারাপ লেগেছিল, তুমি তো কখনও আমাকে ওভাবে বলো না । আলম বোকার মতো মাথা নাড়ে-হঠাৎ করে ফিরোজা, হঠাৎ করে এমনিতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল, তোমাকে শাড়ি দেখতে দেখে আমার মনে হল বহু আগেই তোমাকে একটা নতুন শাড়ি দেয়া উচিত ছিল আমার, কিন্তু অতটুকু পয়সাও অনেকদিন হাতে জমছে না খেয়াল হতেই তোমার ওপর রেগে গেলাম। আসলে আমি তোমার ওপর একটুও রাগ করিনি। একটু থেমে সে বলে—তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ না? ফিরোজা কথা বলে না, সে আলমের চুল মুঠো করে চেপে ধরে আবার ছেড়ে দেয়। আলম বলে—সামনের মাসে তোমাকে একটা সুন্দর শাড়ি কিনে দেব, আমি কিনে দেব পছন্দ করে। ফিরোজা মাথা নাড়ে—উহু, আমার তো টাকা নেই, তুমি আমাকে টাকা দিও, আমি তোমাকে শার্টের কাপড় কিনে দেব পছন্দ করে। না, সামনের মাসে শাড়ি কেনা হবে, আলম আবার ফিরোজাকে কাছে টেনে আনে, আর শোনো কাল আমরা বেড়াতে বের হব। ফিরোজা বাচ্চার মতো মাথা দোলায়— কোথায়? তুমি যেখানে যেতে চাইবে আলম বলে-পার্কে সিনেমায় কিংবা কোনও ভালো হোটেলে খাব।
সত্যি-ফিরোজা জিজ্ঞেস করে। ঘাড় কাত করে আলম-সত্যি, কাল তো হাফ-ডে, আমি সবকিছু ঠিক করে নিয়েছি, নোটন-টোটনকে পাশের বাসায় রেখে বিকেলে আমি আর তুমি যাব। ফিরোজা কতক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে বলে-আমি অনেকদিন বাইরে যাই না, জানি তোমার তো সময় হয় না, তাই তোমাকেও বলি না, কিন্তু মাঝে-মাঝে খুব খারাপ লাগে, সারাদিন শুধু ঘরের মধ্যে, শেষ কবে বেড়াতে গিয়েছি সে তো ভুলেই গেছি. কাল আমরা সত্যি যাচ্ছি। তো? আলম হাসে-সত্যি, তুমি ঠিক করো কোথায় আমরা যাব। ফিরোজা মাথা হেলিয়ে সামান্যক্ষণ ভাবে-ঠিক আছে, আমি ভেবে-চিন্তে তোমাকে বলব। সামান্যক্ষণ চুপচাপ গেল। ফিরোজা হাত ধরে টানে আলমের-চলো। আলম উঠে না-এখানেই থাকি বসে, কী সুন্দর রাত। কিন্তু সে পেছনে ফিরে ফিরোজার চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলে-ও বুঝেছি, চলো চলো।
সকালে রোজাকার মতো ঘুম ভাঙে আলমের। জানালা গলিয়ে রোদ এসেছে মশারির ওপর, ময়লা মশারির একাংশ হলুদাভ উজ্জ্বল। ঘরের ভেতর যে-দু’টো চড়ুই বাসা বেঁধেছে তারা উড়ে যায়। বিছানার চাদরের এদিক-ওদিক দু-তিনটে ছোট-বড় ফুটো । আলম সে সব গুণতে গুণতে উঠে পড়ে। কলঘরে ব্রাশ হাতে বসার আগেই সে রান্নাঘরের দরোজার কাছে ফিরোজাকে দেখে । তার পায়ের শব্দে ফিরে তাকিয়ে ফিরোজা হাসে। গতকালের কথা মনে পড়লে আলমও হাসে। অনেকদিন পরে তারা দু’জন-দু’জনকে নতুন করে দেখছে। গতরাতের স্মৃতি বিয়ের ঠিক পরের দিনগুলোর মতো সজীব । অনেক দিন পর ঝগড়াটা হয়েছিল ভাগ্যিস ।
আলম দাঁত মেজে উঠে আবার ব্যস্ত হয়ে যায়। আজ অবশ্য রেশন আনার ঝামেলা নেই। কিন্তু নাস্তা খেয়ে বাজার থেকে ফিরে আসতেই সময় পেরিয়ে যায়। গোসল সারার আগে সে পুরোনো কাপড় আর তেল দিয়ে ঘষে-ঘষে মোটরসাইকেল সাফ-সুতরো করে। পানি দিয়ে চাকা, মাডি-গার্ড এসব ধুয়ে-মুছে নেয়। ইদানীং খুব ফলস্ স্টার্ট নিচ্ছে আর স্পিড বেশি তুললেই স্পার্কিং আরম্ভ হয়ে যাচ্ছে-ওয়ার্কশপের লোকজনও এসব সারাতে পারছে না । গোসল-টোসল সেরে নোটন-টোটনকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে স্কুলে নামিয়ে দেয়। আজ হাফ-ডে ।
দুপুরে লাঞ্চের সময় সে নোটন-টোটনকে নিয়ে ফিরে আসে। দুপুরে খাওয়ার পর বাসন-কোসন গুছিয়ে রেখে ফিরোজা আলমের পাশে এসে শোয় । বলে- কোথায় যাব ঠিক করেছি জানো? আলম মাথা নাড়ে-উহু, কোথায়? কোথাও না—ফিরোজা খুব দ্রুত বলে। আলম একটু বোকার মতো তাকালে ফিরোজা বলে কোথাও না মানে আমরা পার্কে যাব না; সিনেমায় যাব না; কিন্তু কী করব জানো, তোমার মোটরসাইকেলের পেছনে চেপে বসে আমি শুধু ঘুরব, শুধু রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরব, দেখি তুমি কত দূর আমাকে নিয়ে যেতে পার। আলম খুব সাহসী গলায় বলে-ঠিক হ্যায়, আমি তোমাকে এমন-এমন জায়গায় নিয়ে যাব তুমি খুব অবাক হবে। তা তো হবই-ফিরোজা মাথা দোলায় কতদিন ঘর থেকে বের হই না জানো, এতদিনে কত বদলে গেছে শহর । আলম সামান্য মৃদু গলায় বলে—তা বটে, আমি সব জানি, কিন্তু সময় কোথায় বলো— বাজার, রেশন, নোটন-টোটনদের স্কুল, অফিস করে সারাটা সময় চলে যায়, আসলে আমিও অনকদিন পর বের হব ।
দুপুরটা গল্প করে কাটে। ফিরোজা আলমের চুল থেকে হাত সরায় না। বিকেলের আগে-আগে উঠে তারা জামা-কাপড় বদলে নেয়। পুরনো ঐ ট্রাঙ্ক থেকে বের করে ফিরোজা একটা পুরনো শাড়ি পরলে আলম অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে—তুমি আসলেই মাৰ্ভেলাস… নোটন দেখ তো, তোমার মাকে কেমন লাগছে? ফিরোজা নোটন-টোটনকে ডেকে বলে— বাবুরা আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি, তোমরা দু’জন রঞ্জুদের বাসায় থেকো, ফেরার সময় তোমাদের জন্যে চকলেট নিয়ে আসব।
নোটন-টোটন মাথা নাড়ে। দরোজায় তালা দিয়ে চাবি পকেটে রাখে আলম । নোটন-টোটন রঞ্জুদের বারান্দা থেকে হাত নাড়ে। আলম বলে-ইশ, কতদিন পর আমরা বের হচ্ছি। তোমার কথাই ঠিক ফিরোজা, কোনও নির্দিষ্ট দিকে নয়, যেদিকে চোখ যায়, শুধু সেদিকেই যাব।
বাকিটুকু পেরোতেই সামান্য স্পিড বাড়ায় আলম, ফিরোজাকে বলে-যেদিকে যায় মোটরসাইকেল সেদিকেই আমরা । সামান্য এগিয়েই সে দেখতে পায় রেশন শপ; ফিরোজাকে দেখায়-ওই যে ওখান থেকে রেশন তুলি … আর ওই যে বাজার, আর কতকটা এগিয়ে সে বাজারের দিকে আঙুল উচিয়ে দেয় এখন তো ভিড় নেই, সকালবেলা দেখলে বুঝতে কী অবস্থা। খুব আমুদে গলায় কথা বলতে-বলতে আলম স্পিড তুলে এগিয়ে যায়। বেশ দূরে নোটনদের স্কুল দেখে সে স্পিড ক্রমশ কমিয়ে আনে। স্কুলের সামনে এসে থেমে যায় হঠাৎ—এটা কি জানো, উহু সাইনবোর্ড দেখলে হবে না, এটা হচ্ছে নোটন-টোটনদের স্কুল। ফিরোজার দেখা শেষ হওয়ার আগেই আলম ইঞ্জিন স্টার্ট দেয় । খুব একটা ভাবছে না আলম, মোটরসাইকেল যেন অনেকটা নিজের ইচ্ছেয় এগিয়ে যাচ্ছে। অফিসের সামনে এসে সে খুব কায়দা করে মোটর-সাইকেল থামায়-এবার বলো আমরা কোথায় এসেছি? ফিরোজা কিশোরীর মতো মাথা দোলায়—কীভাবে বলব বলো, একটু সন্দেহ হচ্ছে বই-কী । ঠিক সন্দেহ-আলম জোরগলায় বলে- ওই যে পশ্চিম দিকে কাচের জানালায় নীল রঙ, ওই ঘরে আমরা বসি। এরপর তারা আরও এগিয়ে যায়। দু’পাশের লোকজন, গাড়িঘোড়া, ভাঙাচোরা রাস্তা। এসবের মধ্যেও আলম খুব স্বচ্ছন্দে মোটরসাইকেল এগিয়ে নেয়। আর এবার দেখ, সে বলে, ওখানে আমি মোটরসাইকেল সারাই, ওই যে, নিবেদিতা ওয়ার্কশপ, চেনাজানা লোক আছে, আলাপ করবে? ফিরোজা বলে-ধ্যাৎ । মোটরসাইকেল আরও এগিয়ে যায় । তোমাকে একটা মজার জিনিস দেখাব— আলম বলে-ওই যে ডানপাশের একতলা হলুদ বাড়িটা, কে থাকে জানো, ব্যাটা সুদখোর হান্নান, আমাদের সঙ্গেই কাজ করে, আমি দরকার পড়লেই ওর কাছ থেকে টাকা ধার নেই, সুদ নেয় নিক তবু ভালো, আজকাল কে ধার দেয়?
আলমের কাধের ওপর একটা হাত রেখেছে ফিরোজা, আর এক হাতে সিটের একাংশ ধরে ব্যালান্স ঠিক রাখছে। এসব জায়গার কথা প্রায় সে আলমের মুখে শুনেছে। আজই সে প্রথম দেখছে। এবার নিশ্চয় আরও এগিয়ে যাবে তারা, সে ভাবে । আলম দ্রুত স্পিডে দু’পাশ থেকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। স্পার্কিং আরম্ভ হলে সে স্পিড সামান্য কমিয়ে আনে। আরও কিছুটা এগিয়েই রাস্তাঘাট চেনা-চেনা মনে হয় ফিরোজার। আর একটু এগিয়েই ফিরোজা দেখতে পায় তাদের বাড়ি, রঞ্জদের বারান্দায় নোটনকেও সে হয়তো এক পলক দেখে । তারপরে ক্রমশ তার চোখে পড়ে রেশন শপ, নোংরা ময়লা কাদায় একাকার বাজার । সে আলমকে বলে— তুমি আবার এ-পথে এলে যে বড়, এ-পথে আমরা তো প্রথমেই ঘুরে গেছি। কই— আলম বলে, তারপরেই সে-ও অবাক হয়— আরে তাই তো, একদম খেয়াল ছিল না। ততক্ষণ তারা নোটন-টোটনদের স্কুল ছাড়িয়ে এসেছে। ফিরোজা ভাবে এবার তারা অন্যদিকে ঘুরবে। আলমকেও খুব নিরুদ্বেগ দেখায়। কিন্তু একটু পরেই ফিরোজার চোখে পড়ে আলমের অফিস, তারপর নিবেদিতা ওয়ার্কশপ, আরও এগিয়ে সুদখোর হান্নানের বাড়ি। ফিরোজা রেগে যায়—কী ইয়ার্কি মারছ, তুমি কি একই রাস্তায় ঘুরাবে আমাকে? দাড়াও ঘুরাচ্ছি, কী যে হল, বেখেয়ালে এক রাস্তায়ই চলে এলাম— আলম মোটর-সাইকেলের ওপর খুব নজর রাখতে রাখতে বলে ।
কিন্তু সামান্য পরেই ফিরোজা প্রায় চেচিয়ে ওঠে। আবার মোটর সাইকেল তাদের বাড়ির সামনে ফিরে এসেছে। তারপর ক্রমশ রেশনশপ পেরিয়ে বাজারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফিরোজা গম্ভীর গলায় বলে— আমাকে নামিয়ে দাও, এসব ঢঙের দরকার নেই, তুমি কি অন্য রাস্তা চেনো না? কিন্তু আলমের কাধে রাখা ফিরোজার হাত টের পায় আলম কাপছে। সে বলে- না না, দাড়াও ফিরোজা, আমি দেখছি। সে মোটর সাইকেলের ওপর ঝুকে পড়ে; তীক্ষ্ণ চোখ রাস্তার দিকে তাকায়, বারবার অর্থহীন গিয়ার বদলায় সাইকেলের, স্পিড বাড়িয়ে আবার কমিয়ে আনে। কিন্তু মটরসাইকেল ক্রমশ তাদের নিয়ে বাজার পেরিয়ে আসে, রেশনশপ ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে তারা দেখতে পায় নোটন-টোটনদের স্কুল, আলমের অফিস, নিবেদিতা ওয়ার্কশপ। আলম খুব চেষ্টা করে, সাইকেলের কত কী ঘোরায়-নাড়ায়, ফিরোজা তার কিছু বোঝে না, খুব কাঁপছে আলম সে শুধু বুঝতে পারে। আবার তারা ফিরে আসছে ফিরোজা টের পায়। আলমের হাত কেঁপে যায় মোটরসাইকেলে, সে চেচিয়ে উঠে- ফিরোজা আমি চেষ্টা করছি ফিরোজা, কিন্তু বাজার, রেশনশপ, নোটনদের স্কুল, ওয়ার্কশপ, সুদখোর হান্নানের বাড়ি- আমি বের হতে পারছি না, ফিরোজা আমি বের হতে পারছি না।
.