[গত পর্বের পরে…]
বহুজনকে দীর্ঘদিন তৈলমর্দন করেও কলকাতার কোন পত্রপত্রিকায় যখন কোন চাকরি জোটাতে পারলাম না, তখন এক্সপ্রেস আর ক্রনিকেলের ঐ সামান্য অস্থায়ী কাজও বড় ভাল লেগেছিল। কিন্তু কতকাল? মেমসাহেবকে নিয়ে আমার জীবনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন অনিশ্চয়তা ছিল না। কর্মজীবনে সে অনিশ্চয়তা আমাকে এবার ধীরে ধীরে উদ্বিগ্ন করতে লাগল।
দৈনন্দিন রিপোর্টিং ছাড়া প্ৰবন্ধ ফিচার ইত্যাদি লেখা ঠিকই চলছিল। কখনও এ কাগজে, কখনও সে কাগজে এসব লেখা ছাপাও হচ্ছিল। কোন কোন লেখা অমনোনীতও হচ্ছিল। মাঝে মাঝে দশ-পনের-বিশ টাকার মানিঅর্ডার বা চেকও পাচ্ছিলাম। মন্দ লাগিছিল না। কিন্তু সাংবাদিক ফেরিওয়ালা হয়ে তো জীবন কাটাতে পারি না। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে মেমসাহেবকে তো টেনে আনতে পারি না। তাছাড়া আমাকে পাশ কাটিয়ে অনেক পরিচিত নতুন ছেলেছোকরার দল আলিগলি দিয়ে কর্মজীবনের রেড রোড ধরে ফেলল। নিজেকে বড়ই অপদাৰ্থ, অকৰ্মণ্য মনে হল।
মেমসাহেবকে আমি কিছু বলতাম না। নিজের মনে মনেই অনেক কথাই চিন্তা করতাম। একবার ভাবলাম চুলোয় যাক জার্নালিজম। যদি খেতে পরতে না পেলাম। তবে আবার জার্নালিজম-এর শখ কেন? দুর্বল মুহুর্তে অন্য চাকরি-বাকরি নেবার কথাও তাবলাম। কিন্তু পরের মুহুর্তে নিজের মনকে শাসন করেছি। বুঝিয়েছে, না তা হয় না। এতবড় পরাজয় আমি মেনে নিতে পারব না। যৌবনেই যদি কর্মজীবনের এত বড় পরাজয় মেনে নিই, তবে ভবিষ্যতে কি করব? কি নিয়ে লড়াবা?
আবার ভেবেছি কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যাই। দিল্লী, বোম্বে বা লণ্ডন চলে যাই। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া বললেই তো আর পালিয়ে যাওয়া যায় না। বিলেতে যেতে অনেক টাকার প্রয়োজন। সে টাকা আমার ছিল না। তাছাড়া বিলেত গিয়ে কি করতাম। বিলেত গিয়ে কেরানীগিরি বা বাস কণ্ডাকটর হয়ে এ্যাণ্টনি সাহেব হবার শখ কোনদিনই আমার ছিল না। কয়েকটা দেশী কাগজের কাজ নিয়ে বিলেতে যাবার পরিকল্পনা অনেক দিন মনের মধ্যে উকিঝুকি দিয়েছিল। কিন্তু তার জন্যও দেশের মধ্যে অনেক ঘোরাঘুরি প্রয়োজন ছিল। আমার পক্ষে তাও সম্ভব হয় নি। রাসবিহারী এভিন্যুর পোস্টাফিসে মেমসাহেবের কিছু টাকা ছিল। আমার কল্যাণে ইতিমধ্যেই তাতে দু’একবার হাত পড়েছিল। সুতরাং ওদিকে হাত বাড়ানোর কথা আর ভাবতে পারলাম না।
দু’একবার অত্যন্ত আজেবাজে চিন্তাও মাথায় এসেছে। ভেবেছি মেমসাহেবকে কিছু না জানিয়ে অকস্মাৎ একদিন যেখানে হোক উধাও হয়ে যাই। যৌবনে প্ৰাণবন্ত সব ছেলেমেয়েরাই প্ৰেমে পড়ে। ক’জন সে প্ৰেম আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে?
আমিও না হয় পারলাম না। কি হয়েছে তাতে? মেমসাহেব দু-চারদিন কান্নাকাটি করবে, দু’এক বেলা হয়ত উপবাস করবে। কেউ কেউ হয়ত কয়েকদিন উপহাস করবে, কেউ বা হয়ত কিছু কিছু অপ্রিয় মন্তব্য করবে। কিন্তু তার পর? নিশ্চয়ই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ডেভেলপমেণ্ট ডিপার্টমেন্টের আমেরিকা ফেরত ফিসারি এক্সপার্ট সুবোধবাবু নিশ্চয়ই মেমসাহেবকে অপছন্দ করবেন না। তারপর শুভদিনে শুভক্ষণে বুড়ো সাজ্জাদ হোসেনের সানাই বেজে উঠলে সুবোধবাবু জামাই বেশে হাজির হবেন। কিছু পরে মেমসাহেব বধু বেশে কলাতলায় সুবোধকে মালা পরাবে, পুরোহিত মন্ত্র পড়ে সম্পত্তি ট্রান্সফার পাকাপাকি করবেন। তারপর বাসর। একটু হাসি, একটু ঠাট্টা, একটু তামাশা। লোকচক্ষুর আড়ালে হয়ত একটু স্পৰ্শ, একটু অনুভূতি। দেহমনে হয়ত বা একটু বিদ্যুৎ প্রবাহ।
আমার মাথাটা একটু ঝিমঝিম করল। তবে সামলে নিলাম। পরের দিনটার জন্য খুব বেশী চিন্তা হয় না। কিন্তু তার পরের দিন। ফুলশয্যার কথা ভাবতে গিয়েই মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল। রজনীগন্ধা দিয়ে সাজান ঐ ফোমড রবারের শয্যায়। মেমসাহেবের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে সুবোধ। তিলে তিলে ধীরে ধীরে যে মুকুল চব্বিশ-পঁচিশ বসন্তে পল্লবিত হয়ে আমার মানস-প্রতিমা মেমসাহেব হয়েছে, যার মনের কথা, দেহের উত্তাপ, বুকের স্পন্দন শুধু আমি জেনেছি, পেয়েছি ও অনুভব করেছি, সেই মেমসাহেবের অঙ্গে সুবোধের স্পর্শ। অসম্ভব। তাছাড়া যে মেমসাহেব তার জীবন সর্বস্ব দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে আমাকে সুখী, সার্থক করতে চেয়েছে, তাকে এভাবে বঞ্চিত করে পালিয়ে যাব? না, না, তা হয় না।
তবে?
তবে কি করব, তা ভেবে কোন কুলকিনারা পাচ্ছিলাম না। মনে মনে অবশ্য ঠিক করেছিলাম। কলকাতায় আর বেশীদিন থাকব। না। খবরের কাগজের রিপোর্টার হবার দৌলতে বাংলাদেশের বহু প্ৰথিতযশা লব্ধপ্ৰতিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল।
দুর্ভাগ্য!
হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য। দুৰ্ভাগ্য নয়ত কি বলব বল? কলকাতার ময়দানে মনুমেণ্টের নীচে লক্ষ লক্ষ মানুষ এদের বক্তৃতা শোনে, হাততালি দেয়, গলায় মালা পরায়। প্ৰথম প্ৰথম এদের কাছে এসে নিজেকে কৃতাৰ্থ মনে করতাম। শিক্ষা-সংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়ে যাঁরা সিনেট হল—ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট—মহাবোধি সোসাইটি হল গরম করে তুলতেন, তাঁদের সবাইকেও ঠিক শ্ৰদ্ধা করে উঠতে পারলাম না। সাড়ে তিন কোটি বাঙালী নারী-পুরুষ-শিশুর দল যাঁদের মুখ চেয়ে বসে আছে, যাদের বক্তৃতা আমরা নিত্য খবরের কাগজের পাতায় ছাপছি, তাঁদের স্বরূপটা প্ৰকাশ হওয়ায় আমি যে কি দুঃখ, কি আঘাত পেয়েছিলাম, তা ভাষায় প্ৰকাশ করতে পারব না। কি কি কারণে এদের আমি শ্রদ্ধা করতে পারিনি, সে-কথা লেখার অযোগ্য। বিদ্যাসাগরের বাংলাভাষা দিয়ে এদের কাহিনী লিখলে বিদ্যাসাগরের স্মৃতির অবমাননা করা হবে, বাংলাভাষার অপব্যবহার করা হবে। তবে যদি এইসব মহাপুরুষের কথা লিখতে পারতাম, যদি সে-ক্ষমতা আমার থাকত, তবে বাংলাদেশের কিছু মানুষ। নিশ্চয়ই বাঁচতে পারত।
তুমি ভাবছি আমি বাচালতা করছি। তাই না? সত্যি বলছি দোলাবৌদি, আমি একটুও বাচালতা করছি না। ইংরেজীতে যাকে বলে ট্রাডিশন, তা তো বাঙালীর আছে। শিক্ষা-দিক্ষ-আদৰ্শ ও দেশপ্রেমের অভাব তো বাংলাদেশে নেই। গ্রামে গ্রামে দরিদ্র গৃহিণীরা আজও ক্ষুধার অন্ন দিয়ে অতিথির সেবা করতে কাৰ্পণ্য করেন না। উদার বাংলা বুক পেতে সারাদেশের মানুষকে আসন বিছিয়ে দিয়েছে। ভারতবর্ষের দিগ দিগন্তর থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এসেছেন বাংলাদেশে। কিন্তু কই আর কোন প্রদেশের মানুষ তো এমনি করে। সারাদেশের মানুষকে নিয়ে সংসার করবার উদারতা দেখাতে পারে নি। রাজনীতির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। শিক্ষায়-দীক্ষায়, শিল্পে-সংগীতে বাঙালীর ঔদার্য অতুলনীয়। অতীতের ইতিহাস ওল্টাবার কোন প্ৰয়োজন নেই। ইদানীং কালের ইতিহাসই ধরা যাক। প্ৰমথেশ বড়ুয়া, কুন্দনলাল সায়গল, লীলা দেশাই বাঙালী নন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে এদের অকলঙ্কিত আসন চিরকালের জন্য রইবে। বড়ে গোলাম আলি খা-র গান শোনার জন্য একমাত্র বাংলাদেশের অতিসাধারণ মানুষই সারা রাত্তির রাস্তার ফুটপাথে বসে থাকে। টি আও, আপ্পা রাও, মেওয়ালাল বা লালা অমরনাথ, মুস্তাক আলিকে বাঙালীর ছেলেরা যা ভালবাসা দিয়েছে, তার কি কোন তুলনা হয়? হয় না দোলাবৌদি। হবেও না।
শিক্ষা-দীক্ষা-আদর্শ ও সর্বোপরি হৃদয়বত্তা সত্ত্বেও বাঙালী কেন মরতে চলেছে? বাঙালীর ঘরে ঘরে কেন হাহাকার? কান্না? সারাদেশের মানুষ যখন নতুন প্ৰাণস্পন্দনে মাতোয়ারা, তখন বাঙালীর এ-দুরবস্থা কেন? সাড়ে তিন কোটি বাঙালীর মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিল কে? কেন সারা জাতটা সর্বহার হলো?
আগে সবকিছুর জন্য অদৃষ্টকে ধিক্কার দিতাম। কৈশোরযৌবনের সন্ধিক্ষণে আশা করতাম। ময়দানে মনুমেণ্টের তলায় নেতাদের গলায় মালা পর্যালে, তাঁদের বক্তৃতা শুনলে হাতে তালি দিলে বাঙালীর সর্বরোগের মহৌষধ পাওয়া যাবে। রিপোর্টারী করতে গিয়ে বড় আশা নিয়ে এদের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু হা ভগবান! মনে মনে এমন ধাক্কাই খেলাম যে তা বলবার নয়।
ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা নিশ্চয়ই খুব জরুরী ব্যাপার। কিন্তু সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সমাজ-জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা অসম্ভব। তাই তো সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে ক্ষয়রোগ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। তাই তো কলকাতার জীবন আমার কাছে আরো তেতো মনে হতে লাগল।
এইসব নানা অশান্তি মনকে তোলপাড় করে তুলেছিল। মুখে কিছুই প্ৰকাশ করছিলাম না। বন্ধুবান্ধব সহকর্মীদের কেউই কিছু জানতে পারছিল না। আমার মনের মধ্যে কত চিন্তা-ভাবনার যে কি বিচিত্র লড়াই চলছিল, সে-খবর কেউ জানতে পারল না। তবে মেমসাহেবকে ফাঁকি দিতে পারিনি।
সেদিন দুজনে ন্যাশানাল লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম। নোটস নেওয়ার কাজ শেষ করে একটা গাছতলায় এসে বসলাম দুজনে। আমি বোধহয় দৃষ্টিটা একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে কি যেন দেখছিলাম। মেমসাহেব বললো, ওগো, চিনেবাদাম কিনে আনবে?
আমি গেটের বাইরে থেকে দু। আনার চিনেবাদাম আর দু’টো ম্যাগনোলিয়া আইসক্রিীম কিনে আনলাম। আইসক্ৰিীম, চিনেবাদাম খাওয়া শেষ হয়েছে। মেমসাহেব তখনও একটু একটু ঝাল-নুন খাচ্ছে আর জিভ দিয়ে রসাস্বাদনের আওয়াজ করছে। ওর কখন ঝাল-নুন খাওয়া শেষ হয়েছে, কখন আমার কাছে রুমাল চেয়েছে, তা আমি খেয়াল করিনি।
মেমসাহেব হঠাৎ আমাকে একটা ঝাকুনি দিয়ে বললো, ওগো, রুমালটা দাও না!
আমি রুমাল দিলাম। রুমাল দিয়ে হাতটা মুখটা মুছে আবার আমাকে ফেরত দিল, এই নাও।
রুমালটা পকেটে রাখতে রাখতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার রুমাল কি হলো?
সর্বমঙ্গলার নির্মাল্য বেঁধে তোমাকে দিলাম না।
ও! তাইতো!
মেমসাহেব প্রশ্ন করল, একটা কথা বলবে?
কেন বলব না?
কি এত ভাবছ আজকাল?
কই? কিছু না তো।
ও একটু হাসল। বললো, আমাকে ছুঁয়ে বলতে পার তুমি কিছু ভাবছ না?
কথা শেষ হতে না হতেই ও আমার হাতটা টেনে নিয়ে বুকের ওপর রেখে বলে, বল।
আমি হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলি, কি ছেলেমানুষি করছ! মেমসাহেব একটু হাসে, একটু ভাবে। বোধহয় আমার কথায় একটু দুঃখ পায়। ঐ ঘন কালো দু’টো চোখ যেন শ্রাবণের মেঘের মত ভারী হয়ে ওঠে। আমি এক ঝলক দেখে নিয়ে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিল।
মেমসাহেবের একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। আমি দৃষ্টিটা আবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। জানতে চাই, কি এত ভাবছ?
জেনে তোমার লাভ?
আমি ভেবেছিলাম সহজ সরলভাবে মেমসাহেবকে এড়িয়ে যাব। কিছু বলব না। কিন্তু গভীর ভালবাসায় ওর দৃষ্টিটা এত স্বচ্ছ হয়েছিল যে, আমার মনের গভীর প্রদেশের ও কোন কিছু লুকান সম্ভব ছিল না। ও স্থির জেনেছিল আমার মনটা একটু বিক্ষিপ্ত আছে। কিন্তু কি কারণে মনটা বিক্ষিপ্ত তা জানতে না পারায় মেমসাহেবের দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক। সে-কথা উপলব্ধি করেও ওকে ঠিক সত্য কথাটা বলতে আমার বেশ কুণ্ঠা হলো।
দু’চার মিনিট দুজনেই চুপচাপ রইলাম।
তারপর মেমসাহেব ডাকে, শোন।
বল।
তুমি কি আজকাল এমন কিছু ভাবছ যা আমাকে বলা যায় না।
তুমি কি পাগল হয়েছ!
তবে বলছ না কেন?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। বললাম, কি বলব মেমসাহেব! নতুন কিছুই ভাবছি না। ভাবছি নিজের কর্মজীবনের কথা। আর কতকাল এমনি অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকব। তাই খালি ভাবছি।
মেমসাহেব উড়িয়েই দিল আমার কথাটা। বললো, তা এত ভাববার কি আছে? কেউ একটু আগে, কেউ বা একটু পরে জীবনে দাঁড়ায়। তুমি না হয় দু’বছর পরেই জীবনে দাঁড়াবে, তাতে কি ক্ষতি হলো?
ভাবব না? হকারের মত ফিরি করে রোজগার করতে আর ভাল লাগে না। হাজার হোক বয়স তো হচ্ছে!
মেমসাহেব তাড়াতাড়ি আমাকে কাছে টেনে নেয়। দু’হাত দিয়ে আমার মুখটা তুলে ধরে বলে, ছি ছি, নিজেকে এত ছোট ভাবছ কেন?
ছোট ভাবতাম না। তবুও যদি ভদ্রলোকের মত রোজগার করতে পারতাম।
তোমার কি টাকার দরকার?
‘না, না, টাকার আবার কি দরকার!
বল না। আমি তো মরে যাইনি।
মেমসাহেব বড়ই উতলা হলো আমার কথায়। জানতে চাইল, আর কি ভাবছ?
বলব?
নিশ্চয়ই।
ভাবছি আমার এই অনিশ্চয়তার জীবনে তোমাকে কেন টেনে আনলাম। একটা আধাবেকার জার্নালিস্টের সংসারে তোমাকে এনে কেন তোমার জীবনটা নষ্ট করব, তাই ভাবছি।
মেমসাহেব রেগে ওঠে, চমৎকার। হাততালি দেব?
কেন ঠাট্টা করছ?
তোমার কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারছি না। তোমার টাকা না থাকলে আমি তোমার কাছে ঠাই পাব না? তুমি আমাকে এত ছোট, এত নীচ ভাব?
পাগল কোথাকার। তোমাকে আমার সংসারে এনে যদি সুখ, শান্তি, মৰ্যাদা দিতে না পারি। তবে……
ও আর এগুতে দিল না, তুমি দুপাঁচশ’ টাকা রোজগার করলেই আমার শান্তি? টাকা হলেই বুঝি সবাই সুখী হয়?
না তা হবে কেন? তবুও ভদ্রভাবে বাঁচবার জন্য কিছু তো চাই।
আমার বা আমার সংসারের চিন্তা তোমার করতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে যাও তো।
কথায় কথায় বেলা যায়। সূৰ্যটা আস্তে আস্তে নীচে নামতে থাকে, গাছের ছায়া দীর্ঘতর হয়। বেলভিডিয়ারের সুবিস্তীর্ণ প্ৰাঙ্গণ। সূৰ্যরশ্মির বিদায়বেলায় মিষ্টি আলোয় ভরে যায়।
মেমসাহেব আমার কাঁধে মাথা রাখে। ওগো, বল তুমি এসব আজেবাজে কথা ভাববে না। আজ না হয়। ভগবান নাই দিলেন। কিন্তু একদিন তিনি নিশ্চয়ই ভরিয়ে দেবেন। তোমাকে।
তুমি বুঝি সবকিছু জান?
একশবার। ওয়েলিংটন স্কোয়ার আর মনুমেণ্টের মিটিং কভার করেই তোমার জীবন কাটাতে হবে না।
তবে কি করব?
কি না করবে। তাই বল। তুমি দেশদেশান্তরে ঘুরবে, কত বড় বড় লোকের সঙ্গে তোমার পরিচয় হবে, তুমি কত কি লিখবে…
তারপর?
মেমসাহেব আমার গাল টিপে বলে, তারপর আর বলব না। তোমার অহঙ্কার হবে।
আমার হাসি পায় মেমসাহেবের প্রলাপ শুনে। তুমি কি বোম্বে যাচ্ছ?
ও অবাক হয়ে বলে, আমি কেন বোম্বে যাব?
হিন্দী ফিল্মের স্টোরি লেখার জন্য।
অসভ্য কোথাকার।
সেদিন আমি শুধু একটা মোটামুটি ভাল চাকরির স্বপ্ন দেখতাম। আর? আর ভাবতাম। অফিস থেকে আমাকে একটা টেলিফোন দেবে। আমি অফিসের গাড়ি করে রাইটার্স বিল্ডিং, লালবাজার যাব, পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর অফিসে ঘুরে বেড়াব। চীফ মিনিস্টারের সঙ্গে দাৰ্জিলিং যাব। রাইটার্স বিল্ডিং-এর সেক্রেটারী ডেপুটি সেক্রেটারীরা আমাকে উইস করবেন, পুলিস কমিশনার ভিড়ের মধ্যেও আমাকে চিনতে পারবেন, শ্যামপুকুর থানার ও-সি আমাকে কাটলেট খাওয়াবেন।
স্বপ্ন দেখারও একটা সীমা আছে। তাইতো আমি আর এগুতে পারতাম না। আজ সেসব দিনের কথা ভেবে হাসি পায়। কোনদিন কি তেবেছি আমি নেহেরু-শাস্ত্রী-ইন্দিরার সঙ্গে পৃথিবীর পঞ্চ মহাদেশ ঘুরে বেড়াব? কোনদিন কল্পনা করতে পেরেছি। বছর বছর বিলেত যাব? কোনদিন কি ভাবতে পেরেছি। প্ৰাইম মিনিস্টারের সঙ্গে এয়ার ফোর্সের স্পেশ্যাল প্লেনে দমদমে নামিব? রাজভবনে থাকিব? আরো অনেক কিছু ভাবিনি। ভাবিনি। ভারতবর্ষের টপ লীডরেরা আমার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে গোপন আলোচনা করবেন, হুইস্কি খেতে খেতে অ্যাম্বাসেডরদের সঙ্গে ইণ্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স ডিসকাস করব।
মেমসাহেব বোধহয় এসব ভাবত। কোথা থেকে, কেমন করে এসব ভাবনার সাহস সে পেত, তা আমি জানি না। তবে আমার কর্মজীবনের কৃষ্ণপক্ষেও সে-আশা হারায় নি। তাইতো যতবার আমি নিরাশায় ভেঙে পড়েছি, যতবার আমি পরাজয় মেনে নিয়ে কর্মজীবনের পথ পাণ্টাতে চেয়েছি, ও ততবার আমাকে তুলে ধরেছে। আশা দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে, ভালবাসা দিয়েছে।
কখনও কখনও শাসনও করেছে।
সবই বুঝি মেমসাহেব। কিন্তু এই কলকাতায় পরিচিত মানুষের দ্বারে দ্বারে আর কৃপা প্ৰাথী হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারছি না।
মেমসাহেব স্পষ্ট বললো, কলকাতাতেই যে তোমার থাকতে হবে, এমন কি কথা আছে। যেখানে গিয়ে তুমি কাজ করে শান্তি পাবে, সেইখানেই যাও।
এক মুহুর্ত চুপ করে ও আবার বললো, আমি তো তোমাকে। আমার আঁচলের মধ্যে থাকতে বলি না।
মেমসাহেব জীবনে একটা লক্ষ্য স্থির করেছিল। সে-লক্ষ্য ছিল আমার কল্যাণ, আমার প্রতিষ্ঠা। আর চেয়েছিল প্রাণভরে ভালবাসতে, তালবাসা পেতে।
মধ্যবিত্ত সংসারের কুমারী যুবতীর পক্ষে এমন অদ্ভূত লক্ষ্য স্থির করে অগিয়ে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। মেমসাহেবের পক্ষেও সহজ হয় নি। বাধা এসেছে, বিপত্তি এসেছে, এসেছে প্ৰলোভন। এইত সুবোধবাবু আমেরিকা ফেরার পর যখন ইঙ্গিত করলেন মেমসাহেবকে তাঁর বেশ পছন্দ, তখন বাড়ির অনেকই অনেক দূর এগিয়েছিলেন।
মেমসাহেব কি বলেছিল জান? বলেছিল। মেজদি, মা-কে। একটু বুঝিয়ে বলিস রেডিমেড জাম-কাপড় দেখতে একটু চকচক করে। কিন্তু বেশীদিন টেকে না, তার চাইতে ছিট কিনে মাপমত নিজের হাতে তৈরি করা জিনিস অনেক ভাল হয়, অনেক বেশী সুন্দর হয়।
মেজদি ইঙ্গিত বুঝেছিল। তবে আমার সঙ্গে ঘুরেফিরে বেড়ান নিয়ে মেমসাহেবের আত্মীয় মহলেও গুঞ্জন উঠেছিল। অপ্রিয় অসংযত আলোচনাও হতো মাঝে মাঝে। ও সেসব গ্রাহ্য করত না। দেখ খোকনদা, আমি কচি মেয়ে নই। একটুআধটু বুদ্ধিসুদ্ধি আমার হয়েছে। কিছু কিছু ভালমন্দও বুঝতে শিখেছি।
সব মিলিয়ে কলকাতার আকাশটা বেশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠল। মেমসাহেবও ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল আর বেশীদিন কলকাতায় থাকলে দুজনেরই মাথাটা খারাপ হয়ে উঠবে।
ওগো, সত্যি তুমি এবার কোথাও যাবার ব্যবস্থা কর। আশপাশের কতকগুলো অপদাৰ্থ মানুষের ভালবাসার ঠেলায় প্ৰাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।
আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে?
পারব। তবে যখন যেদিন দুজনে মিলবো, সেদিন তো আর কেউ বিরক্ত করতে পারবে না।
আত্মীয়বন্ধুর দল কেউ জানতে পারলেন না। ধীরে ধীরে আমি দিল্লী যাবার উদ্যোগ আয়োজন শুরু করলাম। গোপনে গোপনে কিছু কিছু কাগজপত্রের অফিসে গিয়ে আলোচনা করলাম। শেষে একদিন অকস্মাৎ এক অপ্ৰত্যাশিত মহল থেকে এক নগণ্য সাপ্তাহিকের সম্পাদক বললেন, দিল্লীতে আমার এক’জন করসপানডেন্টের দরকার। তবে এখন তো একশ টাকার বেশী দিতে পারব না।
কুচপরোয়া নেই। একশ টাকাই যথেষ্ট।
কথা দিলাম, ঠিক আছে আমি যাব।
কবে থেকে কাজ শুরু করবেন?
আপনি যেদিন বলেন।
অ্যাজ আলি অ্যাজ ইউ ক্যান গো।
মেমসাহেব পরের শনিবার ভোরবেলায় আমাকে নিয়ে কালীঘাটে গিয়ে পূজা দিল, প্ৰসাদ দিল, নির্মাল্য দিল। এই নির্মাল্যাটা সব সময় কাছে রেখো।
সন্ধ্যেবেলায় দুজনে মিলে ডায়মণ্ডহারবারের দিকে গেলাম। বেশী কথা বলতে পারলাম না কেউই।
মেমসাহেব বললো, আমার মন বলছে তোমার ভাল হবেই। আমার যদি ভালবাসার জোর থাকে, তাহলে তোমার অমঙ্গল হতে পারে না।
আমি শুধু বললাম, তোমার দেওয়া নির্মাল্য আর তোমার ভালবাসা নিয়েই তো যাচ্ছি। আমার আর কি আছে বল?
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার নামতে শুরু করেছিল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চল এবার যাই।
ও উঠল না। বসে রইল। ডাকল, শোন।
বল।
কাছে এস। কানে কানে বলব।
কানে কানে কি বললো জান? বললো, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করবে?
আবছা অন্ধকার আরো একটু গাঢ় হলো। আমি দু’হাত দিয়ে মেমসাহেবকে, টেনে নিলাম বুকের মধ্যে। সমস্ত অন্তর দিয়ে, সমস্ত মন-প্ৰাণ দিয়ে অনেক আদর করলাম।
তারপর মাথায় আঁচল দিয়ে ও আমাকে প্রণাম করল। আশীৰ্বাদ করে আমি যেন তোমাকে সুখী করতে পারি।
যুধিষ্ঠির রাজত্ব ও দ্ৰৌপদীকে পণ রেখে পাশা খেলেছিলেন। আমার রাজত্ব ছিল না। তাই নিজের জীবন আর মেমসাহেবের ভালবাসা পণ রেখে আমি কর্মজীবনের পাশা খেলতে যুধিষ্ঠিরের স্মৃতিবিজড়িত অতীতের ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ, বর্তমানের দিল্লী এলাম।
[ক্রমশ]
.