রক্তগাছ
গত রাতেই বুড়িগঙায় কাজটা শেষ করেছিল সে। কাজটা শেষ হবার পর থেকে ইয়াছিনের মনটা বিবশ হয়ে আছে । নিজের মধ্যে যেন জেগে উঠল অন্য কে একজন। কে? অন্ধকারের রসাতল বেয়ে কে আবার! কাজটা সারার পর মোবাইলটা বন্ধ রেখেছিল বেশ কতক্ষণ। খুলে দেখে তার বউ সীমা এসএমএস দিয়েছে। ডাক্তার বলছে, ‘এবার আর নষ্ট হবার সম্ভাবনা নাই। আলট্রাসনোতে দেখা গেল সব ঠিকঠাক। আপনে আইসা পড়েন।’ দূর শালা! আরেক প্যাঁচাল। নিজের মনেই ভাবল ইয়াছিন।
পাঁচমাসের অন্তঃসত্তা তার স্ত্রী সীমা এবার বাচ্চার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে। পরপর তিনটি বাচ্চা নষ্ট হবার পর এবার আর মোনাজাতের শেষ ছিল না। শবে-বরাতের রাতে সারারাত নামাজ পড়েছিল আর আল্লার কাছে আকুল কেঁদেছিল সীমা। এসব নিয়ে অবশ্য ইয়াছিনের কোন মাথাব্যথা ছিল না। যেদিন থেকে মানুষ মারার লাইনে সে এসেছে, সেদিন থেকেই আল্লাখোদা সে ভুলে গেছে । সীমার পরপর বাচ্চা নষ্ট হওয়াতে সে মনে মনে খুশিই ছিল। ‘‘কি দরকার খুনির পোলা জন্মানোর! রাস্তা দিয়া হাইট্যা গেলে মাইনষে ছেপ্ মাইরবো। ওয়াক্ থুঃ।” তবু খোদা শেষ পর্যন্ত সীমার আবেদন শুনবে বলেই তার মনে হচ্ছে। আর তার দুশ্চিন্তার শুরুটাও এখানেই। আর তা এখন তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করছে। হাড়গুলোকে যেন শীত ধরিয়ে দিচ্ছে।
কাজ শেষে নৌকা দিয়ে বুড়িগঙ্গার পারে এসেই মোবাইলটা অন করেছিল ইয়াছিন। এক নিঃশ্বাসে এসএমএসটা পড়ে ফেলেছিল। রাত তিনটা বাজে। রমজানের রাত। মানুষ ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। গরমও পড়েছে বেশ। একটু পরেই সেহরির সময় হয়ে যাবে। তার নিজের আস্তানায় ফিরতে হবে সেহরির আগে আগেই। আস্তানায় অপেক্ষা করছে পলাশ, কল্লোল ও তার দলের আরও চার জন। তারা একটু দুশ্চিন্তায় আছে। যার লাশটি সে কেটে সাইজ করল, সে ছেলেটির বাবা বেসরকারি এক নামকরা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। তারা দরকার মতো সব ধরনের থানা পুলিশ করবে। অন্য কোনো সময় হলে সে বাতাসের আগে আস্তানায় পৌঁছে যেত। অথচ এখন যেন তার পা আর চলতে চাইছে না। যখন সে লাশের টুকরাগুলো পলিথিনের প্যাকেটে করে নিয়ে যাচ্ছিল ট্যাক্সি ক্যাবে করে, তখন একজন টহলদার পুলিশ জিজ্ঞেস করেছিল, এত রাতে পলিথিনের ভিতর কী? সে একটুও ভয় না পেয়ে বলেছিল, পীরের আদেশে রাত তিনটায় বুড়িগঙ্গায় গরু জবাই মানত করেছে সে। তাই কাজটি করতে যাচ্ছে। পুলিশ কোনো সন্দেহ করল না। আশ্চর্য! কিন্তু কাজ শেষের পর, কোন ঝামেলা না হওয়ার পরও এখন সে টের পাচ্ছে অন্য কিছু। নির্বিঘ্নে কাজ করতে যাবার মানুষটি আর ফিরে আসা মানুষটি এক মানুষ নয়। এমনকি কাল রাতে যখন সে ছেলেটিকে, ইফতারের পর ঠান্ডা মাথায় গলা টিপে খুন করে, আর খুন করার পর সারারাত মরা লাশটির সাথে কাটায়, তখনও নিজের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব সে আবিষ্কার করেনি। তারপর আজ সারাদিন রোজা রেখে, ইফতারের পর লাশটিকে যখন করাত দিয়ে আটাশ টুকরা করে, তখনও একটু হাত কাঁপেনি তার। বরং সে ভয় পেয়েছিল পাশের বিল্ডিংটার পাইলিংয়ের শব্দ বন্ধ হয়ে গেলে, কাটাকুটির শব্দটা বাইরে ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই বিকাশকে পাঠিয়ে বেশি টাকা দিয়ে পাইলিংয়ের কাজটা রাত নয়টা পর্যন্ত করিয়ে নিয়েছিল।
ফোনটা আবারও সে বন্ধ করে রাখে। একটু হেঁটে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে একটা রিকশা পেয়ে দ্রুত উঠতে চায়। রিকশাওয়ালা যেতে চায় না। মানিব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার একটি নোট দেখালে আধো ভয়ে, আধো লোভে, সিদ্ধান্তহীনতার মাঝেই সে রাজী হয়ে যায়। রিকশায় উঠে সে ভাবতে থাকে এই দুনিয়ায় কোনো কিছুতে তার ভয় নাই। অথচ সীমার একটা এসএমএস তাকে এমন করে ভয় ধরিয়ে দিল! ভয়ে তার প্রস্রাব এসে গ্যাছে জাঙ্গিয়ার ভিতর। জাঙ্গিয়া উপচে প্যান্টটা একটুখানি ভিজেও গেছে বোধ হয়। ভিজে গেছে কি! কিন্তু হাত দিয়ে সে টের পায় না। অবাক হয় সে। নাকি কোনো জিন এসে ভর করল রাত দুপুরে। মাঝ নদীতে যেয়ে লাশ ফেলেছে! নিজের মনেই আবার সে হেসে ওঠে। ‘হায় আল্লা! আমারে দেইখ্যা জিনেও ডরাইব। এত গুনাহ যে-মানুষ করতে পারে তার থেইক্যা দশ হাত দুরে থাকব জিন ব্যাডা।’ তবুও বুকের ভেতর থেকে খচ্খচে ভাবটা যেতে চায় না তার। সে প্যান্টের ভেতরে হাত দিয়ে জিনিসটিকে অনুভব করে আর তার কালো চকচকে মাথাটায় হাত বোলায়। না, রিভলভারটা ফেলে আসেনি সে। জায়গামতোই আছে। দীর্ঘদিন ধরে এর সাথে তার বন্ধুত্ব। যখনই চারপাশটা কোনো কারণে উত্তেজিত মনে হয়েছে তখনই সে ট্রিগারের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ট্রিগারটিও বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো অনেকগুলো চোখ নিয়ে সাড়া দিয়েছে সময়মতো। আর তখনই তার নিজেকে মনে হয়েছে সবার চেয়ে উঁচু ও শক্তিশালী। নিজের কাছে নিজেকে আশ্বস্ত করার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নাই। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা দম আটকানো অনুভূতি তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। রিকশায় যেতে যেতে সীমার এসএমএস-এর সাথে তার এই হঠাৎ ভয়ে কেঁপে ওঠার সম্পর্কটা নিয়ে সে ঠান্ডা মাথায় ভাববার চেষ্টা করে।
২
দাদি মারা যাবার আগে সীমার সাথে তার বিয়ে দিয়েছিল। খুব ছোট বয়সে। তখন তার বয়স পনেরো আর সীমার আট। সীমার বয়স তেরো হলে পরে তাকে স্বামীর বাড়ি পাঠানো হয়। আর সে বছরই গ্রামের জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধে প্রতিবেশীদের সাথে তাদের পরিবারের সংঘর্ষ চরমে ওঠে । তাদের দুধেল গাই বাতামিকে, প্রতিবেশী সেলিমের ছোটভাই পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মারে। সে ছেলেটি ইয়াসিনের সাথেই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। ইয়াসিনের মনে হলো এর প্রতিশোধ না নিতে পারলে বেঁচে থাকা অন্যায়। তার দুদিন পরেই নদীর পাড়ের রাস্তায় তাকে একা পায়। ইয়াসিনের হাত নিশপিশ করে ওঠে । খালি হাতেই সে তার উপরে চড়াও হয়। একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি তাকে প্রচণ্ড বেগে তাড়া করে তার বোধ বুদ্ধিকে তাৎক্ষনিকভাবে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে সে নদীর পারে গ্রোয়েনের কাছে পড়ে থাকা এক বড় সিমেন্টের ব্লকের আঘাতে সেলিমের ভাইয়ের মাথা থেতলে দেয়। ঘটনাটি ঘটার সময় জায়গাটি ছিল নির্জন। বেলা তখন দুপুর একটা। খুনটি ঘটে যাবার পর সে বিবশ হয়ে মিনিট পাঁচেক বসে থাকে। তারপর হৃৎপিণ্ডের সবটুকু অস্থিরতাকে চুপ করিয়ে দিয়ে সে সেলিমের ভাইয়ের লাশটিকে নদীতে ফেলে দ্যায়। বাড়িতে এসে নিজেকে কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত মনে হয়। ভিতরটা জ্বলে যায় কী-এক জ্বালায়। সে যেন সময়ের গভীর ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়েছে। তার চোখের সামনে দিয়ে যায় সীমার ঝলমল করে ওঠা দেহ, গন্ধবতী নারকোল তেলের সুবাস! চুম্বনের ভেজা স্বাদ! কিছুই ভালো লাগে না তার। দু-এক দিনের মধ্যেই বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাবে। তখন প্রতিপক্ষ আরও প্রতিশোধপরায়ণ হবে। থানা-পুলিশ হবে। তাই পরদিন ভোরেই সে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আব্বা চিরকালের হাঁপানি রোগী। বড়ভাই যে বাড়িতে বিয়ে করেছে সে বাড়িতে ঘরজামাই থাকে। ঈদে-পার্বণে মাঝেসাঝে আসে। আম্মা আর সীমারে নিয়াই ভয়। ভোরের দিকে সীমাকে ডেকে বলে, ‘তুই আমার লগে ল। সময় বড় খারাপ। কদিন তোর বাপের কাছে গিয়া থাক। সময় ফিরলে তোরে লইয়াআমু।’
‘এই বিয়ান বিলায় কি কন আপনে? আপনের কি মাথা খারাপ হইল?’
‘যা কইছি তা শোন। এক কাপড়ে চল। হাতে বেশি সময় নাই। আম্মারে আমি বুঝাইয়া কইতাছি।’
বুদ্ধিমতি ইয়াছিনের মাকে বেশি কিছু খুলে বলতে হয়নি। ইয়াছিনের নিদ্রাহীন চেহারায় ভেসেছিল সময়ের নিষ্ঠুর ছোবল। সহজ জীবনের স্বাদ তার ভাগ্যে নাই । কী জানি কী আছে ভাগ্যে! দোয়া পড়ে গায়ে ফুঁ দিয়ে দিল ইয়াসিনের মা। ঘরের বারান্দায় একা, নিঃস্ব, ভিখারির ফুটা থালার মতো পড়ে থাকল সে। চেয়ে চেয়ে নিরূপায় ভাবে দেখল ইয়াসিনের বিদায় দৃশ্য । চোখ দুটো দিয়ে অনর্গল পানি ঝরছিল।
৩
রিক্সাটা চলছে বড় আস্তে আস্তে। রিক্সাওয়ালা কি রোজা রেখেছিল আজ? তার গায়ে একেবারেই জোর নাই। টাকার লোভে সে চালিয়ে নিচ্ছে! না কি ভয়ে! যাচ্ছে মোহাম্মদপুরের দিকে। জেনেভা ক্যাম্পের গলিতে ইয়াসিনের আস্তানা। প্রবল অনিচ্ছায় সে টানছে রিকশাটিকে। শুধু টাকার জন্য।
এ জীবনে কমতো দেখা হলো না! ঢাকায় আসার পর পরই জানতে পারল ইয়াসিনের নামে কেইস দেওয়া হয়েছে। পুলিশ খুঁজছে তাকে। কোনো কাজ নাই। এ দিকে টাকা নাই হাতে। খাবে কী? দুই-চারদিন এর বাসা ওর বাসা করে পরে একদিন রাস্তায় বের হয়ে পড়ল ইয়াসিন। যা থাকে কপালে! পুলিশে ধরলেও ভয় পাবে না সে। সাভারে এক দর্জির দোকানে কাজ শিখার জন্য গিয়েছিল। একমাস খাটানোর পর তাকে তার পাওনা টাকার অর্ধেকটাও দেয়নি সে লোকটি। সেদিন মনের দুঃখে সে সাভার স্মৃতিসৌধের কাছাকাছি একটি নিরিবিলি জায়গায় বসে থাকে। হঠাৎ কয়েক গজ দূরে কয়েকটি ছেলে একজোট হয়ে তার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে থাকে। কিছু না বুঝেই সে সামনে দৌড়াতে থাকে। ছেলেগুলোও পিছন থেকে জোরে দৌড়ে খুব সহজেই তার নাগাল পেয়ে যায়। ছেলেগুলো তাকে ঘিরে ধরে।
‘এই দৌড় দিলি কে? জানস্ আমরা কেডা? এই এলাকার ক্যাডার। তোরে তো আগে এই এলাকায় দেখছি বইলা মনে হয় না? বাড়ি কই?’
ইয়াছিন চুপ করে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না। তার চুপ করা দেখে একজন তার নাক বরাবর একটা ঘুষি চালিয়ে দেয়। তার শেভহীন চোহারা, এলোচুল, ময়লা জামা, ছেড়া ক্যাডস জুতা, সবমিলিয়ে একটা পরিত্যক্ত বিবর্ণ মানুষের উপর ওরা বিনা কারণেই আরও বেশি করে চড়াও হয়ে ওঠে। ইয়াসিন তবু মুখ খোলে না। শরীরটা দুর্বল থাকায় সে হঠাৎ অজ্ঞানের মতো হয়ে যায়। ছেলেগুলো ভাবে সে বোবা। অথবা নেশায় আসক্ত। ওরা তাকে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যাবার সময় ইয়াসিন একটু জোরে স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে, ‘‘আমারে একটা কাজ দিবেন? যেই কাজ দেন, সেইডাই করমু?’’ ওরা আবার ফিরে আসে। একজন বলে, ‘‘দলে ভিরাইয়া ল।’’ সেই গ্রুপটার প্রধান কাজ ছিল, সাভার এলাকায় ছিনতাই করা। সেই থেকে ছিনতাইয়ের গ্রুপের একজন হয়ে সে কাজ শুরু করল। প্রথম দিকে তাকে পিস্তল দেয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে কাজের পারদর্শিতায় সে নিজেই সেই গ্রুপের লিডার হয়ে যায়। ছিনতাইয়ের পাশাপাশি পেশাদার খুনি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
একবার গনপিটুনিতে ওদের দলের দুজন মারা গেলে সে আর এ পেশায় থাকে না। গণপিটুনি সেও একবার হজম করেছিল ছিনতাই করতে গিয়ে। আশুলিয়াতে ঘটেছিল ঘটনাটি। সে আর মাসুদ হাঁটছিল মেইন রাস্তা ধরে । হঠাৎ দেখল ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শাড়ি পরা এক মোটাসোটা মহিলা। তার গলায় দেড় ভরি ওজনের সোনার চেইন, দেখে ইয়াসিন আর লোভ সামলাতে পারল না। তখনও তাকে পিস্তল দেওয়া হয়নি। মাসুদের কাছে তখন ৩২ ক্যালিবারের পিস্তল ছিল। মাসুদ অবশ্য তাকে রিস্ক না-নিতে বলেছিল। ইয়াসিন তবুও অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে যায়। চেইনটা টান দিয়ে দৌড় দেবার সঙ্গে সঙ্গে মহিলাটি বিকট চিৎকার করতে থাকে আর তখনই আশুলিয়ার গার্মেন্টসের শ্রমিকরা লাঞ্চ আওয়ার শেষ করে দলে দলে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। মহিলার চিৎকার শুনে তারা সবাই মিলে ঘুরে দাঁড়ায়। সবাই মিলে ওদের দুই জনের পিছনে দৌড়াতে থাকে। উপায় না দেখে মাসুদ তৎক্ষণাৎ হিন্দি সিনেমার স্টাইলে গুলি ছুড়তে ছুড়তে দৌড়ে পালায়। ইয়াসিন ধরা পড়ে যায়। চোর চোর… চারদিকে চিৎকার। রাগে তাদের চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। তারা তার গায়ে এসে পড়ছিল আর সজোরে ধাক্কা দিচ্ছিল। চারদিক থেকে ধেয়ে আসছিল কিল চড় ঘুষি থাপ্পড়, কনুইয়ের গুতা আর লাথি। ওরা সবাই মিলে তাকে ভয়ংকরভাবে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছিল। তারপর তাকে বেঁধে রাখা হলো। সে কিন্তু জিহ্বার নীচে কৌশলে রেখে দিয়েছিল দেড়ভরি ওজনের চেনটি। ওরা টর্চ দিয়ে মুখের ভিতরে কয়েকবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলো। চেনটি পাওয়া গেল না। একটা ভীষণ মোটা লোক তার বুকে যখন লাথি মারার জন্য এগিয়ে আসতে লাগল, সে মুহূর্তে সে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এত মানুষের মাঝে সে কী ভয়ংকরভাবে একা আর অসহায়! থানা থেকে পুলিশ এল। দুইদিন হাজতে ছিল। দুদিন পর যে বড় ভাইয়ের কাছে ছিনতাইয়ের গয়নাগুলো ওরা বিক্রি করত, সেই বড় ভাই পুলিশের সাথে দেখা করে তাকে ছাড়িয়ে আনে। পরের দিকে বড় ভাইই তাকে নিজের লোকের মতো ব্যবহার করে। কয়েকদিন পরেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তার হাতে পিস্তল তুলে দেয়। তখন থেকে মার্ডার করাই তার একমাত্র পেশা। টাকার অভাব তার আর হয়নি। বরং টাকা এত বেশি ছিল যে মাঝে মাঝে সীমার প্রশ্নে সে থমকে যেত? বছরে দুই-একবার লুকিয়ে বাড়ি যেত আর অনেক গয়না নিয়ে যেত। সীমা অবাক হয়ে বলত, ‘‘কী কাম করো তুমি? এত টাকা পাও কই?’’ ‘‘তোরে কইছি না, গাড়ির ব্যবসা করি? তোর এত প্যডর-প্যাডর ক্যা?’’ সীমা অবাক হয়। দু-একদিনের জন্য বেচারা স্বামীকে পায়, তাই আর ঘাটাতে চায় না। সীমার পাশে শুয়ে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে অপলক চোখে সীমাকে দেখত। পবিত্র শরীরে সে যেন বেহেশতের হুর। আর তার পাশে শুয়ে থাকা সে নিজেকে মনে করত মূর্তিমান শয়তান। বিভিন্ন পতিতা পল্লীতে সে অসংখ্যবার গেছে আর সেখানে যেয়ে সে পছন্দ করেছে সবচেয়ে কুৎসিত মেয়েটিকে। যেন তার ভিতরের অন্ধকারকে সে মিলিয়ে নিতে পারে গনগনে কুৎসিত যৌনতায়। সীমার কথা মাথায় রেখে সে কখনও কনডম ছাড়া সে মেয়েগুলোকে ব্যবহার করেনি। যদি ওর অপরাধে সীমার শরীরে কোন রোগ ছড়িয়ে পড়ে?
৪
সন্তানের পিতা হতে সে চায়নি, কোনোকালে। তবু এই রাতদুপুরে আকাশ ফেড়ে ওঠা তীব্র ভয়ের কবলে তাকে পড়তে হচ্ছে। সে কি পারবে বুক ভরে ভালোবাসতে তার আত্মজকে! হাসতে হাসতে ছুরি বসিয়েছে সে প্রতিপক্ষের বুকে, শ্বাসরুদ্ধ করে মেরেছে কতজনকে, কত বাবার বুক যে সে খালি করেছে তার ইয়ত্তা নাই। বারবার যখন খসে যেত সীমার সন্তান, তার কোনো শোক কষ্ট, কিছুই হতো না। বরং এক ধরনের মুক্তির আনন্দ অনুভব করত সে, যেন এটাই স্বাভাবিক। অথচ আজ যে কথা ভেসে আসল ইথারে তাতে কোন অস্পষ্ট ইঙ্গিত!
ভাবতে ভাবতে সে আজানের শব্দ শোনে। রিকশাটা ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে। তার হঠাৎ ইচ্ছা করে রিকশাওয়ালার সাথে দুইটা কথা বলতে।
‘বুড়া মিয়ার কী বেশি কষ্ট হইতাছে? টানতে পারেন না দেহি।’
‘হ তা হইতাছে কিছুডা। গরীব মানুষ, আল্লায় কপালে রাখছে কষ্ট, কী করুম কন?’ ‘ছেলেপেলে আছে?’ ‘আছে দুইছেলে, লেহাপড়া করাইতেছি। হালাল কামাই করি মিয়াভাই, হালাল কামাই খাই। তা দিয়া পোলাপান মানুষ করতাছি। ’
কথাগুলো তাকে আরও বিভ্রান্ত করতে থাকে। হালাল কামাই শব্দটির সাথে সাথে তার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে একটি সুখি পরিবার। শানকিতে সাদা ভাত, ছোট ঘর, শুনশান উঠান, বারান্দায় ছোট একটি শিশু ঝুমঝুমি দিয়ে খেলছে। এর কোনোকিছুই তার নয়। কোনোদিন সে তা পাবে না। মানুষ মারা বহুত কঠিন কাজ, সবাই তা পারে না। মানুষ মারার আগে নিজেকে প্রথমে মারতে হয়। বহু বছর আগেই নিজেকে সে মেরে ফেলেছে। নিজের শরীরের চারপাশে সে একটা পঁচে যাওয়া মৃত শরীরের গন্ধ পেতে থাকে।
তবু ভোরের বাতাস ফিনফিনে নরম আর ঝিরঝিরে ভাব নিয়ে ভেসে আসে। তার সাথে যেন সে টের পায় মায়ের আঁচলের গন্ধ, সীমার পবিত্র মুখ। তার নিষ্পাপ সন্তানের শরীর। যে শরীর এই পাপিষ্ঠ হাতে কখনও সে ছুঁতে পারবে না। তবু চারপাশে এক অদৃশ্য শান্তির আচ্ছন্নতা টের পায় সে। নীরবতার সাথে আকাশে ভেসে থাকে একটি মিষ্টি শুকতারা। এই সুষম সময়ে সে মন খুলে দিয়ে এক মীমাংসায় যেতে চায় । তার মনে হয় আস্তানার দিকে এগুনো আর ঠিক হবে না। চারপাশে ঘাপটি-মেরে-থাকা অন্ধকারকে পাশ কাটিয়ে রিকশাটিকে সে কমলাপুরের দিকে যেতে বলে। সে ভাবতে থাকে, ট্রেনের প্রচণ্ড শব্দ আর কাঁপুনিতে তার পলায়নপর মুখের যন্ত্রণা কারো চোখে ধরা পরবে না।
জন্ম কুমিল্লায়, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর, লেখালেখি করছেন দীর্ঘকাল ধরে। মূলত গল্প ও উপন্যাস লিখে থাকেন। প্রথম উপন্যাস অতঃপর নিজের কাছে প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে, একুশে বইমেলায়। দ্বিতীয় উপন্যাস, দিগন্ত ঢেউয়ের ওপারে প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে । ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ বর্ণান্ধ রাত ও ডায়েরি। নভেলা যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্রঝিনুক ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। লেখালেখির বাইরে ব্যক্তিগত জীবনে সংগীতচর্চা তাঁর অন্যতম সংরাগ।