monija rahman boi, irabotee.com

বস্তুজগতের অবিকল প্রতিচ্ছবি ‘হৃদয়বোধক চিহ্ন’

Reading Time: 3 minutes

সদ্য প্রকাশিত মনিজা রহমানের হৃদয়বোধক চিহ্ন পড়ে শেষ করলাম গতকাল। আজো তার ঘোর লেগে আছে। ১৩ টি ভিন্ন ভাবনার গল্প নিয়ে বইটি সাজিয়েছেন লেখক। কথাসাহিত্যের প্রধান হাতিয়ারটি যখন কথা বা শব্দ, তখন সবকিছুর আগে দেখে নিতে হয় কথা ব্যবহারে লেখকের বিশিষ্টতা কী। মানব জাতির মধ্যে ভাবের অভাব নেই, বলবার কথা অফুরান, বলার ইচ্ছাও প্রবল। কিন্তু কথাশিল্পের জন্য এসব সম্পদের প্রাচুর্যই যথেষ্ট নয়। কেমন পাত্রে কী সাজে এগুলো সাজিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেটাই একেবারে গোড়ার কথা। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে মানিক, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, প্রেমেন মিত্র, নরেন মিত্র প্রমুখের ধারাবাহিক প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে বাংলা ছোটগল্প যদি আজ বদলে গিয়ে থাকে, তবে সেই পরিবর্তনের সিংহভাগই ঘটেছে তার আঙ্গিকে।

 

শিল্পের ইতিহাস বোধকরি মূলত তার প্রাকরণিক বিবর্তনের ইতিহাস। শৈলী, ভঙ্গি, আঙ্গিকের অনন্যতাই, সব শিল্পের মতো, ছোটগল্পের বেলায়ও গোড়ার কথা।প্রমিত ভাষা ব্যবহারের মধ্যে মধ্যে মনিজা টেক্সট এবং ডায়লগে কথ্য বা আঞ্চলিক ভাষারীতি ব্যবহার করেছেন। যেমন ক্রিয়াপদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, যায়া (গিয়ে/যেয়ে), হয়া (হয়ে), হারায়া (হারিয়ে), শিখায়া (শিখিয়ে), দিয়া (দিয়ে) প্রভৃতি। এটা তাঁর ক্ষণিক নিরীক্ষা নয়, তাঁর সাহিত্যের মূল স্রোতই এই ভাষা। এক্ষেত্রেও লেখক হয়ত ভাষার ‘কেন্দ্রগত’ ধারণাটা ভেঙে দিতে চেয়েছেন। ‘শোভন কথ্যভাষা’ বলে কিছু তিনি মানতে চাননি। ভাষাকে নতুন করে পরিসঞ্চালন করতে চেয়েছেন।

হৃদয়বোধক চিহ্ন গল্পগ্রন্থে অধিকাংশ গল্পেই দেখি সরলরৈখিকভাবে কাহিনীর স্রোত প্রবাহিত হয় না। কখনও কখনও মাঝখান থেকে গল্প শুরু করে তিনি অনায়াসে সামনে-পেছনে চলে যান, এমন কৌশলের সঙ্গে তিনি এ কাজটি করেন যে, পাঠক প্রস্থানবিন্দুগুলো পার হয়ে যায় অলক্ষ্যেই। তাঁর গল্পের বুননে এমন একটা জাদুকরী ব্যাপার আছে, যা কেটে-চিরে দেখানো কঠিন, কিন্তু যার ফল বা প্রভাব অব্যর্থ, লক্ষ্যভেদী।

 

মনিজা রহমান ঐতিহ্যগত নির্মাণশৈলী থেকে বের হতে চেয়েছেন। তাঁর ছোটগল্পের কাহিনিতে বহির্জীবন এবং অন্তর্লোক এক রেখাতে এসে মিলিত হয়। ফলে অন্তর্বয়ান ও বহির্বয়ান একইসঙ্গে ঘটে।সংঘাতের রূপটি তাঁর গল্পে কখনো প্রকাশ্য, অবৈরীমূলক, বৈরীমূলক অথবা প্রত্যক্ষ। দ্বন্দ্বের কারণে ব্যক্তি পরাস্ত, ধ্বস্ত, পঙ্গু, নিজের চরিত্র বিনাশে তৎপর, নিজের বিকাশ সঞ্চয়েও অক্ষম। অন্তর্গত ও বহির্মুখী নানা সংকট প্রোথিত রয়েছে জীবনের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত ও শ্রেণি অবস্থানে। সমাজের মধ্যেই খুঁজতে হয় মানুষের উত্থান ও অবস্থান। মনিজার নীহার সুলতানা গল্পটি সমষ্টিগত পর্যবেক্ষণ লিখছেন একান্ত ব্যক্তিগত কথনের ভঙ্গিতে। আবার ফেরারি আগন্তুক গল্পটিকে মিথিক ফ্যান্টাসিও বলতে পারি। কারণ বাস্তবতা-জ্ঞান থেকে এই গল্পের কোনো অর্থ-উদ্ধার করা যায় না।

 

মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছোটগল্প রচিত হয়েছে। প্রধান-প্রধান গল্পকার যেমন এর প্রেক্ষিতে গল্প রচনা করেছেন, তেমনি নবীন গল্পকাররাও মুক্তিযুদ্ধের উপাদান, অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন প্রবল উৎসাহের সঙ্গে।তেমনি একটি গল্প একাত্তরের যুডাস।ফাদার উইলিয়ামস ইভান্স আর জন এফ কেনেডি কিভাবে যেন ইঙ্গিতে বাস্তবতায় মিলে মিশে যায়।

বাংলা ভাষায় কি কোনো ডায়াসপোরা সাহিত্য রয়েছে? আলোচনার সুবিধার্থে ডায়াসপোরা কথাটির একটি ব্যবহারিক সংজ্ঞা দেওয়া যাক। ডায়াসপোরা শব্দটি গ্রিক, যার অর্থ বীজের ছড়িয়ে-পড়া। নিজ দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ভিন্ন স্থানে বসতি গড়েছে, এমন লোকদেরই আমরা ডায়াসপোরার মানুষ – দেশহীন মানুষ বলে চিহ্নিত করতে পারি। হিব্রু বাইবেল বিশ্বের প্রথম ডায়াসপোরা সাহিত্য বলে বিবেচিত হয়, কারণ নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের হাতে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। ডায়াসপোরার এই মৌল সংজ্ঞা পরবর্তীতে সম্প্রসারিত হয়েছে। শুধু বাধ্য হয়ে যারা দেশ ছেড়েছে, তারাই নয়, যারা স্বেচ্ছায় ভাগ্যান্বেষণে অথবা অন্য কারণে দেশান্তরিত হয়েছে, তারাও কার্যত ডায়াসপোরার অংশ। অন্য কথায়, নিজ দেশের বাইরে যারাই স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে, তারাই এই ডায়াসপোরার অংশ।

 

সেই অর্থে যারা দেশের বাইরে,স্থায়ীভাবে বসবাস করছে এবং সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত, তাদের সৃষ্ট সাহিত্য ডায়াসপোরা সাহিত্যেরই অংশ। মনিজা রহমান ও ডায়ানপোর সাহিত্যের প্রতিনিধি। ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষায় কুসুমের স্মৃতি বা হোমলেস লোকটি তাহলে কোথায় যাবে গল্প দুটি পড়তে পড়তে মনে হবে জীবন যখন একটানা বয়ে চলে, তখন তাতে সম্বিৎহারা না হওয়া পর্যন্ত ছেদ চোখে পড়ে না।

ছোটগল্পের লেখকমাত্রই জানেন যে গল্পটা খুব সামান্য উপাদান এবং কম গুরুত্বপূর্ণ এমনকি ইদানীংকালে গল্পহীন ছোটগল্পও লেখা হচ্ছে। তবু কাহিনি বা গল্পের একটা রেখা প্রায় সব ছোটগল্পে থাকে। সেই অল্প কাহিনি বা গল্পকে বিস্তার করে দেবার নানান কৌশল রপ্ত করতে হয় লেখককে। সোজা কথায় বড় ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে হয়ে তাঁকে। আবার সেই ফাঁকা জায়গা আর্বজনা দিয়ে পূরণ করার সুযোগ নেই, নেই নানা ক্যারিকেচার জুড়ে দেবার।মনিজা রহমানের বিশেষত্ব এখানেই,তিনি পাঠককে টেনে রাখতে জানেন। এত দিন গল্পের বিষয় ও আঙ্গিকের যে নিরীক্ষা মনিজা করেছেন, এই বইয়ে তার একটা সম্প্রসারণ দেখা যায়। এ বইয়ে আঙ্গিকের নিরীক্ষাগুলো তুলনামূলকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে করেছেন লেখক, তবে কোথাও কোথাও মনে হয়েছে যত্ন ও সময় দাবী করে লেখা সেইসাথে দেখা ও অভিজ্ঞতার খামতি ও কিছু কিছু জায়গায় স্পষ্ট।

 

গল্প এখন নতুন-নতুন দিকে বাঁক নিয়েছে,এই মুহূর্তে আমাদের বাংলা ভাষার গল্পের বর্তমান অবস্থান খুব খারাপ নয়। সমাজের কাঠামো বদলাচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রকৃতিও অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিমুহূর্তের বাস্তবতা হাতের তালু বেয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। নগর, শহর, গ্রাম কেমন একটা হতচ্ছাড়া চেহারা নিয়েছে। গল্পও নানা রূপে বহু দেখায় লেখা হচ্ছে রোজ তার নতুন নতুন সেই লেখার গল্পপাঠকরা হয়তো সেই দিকেই চেয়ে আছেন।

 

গল্পগ্রন্থ

হৃদয়বোধক চিহ্ন

মনিজা রহমান

পেন্সিল পাবলিকেশনস

প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

মূল্য: ২৯৪ টাকা 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>