তাহলে শ্রাবণ শেষের গানকে কী বলবে তুমি? কী নাম দেবে পরের পাতার অপেক্ষার? কী বলে ডাকবে উৎসবকে? আখ্যান, নাকি আলেখ্য! কোনো কিছুর বিপরীতে ঠিক সেরকমই আরেকটা কিছু নেই বলে, যেটা আছে, সেটাও মিথ্যে হয়ে যায় না। যেমন, তোমার বিরুদ্ধে আমি নেই; অথচ আমার বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছ তুমি। এর থেকে সত্যি আর কী হতে পারে! জীবন আসলেই কোনো স্ট্রেটলাইন মেথডের ডেপ্রিসিয়েশন সিস্টেম নয়। জীবন মানেই দুই আর দুইয়ের যোগফল চার নয়। জীবন এক আশ্চর্য খেলোয়াড়। সে এই যোগফলকে হামেশাই তিন অথবা পাঁচে পরিণত করতে জানে। ক্ষেত্রবিশেষে শূন্যেও! তাই কোনো অর্বাচীন-বাক্য শুনেই নেচে উঠো না। প্রকৃত অস্মিতা নিজেকে জাহির করে না কোনোদিন। উপযাচক হয়ে তো নয়-ই! একথা মনে রাখা ভালো। ঠিক যেমন আমরা শিখেছি, নিজের সীমাবদ্ধতা জেনে রাখা ভালো। নিজের শক্তিও। তোমার আসল শক্তির জায়গা ওই খোলা আঙিনা। সেটাকে হঠাৎ গুলিয়ে দিতে চাইছে এই যে উটকো উৎপাত, এরা আসলে কারা?
গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় অনেক রকমফের আছে। তার কোনো-কোনোটা সোজাসাপ্টা মিথ্যাচার। যেমন, সেদিন সন্ধ্যার বইপাড়ায়। চা-দোকানের কথোপকথনে একজন প্রবীণ চিত্রশিল্পী তীর্যক সুরে বললেন, ‘সেকেন্ড এডিশন? তা প্রথমে কয় হাজার কপি ছাপিয়েছিলে ভাইটি?’ ‘হাজার’ শব্দটা নিশ্চয় খোঁচা মারার জন্য! তাকিয়ে দেখি, ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় অপ্রস্তুত এক নবীন কবি। সে তখন পালাতে পারলে বাঁচে! মনে পড়ে গেল, পুরোনো লোকেরা খানিক অনুকম্পায় এদেরই ‘নাদান ছোকরা’ বলেন। শুরুতে শ-খানেক কপি ছাপিয়ে, কিছুদিন পরেই সেকেন্ড এডিশনের গল্প ছেড়ে দেওয়া আজকাল বাজারের দস্তুর। বাস্তবের বইপাড়া কিন্তু মাছিই তাড়ায়। গল্প দিয়ে আর যাই হোক, বাণিজ্যের চিড়ে তো ভেজে না! তবুও গল্পটা বলা চাই! ইচ্ছাপূরণের চলচ্চিত্রের মতো মিথ্যে এক-একটা গল্প। এই মিথ্যে আসলে একটা দলবদ্ধ প্রয়াস। এবং সেই দলে কে-কে থাকে, তা বলতে পারার জন্য কোনো পুরস্কার নেই!
আরেকরকম মিথ্যাচারের কথায় আসি। যেমন ধরো, সেদিনের এক রচিত আয়োজন। সেখানে কোথাও তোমার উল্লেখ নেই। কিন্তু সেই আয়োজনকে ভাষা দিতে যদি তোমাকেই লাগে? গরজ তাহলে বড়ো বালাই! অতএব সেই আয়োজনের মধ্যে পরে কোথাও অ্যাপেনডিক্সের মতো জুড়ে দেওয়া হলো তোমাকে। তুমি ভাবলে, স্বীকৃতি। আসলে যা হলো, তাকে বলে তঞ্চকতা। প্রত্যেক অপরাধী যেমন অজান্তেই নিজের অপরাধের ছাপ রেখে যায় ঘটনাস্থলে, এখানেও তেমনি আনএডিটেড পড়ে থাকল মূল আয়োজন! থেকে গেল আমাদের সংগ্রহে। এই হচ্ছে তথাকথিত সহজ-সরল-সুন্দর জনপদবাসের আসল চেহারা! এমন নিদারুণ চালাকি! যেমন অন্যত্রও হয়ে থাকে, আর কী! এটাই তো স্বাভাবিক আজ, এইসব শঠতা। না-হলে তো আজকের পৃথিবীর যাবতীয় নিয়ম মিথ্যা! কিন্তু কথাটা শুধু তাই নয়। কথাটা হলো, কোনো জনপদবাসীই স্বর্গচ্যুত দেবদূত নয়। নেহাতই পাপী-তাপী মানুষ। তাহলে সুযোগ পেলেই তারা ওইসব শীতল-স্বপ্নিল চাদরের বিজ্ঞাপন দেয় কেন? গুরুগিরি আর দাদাতন্ত্রে অভ্যস্ত সাহিত্যযাপনের সৈন্যরা কি এরকম নিরীহ প্রশ্নও তুলতে পারবে কোনোদিন?
আমি আসলে বহুদিন হলো, এইসব দেখে ফেলেছি। ‘চোখ’ থাকলে হয়তো-বা দেখা হয়ে যেত তোমারও। মহানগর আমার জন্মের মাটি। কিন্তু জেলাশহর আমার ধাত্রী। জীবন যেদিকে নিয়ে গেছে তারপর। একবার মহানগর, একবার মফস্বল। আবার মহানগর, আবার মফস্বল! চিরকাল আমার দুই নৌকায় পা! আমি তাই খুব ভালো করে জানি উভয়ের আলো-অন্ধকার। আমি জানি মহানগরের প্রকৃত মহত্ত্ব কোথায়, আর কোথায় তার ক্ষুদ্রতা। আমি জানি মফস্বলের নিবিড় ঠিক কেমন, আর তার কেমন নীচতা। মাঝেমাঝে অজান্তেই একটু ভাবতে হয় তাই। হ্যাঁ, আপাতদৃষ্টিতে পরিধিটা বড়ো হয়েছে তোমার। কিন্তু আকাশ ছোটো হয়েছে আশ্চর্যজনক! ক্ষুদ্রতর সেই ছাদের নিচে ওই যে কাঁকড়া-সুলভ নিচুটান, ওই যে কুয়োর ব্যাঙের ভুবন, সে তোমাকে ওই মেক-বিলিভের দুনিয়ার বাইরে ভাবতেই দেবে না কোনোদিন। মাঝেমাঝে মনে হয়, এসব একবার বলে দিয়ে আসি। পরাজিত, কিন্তু হতমান তো নই! দরজায় একটা নক করি। অথবা একবার কলিং বেল। ইথারের এই তো সুবিধা, দূরে থাকা মানেই দূরে থাকা নয়! কী আর হবে? আরও কিছু বিদ্রুপ? অনেকটা শ্লেষ? সে-সব তো এমনিতেই, ধারাবাহিক! শ্লেষ-শ্লেষ, তোমার প্রেম নাই মৃন্ময়ী?
কথা হচ্ছিল বসন্তদিনের। না, কোনোদিনই আমি মৌখিক বসন্ত রাখিনি। বসন্ত বড়ো তঞ্চক ঋতু। বসন্ত বড়ো প্রতারক। শীত নয় সে, গ্রীষ্মও নয়। সে এক মুখোশধারী। সে এক ছলনাময়। কোনো এক কবিতায় লিখেছিলাম, ‘এই বসন্ত জানে আগামী বসন্তের নিহত রূপকথা’। বসন্ত মানেই তেমন এক হননকাল। কোথায় যেন সেদিন বলছিলাম, সুন্দর-অসুন্দর সব মুখই একদিন আগুনে যাবে। ওটাই চূড়ান্ত গন্তব্য। তাহলেও, এই মুখ যদি বসন্তলাঞ্ছিত হতো, পছন্দ করে ফেলতে কি অতটাই? আমি তাই তোমার জন্য বসন্ত রাখিনি কোথাও। আমি তোমার জন্য রেখেছিলাম মুখোশহীন একটা পৃথিবী। অম্লান আলোর আশ্চর্য একটা জানালা। সোনায় খাদ না-মেশালে যেমন গয়না হয় না, তেমনই সে-আলোয় হালকা একটু আঁধার মেশানোর প্রয়োজন ছিল কিনা, সে-প্রশ্ন না-হয় আজ থাক!
কিন্তু এই শরতে কেন তুলে আনছি আমি ওইসব তঞ্চক দিনের কথা? আমি কি এখনও খুঁজে ফিরছি দেবীবরণের দুপুর? আমি কি আবার লিখব ‘ভাসানের রাতে আমি দেখি তোমার বোধনের রূপ’? অবাঞ্ছিত বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তেও যে-কথা রেখে এসেছিলাম, সে-কথাই আজকেরও কথা হয়ে থাক। সেই নির্দ্বিধার কথা। সর্বত্র আমারই থাকার ছিল, তাই রোজ সে-কথা অস্বীকারে সোচ্চার তুমি। রাধাগ্রাম ছুঁয়ে হোক অথবা অন্য কোথাও, ছবিটা সর্বত্র এক। তা বেশ! কিন্তু আমি আপাতত অন্য একটা আশ্চর্যের থেকে উত্তরণ চাইছি। বসন্তের চাতুর্য এড়াতে চাওয়ার যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, কীভাবে যেন আমার অঙ্গবস্ত্রে এই শরতেও লেগে আছে একটা বসন্তদাগ! জোর করে চাপিয়ে দেওয়া একটা অন্যায়-রঙের দাগ। হিন্দিতে একটা শব্দ আছে, দামন। উৎসটা যেহেতু ফারসি, তাই উর্দুতেও। কথায় বলে, ‘গুলাল ওহি। চেহরে পর হো, তো রঙ কহেলাতা হ্যায়। দামন পর হো, তো দাগ।’ অঙ্গবস্ত্র হোক বা আঁচল, বসন্তদাগ কোথাওই ভালো নয়। অন্যায়-রঙের হলে তো নয়ই!
কথাসাহিত্যিক