| 10 অক্টোবর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: দুই নিকাহী নারীর বেত্তান্ত । মিলন ফারাবী

আনুমানিক পঠনকাল: 32 মিনিট

মহাপৃথিবীর পূর্বপীঠ তখন ঘন অন্ধকার। আলো নাই। অস্ত গিয়াছে সূর্য। বঙ্গোপসাগর হতে ফুঁসিয়া উঠিয়াছে জোয়ার। বেগ পাইয়াছে। সাতনদীর মোহনা, আগুনমুখা,পায়রা, সন্ধ্যা নদী হইয়া উচ্ছসিত জল জম্বুদ্বীপ খাল দিয়া ঢুকিয়া পড়িয়াছে শিমুল পলাশভরা রুপশ্রী গ্রামে। অঢেল জঙ্গলে ঠাসা গ্রামটি। বৃক্ষ আর বৃক্ষ। দিনের বেলাতেই সূর্যের কিরণ শত উঁকিঝুঁকি দিয়াও সবুজ ডালপালার জন্য মাটি স্পর্শ করিতে পারে না। রাত্রিরের অন্ধকার বড় মনোরম। নিবিড় এবং নিঝুম।  জোয়ারের জল একদঙ্গল কচুরিপানা, কর্তিত কলাগাছ, দুর্গাদেবীর মূর্তির বিচ্ছিন্ন একখানা খড়-বিচালির দলা পাকানো হাত ভাসাইতে ভাসাইতে  খান-খান্দানের বাড়ির পেছনে  পশ্চিম কোলার খালে প্রবল ঘূর্নির মধ্যে ঠেলিয়া ফেলিল-জলের মধ্যে তখন বিচিত্র রুপ। ছপাৎ ছপাৎ কোমল শব্দও হইতে লাগিল।

আব্বাস আলী খান চমকাইয়া উঠিলেন। হ্যাজাক লাইট দপ দপ করিয়া জ্বলিতেছিল। সেটির রুপালী আলোতে খড়বিচালির হাতখানাকে শিশু-মনুষ্য আকৃতির মনে হইতে ছিল। আব্বাস তা বুঝিয়া উঠবার আগেই সেটি জলের ঘূর্নির মধ্যে তলাইয়া গেল।

খান খান্দানের বাড়িখানা বৃহৎই বলা যায়। পেছন দিকে মাঠের মত কোলা রহিয়াছে। সেইখানে নিকষ অমাবশ্যার রাতে সালিস বসিয়াছে। বেশ কয়েকঘর লোক। খানবাড়ি ও জ্ঞাতিদের বউভাবীরাও হাজির হইয়াছে। আব্বাস একখানা দুই হাতলবিশিষ্ট কেদারায় বসা। তার পাশে চেয়ার ও  টুল পাতিয়া আকবর, মজাহেদ, মজেম বসিয়াছে। বাকিরা  কেউ গামছা পাতিয়া, কেউ কলাগাছের পাতা টানিয়া আনিয়া, কেউ  হাঁটু ভঙ্গ হইয়া গোলাকার বৃত্তে বসা। তাহাদের ঠিক মাঝখানে দুইজন রমনী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। একজন কালো মিশমিশে রঙ্গের বোরকা পরিয়াছে।  তার বিরাট একটি ছায়া পরিবেশকে বেশ রোমাঞ্চকর তুলিয়াছে। অন্যরমনীর শরীরে বোরকা নাই। তার পরনে বারোহাতি সুতির শাড়ি। কপালে টিপ। মাথার পেছনে সাপের মত দীর্ঘ বেনী। তাহাতে রঙ্গিন ফিতাও পরিয়াছে সে। রমনীর ভঙ্গি বড় উদ্ধত। নেকাবউলী রমনী কলাগাছের মত স্থির দন্ডায়মান। বেনীউলী রমনী সামনে পেছনে বেশ নড়াচড়া করিতেছিল। দুই রমনীর মধ্যে অবশ্য নিকট সম্বন্ধ রহিয়াছে। তাহারা সম্পর্কে সতীন। সালিসের মামলা হইলো এই-দুই রমনীর নানা কূটকচাল, খুনসুটি আর বিবাদের কারণে তাদের স্বামীবাহাদুর  রাত্তিরে ঠিকমত নিদ্রা যাইতে পারেন না। তারা দুইজন দীর্ঘদিন যাবৎ বিবাদকালে হাতচালনাও করে। তাদের নিবৃত্ত করিতে গিয়া স্বামী আহতও হইয়াছেন একাধিকবার।  বেচারা পঞ্চাশোর্ধ নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। নাম নেকাব্বর।  ভীমরুলির গঞ্জে তার বিরাট মুদিখানা রহিয়াছে। মাসিক আয় উপায় লক্ষ টাকার উপরে। রুপশ্রী গাঁও;সন্নিহিত ইউনিয়নে-এমন কি অত্র অঞ্চলে  ইহা নিতান্তই কম নহে।  অর্থের দৈন্য নাই। খোরাকির সঙ্কট নাই। তাহার প্রথম বিবি যৌবনেই দুই  পুত্রের জন্ম দিয়া অকাল গত হইয়াছে। তারপর তিনি বোরকাউলিকে ঘরে তুলিয়াছেন। দুই মাতৃহীন পুত্রকে পালনপোষণ করিয়া সে-ই বড় করিয়াছে। তিনি নিজে কোন সন্তান জন্ম দিতে পারেন নাই। তিনি বন্ধ্যা। নেকাব্বরের সন্তান-তৃষ্ণা তাতে মেটে নাই। তাই বেনীউলীকেও খুজিয়া পাতিয়া আনিয়া সংসারে স্থান দিয়াছেন। বেনীউলী তার ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখে নাই। চাইর চারটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়া সে বাড়ি ভরিয়া ফেলিয়াছে। হাঁটুতে  কন্যা, বগলে কন্যা, কোলে কন্যা-কন্যায় কন্যাকার অবস্থা। কন্যাগুলি রুপবতী হইয়াছে মায়ের মতই। উজ্জল গাত্রবর্ণ। টিকোলো নাক। ভরাট মুখ। শরীর-স্বাস্থ্য ভাল। কিন্তু নেকাব্বর খানের তাতে সন্তুষ্টি নাই। কন্যাসন্তান দিয়া তিনি কি করিবেন! ইহাদের দিয়া জামাই ও কুটুম্বগোষ্ঠির বংশ বর্ধন ঘটিলেও নিজের কি হইবে! তাহার তো ইহাদের বিবাহ-খরচ নির্বাহ করিতেই জান ওষ্ঠাগত হইবে! গুষ্ঠিভরা কন্যা সন্তান তিনি প্রত্যাশা করেন নাই। চাইরটি সন্তানের মধ্যে দুতিনটি  পুত্র সন্তান কেন হইল না, সেই চিরন্তন আফসোস লইয়া তিনি চতুর্থ বিবাহের জন্য জোর প্রস্তুতি নিয়াছিলেন।

গোল বাধিয়াছে এই জায়গায়। শরীয়তে বাধা নাই। সমাজে সমস্যা নাই।  চাউলডাইল বাড়ন্তের গেরস্থও তিনি নন। প্রথম বেগম বিগত হইবার কারণে উপর্যুপরি আরও দুইখানা নিকাহ করিবার শরীয়তি অধিকার রহিয়াছে। তিনি সেই অধিকার পূর্ণ ভোগ করিতেও যান নাই। কেবল তৃতীয় বিবিকে ঘরে তুলিবার খায়েশ প্রকাশ করিয়াছেন মাত্র।  সম্ভাব্য এই বেগমটি দুরাত্মীয়াও নয়। প্রথমা বিবির ছোট বোন। সম্প্রতি তাহার স্বামী গত হইয়াছে। ইদ্দত কাল শেষ হইয়াছে। তার একটি মাত্র পুত্র সন্তান। সোমত্ত বয়স। ভরাট অটুট যৌবন। প্রিয় এই শ্যালিকাকে তিনি অনেক বছর ধরিয়া টোনা পাখি, টিয়া পাখি বলিয়া আদর সোহাগও করিতেছেন। আশা করা যায়, তার পক্ষে আরও দুয়েকটি পুত্র সন্তান জন্মদান সম্ভব হইবে। জেনানাটি বড়ই উর্বর। বেওয়া বেগমকে নিকাহ করিতে যাইয়াই যত বিপত্তি। যে দুই রমনী সর্বদা ছিল দা ও কুড়াল; পরষ্পর কখনও হাসিমুখ করিয়া অপরকে দেখে নাই-তাহারাই এই ইস্যুতে প্রবল ঐক্য গড়িয়া তুলিয়াছে। একাট্টা হইয়া তারা বলিয়াছে- আর কোন বিবি আনিতে তারা দিবে না। স্বামীকে সন্তুষ্ট করিতে তাহারাই যথেষ্ট। স্বামীর কি সুখ চাই। সর্বসুখ; সর্বকিছু তাহারাই দিবে। বোরকাউলির নাম তাজ মহল। সে বলিয়াছে- সে নিজে বন্ধ্যা হইতে পারে;কিন্তু সোয়ামীর সেবা করিতে  কখনওই কার্পণ্য করে নাই। কোন ভুল ত্রুটি তার হয় না। স্ত্রী হিসাবে তার অপরাধ কি! তার সতীন  হাওলা বেগম  তো বন্ধ্যা নয়। সে সন্তান উৎপাদনে পূর্ণমাত্রায় সক্ষম। তাহাদের দুজনার মধ্যে কাহারও  রুপ-যৌবন কিছুই ফুরাইয়া যায় নাই। চাইরটা কন্যা হইয়াছে তো কি হইয়াছে-পরবর্তী গর্ভের সন্তান অবশ্যই পুত্র হইবে। সুতরাং নতুন বিবির কি প্রয়োজন।

অকাট্য যুক্তি। একাব্বর শান্তশিষ্ট মানুষ। তিনি বিবিযুগলের যুক্তি খণ্ডাইতে না পারিয়া তারই চাচাতো ভাই আব্বাস আলী খানের শরণ নিয়াছেন। সমস্যাটি তাহার হাতে সোপর্দ করিয়াছেন। নেকাব্বরের প্রত্যাশা- আব্বাস সুন্দরভাবে বিষয়টির মিটমিমাংসা করিয়া দিতে পারিবে। সেই তাকে উদ্ধার করিতে পারিবে।

আব্বাস গণ্যমান্য লোক। ইউনিয়ন কাউন্সিলের দীর্ঘদিনের মেম্বর। রাজনৈতিক বুদ্ধি যেমন তার প্রখর; তেমনি বংশের ধারা সেই সমুন্নত রাখিয়াছে। তাহার দাদা আইয়ুব খানের বুনিয়াদি ডেমোক্রেসীর গোড়া সমর্থক ছিল। গ্রামের মাতব্বরি সেই হইতে তারাই চালাইয়া আসিতেছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কখনওই মাথা চাড়া দিয়া উঠে নাই। তার বাবাও ছিল মৌলভী। জিয়াউর রহমান আমলে যে ভিলেজ গভর্নমেন্ট ওরফে গ্রাম সরকার হইয়াছিল, মৌলভী তখন রুপশ্রীর প্রেসিডেন্ট হইয়াছিলেন। সেই হইতে তাহাকে স্থানীয় লোকজন পেসিডেন্ট সাব বলিয়া সম্বোধন করিত। খান খান্দানের বাড়িও সেই হইতে প্রেসিডেন্ট মঞ্জিল হিসাবে সম্বোধিত হইয়া চলিয়াছে। আব্বাস আলীও প্রেসিডেন্টের পুত বলিয়া সম্মানিত হইয়া চলিয়াছে। আব্বাসের আরও কয়েকখানা গুণ হইল, সে শরীয়তি- মারিফতি লাইনেও অত্যন্ত কামিল লোক। শরীয়তের  হামানদিস্তা নাড়িয়া চাড়িয়া সে সর্ববিষয়ে ফতোয়া প্রদানেও সক্ষম।  তাহার আরেকখানা সদগুণ হইলো-সে নিজে একখানা বিবি লইয়া সানন্দে ঘরগেরস্তি চালাইয়া যাইতেছে। এত সালিস মিমাংসা করিয়াছে- কখনওই সে কোন রমনীর দিকে মুখ তুলিয়া তাকায় নাই। সর্বদা মাটির দিকে চক্ষু নিবদ্ধ  করিয়া সকল প্রকার সাংসারিক কাজিয়ার সুরাহা করিয়া দেয়।  এইজন্য নেককার লোক হিসাবেও তাহার পরিচয় সুবিদিত। পরনারীকে আপন করিবার লোভ নাই, এমন বান্দা দুর্লভ। সে সওয়াবী না হইয়া যায় না।  তবে তার জবান অতিশয় ক্ষুরধার।

-হাওলা বিবি, ভাবীজান আপনি মনে হচ্ছে অতিশয় উজাইছেন। আগে ঘরের মধ্যে উজাইতেন , উঠানে উজাইতেন। এখন তো দেখতে আছি ঘরের বাইরেও আগানে বাগানে আপনার উজানি ছিটকাইয়া পড়তেছে।

-না, ভাই, মুই মোটেই উজাই নাই। মুই কি কই মাছ যে উজামু।

– দৃষ্টান্তটা খারাপ দেন নাই। কই মাছের লাহানই উজাইছেন। তয় কইমাছ কিন্তু  এক উজাইয়াই চিৎ হইয়া পড়ে। পানি ছাইড়া উঠানে ওঠলে বেশীক্ষণ টেকে না। আপনারাও সেই দশা হইবে।

– আপনি কি ভাইজান ,মরণদশার কতা কইতেছেন। কেয়া মোগো মরণদশা হইবে কেন। মোগো দুই সতীনরে এইখানে কি গলা কাটার  জন্য ধইররা আনছেন নাকি! নাকি চুল কাইটা  বেইজ্জত করবেন। আপনাগো মনের মধ্যে কোনডা আছে ভাইজান।

-আহারে কোথাকার  কতা কোথায় লইয়া যায়! মুই কই কি, হে কয় কি! শোনেন, একাব্বর ভাইজানে আমারে এইখানে সালিশ কইররা দেওয়ার জন্য পাডাইছে। সে আমার বয়সে তিন বছরের বড়। সেই জন্য মুরুব্বি। তার বিবিরাও মুরুব্বি। সালিশে আমি কখনওই  কোন  মাতারিগো কতা শুনি না। মোর কখনওই মাতারিগো দিকে বদনজর নাই, তাতো জানেনই। তাই শুনি না। ঘরেও না । বাইরেও না।  আপনারা সম্পর্কে ভাবীসাব, আপনাদের কোনভাবেই অশ্রদ্ধা করমু না। তয় আপনারাও লিমিট ক্রস কইরেন না।

-দেহো প্রেসিডেন সাবের পুত, মুই একখান কতা কই। মাতারি-মাগিগো বেশী কতা কইতে দেয়াই একটা বেশরীয়তি কাম। তুমি অন্য সব জায়গায় শরীয়তি লাইনে কাম সারবা; আর এইখানে তোমার ভাবীসাব লগে  মারিফতি লাইন ধরবা- এইডা কিন্তু হয় না।

-আহারে মজেম ভাইজান, আপনি মুরুব্বি। আপনি এর মধ্যে প্যাচ মাইরেন না। আমারে কইতে দেন।ভুল হইলে ধরবেন।

 শোনেন আমার দুই ভাবীজান , আপনারা যে আপনাদের সোয়ামীরে আরেকটা নিকাহ করতে বাধা দিতেছেন, এইটা তো একদম ঠিক না। এইটা শরীয়তের বরখেলাপ।

-ক্যান ক্যান! কি খেলাপ করলাম কন দেহি। শরীয়ত কি মোরা কম বুঝি! বুঝাইয়া কইলে মোরাও বুঝমু আনে। শরীয়ত তো আল্লায় আপনাগো পুরুষের লাইগা খালি লেইখ্যা পাডায় নাই।

হাওলা বিবি দন্ডায়মান অবস্থায়ই পা নাড়াইতে নাড়াইতে বলে। বোরকার অতলান্ত হইতে তাজুবিবির গলার দুরাগত আওয়াজও শোনা যায়। -বোঝলা হউরের পুত, শরীয়ত কিন্তু মুইও একটু আধটু বুঝি। বোরকা পইরা থাহি বলে ভাইবো না লেখাপড়া কিছু করি নাই। মোর বাপে কিন্তু মৌলবী না। দাখেল পাস দেওয়া মওলানা -হেয়া কেউ যেন ভুইল্যা যায় না জানি।

-ওই দেহেন, ওই দেহেন, দুই সতীনের কাইজ্যা লাইগা গেছে। একজনে তো মা মনসার মত চেহারাসুরত বানাইয়া শরীয়তি ওয়াজ করলো। কতা কয়। আর পাও নাচায়। কত বড় বেয়াদব। আরেকজন বোরকার তলে থাকলে কি হইবে; সেইখান দিয়াও ভুরভুরাইয়া আওয়াজ উঠতেছে।  সে নাকি মওলানার ঝি! বোজলেন চাচাজান, এইডা কিন্তু আমাগো  বংশরে টিটকারি দিয়া কইলো। মোরা মৌলবীর বংশ আর হে নাকি মওলানার ঝি! হে হে হে। বিয়া বওনের পর মাগীগো আবার মৌলভী- মওলানা কি! হাইল্লা চাষা ভুষার  মাইয়াও যা, মওলানার মাইয়াও তাই।  কী ঠিক কইলাম তো ভাইসব।

আকবরের বয়ানে সমর্থন দেয় সকলে। হয় হয়-সমর্থনে সম্মীলনী ভরিয়া ওঠে।

-আকবইররা, তোরে তো লগে আনাডাই আমার ভুল হইছে। তুই তো কোন জায়গায় কোন কতা কইতে হয়, হেইডাই বোঝোস না। খালি পাগল ছাগলের মত কতা কস। তুই আর একটা কতাও কবি না। কইলে তোরে ঘাড্ডি ধইরা দিমু আনে। মুই এবার দুইডা কতা কই। ইসলাম হইছে কমপ্লিট জীবন বিধান। ফুলকোর্স কোড অব লাইফ। ইসলামের সবচাইতে বড় সৌন্দর্য হইলো- দুনিয়া জাহানে কিয়ামত পর্যন্ত এই একখান মাত্র  ধর্ম যে- নারী জাতি ,রমনী জাতি , আম্মা জাতিরে সম্মানিত করছে। এত বেশী স্বাধীনতা দেছে যে রাখনের জায়গা নাই। এত ফ্রিডম আর কোন ধর্ম দেয় নাই। কিয়ামত পর্যন্ত কোন ধর্ম, কোন জাতি ,কোন দেশ দিতে পারবেও না। দেবেও না। আর আমার দুই ভাবীজানের কতা যদি ধরি, আমি বলব তারা একশ পারসেন্ট হক কতা বলছেন। হাওলা বিবি শরীয়ত সম্পর্কে জানতে চাইছেন। এই অধিকার তো তারে ইসলামই একশ পার্সেন্ট দিছে। আর গদ্দিনশীন মাইজাভাবী বলছে-সে মওলানার মাইয়া। সেইটা তো কোন ভুল কতা না। তার মরহুম আব্বাজান বানারিপাড়ার প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন। তিনি ছিলেন নবীর ধর্মের বড় খেদমতগার।এই তল্লাটে তার মত আর আছে কেডা!  তিনি ইসলামের হুকুম আহকাম লইয়া ফতোয়া সালিশ করতেন। আমি তার সন্নিকটে গেছি। আমারে বড়  স্নেহ  করতেন। বড় বাড়ির কুটুম্ব বইলা সম্বোধন করতেন। শরীয়তের অনেক দুরুহ বিষয় আমি তার সঙ্গে আলাপ সালাপ কইরা সমঝাইয়া নিছি। কী তাজুভাবী, ভুল কইছি কিছু। আপনি তো নিজেই সাক্ষী।

বোরকার তল হইতে এবার মৃদু হাসির আভাস শোনা যায়। হোনো হউরের পো, তোমার মতলব বোঝতে  মোর বাকি নাই। মোর মরহুম বাপরে টাইনা আইনা এহন মোগো ঠগাইয়ো না। আল্লায় সইবে না।

-নাউজুবিল্লা, নাউজুবিল্লা। কী যে কন আপনে। ঠকামু কেন। আপনার মরহুম আব্বাজান হইলেন আমার দ্বীনদারি লাইনের ওস্তাদ। মুই যা কিছু কমু, ধইরা নেবেন আপনার মরহুম আব্বাজানেই এই শরীয়তী ফয়সলা করতেছে। সে আমার সুরত ধইরা এইখানে বইসা আছে।  মওলানায় এন্তেকাল করছেন সত্য; তাই বইলা শরীয়ত তো এন্তেকাল করে নাই।

খান মহল্লার কোলায় উপস্থিত জনমণ্ডলীর মধ্যে বিচ্ছিন্ন কথার জিকির উত্থিত হয়।  ঠিক ঠিক, একশ পারসেন্ট ঠিক- প্রেসিডেন্টের পোলায় খাটি কতা  কইছে। এই জন্যই তো সে প্রেসিডেন্টের উপযুক্ত পুত। কথামালা আব্বাস আলীর কানে যায়। সে ডান হস্ত উত্তোলন করে।

– আপনারা ভ্রমরের গুঞ্জরণ বন্ধ করেন। কতা আমার শুরু হইছে। শেষ করি নাই। আমি কিন্তু দুই লাইনই জানি। ভাবীসাব, আপনারা বিশেষ উজাইয়েন না। উত্তেজনার কিছু নাই। মাইজা ভাই আরেকটা নিকাহ করতে চাইতেছে, এর মধ্যে সমস্যা বা ঝামেলার কিছু দেখতেছি না। শরীয়তে চাইরখান বিবাহ জায়েজ। পুরুষের জন্য চাইরখান বিবি সম্পূর্ণ   হালাল। এই শরীয়তী আল্লার বিধান তো হঠাৎ আকাশ দিয়া পড়ে নাই। নবীজী হেরার গুহায় বছরের পর বছর ফানাবিল্লা হইয়া পইড়া রইছেন। তার হুশজ্ঞান কিছুই ছিল না। কত বড় ত্যাগ। ভাবছেন একবার! তারপর কিতাব পাইছেন। কোরান শরীফ হইতেছে খতমে নবীঈনের কেতাব। আদম আলাইহিসসালাম আসবার পর হাজার কোটি বছর গত হইছে; তিন লক্ষ পয়গম্বরও আসছে দুনিয়ায়। লক্ষ লক্ষ কওম আসছে। আল্লার ওহি আসছে। কেতাব আসছে। নানা গবেষনা করছেন আল্লায়। আল্লার রিসার্চ যখন শেষ, তখন খাতামান নবীঈনরে পাঠাইছেন। তখন নাজিল হইছে কোরআন। ফুলকোর্স কোড অব লাইফ। সেই কিতাবখানায় আল্লায়  চাইরখান বিবাহের বিধান না ভাইবা দেয় নাই। নারী জাতি হইছে আম্মার জাত। কোন নারীর মুখ কল্পনায় আসলেই আমার মরহুম আম্মাজানের কতা মনে পড়ে। তিনি চাইর সতীনের ঘর করছেন। শান্তিমত করছেন। কোন আসুবিধা হয় নাই। কারন তিনি শরীয়তি লাইনের ফিকিরে ছিলেন সব সময়। বরখেলাপ করেন নাই।

এখন সবচাইতে ইমপরট্যান্ট মানে গুরুত্বপূর্ণ ও গম্ভীর প্রশ্ন হইল-মেঝ ভাইজানের কি চারবিবি রাখনের মুরোদ নাই। তার কি ধনদৌলতের অভাব। শরীয়ত কইছে চাইরবিবি রাখার মুরোদ থাকতে হবে। নইলে চাইরখান কেন একখান বিবির সহবতও করিও না। ভাবীসাবগণ, বলেন আপনারা, মেজভাইর সঙ্গতি আছে কি নাই!

-মুরোদের কতা আনো কেন হউরের পো। আরেকটা বউ লাগবে কেন হেইডা কও।

– লাগালাগি লইয়া পরে আইতাছি। আগে শরীয়তি লাইন ক্লিয়ার করি। শোনেন, শরীয়ত সবকিছুর আগে নারীর অধিকারটা দেখছে। যদি পুরুষ চারবিবির ভরণপোষন দিতে না পারে, সে বিবাহ করিতে পারবে না। আমি বাধা দিমু। তারে একঘরে কইররা দিমু। মসজিদে ঢুকতে দিমু না। সমাজে বসতে দিমু না। ভিমরুলি গঞ্জ দিয়া তার মুদিদোকান লাত্থি মাইরা ভাইঙ্গা দিমু।

আব্বাস আলী বসা অবস্থায় লাত্থি দেওয়ার ভঙ্গি করিয়া দেখায়। বলে, আমি আপনাদের কথা দিলাম ভাবী। এবার আসেন আপনাদের দ্বিতীয় অধিকার। শরীয়ত বলছে- সব কয়ডা বিবিরে সমান নজরে দেখতে হইবে। মাইঝা ভাই যদি তাতে সম্মত হয়, তবে আরও দুই বিবি ঘরে তুলতে পারে। কেউ বাধা দিবার পারবে না। এইখানে শরীয়ত কি পুরুষের অধিকার দেখছে। বলতে গেলে দেখে নাই। নারীরে অগ্রাধিকার দিছে। পুরুষের খালি দেওন আর দেওন। খাই-খরচ আর ভরণপোষণ দেওন। নারীর খালি নেওন আর নেওন।সোনা নেও;মোহরানা নেও। নাকফুল নাও। কানের দুল নাও। তার নেওনের শেষ নাই।

হাওলা বিবি খিল খিল করে হাসে। হেয়া তো আপনি কইছেন খারাপ না। নতুন বিবিরে  অবশ্যই সে এক নজরে দেখবে আনে। তার সেই এক নজরের কোন নড়নচড়ন হইবে না।  যে বিবিরে ঘরে আনতেছে , হেরে তো তিনি ছোডকাল হইতে সোহাগের নজরে দেখেন। মোরা কি হেই সব জানি না।

-দেখেন ভাবীসাব, শোনা কতায় কান দেবেন না। এতদিন যে সোহাগ স্নেহের কতা শুনছেন। সেইটা তার শালীরে তখন তিনি  কন্যার চোখে দেখছেন। আমি সাক্ষী। কী মজেম ভাই, আপনি তো মেজভাইর ল্যাংটাকালের দোস্ত; বলেন,ঠিক কইছি কিনা। আপনিও তো ওই শালীডারে কইতে গেলে মাজাভাইর শাশুড়ির কোলেই দেখছেন।

মজেম মাথা নাড়িয়া আব্বাসকে সমর্থন দেয়। বোরকার অতলান্ত হইতে আবার আওয়াজ আসে।

-এইডা তুমি কী কতা শুনাইলা হউরের পো। আগে মাইয়ার চোখে দেখতো মানে। তাইলে তিনি মাইয়াকে নিকাহ করতে যাইতেছেন নাকি।  অসতাগফিরুল্লা। কি নাপাকি কতাবার্তা কও! বোরকাউলী তার নেকাবের জাল ছিন্ন করিয়া একদলা থু থু নিক্ষেপ করিল।

সঙ্গে সঙ্গে সারিন্দার মত হাওলা বিবিও ঝম ঝমাইয়া বাজিয়া উঠিল। খুবই নাপাক কতা কইলেন  কিন্তু ভাইজান। মোর গর্ভে তার চার চারটা কন্যা সন্তান হইছে। এখন কি তাগোও তার নজর দিয়া আগলাইয়া রাখা লাগবে! তারা কিন্তু তার ঔরসেই হইছে।

আব্বাসের মুখমন্ডল মুহুর্তের মধ্যেই কঠিন ও প্রস্তর হইয়া উঠিল।

-খামোশ। মুখে লাগাম দেন আপনারা। দুই ভাবীরেই কইতেছি। এতদিন আপনাদের বেলাগাম কথাবার্তার কথা মেজভাইর কাছে শুনছি আর বিবিমহল হইতেও শুনছি। আজকে তো দেখছি আপনাদের মুখে কিছুই আটকায় না। বড়ই বেশরম, বেলাজ। হাওলা বিবি ওরফে খাওলা বিবি। খাওলা ইসলামের ইতিহাসে কার নাম, আপনি  কি জানেন। বীরাঙ্গনা খাওলা। ওইরকম সাহসী  আউরত আর মোসলেম জাহানে আসে নাই। সেই নাম আপনারে  দিছিল আপনার বাপ মায়। সেই নামের মর্যাদা রাখতে তো পারেন নাই। তাই লোকমুখে হইছেন হাওলা বেগম।

আরে, রমনী মাতারিরা হইছে হাওলাতের মাল। স্বামী তার শ্বশুরের কাছে থেকে এই মালামাল বন্ধক নেয়। মাইয়ার বাপে জামাইর কাছে হাওলাত দেয়। কাবিন নামায় দেনমহরের  চুক্তি হয়। নগদ সোনা দানা দিয়া টাকা পয়সা দিয়া কাবিন করা হয়। এইটা বিবাহের লাইসেন্স।  আপনারে তো দেনমোহর দিয়াই বিয়া করছে ভাইজানে। কোন ভেজাল করে নাই। এখন বান্দরী পাড়ার দিকে হাঁটাইয়া দিলে কিন্তু শরীয়তের কোন বরখেলাপ হইবে না।

– এই তো আপনার মুখ দিয়া আসল রসের কতা বাইরাইতেছে। তাইলে কি এই খানে মোগো দুই সতীনরে হাঁটাইয়া দেওনের জন্যই খাড়া করাইছেন। কাবিনের টাহা পয়সা দিয়া এই কোলা দিয়াই কি বিদায় দিয়া দিবেন।

হিস হিস করে ফোঁসাইয়া ফনাইয়া ওঠে হাওলা বিবি।

-আহারে, কোন কতা কোতায় নেয় ভাবীসাব। আপনাদের বিদায় দেওনের কতা কখন কইলাম। নরম কইররা বুজাইতে ছিলাম, বোঝলেন না। এখন কি গরম লাইনে বুঝামু। শরীয়তে কিন্তু দুই লাইনই খোলা আছে। দুইটাই  ফরজ। গরম হইয়েন না। গরম হইলে লস ছাড়া লাভ নাই। ঘরের চৌকাঠে ঘুন ধইররা গেলে সেই কাঠ পাল্টাইতে বলছে স্বয়ং রসুলুল্লা। সহীহ হাদীস। গদ্দিনসীন ভাবী সাব, আপনার সতীনরে বোঝান। ঘুণ ধরা চৌকাঠ পাল্টানোর ফতোয়া দিতে বাধ্য কইরেন না। রসুলে কি ফয়সলা দিছে। প্রথমে বিবিরে বোঝাও। না পারলে চ্যালাকাঠ উডাইয়া পিডাও। হেইসব কইররাও যদি বিবিরে কন্ট্রোল করা না যায়- তখন ঘরের চৌকাঠ পাল্টাইয়া ফেল। মানে দেনমোহরের টাহাপয়সা দিয়া বিদায় দেও। ওই বেলাজ মাইয়াছেলের মুখ দর্শন করিও না। তার সঙ্গে সঙ্গম-সহবত করিও না।

-তুই একটু থাম তো হাওলা। হউরের পুতরে কইতে দে। মোগো কতা তো কমুই। আগে তার শরীয়তি লাইনগুলা শুনি।

হাওলাকে মৃদু ধমক দেয় তাজমহল ওরফে তাজুবিবি। নখ দিয়া মাটি খুড়িতে খুড়িতে হাওলা বলে- তাতো তুমি বলবাই। তুমি আবার মওলানার  ঝি। মুই তো মওলানা কেয়া- মৌলবীর ঝিও না। ফকিরের ঝি।  তোমার আদরের হউরের পুতে মাইয়া বিয়া করণের ফতোয়া দিতেছে- এইটা কোন শরীয়তে আছে কও দেহি বুবুজান।

কথাগুলো কানে যায় আব্বাসের।

-ভাবীসাব, খুবই আপত্তিকর কতা বলতেছেন। এই মাইয়া সেই মাইয়া না। কাউকে কন্যার স্নেহ দেখা আর নিজের ঔরসের কন্যা- এক জিনিস না। কন্যার চোখে দেখেও কাউরে বিয়া করন হালাল। নবীজী তার পালিত পুত্র জিয়াদের তালাকি বউকে পর্যন্ত নিকাহ করছে। বোজলেন ভাবী, ভাল মাল রাস্তাঘাটে ফালাইয়া রাখা ঠিক না। কুড়াইয়া ঘরে তুইল্লা রাখতে হয়।

-কী কইলেন আপনি ভাই! মাইয়া মানুষ আর মাল এক জিনিস হইলো!

-আহারে। মাল আর জিনিস তো একই। আমি ভাল কতা কই আর আপনি জিনিসটারে নাস্তিক শাহবাগীগোর লাহান ঝুলাইতেছেন কেন। ঢাকার শাহবাগে নাস্তিক মর্দাগো লগে মস্তামস্তি করতে আপনিও গেছিলেন নাকি।

শোনেন, মোদের নবীজীর জীবনাদর্শ অনুসরন করলেই সব দিশা পাইবেন। মাইয়া লোক সব সময়ই মাইয়া লোক। সে রজ:প্রাপ্তি হইলেই মাগী বেডি হইয়া যায়।  বিবাহযোগ্যা। বালেগা হইলেই হইবে। তখন সে বাপের বয়সী দুলাভাইর কাছেও  বিয়া বসতে  পারে;চাইলে দাদার বয়সী লোকের কাছে বিবাহ বসতে পারে। খালি দেখতে হবে সেই দাদাজানের মরদাঙ্গি আছে কি না। দুবাইর মওলানা জাকির নাইকের টিভি অনুষ্ঠান দেখেন নাই। হেয়া দেখবেন কেয়া! আপনেরা সুযোগ পাইলেই লেংটা বেডিগো দিক চাইয়া থাহেন। এই ইন্ডিয়া আমাগো সব দিক দিয়াই ডুবাইতেছে।

-তোমার কতা মন দিয়া শোনলাম হউরের পো।  বোজলাম তোমার মাইজাভাইর এখন মাগীবেডি দরকার। তা মোরা কি বেডি না; মোরা কি মাতারী না। মোরা কি বুড়ি হইয়া গেছি। মোগো কি শরীলে রত লাইগা গেছে! মাডির দিকে চাইয়া থাইক্কা আর রঙ্গ কইরো না বড় হউরের পো। মুই না বোরকার তলে থাকি। হাওলাবিবি তো তোমার নজরের সামনেই তার রুপযৌবন লইয়া খাড়াইয়া আছে। তারে দেইখা কও দেখি- আরও মাতারী লাগবে কেন।

-নাউজুবিল্লা, নাউজুবিল্লা। গদ্দিন ভাবীজান কি যে কইতেছেন হাটভর্তি পুরুষ মানষের সামনে। মুই কি  এখন মুরুব্বি বড়ভাইর  বউর দিকে তাকাইয়া তার রুপ যৌবন দেখমু। সুন্দর না কালা কুচ্ছিত- সেইটা নিরীক্ষণ করমু। নাউজুবিল্লা। না, মজেম ভাই, এইখানে আসাই আমার ভুল হইছে। মেঝভাইজানের  বউ দুইডা খান্ডারনী। তাগো দুইজনের মুখই কুকথার কারখানা।

-কেন, মোরা মুখ খুললেই তা কুকথার কারখানা হইতে যাইবে কেন। আপনি যে বান্দরী পাড়ার দিকে হাঁটাইয়া দিবার কতা কইলেন, ঘরের চৌকাঠ পাল্টানোর কতা কইলেন, হেয়া বুঝি খুব সুখকথা।

-এই মাতারী কি কইতে আছো তুমি। তোমার মাতামোথা ঠিক আছে তো। আব্বাস কইছে রসুলুল্লার কতা। তুমি হাদীস লইয়া তামাশা করো।

খেঁকাইয়া ওঠে মজেম। আইজকে তোমারে দাওয়াত কইরা এইখানে আনা হইছে। তোমারে বাইন্ধা আনা হয় নাই। তা তুমি কি বেশবাস কইরা আসছো।  কপালে ওইডা কি দিছো। ছি ছি। থু থু। নাউজুবিল্লা। কোন মোসলেম জেনানা কপালে সিন্দুরের লাহান টিপ লাগায়। নেকাব্বররে আমি আগেই কইছিলাম, ঘরের মধ্যে টেলিভিশন  ঢুকাইস না। সে শুনলো না। উল্টা কি ডিশ ফিশও লাগাইলো। এখন দেখ নেকাব্বর , টিভি দেখাইয়া বউরে কি বানাইছোস। কই হালার পুতে। সে আইজ সালিশে আসে নাই কেন। কোন গর্তে মুখ লুকাইছে। হেরা দুইজন তো  আর ঘরের বউ নাই। হেরা তো আইজ এতো রাত্তিরে সালিসে আসে নাই। হাওলার  রুপযৌবন দেখাইতে আসছে। হে তো হিন্দি ফিলমের হিরোইন হইছে। ও বেডি, তুমি শাড়িডা পরছো কেমনে! কপালে ওইডা দেছো কি! তুমি কি জানতা না, মোরা মুরুব্বিরাও থাকমু এইখানে।

-মজেমভাই, আপনি মুরুব্বি মানুষ। আপনার কতার কি জবাব দিমু।

-রাখো মাতারী, জবাব দেওনের কোন দরকার নাই। মাতারী মানুষ তুমি, মাতারীর জায়গায় থাকো।

-কেন , জবাব দরকার নাই কেন। মাতারীগো কি মুখ নাই। হেরা কি কতা কইতে জানেনা।

-চুপ মাতারী । একদম চুপ। তুই একটা বেয়াদব। তোর মত ছেনালি মাতারী এইখানে আসবে জানলে মুই আব্বাসের এই সালিসে আসতামই না।

-মাতারীরা কথা কইলেই কি ছেনালি হইয়া যায় মজেম ভাই।

-চুপ বেয়াদব। তুই আমারে ভাই কবি না। কোন ছেনালীর আমি ভাই না। তোরে নেকাব্বর কোতা দিয়া আনছিল হেই কতা কি মোরা জানি না। তোর গোষ্টি তো হইছে জোলার জাত। বজ্জাত। ছোডজাত। তোর গোষ্ঠি মোসলমান হইছে দুতিন পুরুষও হয় নাই। হাদীস কোরানের  মূল্য তুই কি বুঝবি।

-মজেম ভাইজান, আপনি যদি একটু বিশ্রাম করেন, আমি দুইডা কতা কই।

-তুমি অবশ্যই বলবা আব্বাস। তুমি পুরা এই তল্লাটের মাতুব্বর। তোমার সালিসে কখনই ভুল হয় না। তোমার জন্যই আসছি। কিন্তু এই ছেনালী মাগীর কতা শুনতে আসি নাই। তারে একটু সাইজ করন দরকার। আমারে দুইডা কতা কইতে দাও। এই বেডিরে কেমনে কোতা দিয়া নেকাব্বর আনছে হেই খবর মুই জানি।

আকবর খান চেচাইয়া ওঠে- কোথা হইতে তুইল্লা আনছে হেরে, কোন মাগীপাড়া দিয়া- অনেক কতাই  শুনছি। একটু খুইল্লা কন তো চাচামেয়া।

-আর কইস না ভাইস্তা। দু:খের কতা আর কি কমু। নেকাব্বর তো কোন কতা কইতে এই ভর মজলিসে আইবে  না। সব কতা মোরই কইতে হইবে। নেকাব্বরে  তো খালি  ভিমরুলি বাজারে একখান মুদি দিয়াই বইছে। কিসের মুদি দোকানদারি করে। খালি মাইয়া মানষের দিকে চউখ। দোকানদারি তো চালায় ওর দুই পোলায়।

-তুমি আবার মেঝভাইরে নিয়া কেন পড়লা। নিকাহ না কইরা তো সে কোন মাইয়া মানষের দিকে দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে নাই।

নেকাব্বরের সহোদর ভাই মজাহেদ মুখ খুলিল।

-হেই জন্য কি তোর এক মায়ের পেডের ভাই  আগানের বাগানের, জোলাপাড়ার দাসী বান্দি টুকাইয়া ঘরে বউয়ের ইজ্জত দিয়া ঢুকাইবে। আমাগো খান বাড়ির ইজ্জতটা দেখবে না। এই যে জোলার ঝি টারে উডাইয়া আনছে। কেমন বোঝতে আছো এখন। নেকাব্বর যখন বেডিটার পেছন পেছন জোলাপাড়ায় গেল, মুই বাধ্য হইয়া তার লগে গেলাম। কিন্তু তারে মানা তো করছিলাম। কইছিলাম না, জোলার মাইয়া দরকার হইলে কামওয়ালি বানাইয়া আন। তারে গোয়াল ঘরে থাকতে দে। যা করনের মন চায়- হেই জায়গায় শুইয়া চুপেচাপে কর। তোগো খানখান্দানের ওপর কথা তোলনের কেউ নাই। যত ইচ্ছা তারে সোনা পাখি, ময়না পাখি, টিয়া কইয়া ডাক। মূল ভিটায় তুলিস না।

– দেখো, মজেম ভাই। মোরা বুনিয়াদি মুসলমান। শরীয়ত না মাইনা কিছু করতে পারি না। মেঝভাইও পারে না।

 -নেকাব্বর শরীয়ত মানছে ভাল কতা। কিন্তু তোর জোলার বেটি ভাবীজান  কি শরীয়তের কোন কতা মানতেছে। তারে এতো কইরা বুঝায়তেছে আব্বাস । কোন ফায়দা হইতেছে। হে বেডি দেখ, খাড়াইছে কেমনে। মনে হয়  মাইয়ামালের হাটে দাসী বান্দি তোলা হইছে। দেখ, মোর দিকে কেমন কইরা চোখ গোল কইরা হাসতেছে। কী শয়তানির হাসি। কত বড় খারাপ মাইয়া মানুষ। আমি শরীয়তের কতা কইতেছি। সে আন্ধারে  মিট মিট কইরা হাসতেছে। কোন ভয়ডর নাই।

মজেমের শরীয়তী বোলচাল শুনিয়া সত্যিই কী এক গুহ্য  কারনে মৃদু হাস্যমুখ করিয়া যথারীতি পা নাড়িতেছিল খাওলা বিবি।

-তুমি তো অনেক কতা কইয়া ফেললা মজেম ভাই। বেশীর ভাগ কতাই সত্য কইছো। মুই যে জোলার মাইয়া। মোর বাপে জোলা, দাদায় জোলা,ভাই জোলা-সবাই মাছ ধইরা খায়-কোন কতাই মিথ্যা না । সবই সত্য। কিন্তু জোলাপাড়ায় রুপযৌবনের জন্য যায় কারা। মোরা কি আইয়া নিজেরা নিকাহ বইছি তোমাগো লগে। নাকি তোমরা মোরে গিয়া দশ ভরি সোনা দিয়া তুইল্লা আনছো। জোলা হইতে পারি, কিন্তু ছেনালি না। আইজকে যা কইলা, তাতে মনে হইতেছে তুমি জোলা পাড়ায় গিয়া যে একবার কোপ খাইছিলা; হেয়া ভুইল্লা গেছ। মুই ভুলি নাই। তোমার রঙ্গীন পাঞ্জাবিখান উডাইয়া কইলজার দিকটা একটু সবাইরে দেখাও। কইলজা বরাবর কিসের কোপ। আরেকটু হইলে তো কইলজা ছেদ কইরা যাইতো। আইজকে আর জিন্দা থাকতা  না। কী দেখাবা, নাকি আমি আইয়া দেখামু। এই আকবইররা, তুই তো খালি ফাল পারোস, খালি মোর নামে কত কতা হোনোস। এখন তোর জেঠার পাঞ্জাবিটা তুইল্লা ধর। সবাই দেখুক। তোর কাকায় যদি এত সত্যবান যুধিষ্ঠির হইতো; আর জোলার মাইয়ারা সত্যিই ছেনালি হইতো; তাইলে তোর চাচার লগে টেকাটুকা লইয়া শুইতো। দাও দিয়া কোপাইতো না।

আকবর খানের চরিত্র বড়ই বিচিত্র। আমোদপ্রিয় সরল নওজোয়ান। সে তার হাতের টর্চলাইটখানা প্রজ্জ্বলিত করে। তারপর বলা নাই, কওয়া নাই-মজেমের পাঞ্জাবি খানা হঠাৎ টানিয়া উর্ধদিকে তুলিয়া ফেলে। বড়ই হাস্যরসের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মজেম পাঞ্জাবির ঘেরের মধ্যে আটকাইয়া পড়িয়া চেচাইতে থাকে। মজেমের নগ্ন শরীরে কলিজার দিকটায় সত্যিই বিরাট একটি অতি পুরাতন শুকনা দাগ দেখিয়া আকবর বিরল কিছু আবিস্কারের আনন্দে চেচাইতে থাকে। কও জেঠা, এই দাগ হইল কেমনে। এই দাগের কতা হাওলা চাচী কেমনে জানল। তুমিও কি জোলা পল্লীতে রসের নাগর হইয়া গেছিলা নাকি!

বড়ই বেগতিক অবস্থা। গুরু গম্ভীর সালিসের মধ্যে এই রকম প্রহসন উপস্থিত হইবে- সেটা আব্বাসেরও ধারনার বহির্ভুত  ছিল। সে আকবরকে ধমক দিবে; না কি তাহার মুখমন্ডল ও ওষ্ঠযুগলে উত্থিত প্রবল হাসির ঠমক সম্বরণ করিবে- কিংকর্তব্য বিমুঢ় হইয়া পড়িল।  অত:পর সে পরিস্থিতি সামলাইবার মোক্ষম উপায় হিসেবে বলিল, এইবার আমি রসুলুল্লার হাদীস বয়ান করিয়া নেকাব্বরের সমস্যার সুরাহা বাতলাইতেছি। আরবীতে সে হাদীস খানা পড়িল। অতপর বলিল- আল্লার নবী এই খানে কি বলেছেন। তিনি ফরমাইয়াছেন, নারী হইল কোমল। নারী হইল শস্য ক্ষেত্র। সেই শস্য ক্ষেত্রে  যেমন ইচ্ছা পুরুষ জাতি কর্ষন করতে পারে। কর্ষন বলতে কি বুঝাইছেন, তা কি ভাইঙ্গা বলা লাগবে। লাগবে না। যার সঙ্গে পুরুষাঙ্গ আছে, তার কর্ষন বুঝতে অসুবিধার কতা না। এখন প্রশ্ন হইল, এক নারীর শরীলে কয়বার কর্ষন করা সম্ভব। আমাগো চাষের জমিতে দুই মাসে তিনমাসে ফসল ওঠে। আর এই নারীর শস্য ক্ষেত্রে ফসল ওঠে নয়মাসে। নয়মাস আর ওই জমি কর্ষন যোগ্য থাকে না। তারপরও নারীর নানা ফিজিক্যাল সমস্যাদি রইছে। বিষয়টা দুই ভাবীরও ভাল কইরা বোঝা দরকার। তারা মর্দা লোকদের মত কতা বাতাইতে পারে। কিন্তু দেহসৌষ্ঠবে তো তারা  মাতারীই। একজন চিরবন্ধ্যা। সেই ফসলের ক্ষেতে কোনদিন ফসল হইবার সম্ভাবনা নাই। সে বোরকার তলে লজ্জায় শরমে লুকাইয়া থাকে। কিন্তু গলার আওয়াজের কোন কমতি নাই। আরেকজন তো মাশাল্লা। আল্লায় তার রুহানি জগতে মানে রুহস্থানে যত আউরতের রুহ মওজুদ রাখছেন, হাওলাবিবি সবগুলারে তার গর্ভে কইরা দুন্নইতে আনার কন্ট্রাক্ট নিয়া আসছে। তারে তো থামানো দরকার। নইলে আল্লার স্টকে শর্ট পইড়া যাবে। এই অতি-উর্বর জমি মাইজাভাইর দরকার নাই।

আব্বাস আলী খানের কথায় রসময়তার লহরী দেখিয়া সকলে হাসিয়া কুটো কুটি হইতেছিল। রমনীরা মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিল। খাওলার মুখটি অদ্ভুত। তাহাতেও হাস্যরসের সুষ্পষ্ট নিদর্শন দেখা যাইতে লাগিল। হাসি বড়ই সংক্রামক। তাজমহল বিবিও হাসিতেছে।

কেবল আব্বাস কোনরকম হাস্য করে না। বলে, আমি তো এইখানে মীরবেক্কলের  আসর লইয়া বসি নাই। কোরান হাদীস সুন্নাত ইত্যাদি  সিরিয়াস বিষয় লইয়া বসিয়াছি।

বোরকার অতলান্ত হইতেও হাসির ঠমক শোনা যায়। ও হউরের পো, তুমি কি  আইজ সালিশ করতে আসছো। নাকি হাসাইয়া মোগো মারার দশা করবা।

আব্বাস কিছুক্ষণ থামিয়া চুপ করিয়া থাকে। হাস্যপ্রবাহ না থামিলে কোন কথা নয়।

শোনেন ভাবীসাবগন, আর যারা বেডাবেডি এইখানে আছেন, হাসন থামান। দুইডা মূল্যবান কতা শোনেন। আব্বাস মওকা দেখিয়া আবার শুরু করিল।

-সবচাইতে বড় কতা হইলো, মর্দা মানুষের অনেকরকম খায়েশ। তার যদি অর্থসম্পত্তি  থাকে, সহায়সঙ্গতি থাকে-একটার জায়গায় যদি চাইরটা মাইয়ামানুষ পালনপোষন ভরনপোষন দিতে পারে-সেইটা তো গৌরব কি বাত। এইরকম একম সোয়ামীর ঘর করতেছে-তার আউরতরা তো  তা নিয়া গৌরব করবেই। হেয়া না। হেরা আছে স্বামীর মরদাঙ্গি ঠেকানোর তালে।

-তা বড় হউরের পো, তুমি চাইরটা বিয়া করলা না ক্যান। তোমার উপর বেডার বেডা এই তল্লাটে আছে কেডা। মীরকসিমের আব্বায় যদি আরেক বিয়া করতে পারে, তোমার ছয়ডা বিয়া করণ শরীয়তে জায়েজ হওয়ার কতা। তোমার সহায় সম্পদ কিছু কম আছে নাকি।

-এই আব্বাস, তুমি কি এইখানে কৃষ্ণের লীলাখেলার আসর বসাইছো। এই তাজুবিবিরা তোমার লগে লীলারঙ্গ করতেছে। কিছুক্ষন পর তো কইবে- হেরা দুইজন নেকাব্বররে ছাইড়া তোমার গলায় ঝোলবে। তুমি মেঞা, হেইডা চাও নাকি! আর লগে কইরা এই আকবর হারামজাদারে লইয়া আইছো। এইডারে কেন সবজায়গায় লইয়া ঘোরো। একটা আস্তা মাকাল ফল। আস্তা একটা সার্কাস। খানের ঘরে  জন্মাইলেই খানজাদা হওন যায় না। খানের ঘরে খাননির পুতও জন্মায়। এইগুলারে থামাও। নইলে মুই কিন্তু ওডলাম।

মজেম খান উঠিতে উদ্যত হয়। আব্বাস তাহাকে হাত ধরিয়া নিবৃত্ত করে।

-আহারে, ভাইজানে কোথার কথা কোথায় লইয়া যায়। আমার কতা আমারে বলতে দেন। ভাবীসাবরা যদি এইটাকে লীলার আসর মনে কইরা থাকে-তার দাওয়াইও আছে। শোনেন, গদ্দিন ভাবীসাব, আমি চাইরটা বিয়া করি নাই-প্রথম কতা আমার সহায় সঙ্গতি নাই।

আব্বাসের এই কথায় সম্মিলনীস্থলে আবার হাসির লহরী জোয়ারের জলের মতন কলরোল তৈয়ার করে। খানখান্দানের বড় শরীক আব্বাসের বিবাহের সঙ্গতি নাই, কথাটা কৌতুকবহই বটে। বাজারে গঞ্জে এমন কি  জায়জঙ্গলের জমিই তাহার বিঘার পর বিঘা। খাইবার লোক নাই। আব্বাস বিষয়টা অনুধাবন করে।

-হাসনকোদন থামান। শোনেন, সঙ্গতি মানেই ভাত কাপড়ের যোগান দেওয়া নয়। আমার সেই সঙ্গতি অবশ্যই আছে। কিন্তু সারাদিন সালিশ মিমাংসা করি-পাবলিক সার্ভিস করি। ওয়েল ফেয়ার করি।  অনেক খাইখরচা আছে। এইসব কইরা আর বিশেষ কিছু থাকে না। তারপর আমি তো জোলার ঘর, নমু মৌলানার ঘর দিয়া মাইয়া আনি নাই। সেইরকম আনলে তো দাসী বান্দিই বানাইয়া আনতে পারি। নিকাহ করন লাগে না। বিবাহশাদী হইছে আল্লার মহব্বতের নিশানা। ইজ্জতকা সওয়াল।  আমি তো আমার পাল্টা পাল্টি শায়েস্তাবাদের খান খান্দান দিয়াই বিবি আনছি। এই পুরা পেসিডেন্ট মঞ্জিলে খানম বিবি তো ওই একজনই আসছে। সত্য কিনা বলেন আপনারা!

আব্বাসের কথায় উপস্থিত সকলে ঘাড় নাড়িয়া সায় দেয়। যথার্থ কথা। যৌক্তিক কথা। এইদিকখানা এতক্ষণ অন্যরা ভাবে নাই। কিন্তু তাজুবিবি ছ্যাত ছ্যাত করিয়া জ্বলিয়া পুড়িয়া উঠিল। মনে হইল, জলন্ত কড়াইতে জলের ছিটা পড়িয়াছে।

-এইডা কি কইলা হউরের পো। নমু মৌলানা কি মোর বাপরেই কইলা। এতক্ষণ খুব তো ওস্তাদ বইল্লা মানইজ্জত দিলা-কইলা মোর বাপে শরীয়তী লাইনে মহাদিগগজ। এহন একটানে তারে নমুশুদ্রতে নামাইয়া আনলা। হায় হায়। আমি আগেই বুঝছিলাম-তুমি আইছো সালিশ মিমাংসা করতে। মোগো মতন মাতারীগো   যে কইরাই  হোক ঠকাবাই। আমার মরহুম  বাপরে দরকারে কামে  ব্যবহার করবা। দরকারে তারে মাথায় উডাইতে দেরী করবা না। আবার দরকারে গালি দেতেও কসুর করবা না। হেইডাই তো হইল।

-গালি হেরে দেই নাই ভাবিসাব। এতবড় মওলানা, নমুর ঘরে জন্ম নেছে তো কি হইছে। ইসলামে কোন ভেদভাবনা নাই।  নও মুসলিম হইয়াও আপনার বাপজানে  মৌলানা পর্যন্ত হইছে। আলীয়া মাদ্রাসায় পড়ছে। সমাজে ইজ্জত পাইছে। আপনি কি আপনার মরহুম আব্বাজানের মানইজ্জত কিছু অবশিষ্ট রাখতেছেন। আপনি তো আপনার আসল জাত দেখাইতেছেন। হে যে নমুর জাত, কুজাত বেজাত আছিল- সেই গোমড় ফাঁস কইরা দিলেন। বোজলেন, নমু নমুই থাকে। মুসলমান হইলেই জাতে ওডে না। কিছু কই না, কইতেছি না  দেইখা মাথায় উইঠা বসতেছেন। আসল কতা ধইরা টান দিলে সব রহস্য খোলাসা হইবে। মেঝভাইজানে তিনটা বিয়াই করছে ছোটজাতে। প্রথম ভাবীজান। মরহুমা হইছেন। তিনিও জোলার ঘর। খালি পয়সা টয়সা কিছু বেশী আছিল। ফকিরনী ঝি  না। তারপর আপনারে আনতে গেল। সেইসময় তারে ছোটভাই হইয়াও কইলাম- বান্দরী পাড়ার দিকে যাইয়েন না। বিবি আনেন জাতের বিবি আনেন। টাহাপয়সা খরচপাতি করেন। অনেক খোজাখুজি করলেন। বললেন, মলানার ঝি একটা পাইছি। পরে খোজ নিয়া দেখি-নমু মলানা। মাত্র একপুরুষ  মুসলমানে দিক্ষিত হইছে। ভিক্ষা কইরা খাইত। নিরুপায় হইয়া ফুরপুরা পীরের পদযুগলে দাখিল হইয়া কলেমা পইড়া ইসলামে দাখিল হইছে। সেই মলানায় তো মাইজা ভাইরে বড় ঠগানডা  ঠকাইছে।

-কী ঠকাইছে, কী ঠকাইছে! আকবর সুর করিয়া আকামত দিতে লাগিল।

-আর কইস না। গদ্দিন ভাবীসাবের নামখান তো শুনছো। তাজমহল বেগম। কী মাশাল্লা নাম। শাজাহান বাদশা একখান তাজমহল নির্মাণ করছিল- সারা দুনিয়ার মানুষ  সেইটারে হাজার শত বছর ধইরা দেখেতেছে। নয়ন ভইরা দেখেতেছে। আর নমু মলানা একখান তাজমহল পয়দা করছে-সেইটা আবার ঢাকাঢাকনের তাজমহল। সব সময় সেই তাজমহল বোরকার তলে ঢাকা থাকে। এইটার কারন কি কেউ জানে। কেন নমু মলানা তার বান্দরীপাড়ার তাজমহলরে বোরকার তলে চুবাইয়া নিকাহ দিছে। সব হইছে মলানাসাবের ফক্কিরি। তাজমহল ভাবী, আপনার পর্দা ফর্দা কি একটু উঠাইবেন। আপনার তাজমহল রুপ আমার দেখনের কোন খায়েশ নাই। কিন্তু কোলা ভর্তি মানুষ এই বাংলার তাজমহলরে একটু দেখুক। প্রানমন জুড়াক। তাগো আর আগ্রার তাজমহল দেখার পয়সা পাতি নাই। এই দেশী তাজমহলই দেখুক।

শোনেন, কথায় কথা আসে। মেঝভাইজানের কি দু:খ- সেইটা তো আমি বেখবর নাই। সে তো আরেকটা বিয়া করতে চাইবেই। রসুলুল্লা তার  হাদীসে কইছেন যে যদি কোন খুবসুরত আওরত দেখে তোমার মনে কুভাব জাগ্রত হয় , তবে ঘরে ফেরত আসো। পরস্ত্রীর প্রতি বদ-নজর করিও না। নিজের বিবিদের সঙ্গে সহবত করো। তাহারা যদি কোন গৃহকর্ম ; রান্নাবান্না ঝাড়–দানেও ব্যস্ত থাকে- তাকে বিছানায় টাইনা লও। উপগত হও।

রসুলের জবানের ওপর কি কোন জবান আছে!

তাছাড়া, এখন আমাগো গ্রামেগঞ্জে হাটবাজারেও আখেরি জমানা উপস্থিত হইছে! ডাইনে সুন্দরী; বায়ে সুন্দরী। তারা বেপর্দা বেলাজ হইয়া ঘুরতেছে। তাতে নেকাব্বর ভাইজানের মনে যদি কুভাব জাগ্রত হয়- সে যাবে কোথায়। রসুলের শরীয়তি হুকুম-ফরমান অনুযায়ী ঘরে ফিরত আসনের কথা। কিন্তু ঘরে না হয় আসলো-তারপর কি ঘটনা! যদি হাওলাবিবির সঙ্গে সহবত করে-দশ নম্বর মহা-ডেনজার সিগনাল। কেননা  সে  মাইয়া উৎপাদনের কারখানা। আর বোরকা উডাইয়া যদি তাজমহলের দিকে হাত বাড়ায়-ওরে আমার আল্লা-সহবতের সকল ইচ্ছা জান্নাতে ফেরত চলে যায়। এই তাজমহল তার মরাবিবির পোলাপালনের জন্য বড়ই উপযুক্ত-কিন্তু সহবত মহব্বতের জন্য এক্কেবারে বাতিল মাল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত  জনমন্ডলীর মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল। পুরুষরা পরষ্পরের দিকে তাকাইতে লাগিল। জেনানাগন হাসিতে লাগিল। তাহারা রহস্য জানে। তাজুবিবির বোরকার অতলান্ত হইতে ফুপাইয়া ওঠা ক্রন্দনের ধ্বনি বাহির হইতে লাগিল। পরিবেশ বিচিত্র ও নাটকীয় হইয়া উঠিল। মোজেম খান তার তর্জনীর অঙ্গুলিখানা নাসিকার ছিদ্রের মধ্যে ঢুকাইয়া কোন গুহ্য সম্পদরাশির অনুসন্ধানে ব্যাস্ত ছিল। সেও শব্দ করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, মোরে আবার কেউ এই রহস্য খোলাসা করতে বাধ্য করিস না। আমাগো নেকাব্বর বোরকার তলে কি তাজমহল লুকাইয়া রাখছে- সেই কু-উ-ব-সুরত আওরত  তো নিজেই বোরকা উডাইয়া দেখাইতে পারে। কোলার মানুষ তারপর সেই বেডির  তাজমহল রুপ দেইখা রায় দিবে-নেকাব্বরের  আরেকটা বিয়া করন ঠিক না বেঠিক।

জনমন্ডলীর মধ্যে বিপুল হাস্যরাশি হিল্লোলিত হইতে লাগিল। তাজুবিবির ফোপানি-ক্রন্দন তাহাতে তলাইয়া গেল। হাওলা বিবি তাহার পাশে দন্ডায়মান সতীনকে ঠেলা দিল। বলিল, দেখছো, বুবুজান, জোলার পুতেগো অবস্থা। সবগুলা হইছে জোলার পুত। আর হাসতেছে এমন আটখানা হইয়া-ভাবখানা সবাইর যেন  আরবের সৈয়দ খান্দানে জন্ম।  তাগো মুখে তো হাসি আর ধরতেছে না। হাসি দেহো কেমন উপচাইয়া উপড়াইয়া পড়তেছে।

কথাগুলো হাওলা বেশ শব্দ করিয়াই বলিয়াছিল।  প্রতিক্রিয়া হইল মন্দ নয়। অনেকের হাস্য থামিয়া গেল।

মজেম চেঁচাইয়া উঠিল।

-ওই মাগী কী কইলি তুই! ওই মাগীর ঘরের খানকি, কি কইলি তুই।

-মুখ সামলাইয়া কথা কন মজেম ভাই। যা কইছি হেডা তো আপনার কানের মধ্যে ঢোকছেই। নইলে তো মাগী-খানকি কইয়া গাইল পারতেন না।

-শোনছো আব্বাস শোনছো। ওই জোলাবাড়ির খানকি বেডি মোগোরে জোলার পুত কইছে। কত বড় সাহস বেডির। তুমি যদি কঠিন বিচার না করো- আমি আইজ এই কোলা ছাইড়া যামু না।

– মজেম ভাইর দিলে খুব চোট লাগল মনে হইতাছে। যহন জোলাবাড়ির মাইয়া, নমু বাড়ির মাইয়া কইয়া ঝোলাঝুলি করলেন, তখন মুখ সামলাইয়া কথা কইলে এই কথা শোনন লাগত না। নিজেরা কওনের সময় ব্রেক থাহে না-এহন মুই কইলে কানের মধ্যে ঠাডা পড়ছে নাকি!

– শোনছো! খানকি বেডির কথা শোনছো! কত বড় সাহস।

-মজেম ভাই, আপনে খানকি কারে কন। মুই খানকি হইলে এই পেসিডেন্ট বাড়ির সব বউই খানকি। সব খানকিগুলারে জোলাবাড়ি, বান্দরিপাড়া, ভীমরুলি হইতে টোকাইয়া টুকাইয়া এই বাড়িতে বউ বানাইয়া উডাইছে। মোরা খানকি, মোগো শাশুড়িরা খানকি। হেগো শাশুড়িরা খানকি। আর কি উপরের দিকে যাওন লাগবে। হেগোও যেমন মোহরানা দিয়া ঘরে তুলছে। মোগোও তেমনি দেনমোহর দিয়াই ঘরে আনছে। মোরা যদি মোহরানা লইয়া বেশ্যা-খানকি হই;এই বাড়ির সকল বউ-বিবি, বিয়াইত্তা মাইয়াছেলে একই জাত।

-চোপ বেয়াদব। খামোশ। আর একটা কতা কইলে তোর জিহবা টাইন্না ছিইরা ফালামু। তুই হইছো জোলাবাড়ির খানকি। তোগো জোলাবাড়ির সব মাইয়াছেলে খানকি। মজেম অগ্নিরূপ ধারণ করিয়া চেচাইতে লাগিল।

কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই পশ্চিমের  কোলার পরিস্থিতি আকাশ পাতাল বদলাইয়া গেল। কিছুক্ষণ আগেও যাহারা বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসিতেছিল। তাহাদের মুখ শুকাইয়া আমসি হইয়া গেল। পরিবেশ থমথমে হইয়া উঠিল। কূলবধূ হিসাবে উপস্থিত জেনানাগন শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল।  একজন অন্যজনকে ঠেলাঠেলি করিতে লাগিল। তাহারা সম্ভবত সটকাইয়া পড়িতে চায়। কিন্তু প্রবল কৌতুহল তাহাদের পদযুগলকে সালিশস্থলে বাঁধিয়া রাখিল। রাত্রি গভীর ও  গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছে। তাহাতে কারও ভ্রুক্ষেপ নাই। কি ঘটিতে চলিয়াছে সম্মুখে- তাহা নিয়া সকলের মনে প্রচন্ড আগ্রহ ও উত্তেজনা দানা বাধিয়া উঠিল। আব্বাস খুবই বিব্রত বোধ করিতে লাগিল। অবস্থা এতটা বেপরোয়া, সঙ্গীন ও বৈরী হইয়া উঠিবে তাহার ধারনা ছিল না। তাহার মুখমন্ডল কঠিন হইয়া উঠিল। মুখ চোখ পাকাইয়া একবার হাওলাকে কিছু বলিতে গিয়াও বলিল না। ভাবিল, অরিকে দমন করিতে হইবে। রাগান্বিত হইয়া এই সালিশ বৈঠকে সুবিধা করা যাইবে না। হাওলাবিবির কথায় লোকজনের মধ্যেও অতিরিক্ত উত্তাপ সঞ্চারিত হইয়াছে। এই উত্তাপ অপ্রীতিকর দিকেও গড়াইতে পারে। যাহা আব্বাসের মোটেই কাম্য নহে। আবার এই বেপরোয়া মত্ত ঘোটকী হাওলাকে ছাড়িয়া দেওয়াও সঠিক হইবে না। যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহন আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছে। আব্বাস তাহার মুন্ডু-মগজ ও চিন্তাশক্তিকে  স্থির রাখিয়া বলিল-হাওলা বিবি, আপনি যে খান খান্দান , প্রেসিডেন্ট মঞ্জিলের সকল  বিবি-বউকে খানকি বললেন, আপনার কাছে কোন শরীয়তি বা আইনী দলিল আছে কি। নাকি আপনার সতীন নমু মলানার ঝির কাছে কোন দলিল  রইছে। যদি না থাকে তাহলে আপনারা দুজন নাকে খত দিয়া হাঁটুগাড়া হইয়া সকলের মাফ চাইবেন।

হাওলার ছ্যাঁৎ-চেতানি কিছুমাত্র কমিল না। পুরুষকুলে নানা কদর্য শব্দ- যেমন – এই বেডি খামোশ; মাগী তুই এখন চুপ মার; তোর আইজ এমন বেইজ্জত হইবে, তুই জানস না- এই বেডিরে চুল কাইট্টা গেরাম দিয়া খেদাইয়া দেওন দরকার; বেডির দেহি লেংটা হইয়া নাচনের শখ হইছে -ইত্যাদি কথামালা বিচ্ছিন্নভাবে সগৌরবে উচ্চারিত হইতেছিল। তাহাতেও হাওলা  দমিল না। ভ্রুক্ষেপ করিল না। ভয়ডরের কোন লক্ষণ তার মধ্যে দেখা গেল না।  সে বরং ব্যঙ্গের সহিত কহিল- জোলাবাড়ির ঝিয়ের কাছে  শরীয়তী দলিল!! হি হি। বড় হাসাইলেন। জোলা নমুর আবার শরীয়ত কি!  তয় আপনি যখন কইতে বলেন-দুইডা যুক্তি আমার মনের মধ্যেও আসছে। মাগী হইছি দেইখা তো ভাইসা আসি নাই। জান্নত হইতে মোরাও আদমের লগেই বোরাকে চইড়া আসছি। আদম আলাইহিসসসালাম না হয় কোন মাগীর ঔরসে  জন্ম নেন নাই। কিন্তু তারপর যত জন্ম, যত পুরুষ আসছে দুন্নইতে-সব মাগীর গর্ভের পয়দা। এই সত্যটা বোঝার জন্য তো আলেম কোলেম বা  মলানা হওন লাগে না।

-আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না ভাবীজান। আব্বাস অনেক কষ্ট করিয়া নিজেকে সম্বরণ করিল। জনমন্ডলীও ফুঁসিতেছে।

-কিসের ভাবীজান!  মোরে আপনি ভাবীজান কইতেছেন!! ছ্যা ছ্যা। আপনে আমাগো আজকে হইতে ভাবীজান না বইলা খানকিজান, মাগীজান সম্বোধন করলেই ভাল হয়।

হাওলা সরোষে কহিল।

– ঠেস দিয়া কথা বলবেন না! সহবত কইরা কথা বলেন।

-তুমি এই বেডির লগে কি ইজ্জত দিয়া কথা কও আব্বাস। মাগীর তেজ দেখছো। তুমি ডাকতেছো ভাবীজান; সে ডাকতে বলতেছে খানকিজান। বেডি একটা রান্ডি বেশরম আওরত। ও মোগো পুরা খান খান্দানের ইজ্জত লইয়া টান দেছে। খানের পুতেগো কইতেছে খানকির পুত। মুই উইডডা  ওর ঘাড়-ঘাড্ডি পেচাইয়া দুইডা থাপ্পড় মুহি দিমু নাহি। নইলে এইডারে কন্ট্রোল করতে পারবা না তুমি। ওর লগে ভদ্রতা মাড়াইয়া লাভ নাই।

আব্বাসকে উত্তেজিত করিবার জন্য মজেম যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে লাগিল। আব্বাস বরং মজেমকেই কঠিন চক্ষুর ইশারায় শান্ত হইবার জন্য কহিল।

-সালিশ তো আমি করতে আইছি মজেম ভাই। এখনও ফালাফালির মতন কিছু হয় নাই। মোহতারেমাদের আমি বিশেষ ইজ্জত করি। এইটাই ইসলামের বিধান।

-মোতারেমা! খিক খিক করিয়া হাসিয়া উঠিল তাজমহল বেগম। যে জেনানা এতক্ষণ গুম হইয়া ছিল; তার হঠাৎ এমন সশব্দ হাস্য; উপস্থিত সকলে চমকাইয়া গেল। বোরকার তলা হইলে এইরকম বিকট হাসি উৎসারিত হইতে পারে-তাহা কল্পনার অতীত। হাওলা বেগমও চমকাইয়া গেল। বলিল, মোতারেমা কি জিনিস বুবুজান। এইটা কি খানকি বেশ্যার চাইতেও কঠিন কোন গালি।

-না না। এইটা কোন গালি না ভাবীসাব। আরব দেশে নারীজাতিকে সম্মান-শ্রদ্ধা  কইরা মোহতারেমা বলে। অত্যন্ত ইজ্জতের শব্দ।

খিক খিক খিক। তাজুবিবির হাসি থামিবার কোন লক্ষণই নাই। বরং তা উৎকট হইতে লাগিল। হাসিয়া উঠিল হাওলা বিবিও। বলিল, বুঝছি, বুঝছি। যারে বাংলায় কয় খানকিবেডি; তারে  আরবরা কয় মোতারেমা বেডি। হি হি হি। আর বুঝাইয়া কওয়া লাগবে না।

তাজমহলও কনুই দিয়া  ঠেস দিল হাওলাকে। হাওলার কথায় সে বড়ই যেন চমৎকৃত হইয়াছে। জনমন্ডলী কিয়ৎকালের জন্য বেশ থমকাইয়া গেল। সম্মীলনীর মূল নজর আব্বাস হইতে সরিয়া গিয়া দুই আসামী আওরতের বাতচিত আর কর্মকাণ্ডের দিকে নিবদ্ধ হইল। বিশেষ করিয়া হাওলার বক্তব্য বড়ই কৌতুহলউদ্দীপক হইয়া উঠিল সকলের কাছে।  আব্বাসও অনুধাবন করিতে লাগিল- বল তাহার কোর্ট হইতে হাওলা কাড়িয়া লইয়া যাইতেছে। সে এইবার বলিল, আপনার মনে হয় পাখা গজাইয়াছে। পিপড়ার পাখা। যাই বলি না কেন, আপনি খানকি বেশ্যাগো দিকে টাইনা নিতেছেন। মজেম ভাই আপনারে খানকি বলছে- এইটা শুইনা  খুব আরাম লাগতাছে নাকি।  নেকাব্বর ভাই কোনখান দিয়া আপনারে তুইলা আনছে- আপনি কি জাত চেনাইতেছেন।

-শোনেন ভাই, জাত আমি চিনাই নাই। চিনাইছেন আপনারা। এখন মোতারেমা কইয়া গালি দেন, ইজ্জত দেন- কোন লাভ নাই। আসল কথা হইছে আমরা খানকি বেডি; এইটাই শেষ কথা।

-তা সেটা আপনি নিজের ব্যাপারে বলতেই পারেন। কোন বাধা নাই।

-খালি  নিজের ব্যাপারে কেন কমু; আবারও জোর গলায় সক্কলের ব্যাপারে কইতেছি। আর তোমরা যে খানকির পুত সেইটাও জোর গলায় কইতেছি। জোলা বাড়ি দিয়া কও; নমু মৌলানার বাড়ি দিয়া কও -আর তোমার শায়েস্তাবাদ দিয়া কও; যেখান দিয়াই যত বউবিবি আসছে, সব হইছে খানকি বেডি। এই বেডিগুলারে কাবিন মাড়াইয়া, দেনমোহর দিয়া বিবি বানাইয়া আনছো। তোমাগো কথায় নাচলে মোগো বিবি-বেগম  কইয়া সোহাগ করো- না নাচলেই মোরা খানকি হইয়া যাই। আরে এত বড় খান খান্দান তোমরা যে হইছো-তোমাগো পেডে ধরছে কেডা। এই খানকিরাই। কয়টা টাহা মোহর দিয়া, একটু সোনাদানা রুপা দিয়া মোগো কিইনা লইছো নাকি। ওই বেডা মোগো সোয়ামী নেকাব্বর-হে মোগো দুইজনরে কেনছে- এখন তার ধনদৌলতের লোভ দেখাইয়া তার পরম সোহাগী শালীডারেও কিনা আনতে চায়। যতই বেগম কইয়া সোহাগ করুক- মোরা বান্দি তো বান্দিই। সহজ কথাটা বোঝছো তো দেওরা ভাই।

– আহারে, এই বেডি তো কোথার কথা কোথায় লইয়া যায়।

 নিজেকে আর  সামলাইতে পারিল না আব্বাস। পটকা বিস্ফোরনের মত গর্জন করিয়া সে বলিল-তোর কথা অনেক শুনছি বেডি- আর একটা বাতচিত করবি তো তোরে এই কোলার মধ্যে পুইত্তা আইজ আমি রাইতে  ঘুমাইতে যামু।

অগ্নিমূর্তি ধারণ করিল সে।

-তুইতো বেডি একটা মহাহারামী। তোরে তো মুসলমানের  পয়দা বইল্লা আর মনে হইতেছে না। তুইতো একটা নাস্তিক। তুই তো কাফির হইয়া গেছো। তোরে যত বুঝাই; যতই শান্তির কথা কই- তুই ততই ফাল পারো। বেডি মানুষ; বেডি হইয়া থাক। তোর কাছে আমাগো কি আইজ ধর্ম কর্ম শিখতে হইবে নাকি।

আব্বাসের সহিংস চেহারা দেখিয়া হাওলা প্রাথমিকভাবে  একটু স্তিমিত হইলো। কিছুটা বিস্মিত হইয়া কহিল-বয়েসে ছোট দেওর হইয়া এই তুই তোকারি কি তুমি আমারে করলা হউরের পো। খুব তো শরীয়তি মারিফতি শান্তি শান্তি কইলা; খুব তো ধর্মের নেককার দ্বীনদার কথা কইলা-এহন তো তোমার কুম্ভীর চেহারা বাইরইছে। মনে হইতেছে কাচ্চা চাবাইয়া খাবা।

খাওলা হিসহিস করিয়া হাসিতেছে। অন্যদিকে তাজুবিবি বোরকার নীচে তীব্র ফনায় ফোসাইতেছে। সে “হউরের পো, হউরের পো” বলিয়া কেন যে জিকির করিয়া চলিল, তাহার রহস্য কেবল সেই বলিতে পারিবে। আব্বাসের কানে এই হউরের পো-সংক্রান্ত জিগির তীব্রভাবে বাজিতে লাগিল। সে কেদারা ছাড়িয়া দাড়াইয়া পড়িল।

-এই দুই বেডি তো দাজ্জালের বংশ। তোরা তো আবু জাহিলের বউ হিন্দার চাইতেও বড় খানকি। তোরা আমারে লইয়া জিকির করতেছস কেন। থামতে কইলাম কিন্তু । হাওলা বেডি যা কইলো, সে তো ইসলাম ধর্ম দিয়া খারিজ হইয়া গেল। কপালে কত্ত বড় একখান টিপ পরছে। শাড়ি যেমন পেচাইয়া পরছে -মনে হয় রান্ডিপাড়ার বারান্দায় বেড়াইতে আইছে।  আর নমু মৌলানার ঝিটার তো মনে হয় হিচকানি ওডছে। আর কোন কথা নাই। আর কোন বিচার নাই। এখন আমি ফাইনাল বিচার করমু। চোপ একদম খামোশ। সবাই মন দিয়া শোনেন। ওরে আকবইরা, ওরে মজাহেদ,তোগো অস্ত্রপাতি বাইর কর।  কোন বেডিরে আগে জবাই করবি বল; তোগোরে আইজ রাইতের জন্য  আমি হুকুম দিয়া যামু। খুনের দরিয়া বহাইয়া দিবি। কাইল দিনের বেলা সব সমস্যা আমি দেখমু। বেডি মানুষ হইয়া ওরা ধর্ম লইয়া কুকথা কইছে। ওগোরে আইজ জ্বেনার শাস্তি দিমু। ওগোরে আইজ ব্লাসেফেমীর শাস্তি দিমু। মজেম, আকবর, রশি টশি ল। বেডি দুইটারে আগে বান্ধ। কমজাত রমনী। এই ইবলিশের জাত বেডিগো পাল্লায় পইরাই আদম আলাইহিসসালাম গন্ধম খাইছিলেন।

আব্বাসের তর্জন গর্জন শুনিয়া পুরো সভা নীরব হইয়া পড়িল।  প্রকাশ্যে জবাই করিবার উক্তি আতঙ্কময়তার আবহ তৈরী করিতে বিশেষ সময় নিল না। মজেম ও আকবর- আব্বাস আলী খানের এই দুই সহকারী যে অকুস্থলে  দড়ি ও রামদা মওজুদ করিয়া রাখিয়াছিল- অমাবশ্যার রাত্রিতে  হ্যাজাক লাইটের আলোয় তাহা এতক্ষণ কাহারও দৃষ্টি গোচর হয় নাই।  এইবার হইলো। আকবর উঠিয়া দাড়াইয়াছে। রামদা খানা রুপালি আলোকে চিক চিক করিয়া উঠিল। সকলের মধ্যে শীতল দ্যোতনা তৈয়ার করিল।  এবার সকলের রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। কী হয়। সত্যিই দুই গন্ধম-রমনীকে জবাই করা হইবে কি!

পিন পতন নিস্তব্ধতা। আব্বাস কিছুক্ষণ কিছু আর বলিল না। দম গ্রহণ করিল। উত্তেজিত মস্তিষ্ককে আবার সুস্থির করিবার প্রয়াস নিল। মধ্যরাতের স্তব্ধতা তাহাকে আশ্বস্ত করিল। আকবর ও মজেম অগ্রসর হইতেছিল। আব্বাস তাহাদের হাত তুলিয়া থামাইল। পরিস্থিতি এক্ষণে অনুকুলে। প্রকৃত প্রস্তাবে তাজু ও হাওলাকে বান্ধিবার বা জবাই করিবার কোন অভিপ্রায় তাহার নাই। এইটা তাহার সালিশের একটি চুড়ান্ত ও অপ্রচলিত ঔষধ। যখন অবস্থা মাত্রাতিরিক্ত প্রতিকুল ও বৈরী হইয়া ওঠে- তখন সে এই পদ্ধতি এস্তেমাল করে। সচরাচর এই পদ্ধতি তাহাকে প্রয়োগ করিতে হয় না। তাহার মত হইলো, সালিশে শারিরীক একশন না করাই উত্তম। পরবর্তীতে পুলিশ আসে। থানা পুলিশ হয়। বড়ই পেরেশানি।

আব্বাস এইবার গলার কর্কশতা  কিঞ্চিৎ   হ্রাস করিয়া কহিল- আমাদের ধর্ম হইলো আখেরি দ্বীন। কমপ্লিট ফুলকোর্স কোড অব লাইফ। এই ধর্মে সর্বব্যবস্থা আছে। এইখানে কোন রক্তপাতের ইচ্ছা আমার নাই। কিন্তু বাধ্য করিলে আমি কিন্তু একটুও পিছপা হমু না। খাওলা আর তাজুরে আমি যদি অমাবশ্যার বিলে জবাই কইরা পুইতা রাখি-কোন কাকপক্ষীও প্রতিবাদ করবে না। এইটা প্রেসিডেন্ট বাড়ির কোলা। চাইলে আমি তা করতে পারি। ধর্মের বিধান রক্ষায় সব ধরনের ফতোয়াই আছে।  যদি মিষ্টি কথায় কাজ হয়- তবে মিঠে কথা বলো। আর যদি মিছরিতে কাজ না হয়- তখন হাত গুটাইয়া বইসা থাকতে বলে নাই। যদি কতলের দরকার পড়ে- তবে কতলের ফতোয়াও আছে। গলা কাইটা নামাইয়া দাও। হাতপা-রগ  কাইটা লুলা বানাইয়া দাও। দরকার হইলে ঢিলাইয়া পাথর-কঙ্কর মাইরা হত্যাও জায়েজ। আমাদের শরীফ ধর্ম হইছে-যেমন মাখনের মত নরম; তেমনি দরকারে পাষান পাথরের চাইতেও কঠোর।  আমি কিন্তু সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়াই আসছি। আমার মুখ মিষ্টি। কাম কিন্তু মিষ্টি না।   রাত গভীর হইছে। আইজ কোন রক্তপাত চাইতেছি না। যদিও হাওলাবিবি যে কুকর্ম করছে- তাতে তারে কঙ্কর মাইরা হত্যাও কম শাস্তি  হয়।

হাওলা বিবি কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত হইয়াছিল। রামদা দিয়া তাহাদের কোপাইয়া কতল করা হইবে-এমন কোন পূর্বধারনা নিয়া সে সালিশস্থলে আসে নাই। তাহা হইলে একখান দা সেও কোমরে লুকাইয়া আনিতে পারিত।   সোয়ামির নিকাহে বাধা প্রদানের শাস্তি কতল হইতে পারে-আকবর ও মজেমের প্লিহা চমকাইবার আয়োজন দর্শন করিবার আগে পর্যন্ত  সে তাই সমুপস্থিত বাস্তবতা বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। এবার সে সম্বিৎ ফেরত পাইলো। সে কহিতে ছাড়িল না- হউরের পো, যদি আমাগো কঙ্কর মারতে চাও-মাইররা দেহাও দেখি। গালিগালাজের কঙ্করে এতক্ষণ যেভাবে জর্জরিত করলা-সারা অঙ্গ জ্বইল্লা পুইড়া যাইতেছে। এবার যত খুশি ঢিলাও। দেখি-মাটির কঙ্করের বেদনা তোমাদের মুখের কঙ্করের চাইতে বেশী না কম যন্ত্রণার। এতক্ষণ মুখ দিয়া যেভাবে কোপাইলা-এখন রামদা দিয়া কোপাইলেও মনে হয় বেদনা পামু না।

হাওলার সবেদন উচ্চারণ এইবার তেমন আর কারো নজর আকর্ষন করিল  না। সবাই আব্বাসের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আব্বাসীয় নাটকীয়তা সকলের মধ্যে ঘোর তৈরী করিয়াছে। আব্বাস শীতল কন্ঠে বলিল- না ভাবীসাব, সে প্রয়োজন আর দেখি না। আমার সেই এরাদাও নাই। রাত গভীর হইছে। আইজকে ধর্মের বাহাস আর আপনার ব্লাসফেমীর বিচার করার ফুরসত নাই। ওই সমস্যা লইয়া আজকে বসিও নাই। আপনি অকারনে ওই সমস্যা তৈরী করছেন।ওই কেস আজকে মুলতবি।

তবে নেকাব্বর ভাইজানের নিকাহ নিয়া আমার ফয়সালা হইলো-তিনি খায়েশ যেটা করছেন, সেটাই হইবেই। তিনি জানাইছেন-তার বিবাহে আপনারা যদি বাধা দেন; তা হইলে তিনি আপনাদের তালাক দিয়া নতুন বিবাহ করিবেন। আপনাদের কাবিননামা আমি দেখছি। বলদামি যা করার আগেই কইরা রাখছেন। কেননা কাবিনের কাগজে  যেকোন সময় আপনাদের তালাক দেওয়ার ক্ষমতা স্বামীর হাতে দুই বিবিই তুইল্লা দেছেন। তাই কোন দলিলি সমস্যা দেখি না। তারপরও স্বামীর  চতুর্থ নিকায় যদি কারো আপত্তি থাকে-তবে তিনি মোহরানা টাকা পয়সা বুইঝা তালাক নিয়া বাপের বাড়ি চইলা যাইতে পারেন। সহজ সরল হিসাব।

আব্বাসের ফয়সালায় সকলে উল্লাস প্রকাশ করিয়া সমর্থন প্রকাশ করিল। প্রেসিডেন্টের পুত্র যেইভাবে চরম বিরোধপূর্ন পরিস্থিতিকে সামলাইয়া নিয়া মার্জিত ভাষায় রায় প্রকাশ করিল-তাহা প্রশংসিতও হইতে লাগিল। সবাই হ্যাজাকের আলোর মধ্যেই হাওলা ও তাজুবিবির প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করিতে চাহিল-অবাক হইয়া  দেখিল- হাওলা পূর্বাপর ভঙ্গিতে হাসিতেছে। তাজুবিবি বোরকার মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়াই অস্থির হইয়া নড়াচড়া করিতে লাগিল। আকবর হ্যাজাক লাইট উচা করিয়া হাওলার উপর ফেলিল। আলোতে হাস্য আরও প্রকট হইয়া উঠিল। মজেম তাহা দেখিয়া চেরা বাশের মত চিরচিরাইয়া উঠিল-দেখছো তো আব্বাস- বেডির তেজ একটুও কমে নাই। বেডি যে খান খান্দানের সক্কলডিরে খানকির পুত কইলো -তার বিচার কইরা তুমি কেদারাখান ছাড়বা। নইলে কিন্তু মোরা সবাই বুঝমু সত্যিই তুমি খানের সহীহ পুত্রসন্তান না।

আব্বাস তার ভ্রাতার আবদারখানা শুনিয়া এইবার হাসিল। বলিল- এইটার আবার কি বিচার। এইটার বিচার তো ভাবীজানেরা নিজেরাই করছে। আমি খালি তাদের কথার পূনরাবৃত্তি করতে পারি। হাওলাভাবীই তো হুকুম করছেন আমাকে- তাকে যেন ভাবীজান না বইলা খানকিজান কই। মুরুব্বি মানুষ। তার হুকুম আমি আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। আইজ থেকে তাগো দুজনকে সমাজে ওই নামেই ডাকা হইবে। হাওলার তেজ-খাউজানি বেশী। তাই সে হইল খাননি নম্বর এক। আর তাজুবিবির চুলকানি একটু কম বইলা মনে হইছে।  সে হইলো- খাননি নম্বর দুই। কী খুশি হইলেন সবাই। মজেম ভাই খুশি! তাদেরকে এই টাইটেল সকলের এবং তাদের সম্মতিতেই দিলাম । এইটাও ইসলামের বিধান। আমি ইসলামের ডেমোক্রেসিও রক্ষা করলাম।  এতেও যদি তারা সন্তুষ্ট না হয়-তাইলে তারা গিয়া বান্দরীপাড়ায় রান্ডিখানায় দাখিল হইতে পারে।

সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লা বলিয়া স্বাগত জানাইল।

রাত তখন কতটা গভীর হইয়াছে-ঘটনার ঘনঘটায় ও প্রহসনময়তায় কেউই খেয়াল করিয়া উঠিতে পারে নাই।  কিন্তু মাদবর বাড়ির মসজিদের মাইকে যখন উচ্চারিত হইলো-আসসালাতু খাইরুম মিনাল নাইয়ুম। আব্বাসের সম্বিৎ হইলো। কহিল- সালিশের মজমা দেখতে আইসা আমাগো মুয়াজ্জিন হালার পুতের আজানের টাইমও কি   খেয়াল হয় নাই। হালার পুতে কই। মরছে না টাট্টিখানায় ঢোকছে! মোগো খান মঞ্জিলের মসজিদে কি আজান হইবে না আইজ ।

অন্ধকারে ভীড়ের মধ্যে  শোরগোল তুলিয়া কেউ একজন পড়ি মরি দৌড়াইয়া নিকটস্থ মসজিদের পানে ছুটিয়া গেল। জনমন্ডলীর মধ্যে অবশ্য  ইহা নিয়া বিশেষ কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। খানবাড়ির মসজিদের চতুর্মুখী মাইকে  যখন কিশোর মুয়াজ্জিনের সুমধুর কন্ঠে আজান ধ্বনিত হইতেছিল-খানগোষ্ঠির কোলায় তখন শ্লোগান আর শ্লোগান ঢেউ খেলিয়া যাইতেছিল। আকবর চেঁচাইয়া শ্লোগান ধরিল- খাননি নম্বর এক। সবাই বলিল-হাওলা বিবি, হাওলা বিবি।

আকবর তৎপরে  শ্লোগান ধরিল- খাননি নম্বর দুই..

সবাই সমস্বরে বলিল-তাজমহল, তাজমহল।

 ব্যাপক উদ্দীপনা, প্রানপ্রবাহ সকলের মধ্যে তুমুল সঞ্জীবনীর সঞ্চার করিল।

দুই.

নারীত্ব, মাতৃত্ব কেবলই কি প্রহেলিকা! মোহরানা লইয়া কোন মর্দের বিবি-বধু হওয়া;রতিমর্দনকালে  সোয়ামীর আদর সোহাগ;হাবুডুবু আবেগের কালে  বেগম বলিয়া সম্বোধন-রান্না সুস্বাদপূর্ন হইলে অঢেল প্রশংসা; ব্যাবসা বানিজ্যে ফজিলত হইলে ঘরের লক্ষী বা বিবি খোদেজা বলিয়া সম্বোধন-তাহাও কি কুহেলিকা; এইসব গুরুগম্ভীর প্রশ্ন হাওলা বিবি ও তাজমহলকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল কিনা-বিস্তারিত বলিতে পারিব না। কিন্তু এই গল্প এইখানে শেষ হইয়া যায় নাই। গল্পের এই দুই স্ত্রীচরিত্রকে আমাদের আরও অনুসরণ করিতে হইবে। তাহারা স্বামীর ভিটায় ফিরিয়া গেল কিনা; যাইলেও কখন কিভাবে প্রত্যাবর্তন করিল-তাহা জানা অতীব প্রয়োজন। কেননা তাহাতে নারী চরিত্রের আরও কিছু দুর্লভ  দিক উদ্ভাসিত হইতে পারে। সেই প্রলোভন আমরা ত্যাগ করিব কেন!

পশ্চিমের কোলা শেষ রাত্রিরে বিরান হইয়া গেল। জনমনুুষ্য নাই। সঘন শ্যামলা বনানীর ফোকর হইতে সুবেহ সাদিকের আলোকমালা উজ্জ্বল হইতে লাগিল। রুপশ্রীর বনমালার অন্ধকার তাহাতে সবিশেষ যে কাটিল; বলা যাইবে না। কোলার ঠিক মধ্যখানে দুটি স্ত্রীমূর্তি স্থানুর মত দন্ডায়মান রহিয়াছে। নড়িতেছে না। চড়িতেছে না। আব্বাস আলী খান গং তাহাদের দড়ির কঠোর বন্ধনীতে  আবদ্ধ করিয়া যায় নাই। তাহারা সকলে চলিয়া গিয়াছে। হাওলা ও তাজুবিবি কোথাও যায় নাই। তাদের পদযুগল নিশ্চল। কোথায় যাইবে তারা। কোথা হইতেই বা  তারা এইখানে আসিয়াছে! এখন কোথায় তাহাদের পরবর্তী গন্তব্য-তার ফয়সলা সম্ভবত তারা করিয়া উঠিতে পারিতেছে না। এই দুই স্ত্রীপ্রজাতির প্রানীর  পরষ্পর প্রথম সাক্ষাৎ সতীন হিসাবেই। তাহার আগে কখনও তাহাদের মধ্যে কোন সম্বন্ধ ছিল না। প্রথম সাক্ষাতের অনতিকাল পর হইতেই তাহাদের সম্পর্ক অহি-নকুল বৈরীতায় রুপ নিয়াছিল। সেই মতনই চলিতেছিল। ভবিতব্যেও চলিবে বলিয়া ধারনা জোরদার ছিল। কখনওই মিত্রতা বা মিষ্টতার কোন ঘটনা ঘটে নাই। কিন্তু আজকে তাহাদের দুজনার অন্তরে বিচিত্র এক বিষাদ বেহাগ। তাহারা আজ পরষ্পর শুধু কাছেই আসে নাই। বলিতে গেলে একে অপরকে জড়াজড়ি করিয়া ধরিয়া রহিয়াছে। আব্বাস গং দৃশ্যত তাদেরকে না বান্ধিলেও তাহারা অদৃশ্য এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাধা পড়িয়াছে। একপর্যায়ে তারা মাটিতে বসিয়া পড়িয়াছে বটে-কিন্তু পরষ্পরের হাত-বন্ধনী টুটে নাই। মহাপৃথিবীর তলভাগ হইতে সূর্যকিরন আরও প্রবল হইতে লাগিল; যখন তাহা অন্ধকারকে গ্রাস করিয়া আলোয় ভরিয়া দিবার উপক্রম করিল-তাজুবিবি তখন বলিল-বেইন হইতেছে। কোথাও গর্তেও মইধ্যে না হান্দলে তো মোগো খানকি মুখ সবাই দেইখা ফালাইবে। মোরা এখন আর কারো বউ নাই, বিবি নাই-মোরা সকলের জন্য খানকি বেডি হইয়া গেছি রে। আব্বাইসসা হউরের পুতে মোগো এইরকম বেইজ্জত করবে, মুই  এক্কেবারে ভাবি নাই। ওড। কোথাও গিয়া হান্দি।

বলিয়া তাজমহল অবিরাম কাঁদিতে লাগিল। সে ফুপাইতেছে না। কোন শব্দও করিতেছে না। কিন্তু তাহার চক্ষুযুগল হইতে নিরবচ্ছিন্ন জল গড়াইতে লাগিল। হাওলাবিবির অবশ্য এইরকম রোরুদ্যমান প্রতিক্রিয়া নাই। কোন কথাও সে বলিতেছে না। তাহার কপাল হইতে টিপখানা খসিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছিল-সে কেবল সেটি যথাস্থানে কপালের মধ্য বরাবর চাপিয়াচুপিয়া স্থায়ী করিল। টিপখানা যেন কোন অবস্থাতেই স্থানচ্যুত হইতে না পারে। তাজমহল উঠিল। তাহার হাত ধরিয়া হাওলাও সঙ্গে সঙ্গে চলিল। একসময় উভয়েই আবিষ্কার করিল, তাহারা নেকাব্বর মুদির খানকাশরীফে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। দোতলা দরদালান।  উপরে টিনের ছাউনি দেয়া খানকা। নীচতলায় পাকখানার কোনায় তাজুবিবির থাকিবার কক্ষ। এই কক্ষে কখনওই হাওলা প্রবেশ করে নাই। আজ সম্ভবত নিজের অজান্তেই তাজুর হাত ধরিয়া ঢুকিয়া পড়িল। অত:পর, নতুন কোন অচিন স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে-এমন বেকুব কৌতুহলী চিত্তে চারিদিকে তাকাইতে লাগিল। ঘরখানা

গুম-অন্তর্ধানের জন্য বড়ই উপযুক্ত। দুইখানা জানালা আছে বটে। কিন্তু তাহাতে মোটা কালো কাপড়ের পর্দা টানাইয়া রাখিয়াছে তাজুবিবি। হাওলাবিবির এই প্রথম অন্তর হইতে অনুধাবন হইলো-নমু মৌলানা পিতার অসিহত মানিয়া পর্দাপুশিদা সংরক্ষণ সত্যিই সুকঠিন বটে। তাজুবিবি কালো বোরকা তো পরিধান করেই-তদুপরি কক্ষখানায় কৃষ্ণপর্দার এস্তেমাল ঘরটিকে রীতিমত অলঙ্ঘনীয় কবরখানায় পরিনত করিয়াছে।

তাজুবিবি যেমন চক্ষুর জল ঝরাইতেছে- তেমনি নিজে নিজে প্রচুর বাক্যালাপও করিয়া যাইতেছে। হাওলাকে প্রশ্ন করিতেছে বটে, কোন জওয়াব মিলিতেছে না। হাওলাকে যেমন জিজ্ঞাসা করিল-বুইন, এরপর তুই কি করবি! মাইনষেরে মোরা মুখ দেখামু কেমনে! ঘাটলায় যাওন লাগবে না! কলখানায় যাওন লাগবে না! যামু আনে কেমনে! ও বুইন কথা কস না কেন। নেকাব্বর মুদির খানকায় কি মোগো ভাত বন্ধ হইয়া গেল। নেকাব্বর মুদি মোগো লগে আর সহবত সংসর্গ করবে রে! কীরে বুইন, তুই কি বোবা হইয়া গেলি। মুখের মধ্যে তালা দেছো নাকি! জিহবায় সুই ফুডাইছো নাহি!

কোন জওয়াব দেয় না হাওলা। তার ফরসা বদন তীব্রভাবে রক্তশূন্য ফ্যাকাশে বলিয়া পরিলক্ষিত হইতে লাগিল। তাহার জবান যে ভয়ডরশূন্য, তাহা আর ব্যখ্যার আবশ্যক নাই। কিন্তু এখন তার মস্তিষ্কও ক্রমশ চিন্তাশূন্য হইয়া পড়িতেছে। তাহার চিত্তমধ্যে বারংবারই প্রবল বিক্ষোভ জমাট বাধিয়া উঠিতেছে-বলাই বাহুল্য। মনের পর্দায় বিচিত্র সব ভাবনাও উপস্থিত হইতেছে। হাওলা সেইসবের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করিতে লাগিল।

তাজুবিবির কবর-কক্ষের স্বস্তিদায়ক ফজিলত হইলো এই যে- বাইরের দুনিয়ায় কি আলো ফুটিয়াছে; দুন্নইজাহান কি জাগ্রত হইয়াছে-তাহা কিছুই অনুধাবনের কোন ফুরসত নাই। সময় এইখানে স্থির। সর্বদাই গভীর রাত্রির সুষমা বাসিন্দাদের আচ্ছন্ন করিয়া রাখিতেছে। এর মধ্যে দুইচাইর বার হাওলার গর্ভজাত কন্যারা দরজায় করাঘাত করিয়া গিয়াছে। আম্মা আম্মা বলিয়া আকুলি-ব্যাকুলি করিয়াও গেল।  আম্মা বেইন হইছে; আম্মা দুফুর হইছে; আম্মা, বড় আফায় মুরগের গোস্ত রানছে-তরকারির মধ্যে বেশী আলু দেছে; তুমি আর মেঝ আম্মায় কি আইজ না খাইয়াই থাকবা-ইত্যাদি কথা সুর করিয়া বলিয়া যাইতেছে কন্যারা। হাওলা সেসবের কোন জবাব দিবার প্রয়োজন বোধ করে নাই। দেয়ও নাই। তাহার কন্ঠে কোন আওয়াজ নাই। একসময় মেঝকন্যা সামিনা আসিয়া ফিসফিসাইয়া কহিল- আম্মা , আব্বায় খুব খারাপ কথা বলতেছে। হে আমাগো কইছে-তুমি যদি জলাবাড়ি তোমার বাপের বাড়িতে চলিয়াও যাও- মোরা যেন ভুলে তোমার লগে পাও লম্বা না দেই। পাও লম্বা দেলে মোগো ঠেং নাকি কাইট্টা ফালাইবে। ও আম্মা, তুমি এই বাড়িতে না থাকলে মোরা চাইরবোনও কিন্তু মুদির হারাম  খানকায় থাকমু না। মোরাও তোমার লগে যামু।

এইসব কথা বলিতে বলিতে সামিনা হাপুস হুপুস নয়নে কাদিতে লাগিল। আর দরজার উপরে মৃদুভাবে মাথা ঠোকরাইয়া মায়ের দুর্গতির প্রতি তাহাদের সংহতি প্রকাশ করিতে লাগিল।

সামিনার কথা শুনিয়া তাজুবিবিও কাদিতে লাগিল। তাহার কান্নার বিষয়বস্তু অবশ্য আলাদা। তাজু কথা বলিতেছে এতই নিচুস্বরে যে- কেবল নিকটবর্তী হাওলাই তা শুনিতে পায়। সে আহাজারি করিল- ও বুইন, তুই নাইলে বাপের বাড়ি যাবি- মুই যাইয়া উডমু কই। মুই কি এই মুদি খানকায় খানকি হইয়াই থাকমু। ওরে  মোর আল্লা, কির  লাইগা যে আব্বাইসসা হউরের লগে মুখে মুখে কতা কইতে গেলাম। ও বুইন, তোর বিয়া তো মুই মানছি- আরেকটা নিকা মাইন্না নিলে মোর তো বড় অসুবিধা হইতো না। মুদির হালি না হয় মোরে দাসী বান্দি কইরাই রাখত- কিন্তু এহন তো খানকি হইয়া এইবাড়িতে থাকতে হইবে।

ও বুইন, ও হতীন, ও জোলা মারানির ঝি- কথা কস না কেন। মোর তো যাওনের কোন জায়গা নাই। বাপের বাড়ি তো মোর কেউ নাই। ভাই যেটা ছিল-হেডায় তো সৌদী আরব গিয়া ওডছে। মোর এই ঘর ছাড়লে বুইন, হয় সৌদী আরব  নয়তো বান্দরী পাড়ার রান্ডিপাড়ায় গিয়া ঘর লইতে হইবে। মোর যেরকম কালা কুচকুইচ্চা চেহারা; মোর ঘরে কি মর্দা পোলা আইবে।

তাজমহল বিবি কপাল চাপড়াইতে লাগিল। বুইনরে বুইন, মোরে কি অপমান অসম্মানডা করলো। মোর কালা কোলা গায়ের রং লইয়া কি তামাশাডাই করলো। ও বুইন, মুই কি যাইয়া মাটির তলে ঢুকমু। তুই যাওনের আগে মোরে একটা কবর খুড়াইয়া দিয়া যাইস। মুই কবরে গিয়াই থাকমু। ও বুইন, খানকি বেডি গো নাকি কবর দেওয়া হয় না! হেগুলারে নাকি চিতায় তুইল্লা আগুনে পোড়াইয়া জ্বালান হয়। মোগোও কি সেই দশা হইবে। এই খান খান্দানের খানকায় থাকলে মোগো তো কবরের বন্দোবস্ত হইবে না।

ওরে মোর আল্লা, শেষ পর্যন্ত মৌলানার মাইয়া হইয়াও কবরের মাটিও কি পামু না।

নাকিকন্ঠে কাঁদিতে কাঁদিতে তাজমহল আহাজারি করিয়া চলিয়াছে। কখনও মরণের ভয়, মরণের পরের দশা, কবর না হইবার আশঙ্কা-আতঙ্ক তাহাকে তাড়াইয়া বেড়াইতে লাগিল। সে অনেকখানি বেদিশা হইয়াও পড়িল।   হাওলার কন্যাকুল বার বার মায়ের খোঁজ খবর লইতে আসায় তাজুবিবি অন্য এক মনোসঙ্কটের মধ্যেও পতিত হইল।

  -ওরে বুইন, পেডের মধ্যে গর্ভে ধরা সন্তান আর বুকে ধরা সন্তান মনে হইতেছে এক না। তোর মাইয়ারা দেখ, কতবার তোর জন্য আসতেছে। কানতেছে। তুই খাইছোস কিনা, তোর জন্য রান্নাবান্না কইরা ডাকাডাকি করতেছে। মোর দুই পোলায় কই! আসলাম, কালাম গেলো কোথায়! মায়েরে সমাজে খানকি সম্মান দেছে দেইখা খালাম্মার বাড়ি যাইয়া ওডছে নাকি! এই দুইডারে মুই তো লেদা অবস্থা দিয়া বড় করলাম। গর্ভে না হয় ধরি নাই। মোর নিজের মরা পোলার স্তন্যের দুধ তো দুই হারামখোররে খাওয়াইছি। মোর স্তন্যের দুধ দুই সর্পের বাচ্চা টাইন্না শুইষ্যা খাইছে। কই,মায়ের চরম দুর্গতির দিনে হারামজাদা দুইডা কই। ওরা তো মর্দা পোলা। হেরা যদি বুক চিতাইয়া কয়- মোগো স্তন্যদায়িনী মায়ে ঘরে থাকতে বাপরে আরেকটা নিকা করতে দিমু না। ওই নেকাব্বর মুদী কেন, আব্বাইসসার গোষ্ঠির কোন সাধ্য আছে নতুন আরেকটা খানকি ঘরে আনে। হিহি! হাতে দেনমোহরের নীলা একটা কাগজ ধরাইয়া দুই দিন ঘরে তুইল্লা সোহাগ; তারপর খানকি কইয়া বিদায়। হি হি হি।

তাজুবিবি ক্রন্দন স্থগিত রাখিয়া এবার হাসিয়া উঠিল। তার হাসির  আওয়াজ অদ্ভুত শোনাইতে লাগিল। মনে হইলো ঘরের মধ্যে চুহা প্রবেশ করিয়াছে। সেই প্রাণীটি হিস হিস শব্দ করিয়া এমাথা ওমাথা করিতেছে। বুইনরে ,আসলাইম্মা আর কালাইম্মা যদি মোর গর্ভের সন্তান হইতো ; তাইলে এই অসম্মান তারা ঠেকাইতো না! তাজু এবার কাদিতেছে।

এই ক্রন্দন, এই হাস্য-এইভাবে সে তার মনের ভাব প্রকাশ করিয়া চলিল। কখনও ক্যানক্যানানো কন্ঠে গান গাইতেও প্রয়াস চালাইল।

মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোষ বানাইলেও ঋণ শেষ হবে না মাগো। ই ই হি হি হি।

সমগ্র দিন ধরিয়া দুই নারী কোন খাদ্যগ্রহণ করিল না। জলও স্পর্শ করিল না। সন্ধ্যা হইল। রাত গড়াইল। তাহারা অন্ধকার কবর কক্ষে পৃথিবীর সকল আলো, সকল পার্থিব সুবিধাদি হইতে নিজেদের বঞ্চিত রাখিয়া গুম-গুপ্ত হইয়া থাকিল।

অবিশ্রান্ত ক্রন্দন-হাস্য শব্দ-সঙ্গীত করিয়া তাজুবিবি ক্রমশ দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার চক্ষুযুগল মুদিয়া আসিয়াছিল। হঠাৎ সে বিচ্ছিন্ন টুটাফাটা নিদ্রা ত্যাগ করিয়া হাতড়াইতে লাগিল। তাহার হাত কিছুর সন্ধান করিতেছে। পাইল না। হাওলা বিবি কি তাহা হইলে তাহার পার্শ্বে আর নাই। সেকি তার সান্নিধ্য ছিন্ন করিয়া তাহার নিজের কক্ষে কন্যাদের সকাশে উপস্থিত হইয়াছে। সে কি এখন কন্যাদের রান্না করা সুস্বাদু খাদ্য চুপি চুপি ভক্ষন করিতেছে। হি হি হি। এই মিছা মায়ার জগৎ বড়ই বেঈমান। তাজমহল বিবির মত দুর্ভাগ্যবতী আর বুঝি জগতে-সংসারে নাই। খোদা তাকে কদর্য কুরুপা পাতিলের কালি করিয়া দুন্নইতে পাঠাইয়াছে। জন্মদাতা পিতাও তার সঙ্গে নির্মম মশকরা করিতে পিঠটান দেয় নাই। মওলানা শখ করিয়া তার নাম দিয়াছে তাজমহল। হি হি হি। একটি গর্ভ তাহার হইয়াছিল বটে। কিন্তু প্রসব করিল মৃত পুত্র। সন্তানের মাতা হইবার ভাগ্যও তার হইলো না। দুগ্ধমাতা-বান্দিমাতা হিসাবে সে তার সকল মাতৃশ্রম ও স্নেহ যাহাদের সেবায় ঢালিয়া  দিয়া  ডাঙ্গর করিয়া তুলিল; সবই পণ্ডশ্রম। তাহারা এখন আপন খালাম্মাকে আম্মা করিয়া আনিবার উৎসব  আয়োজনে ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া উঠিয়াছে।

এই জীবন রাখিয়া কী হইবে!

এই নারী জন্মের মূল্য কি।

এই স্তন্যদানের কয় পয়সা দাম। এই ব্যর্থ মাতৃত্ব তাজুবিবি কোন তোরঙ্গে তুলিয়া সঙ্গোপন করিয়া রাখিবে!

হি হি হি হি।

তাজু একবার হাসিতেছে। আবার কিয়ৎকাল পরে কাঁদিতেছে। সে কিছুতেই তার জীবন একাঙ্কিকার হিসাব কুলাইয়া উঠিতে পারিল না।

তিন.

মধ্যরাত। রুপশ্রী গ্রাম, শতদলশ্রী, ভিমরুলীর উজান-সর্বদিকে ঘুরঘুট্টি নিঝুম নির্ঘুম আন্ধার। মায়াবতী সংসারের সকল মায়ার বন্ধন ছিন্ন করিয়া, সকল লোভ-মোহ মোক্ষ ত্যাগ করিয়া নিকষ অন্ধকারের নেকাব-বন্ধনীকে আশ্রয় করিয়া হাওলা বিবি এক কাপড়ে মুদির খান্দানি খানকা  হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে। ফিরিবার সকল পথ স্তব্ধ করিয়া সম্মুখের পানে সে অগ্রসর হইতেছে। কন্যাদের কাউকেই সে কিছু বলে নাই। তাজমহল বিবিকেও  সফরসঙ্গী করিয়া আনে নাই। কোথায় যাইবে; কী করিবে-গন্তব্য তাহার জানা নাই। তাজুবুবুর কবর কক্ষে যতক্ষন সে অবস্থান করিয়াছিল-তার চক্ষু যুগল ছিল শুষ্ক খটখটে। জল আসে নাই। কিন্তু এক্ষনে তার চক্ষু অনিরুদ্ধ জলধারায় ভিজিয়া উঠিতেছে।

হাওলা এক কদম অগ্রসর হইতেছে। পশ্চাতে তার কন্যারা আকুল ব্যাকুল হইয়া ক্রন্দন করিতেছে। আম্মা, ও আম্মা, একমুঠ ভাতও কি মুখে দিবা না। আম্মা, না খাইলে কি চলবে। মোগো আম্মা, কেডায় দেখবে!

হাওলা বিবি তবুও আরেক কদম অগ্রসর হইলো। মেঝকন্যা সামিনা আসিয়া তার পা ধরিয়া সিজদায় পড়িল। আম্মাগো, মোগো রসুলে না কইছে-আল্লার পরে সিজদা দেওনের শরীয়তি ফরমান যদি হইতো-সে হইতো মায়। সেই মাতা হইয়া মোগো এই জাহান্নামের মধ্যে রাইখা তুমি কই যাও। মোগো কি এইখানে পোড়াইয়া মারার জন্য রাইখা গেলা আম্মা।

হাওলা অনেক কষ্টে পদযুগল ছাড়াইল। কদমের পর কদম ফেলিয়া অনেক কষ্টে অগ্রসর হইতে লাগিল। তার পা পাথরের চাইতেও ভারী হইয়া উঠিয়াছে।  পশ্চাতে ক্রন্দন করিতে করিতে তার কন্যার ছুটিয়া আসিতেছে। তাহাদের ক্রন্দন-ধ্বনি আকাশ বাতাস কাপাইয়া তুলিতেছে। হাওলা ভ্রুক্ষেপ করিল না।

সে পশ্চাতে তাকাইল না।

হাওলা কপর্দকও সঙ্গে করিয়া আনে নাই। নেকাব্বর মুদির কাছে হইতে  তার দেনমোহরের কোন অর্থই আদায় করা হয় নাই। সর্বস্বই তাহার কাছে গচ্ছিত রহিয়াছে।

হাওলা কি ভুল করিল। অনির্দিষ্ট পথে পা ফেলিবার আগে মোহরানা আদায় করিয়া নিলে বিপদকালে তা পাথেয় হইতে পারিত।

কিসের দেন মোহর।  ভরমজলিসে পুরা খান-খান্দান তাহাকে খানকি বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছে। হাওলার তীক্ষ্ণ ফনা হিস হিস করিয়া উঠিল।

খানকিগিরির ওই দেনমোহর তার দরকার নেই। ওই দেনমোহরে সে থু থু নিক্ষেপ করে।

ও হাওলা তুই কোথায় যাইতেছিস। কোথায় তোর গন্তব্য। তুই কি জোলাপাড়ায় তোর বাপ ভাইদের ভিটায় ফিরিয়া যাইতেছিস। সেইখানে কি তোর স্থান সংকুলান হইবে। খান খান্দানে তোর নিকাহ হইয়াছিল। নেকাব্বর মুদি তোর অঢেল রুপযৌবন সোনা রুপা আর মোহরের দাম চুকাইয়া কিনিয়া লইয়াছে-তারপর কত দিন গড়াইয়াছে।  ভাতৃবধুদের সঙ্গে কত দৌলতপনা দেখাইয়াছিস। তোর সেই রুপের দৌলত আজ গেল কই। তুই কি এই চন্দ্রবদন লইয়া ভাতৃবধূদের সকাশে দাঁড়াইতে পারবি। তোর মৃত বাপের ভিটা বলিয়াও আর কিছু অবশিষ্ট নাই। সব ভাইরা লুটিয়াপুটিয়া বিক্রিবাটা করিয়া দিয়াছে।

ও হাওলা, কোন সাকিন-উদ্দেশের সন্ধানে তুই কদম বাড়াইয়াছিস!

হাঁটিতে হাঁটিতে জম্বুদ্বীপ খাল-সাঁকো  অতিক্রম করিয়াছে সে। হাতের ডান দিকে উত্তরে জোলা পাড়া। কী মনোরম খাল ও নদীর সঙ্গম। কী অপরুপ সবুজের সমারোহ। শিমুল পলাশ অর্জুন আর কদম্ব গাছে কী অপরুপ ফুল ফুটিয়াছে। জোলাবাড়ি দরিদ্র গ্রাম। কিন্তু শ্যামল সবুজের মায়াচ্ছবি কি অনঙ্গ আলিঙ্গন করিয়া গ্রামটিকে  আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছে-সকল দু:খকষ্ট কালিমা তাহাতে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে।

হাওলার চারিপাশে রাশি রাশি অন্ধকার পেজা তুলার মত ভাসিয়া বেড়াইলেও উত্তরের সরু রাস্তায় সে অপরুপ ছবিগুলো চলচ্ছবির মত পরিষ্কার দর্শন করিতেছে।

হাওলা সেই চিরচেনা উত্তরাপথের পানে তাকাইয়া একমুখ বিষন্ন হাসিল। দক্ষিনে আরেকখানা রাস্তা অন্ধকারের বুক চিরিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। সে কদম চালাইল দক্ষিণে। এই পথ নিরুদ্দেশে অগ্রসর হইয়াছে। তীব্র অন্ধকারের মধ্যে সেই পথে অজস্র জোনাকী পোকা জ্বলিতেছে; নিভিতেছে। জোনাকীর আশ্চর্য আলো সম্ভবত হাওলাকে আকর্ষন করিল।

কয়েক লক্ষকোটি আলোকবর্ষ দূর  হইতে এক তারকামন্ডল তীব্র অমাবশ্যার রাত্রিতেও মহাপৃথিবীর সর্বদক্ষিনের এক বনময় জলময় জনপদে সবুজ-অন্ধকারকে ভেদ করিয়া অবিশ্রান্তধারায় কিরণবর্ষণ করিয়া চলিয়াছে। সেই আলো আসিয়া হাওলার কপালের লাল টিপখানিকে স্বর্গসম্ভব উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছে। কপর্দকশূন্য হাওলা সুদূর নক্ষত্রের কিরণের দিশা অনুসরণ করিয়া কদম বাড়াইল। আর থামিল না।

খানদের খানকায় গম্ভীর রাত্রিতে মহাশোরগোল। নেকাব্বরের কন্যারা মায়ের সন্ধানে আবার যখন আসিল, তাজমহল বিবির তখন আর জানিতে বিলম্ব হইলো না-হাওলা নাই; সর্বত্যাগ করিয়া সে উম্মুক্ত হইয়াছে।

তাজমহলও আর বিলম্ব করিল না। নক্ষত্রের আলোর সন্ধান তাহারও চাই। সেও চক্ষু মেলিয়া দেখিতে চাহে মহাপৃথিবীর সকল সুন্দর। সেও তাকাইতে চাহে মহাঅম্বরের পানে। যাইবার কালে হাওলা তাহার চিত্তে কোন মন্ত্রসিদ্ধ বান প্রবেশ করাইয়া গেছে কিনা জানা যায় নাই। কিন্তু তাজমহলও উজ্জীবীত হইয়া উঠিল। হাওলাকে সে কিছুতেই জিতিবে দিবে না। অর্ধেকজীবন দুই সতীন ঝগড়াবিবাদ করিয়াই কাটাইয়াছে। এখন হাওলা তাকে হারাইয়া দিবে- তাহা হয় না।

তাজমহল উঠিয়া দাঁড়াইল। ক্রন্দন থামাইল। হাসি সম্বরণ করিল। কৃষ্ণ-গহ্বর হইতে তাহাকেও মুক্তি পাইতে হইবে। কবরের অন্ধকারে সে আর থাকিবে না।  জানালার পাশে গিয়া দাড়াইল। ভারী কৃষ্ণপর্দা টানিয়া খুলিল। দরজার পাশে গিয়া দাড়াইল। কৃষ্ণ-নেকাব টানিয়া খুলিল। অত:পর শরীরের সকল শক্তি প্রয়োগ করিয়া পরণের কালো বোরকা খুলিয়া ফেলিল। মুখমণ্ডল হইতেও জালি-পর্দা হটাইয়া দিল। সর্বশক্তি দিয়া ছিন্ন ভিন্ন করিল। কাঁচি আনিয়া কাটিয়া কুটি কুটি করিল।

তাহার গাত্রবর্ণ কালো- কী হইয়াছে।

তাহার রূপ পাতিলের মতন কালো- কী হইয়াছে।

সকল বন্ধন, সকল অবগুণ্ঠন- বোরকার অতলান্ত অন্ধকার ভেদ  করিয়া তাজমহল আপন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করিল।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত