Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,monday special gitoranga pakha kahani

ইরাবতী লোকসংস্কৃতি: পাখা কাহিনী । রানা চক্রবর্তী

Reading Time: 9 minutes
হাতপাখা অতি প্রাচীন কারুশিল্প। ঠিক কোন সময়ে মানুষ পাখার ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে তার কোন ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে অতি গরমে বাতাসকে চলমান করে, গরম হাওয়া সরিয়ে অপেক্ষাকৃত শীতল হাওয়া প্রবাহের জন্য হাতপাখার ব্যবহার শুরু হয় বলে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা মনে করেন। পরবর্তী সময়ে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় হাতপাখা একটি অলঙ্কারিত শিল্পে রূপ লাভ করেছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত নানাভাবে পাখার ব্যবহার চলছে। উষ্ণ আবহাওয়ায় সর্বজনীনভাবে পাখা ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে আজও ধর্মীয় ও রাজকীয় অনুষ্ঠানে অলঙ্কৃত হাতপাখার ব্যবহার প্রচলন রয়েছে। ভারতবর্ষ, চীন, জাপানসহ প্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও পাখার ব্যবহার ছিল। প্রাচীনকালে মধ্যপ্রাচ্যের পশুর চামড়ার তৈরি অলঙ্কৃত অনেক পাখার সন্ধান পাওয়া গেছে। সে সময় চামড়াতে এম্বুস এবং বাটিকের মতো নকশা করে পাখা বানানো হতো। এর হাতলে কখনও গাছের ডালের অংশ অথবা পশুর হাড় ব্যবহার হতো।
একসময় নানা আচার উৎসব এবং সমাজের গণ্যমান্য ও উচ্চবিত্ত মানুষদের মেলামেশার অনুষ্ঠানে বিশেষত বিত্তবান মহিলাদের হাতে শোভা পেত অনন্যসুন্দর নানা ধরনের হাতপাখা। হাতপাখার বিবর্তনের ইতিহাস আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে। এমনকি গ্রিক রোমানদের যুগেও এই হাতপাখার প্রচলন ছিল। প্রথম দিকটায় পাখাগুলো ছিল একটা সম্পূর্ণ অংশ। ভাঁজ বা ফোল্ডিং পাখা এসেছে আরো অনেক পরে। ইউরোপীয় বণিকরা প্রথম এই ধরনের পাখা নিয়ে আসে চীন ও জাপান থেকে। তখন এসব পাখা বেশ দুর্মূল্যই ছিল। এগুলোতে ব্যবহার করা হতো মণিমুক্তো ও হাতির দাঁত। সোনা-রুপোর পাত বসানো হাতপাখাগুলোয় নিপুণ হাতে শিল্পীরা আঁকতেন সেই সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক চেতনা কিংবা ধর্মীয় নানা কাহিনী, ফুল লতাপাতাসহ সমসাময়িক নানান বিষয়াবলী। আঠারো শতকের গোড়া থেকে ইউরোপে হাতপাখা তৈরি শুরু হয়। তবুও চীন থেকে আসা পাখার আবেদন তখনও ছিল তুঙ্গে।
প্রাচীন যুগে রাজ সিংহাসনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে ভারতে চামরের আত্মপ্রকাশ। রাজঅঙ্গে হাল্কা বাতাস বইয়ে দেওয়াই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। শুধু ভারতই বা কেন, মধ্যপ্রাচ্যের সুলতানদের দরবারেও শোভা পেত নানান কিসিমের চামর। হিন্দুদের পুজোআচ্চাতেও তার বহুল ব্যবহার বহাল রয়েছে। আর মুসলিম পরম্পরায় মুশকিল আসানের হাতে চামর দোলানোর দৃশ্য বহুজনের শৈশব স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। এখনও পথে-ঘাটে ক্কচিত্ কালো জোব্বা আর তসবি গলায় দরবেশদের চামর হাতে চোখে পড়ে। ১৯৫৭ সালের ২৫শে জুন পলাশীর আমবাগানে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার ফৌজকে দুরমুশ করে বাংলার সিংহাসন দখল করল কোম্পানি বাহাদুর। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরে ১৮৫৮ সালে ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট পাশ হলে কোম্পানির সম্পত্তি থেকে সরাসরি ব্রিটিশ উপনিবেশের লেবেল সাঁটল ভারতের কপালে।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে দলে দলে ইংরেজ তরুণ এদেশে পাড়ি দিতে শুরু করেন। নিছক চাকরি নয়, সেই সঙ্গে বেনামে ব্যবসা করে কাঁচাটাকা কামানো আর তাই দিয়ে আয়েশ-আরাম করার স্বপ্নে মশগুল হয়ে ভারতমুখো জাহাজে সওয়ারি হতেন তাঁরা। কিন্তু জন্ম থেকে ব্রিটেনের ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় অভ্যস্ত প্রাণ এদেশের দাপুটে গ্রীষ্মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হামেশা নাকাল হতো। হাঁসফাঁস গরম থেকে রেহাই পেতে জানলা-দরজায় টাটি অথবা খসখসের পর্দা বা চিক টাঙিয়ে চার বেলা যেমন জল ছিটানো হতো, তেমনই তালপাতার বড় বড় পাখা নিয়ে বারান্দা বা দাওয়ায় মোতায়েন থাকত পাঙ্খাওয়ালারা। সেই সমস্ত পাখার হাতল ছিল প্রায় তিন-চার ফিট লম্বা। মাটিতে ভর দিয়ে তাকে খাড়া করা হতো। পাখার বেড়ে মখমলের ঝালর বসানো থাকত। সাহেবের কুর্সির পাশে দাঁড়িয়ে সেই পাখা দুলিয়ে বাতাস করত তালিমপ্রাপ্ত নফর। শুধুমাত্র তালগাছের পাতাই নয়, বাঁশের কঞ্চি, বাকল, ঘাস, বিভিন্ন রকম কাপড় এমনকি চামড়ার তৈরি পাখা ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার নানান দেশে ব্যবহার করা হতো। হাটুরে থেকে জমিদার, বামুনঠাকুর থেকে গাড়োয়ান- প্যাচপেচে গরমে প্রাণ জুড়োতে হাতপাখার বিকল্প ছিল না। ইতিহাস বলে, ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাখার প্রচলন হয়। মধ্যযুগে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা চালু ছিল।
হাতপাখার সাহায্যে যতটা হাওয়া বওয়ানো যায়, তার চেয়ে বড় জায়গা ঠান্ডা রাখতে ভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োজন দেখা দিল। ইতিহাস বলছে, অষ্টম শতকে আরবে দড়িতে টানা পাখা ব্যবহার করা হতো। ভারতে তার আবির্ভাব হয় ইওরোপীয়দের হাত ধরে। প্রচলিত মতে, গুমোট আবহাওয়ায় অনেকটা জায়গা জুড়ে হাওয়া খাওয়ার এই অভিনব কৌশল এদেশে প্রথম চালু করে পর্তুগিজরা। পরে তা অনুসরণ করে ইংরেজ। ঐতিহাসিক এইচ ই বাস্টিড তাঁর “Echoes From Old Calcutta” (১৯০৮) গ্রন্থে লিখেছেন, কলকাতায় টানা পাখার আবির্ভাব হয় ১৭৮৪ থেকে ১৭৯০ সালের মধ্যে। ১৭৮৩-৮৪ সালে জনৈকা সোফিয়া গোল্ডবর্নের চিঠিতে ভারতীয় পাখার উল্লেখ পাওয়া যায় বলে তিনি জানিয়েছেন। গোল্ডবর্ন দু’রকম পাখার কথা লিখেছিলেন। তালপাতার হাতপাখা ছাড়া দড়িতে টানা আর এক ধরণের পাখার কথা তিনি লিখেছেন, যা সাহেব-সুবোদের ঘরের সিলিং থেকে ঝুলত। তবে বাস্টিডের মতে, পর্তুগিজদের অবদানের ঢের আগে ভারতের মানুষ এই পাখার ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। সম্রাট শাহজাহানের ছেলে যুবরাজ দারা শুখোর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, পরবর্তীকালে সম্রাট অওরঙ্গজেবের দরবারের নিয়মিত সদস্য ছিলেন ফরাসি চিকিৎসক তথা পরিব্রাজক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ে। তাঁর “Travels in the Mughal Empire” বইয়ে ১৬৬৩ সালের জুলাই মাসে এক মুঘল অমাত্যের বাড়ির অন্দরমহলের বর্ণনায় টানা পাখার দেখা পাওয়া যায়।
উত্তর ভারতের সেই পাখা পরে বাংলা মুলুকেও ব্যবহার হতে শুরু করে। ১৭৭৪ সালে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে স্থাপিত ক্যালকাটা সুপ্রিম কোর্টের বেঙ্গল ইনভেন্টরি অনুসারে, ১৭৮৩ সালের ৩রা জুন তারিখে মৃত রিচার্ড বেচারের সম্পত্তির তালিকায় একটি ‘কাপড়ের পাখা’র উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তখনও টানা পাখার ব্যবহার সীমিত ছিল। ১৭৭৫ সালে মহারাজা নন্দকুমারের বিচারের সময় দেখা যায়, দিনে বেশ কয়েকবার বিচারকরা ঘামে জবজবে পোশাক পাল্টাতে বাধ্য হতেন। ১৮০০ সালে লর্ড ওয়েলেসলি সেন্ট জন’স চার্চ এবং শহরের অন্যান্য গির্জায় দড়িতে টানা পাখা বসানোর ব্যবস্থা করেন। তবে তখনও কলকাতা শহরের সব ইংরেজ বাড়িতে মনে হয় এমন ব্যবস্থা চালু হয়নি। ১৮১০ সালে উইলিয়ামসনের লেখায় তাঁর বাড়ির পরিচারকদের তালিকায় পাঙ্খাওয়ালা বা পাঙ্খাবরদারের কোনও উল্লেখ মেলে না। আবার ১৮১৩ সালে আঁকা শিল্পী ডি’অয়লির ছবিতে ডাইনিং টেবিলের ওপর নকশাদার কাপড়ে মোড়া পাখা ঝুলতে দেখা যায়, যার দড়ি হাতে দণ্ডায়মান এক খালাসি। এর আগে ১৭৯০ সালে ফরাসি পর্যটক গ্রাঁপ্রের লেখনী জানাচ্ছে, খাবার টেবিলে ডিনার পরিবেশিত হওয়ার সময় ইউরোপীয় অতিথিদের প্রখর গ্রীষ্মের গুমোট গরম থেকে বাঁচাতে হাতপাখা নিয়ে মোতায়েন থাকত একদল পরিচারক। প্রত্যেক অতিথির চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে একজন পরিচারক হাতপাখা দুলিয়ে বাতাস করত। ১৮৫৬ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত “Putnam’s Monthly Magazine of American Literature, Science and Art” – এ অবশ্য জানানো হয়েছে যে, সেই সময় কলকাতার প্রায় প্রতিটি সচ্ছল ইংরেজ পরিবারে ঘরের সিলিং থেকে টানা পাখা ঝুলত।
সিলিং থেকে ঝোলানো পাখা লম্বায় ৮ ফিট, ১২ ফিট আবার কখনও ২০ বা ৩০ ফিটও হতো। হাল্কা কাঠ দিয়ে তৈরি হতো তার কাঠামো বা ফ্রেম। তার ওপর লংক্লথ অথবা নকশাদার কাগজ মুড়ে দেওয়া থাকত। পাখার নীচের অংশে বুনে দেওয়া হতো মসলিনের ঝালর। সিলিংয়ের ৩-৪টি হুক থেকে বাহারি দড়ির সাহায্যে তা ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। আর একটি লম্বা দড়ি পাখার শরীর থেকে বেরিয়ে মুখোমুখি দুই দেওয়ালে গাঁথা দু’টি পিতলের চাকার ওপর দিয়ে গিয়ে দেওয়ালের একটি গর্ত দিয়ে ঘরের বাইরে পৌঁছত। সেখানে দড়ির শেষ প্রান্তটি ধরা থাকত পাঙ্খাবরদারের হাতে। মেঝের উপরে পা মুড়ে বসে সে ওই দড়ি ধরে বিশেষ ছন্দে টান দিত। মনিবের চাহিদা অনুযায়ী কখনও অতি দ্রুত দড়ি টানা হতো, আবার কখনও ফরমায়েশ মেনে ধীর লয়ে পাখা টানতো পাঙ্খাবরদার। অফিস-কাছারি-গির্জায় একাধিক টানাপাখার ব্যবস্থা থাকত। প্রতিটি পাখার দড়ি একগাছি মোটা দড়িতে এসে মিলত। তা ধরে টানলে একই সঙ্গে অনেকগুলি পাখা নড়াচড়া করে গোটা হলঘরে বাতাস সঞ্চার করত।
টানা পাখার হাওয়া কিন্তু সমান ভাবে ঘরের ভিতর খেলতো না। দড়ি টানলে পাখা সামনে এগোত, আবার পরমুহূর্তে দড়ি ছাড়লে তা নিজের ভারে দুলে পিছু হঠে যেত। আবার টেনে তা সামনে আনা হতো। এই রকমই ছিল পাখার চলন। ঘরের যে দেওয়ালের দিকে পাখা টানা হতো, সে দিকে হাওয়া জোরে বইতো। ১৮৯৫ সালে জি এফ অ্যাটকিন্সনের লেখা “Curry And Rice” বই থেকে জানা যায়, ঘরের এই দিকটিকে বলা হতো ‘বম্বে সাইড।’ আর দড়ি ছেড়ে দিলে নিজের ভারে পাখা বিপরীত চালে যে দিকে দুলতো, তার নাম ‘বেঙ্গল সাইড।’ আসলে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসা মৌসুমী বায়ুর যাত্রাপথ অনুসারেই এই নামকরণ। জলকণা বয়ে আনা বাতাস প্রথমে ভারতের পশ্চিম উপকূলে আছড়ে পড়ত, তখন তার গতিবেগ থাকতো অনেক জোরালো। সেই বাতাস পশ্চিম থেকে যখন পূবে বাংলা মুলুকে এসে পৌঁছত, তখন তার গতি হ্রাস পেত। এই কারণে ঘরের যে দিকে পাখার হাওয়ার ঝাপটা বেশি, তা বম্বে, আর যে দিকে কম, তা বাংলা।
কোম্পানির সাহেব অথবা দেশি ধনীদের বাড়ির দুই অংশে পাখা টাঙানো হতো- খাওয়ার ঘর ছাড়া শোওয়ার ঘরে খাটের ওপরেও পাখা ঝুলতো। প্রখর গ্রীষ্মের রাতে পাখার মৃদুমন্দ বাতাস না বইলে সাহেব-সুবো-রাজা-জমিদারদের ঘুম উবে যেত। মোলায়েম হাওয়ায় ঠান্ডা ঘরের পালঙ্কে যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন গৃহস্বামী, তখন ঘামে ভিজে ডাঁশ আর মশার কামড় সহ্য করে ঢুলতে ঢুলতে রাতভর পাখা টেনে যেত পাঙ্খাবরদার। শোনা যায়, এই কাজে বিশেষ কদর ছিল কানে খাটো মানুষের। বাড়ির নিভৃত কোণে তার উপস্থিতিতে পাছে গোপন কথা ও কীর্তি ফাঁস হয়ে যায়, সেই আশঙ্কাতেই বধিরদের জন্য এই চাকরি বাঁধা ছিল। আবার বংশ পরম্পরায় এই কাজে বহাল হওয়ার রীতিও ছিল। পাঙ্খাবরদাররা সকলেই এদেশের নিম্ন শ্রেণিভুক্ত। তাদের আর্থিক সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে অত্যন্ত কম বেতনে কাজে বহাল করা হতো। খাতাপত্তর উল্টে জানা যাচ্ছে, আঠারো শতকে সারাদিন পাখা টানা বাবদ মাথাপিছু তিন আনা মাইনে পেত পাঙ্খাওয়ালা। রাতে কাজ করলেও একই হারে বেতন ধার্য করা হতো। অনেক সময় পাখা টানা ছাড়াও তাদের বাড়ি বা দপ্তরের বেশ কিছু ফুটফরমায়েশ খাটতে হতো।
১৯২৪ সালে লেখা ই এম ফর্স্টারের আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া উপন্যাসে পাঙ্খাওয়ালার বিবরণ মেলে। বইয়ের ২৪ নম্বর অধ্যায়ে ডক্টর আজিজের বিচার চলাকালীন আদালত কক্ষের বাইরে বসে দড়ি টানতে থাকা এক পাঙ্খাওয়ালাকে দেখে উপন্যাসের নায়িকা মিস অ্যাডেলা কোয়েস্টেডের মনে দার্শনিক ভাবনা জেগে ওঠে। ভারতীয়দের প্রতি শাসক ইংরেজ শ্রেণির স্বভাবসুলভ বিরূপতা ছাপিয়ে সামান্য এক পরিচারকের মধ্যে এক অন্য ভারতকে যেন আবিষ্কার করেন অ্যাডেলা। পাখার দড়ি টানা সেই তরুণের বিবরণ দিতে গিয়ে ফর্স্টার তাকে জগন্নাথদেবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ব্যস্ত এজলাসের বাইরে বসে থাকা মানুষটির গায়ের রং ঘোর কালো। যন্ত্রের মতো সে পাখার দড়ি টেনে চলেছে। আদালতের উত্তেজনা তাকে স্পর্শ করছে না। তার চোখেমুখে লেপে রয়েছে এক ঐশ্বরিক নির্লিপ্ততা। ঔপন্যাসিকের জবানে, ‘a perfect naked god’। শোনা যায়, ১৯১৩ সালে ঔরঙ্গাবাদ আদালত প্রাঙ্গণে দেখা এক নবীন পাঙ্খাবরদারকে দেখেই চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন ফর্স্টার। তবে তাকে চিনতে ভুল করেননি লেখক- জাগতিক বৈভবের মাঝে নিজের দারিদ্রের প্রকট উচ্চারণে আদপেই কোনও ভ্রূক্ষেপ করার ফুরসত মিলত না পাঙ্খাবরদারের। তার কাজ শুধু, সব ভুলে মনিবের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বাতাসের জোগান দেওয়া।
তবে বিত্তবান ছাড়া ঘরে পাখা টাঙানোর শৌখিনতা বজায় রাখা সেকালেও অসম্ভব ছিল। ১৮৭৯ সালে কলকাতায় প্রথম বিজলিবাতি জ্বালানো হয়। ১৮৯৯ সালে চালু হয় বৈদ্যুতিক পাখা। প্রযুক্তির মোক্ষম চালে টানাপাখার যুগের অবসান হয়। কাজ ফুরোয় পাঙ্খাওয়ালাদেরও।
হাতপাখা সম্পর্কে বাংলা একাডেমীর ‘ভাষাশহীদ গ্রন্থমালার লোকশিল্প’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে উষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত এই উপ মহাদেশের খর বৈশাখের দাবদাহ এবং ভাদ্রের আদ্রতা মিশ্রিত গরমে হাতপাখা মানুষের নিত্যসঙ্গী। সুতা, বাঁশ, চুলের ফিতা, বেত, খেজুরপাতা, নারকেলপাতা, তালপাতা, কলার শুকনো খোল, পাখির পালক, সুপারির খোল, সোলা, গমের ডাঁটা, মোটা কাগজ প্রভৃতি পাখার উপাদান। এ নিত্যব্যবহার্য বস্তুটি বিশেষ করে মেয়েদের হাত পড়ে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। সুতা, বাঁশ, সরতা বেত ও কলার খোলের শুকনা বেতি দিয়ে পাখা বোনা হয় পাটি বা ম্যাট বোনার কায়দায়। বিভিন্ন মোটিফ বা ডিজাইনে এ পাখা তৈরি হয় এবং এগুলোর বিভিন্ন নামও রয়েছে। এর মধ্যে পানগুছি, কেচিকাটা, তারাজো, পুকুই রাজো, ধানছড়ি, ফলং ঠেইঙ্গা, ফড়িংয়ের ঠ্যাং, রাবণ কোডা, নবকোডা, কবুতর খোপ, মাকড়ের জাল, পদ্মজো, কামরাঙ্গা জো, ধাইড়া জো, সুজনি জো, চালতা ফুল, কাগজ কাটা, হাতি, মরিচ ফুল, আটাসান, শঙ্কলতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
“তালের পাখা
প্রাণের সখা,
গরমকালে
দেয় দেখা।”
বর্তমানে প্লাস্টিকের হাত পাখা প্রচলন হলেও তালের হাত পাখা বা খেজুর পাতা, কাপড়ের তৈরি পাখার মর্যাদা নিতে পারেনি। তালের হাত পাখার বাতাস একদম শীতল। রাজা বাদশাদের আমলে রাজার সিংহাসনের পিছনে দুইজন পাখা হাতে দাঁড়িয়ে থাকত। তাদের কাজ ছিল বিশাল সাইজের এই পাখা ধীরে ধীরে বাতাস করা।
বর্তমানে এই ধরনের পাখা না দেখা গেলেও হাত পাখার কদর এখনো কমে নি। বিশেষতঃ বঙ্গদেশের গ্রামাঞ্চলে। অঞ্চল ভেদে হাতপাখার অদ্ভুত কিছু স্থানীয় নামও আছে। যেমন, অধুনা বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে হাতপাখা ‘বিছুন’ আবার ময়মনসিংহ তে ‘বিচুইন’ নামে পরিচিত।
উভয় বঙ্গের গ্রামাঞ্চলে অনেক জায়গায় পাখা তৈরি হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এই পাখা শিল্পের পরিমান অনেক বেশি। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময় পাখা তৈরি হয় এবং বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনেও শীর্ষে রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, নওগাঁ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, বরিশাল অঞ্চলে কিছু কিছু পাখা তৈরি হয়। এসব পাখা নির্মাণশৈলীতে স্থানীয় পরিবেশ প্রতিবেশের সমন্বয়ে নকশা নমুনার নানান দিক ফুটে উঠেছে এবং ব্যবহারেও বৈচিত্র্যময় দিক রয়েছে।
এসব অঞ্চলে পাখা তৈরির ক্ষেত্রে হাজার হাজার পরিবার নিয়োজিত রয়েছে। তালপাতার পাখা তৈরির ক্ষেত্রে আগে গ্রামের গরিব মানুষ চেয়ে চিন্তে পাখা সংগ্রহ করে পাখা বানাত। কিছু কিছু মানুষ তালপাতা হাটবাজারে বিক্রি করত। স্বল্পমূল্যে পাতা কিনেও পাখা বানাত অনেকে। কিন্তু তালগাছের সংখ্যা তুলনামূলক হ্রাস পাওয়ায় হাটেবাজারে এখন আর তালপাতা পাওয়া যায় না। আজকাল অধিকাংশ কারিগরই পাখা তৈরি বন্ধ করেছেন। কাপড়ের পাখা তৈরির ক্ষেত্রে সুতা দিয়ে ফুল তোলার আগে আউট লাইন ড্রইং করে নিয়ে ফর্মা তৈরির জন্য কারুশিল্পী নিজেই কাজ করেন। পরিপূর্ণভাবে লোকচিত্রকলার ভাব ফুটে ওঠে কাপড়ের তৈরি পাখাতে। এছাড়া এ পাখাগুলোতে থাকে নানান ধরনের ডিজাইন, ফুলের নকশা। তালপাতার পাখা বা যে কোন ধরনের হাতপাখার প্রধান কারিগর বা কারুশিল্পীরা ছিলেন মহিলা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে কিছু কিছু পুরুষ পাখা তৈরির কাজে দক্ষতা অর্জন করেছেন।
তালপাতা ভালো করে রোদে শুকিয়ে ঠান্ডায় নরম করে নেওয়ার পর বাঁকাকাঠি সুন্দর নকশা করে তার ভিতর তালপাতা ঢুকিয়ে, গুনে (তার) দিয়ে বেঁধে সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়। তারপর রং করে শুকাতে হয়। ফাল্গুন থেকে ভাদ্র-আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাখা বানানোর কাজ চলে।
তালের প্রধানত দুই রকম পাখা বানানো হয়।
১। পকেট পাখা
২। ডাটি পাখা।
একটা গাছের ১৫ থেকে ২০ টা ড্যাগ থাকে। তাতে দেড়শ থেকে দুশো টি পাখা হয়। একশো টি ডাটি পাখা বানাতে এখন খরচ হয় চারশো বা পাঁচশো টাকা।
আর এক হাজার টাকার তালপাতায় পকেট পাখা হয় সাড়ে তিন হাজারটির মত। খরচ পড়ে তিন থেকে সাড়ে হাজার টাকা। সময় লাগে ২০-২৫ দিন।
প্লাস্টিকের হাতপাখার দাপটে গ্রামবাংলার তালপাতার পাখাশিল্প প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে বলে অভিযোগ। এমনিতে গ্রামের ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে। ফলে প্রতি বাড়িতেই ইলেক্ট্রিক পাখা, অনেকের বাড়ি এসি রয়েছে। ফলে হাতপাখার প্রয়োজনীয়তাও কমে গিয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বাড়িতে হাতপাখার প্রয়োজন হলেও তাঁরা বাজার থেকে সস্তায় প্লাস্টিকের পাখা কিনছেন। অথচ দু-তিন দশক আগেও বর্ধমানের পূর্বস্থলীর দুই ব্লকে শতাধিক পরিবার তালপাতার হাতপাখা তৈরি করত। কিন্তু, এখন মাত্র কয়েকটি পরিবার তালপাতার হাতপাখা বানায়। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায় তালগাছের সংখ্যাও কমে গিয়েছে। ফলে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকেই ঝুঁকেছেন শিল্পীরা।
যদিও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তালপাতার পাখার বাতাস স্বাস্থ্যকর ও আরামদায়ক। তুলনায় এসি বা এয়ার কুলারের হাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়। গরমে সাময়িক স্বস্তি দেয় মাত্র। এখন কেউ আর কৃষিজমিতে তালগাছ বসান না। অধিকাংশ তালগাছই কেটে মাটির বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই তালপাতার পাখার শীতল হাওয়া আগামীদিনে হয়তো গল্প কথায় পরিণত হবে। এমনটাই দাবি করেছেন পাটুলির মহাজনপট্টির প্রবীণ তালপাতার পাখাশিল্পী গোপাল মহান্ত। তাঁর বাবা তারাপদ মহান্ত ছিলেন তালপাতার পাখাশিল্পী। দিনে ৩০-৪০টি পর্যন্ত হাতপাখা বানাতে পারতেন তিনি। পাটুলিতে আগে অনেক পরিবার তালপাতার পাখা তৈরি করত। ধীরে ধীরে এর চাহিদা কমায়, তারা এই পেশা ছেড়েছে বলে জানা গিয়েছে। একসময় পূর্বস্থলীজুড়ে হাজার হাজার তালগাছ দেখা যেত। এখন তার ১০ শতাংশ গাছও নেই। তালগাছের পাতা সংগ্রহ করতে হয় বীরভূম, পুরুলিয়া থেকে। সেগুলিকে বেশ কিছুদিন রোদে শুকিয়ে হাতপাখা করতে বসেন পরিবারের সদস্যরা। তালপাতার পাখা বিক্রির মরশুম শুরু হয় ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি। চলে আশ্বিন মাস পর্যন্ত।
গোপালবাবু বক্তব্য অনুসারে, পৌষমাস থেকে তাঁরা তালপাতা সংগ্রহ শুরু করেন। একশ্রেণীর মহাজন আছে, যারা বিভিন্ন জেলা থেকে দিনমজুরদের দিয়ে তালগাছের পাতা কাটায়। পরে সেই পাতা তাঁদের বিক্রি করে। তাঁরা সেগুলিকে সাইজ করে কেটে, সরু বাঁশের টুকরো দিয়ে বেঁধে রং করে হাতপাখার রূপ দেন। বাড়ির মহিলারা এই কাজে সহযোগিতা করেন।
তালপাতার পাখা বিক্রির বড় জায়গা গ্রামীণ এলাকার মেলা। ফাল্গুন থেকে চৈত্রমাস পর্যন্ত বিভিন্ন মেলায় তালপাতার পাখা বিক্রি বাড়ে। বছর পাঁচেক আগে একটি পাখা ৮ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন তার দাম বেড়ে হয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। গোপালবাবুর ছেলে নির্মল মহান্তর বক্তব্য অনুসারে, শতকরা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে তাঁদের তালপাতা কিনতে হয়। তারপর পাখা তৈরি করতে রং, বাঁশের খরচ রয়েছে। আগের থেকে এই পাখার চাহিদা অনেকটাই কমে গিয়েছে। লাভও এখন তেমন নেই। অনেকে প্লাস্টিক, ফাইবারের পাখা ব্যবহার করেন। তাই আগামীদিনে হয়তো তাঁদের এই পাখা তৈরির পেশা ছেড়ে দিতে হবে।
আবহমানকাল থেকে যখন কিনা বিদ্যুতের বালাইও ছিল না, তখন থেকেই মানুষের হাত ঘুরে চলছে এই হাতপাখা। রকমারি ফ্যান, এয়ারটাইট ঘরে এসির শীতলতা যারা কল্পনাও করতে পারে না তাঁদের কাছে হাতপাখা নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকবে চিরকাল।
বৈদ্যুতিক পাখা বা এসি, অথবা প্লাস্টিকের হাত পাখার দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে তাল পাতার পাখা। তাল গাছ নেই। দূরদূরান্ত থেকে তালপাতা সংগ্রহ করা হলেও পাখা তৈরি করার কারিগর মেলা ভার। এক সময়ে গরম পড়লে যেখানে তালপাতার পাখার চাহিদা তুঙ্গে উঠত, সেই চাহিদা কমছে দিন দিন। তবে ড্রইং রুমে ক্রিস্টালের দামী সোপিস এর সাথে বাহারি হাতপাখা আর বেমানান নয়।
পাখা তৈরির প্রধান উপকরণ তালের পাতার তীব্র সঙ্কট, রঙসহ অন্যান্য উপকরণের দাম আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। পাখা তৈরির উপকরণ সামগ্রীর দাম বাড়লেও বাড়েনি পাখার দাম। তাই এ তাল পাখা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা কারিগরদের একান্ত দরকার।
তথ্যসূত্র:
১- বর্তমান পত্রিকা, ৩রা মে ২০১৯ সাল।
২ – উইকিপিডিয়া।
৩- বাংলাপিডিয়া।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>