| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

সাপ্তাহিক গীতরঙ্গ: ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক জাদুঘর

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ছোটবেলা থেকে জাদুঘর শব্দটির সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। বিভিন্ন বয়সে জাদুঘর নিয়ে চিন্তাভাবনাও বিভিন্ন ছিল। ছোটবেলায় জাদুঘর শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে আসতো এমন এক দৃশ্য যেখানে একটি ঘরে যাদুকর যাদু দেখাচ্ছে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে চিন্তাচেতনার পরিবর্তনের পাশাপাশি জাদুঘর সম্পর্কে আমাদের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের লেখা “জাদুঘরে কেন যাবো” প্রবন্ধটির মাধ্যমে জাদুঘর আমাদের কাছে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করে। তিনি লিখেছেন, জাদুঘরের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অজানা বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ বা কৌতুহল সৃষ্টি করা। আজকের এ আলোচনায় জাদুঘর স্থাপনের ইতিহাস, প্রকারভেদ, কিভাবে জাদুঘর গড়ে উঠে, জাদুঘরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

জাদুঘর কি?

জাদুঘর সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই জাদুঘর কি সেটা জানতে হবে। জাদুঘর এমন একটি জায়গা যেখানে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক, ঐতিহাসিক পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংগৃহীত থাকে এবং প্রদর্শিত হয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের মতে, বাংলা জাদুঘর শব্দটি আরবি ‘ আজায়েব খানা’ শব্দটির সাথে তুলনীয়। ইংরেজি Museum (মিউজিয়াম) শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে। মিউজিয়াম শব্দটির মূল উৎস গ্রিক শব্দ Mouseion থেকে যার অর্থ দাঁড়ায় গ্রিক পুরাণের শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক মিউজদের মন্দির। প্রাচীন গ্রিসে মন্দিরসমূহকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতো বিভিন্ন পুরাকীর্তির সংগ্রহশালা। International Council of Museum এর মতে, জাদুঘর এমন একটি অলাভজনক, উন্মুক্ত ও স্থায়ী সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেখানে জ্ঞানার্জন ও আনন্দদানের উদ্দেশ্যে প্রাচীন ঐতিহাসিক বস্তু সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শণ করা হয়। এসব নিদর্শন নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নতুন করে জানা সম্ভব হয়।

জাদুঘরের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি

এই পৃথিবীতে উদ্দেশ্য ছাড়া কোনকিছুই করা হয় না। এরকমই বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি নিয়ে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাদুঘরের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি নিম্নরূপঃ

  • জাদুঘর স্থাপন করতে গেলে প্রথমেই মূলভিত্তির দিকে নজর দিতে হয় আর তা হলো নিদর্শনসমূহ সংগ্রহ। এটি জাদুঘরের প্রাথমিক উদ্দেশ্যও বটে। কারণ পূর্বের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিদর্শনই আজকের ইতিহাস রচনা করবে।
  • নিদর্শন সংগ্রহের পর আরো বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন। জাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন নিদর্শনের মধ্যে প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাদের ব্যবহৃত উপকরণ, অলংকার, মুদ্রা, শিল্পকর্ম, দুষ্প্রাপ্য বস্তু উল্লেখযোগ্য।
  • জাদুঘরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কোন মূল্যবাদ বস্তুর প্রতিকৃতি তৈরি করা যার বাস্তবিক প্রদর্শন সম্ভব হয় না।
  • সংগৃহীত সংরক্ষিত নিদর্শনাবলী প্রদর্শন, জনসচেতনতা তৈরি, গবেষণায় সাহায্য, জ্ঞানের প্রসার, জীবন্ত ইতিহাস উপস্থাপন জাদুঘরের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মূলত অতীত পুনর্গঠনই জাদুঘর স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য।

জাদুঘরের শ্রেণিবিভাগ

প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত বস্তুগুলোর ভিত্তিতে জাদুঘরকে প্রধানত ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

  • সাধারণ জাদুঘর
  • কলা জাদুঘর
  • ঐতিহাসিক জাদুঘর
  • বিজ্ঞান জাদুঘর

১। সাধারণ জাদুঘর

  • বহুমুখী জাদুঘরঃ এখানে শিল্প ও স্থাপত্যকীর্তির নমুনা, চিত্র, পান্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। যেমন, ভারতীয় জাদুঘর, কলকাতা।
  • শিশু জাদুঘরঃ ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য মূলত এ ধরণের জাদুঘর তৈরি করা হয়। যেমন, মাউন্ট রায়ান্ড চিল্ড্রেন মিউজিয়াম।
  • কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরঃ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে এ ধরনের জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের গবেষণার কাজে জাদুঘরকে ব্যবহার করেন। যেমন, ব্যাসেলের জাদুঘর, সুইজারল্যান্ড।

২। কলা জাদুঘরঃ

  • শিল্প সংরক্ষণ জাদুঘরঃ এ ধরণের জাদুঘরে মৃৎশিল্প, আসবাবপত্র, ভাস্কর্য, নকশা, প্রাচীনমূদ্রণ প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। যেমন, আশুতোষ মিউজিয়াম অব ইন্ডিয়ান আর্ট, কলকাতা।
  • শিল্পদ্রব্য ও প্রতিকৃতি প্রদর্শনশালাঃ এ জাদুঘরে শিপ্লজাত জিনিসপত্র প্রদর্শন করা হয়। যেমন, অকল্যান্ড শিল্প প্রদর্শনশালা, নিউজিল্যান্ড।
  • আধুনিক কলা জাদুঘরঃ এখানে সমসাময়িক শিল্পকলার নমুনাসমূহ গবেষণার জন্য সংরক্ষিত থাকে।
  • লোককলা ও কারুশিল্প জাদুঘরঃ ন্যাশনাল ফোক ও ক্রাফট মিউজিয়াম, নয়াদিল্লি।

৩। বিজ্ঞান জাদুঘরঃ

  • ভূতাত্ত্বিক জাদুঘরঃ এখানে খনিজ দ্রব্য, পাথর, জীবাশ্ম প্রভৃতি ভূতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষিত থাকে। যেমন, বোটালিক্যাল গার্ডেন, পশ্চিমবঙ্গ।
  • প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরঃ এ ধরণের জাদুঘরে জীবন্ত প্রাণিদের স্থায়ীভাবে প্রদর্শন করানো হয় কিংবা বিভিন্ন বিলুপ্ত প্রাণিকে প্রক্রিয়াজাত করে আলাদাভাবেও সংরক্ষণ করা হয়। যেমন, জুলোজিকাল গার্ডেন, কোলকাতা।

৪। ঐতিহাসিক জাদুঘরঃ

  • প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরঃ মহাস্থানগড় জাদুঘর, বগুড়া
  • ব্যক্তিবিষয়ক জাদুঘরঃ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, কলকাতা।
  • স্মৃতি জাদুঘরঃ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা

জাদুঘর কিভাবে গড়ে উঠেছে?

জাদুঘর হুট করে গড়ে উঠেনি। আর পূর্বের জাদুঘরসমূহ বর্তমানের মত ছিল না। প্রারম্ভিক সময়ে শুধু ধনী ব্যক্তি অথবা তাদের পরিবারের বিরল ও দুষ্প্রাপ্য বস্তু প্রদর্শিত হতো। তখন এ গুলোকে আশ্চর্যকক্ষ/ কৌতুহল কেবিনেট নামকরণ করা হয়েছিল। ২৫০০ বছর পূর্বে ব্যাবিলিয়ান রাজকুমারী দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জাদুঘর। বর্তমান বিশ্বের সব প্রাচীন জাদুঘরগুলো নির্মিত হয়েছিল ইতালিতে রেনেসাঁর সময়ে। বিশ্বের প্রাচীনতম সংগ্রহশালা “ক্যাপিটোলিন মিউজিয়াম” এর সূচনা হয় ১৪৭১ সালে। বর্তমান বিশ্বে যতসব জাদুঘর আছে তা প্রাচীন জাদুঘরের সোনালী ফসল বলা চলে।

ভারতীয় উপমহাদেশে জাদুঘর

ব্রিটিশদের মাধ্যমে মূলত বাংলায় তথা ভারতীয় উপমহাদেশে জাদুঘরের ধারণা এসেছে। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যদের উদ্যোগে এ উপমহাদেশে জাদুঘরের ইতিহাসে সূচনা হয় ১৭৯৬ সালে। কলকাতার পার্কস্ট্রিটে বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য একখন্ড জমির ব্যবস্থা করেন। ১৮০৮ সালে নির্মাণ শেষ হলেও ১৮১৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়াম নামে তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এরপর ১৮১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে “কেরি মিউজিয়াম” প্রতিষ্ঠিত হয় যা উপমহাদেশের প্রথম মহাবিদ্যালয় জাদুঘর। প্রথম ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর হলো স্টুয়ার্ট মিউজিয়াম। উইলিয়াম জেমস্ কে বাংলার জাদুঘর সংস্কৃতির প্রবর্তক বিবেচনা করা হলেও উপমহাদেশে জাতীয় জাদুঘরের ধারণা আসে জেমস প্রিন্সেপ এর কাছ থেকে। ব্রিটিশ কখনোই এই উপমহাদেশে জাদুঘর স্থাপনে আগ্রহী ছিল না। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এখান থেকে নিদর্শন নিয়ে লন্ডনে নিজেদের জাদুঘর সমৃদ্ধ করা। ১৮৬১ সালে “আর্কি ও লজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপমহাদেশে নতুন যুগের সূচনা হয়।

পরবর্তীতে ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ সরকাল এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়ামকে ইম্পেরিয়াল মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করে যা পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯০১ সালের ২২ জানুয়ারি মহারানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর তার শাসনামলের স্মৃতির রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠিত হয় ” ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল”। ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে ” বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ চিত্রশালা” স্থাপিত হয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে এই সংগ্রহশালার শাখা স্থাপিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর স্থাপিত হয় যা মূলত নৃতাত্ত্বিক জাদুঘর।

বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর হচ্ছে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর যা ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় “ঢাকা মিউজিয়াম” যার আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধন করেন লর্ড কারমাইকেল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালে দেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখান হতে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের জন্য ১৯৬৬ সালে ময়নামতিতে, ১৯৬৭ সালে মহাস্থানগড়ে, ১৯৭১ সালে লালবাগ ফোর্টে প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িকে “সংরক্ষিত সৌধ” করা হয় যা পরবর্তীতে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়।

১৯৬৬ সালে ঢাকার শাহবাগে কেন্দ্রীয় জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং বলা হয় ঢাকা জাদুঘর হবে প্রস্তাবিত জাদুঘরের মূল অংশ। এ ভবনের নির্মাণ শেষ হবার পর ১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় “বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর” যেখানে ঢাকা জাদুঘরের নিদর্শনগুলো স্থানান্তর করা হয়। দেশের বর্তমানে ৮০ টির ও বেশি জাদুঘর রয়েছে যার মধ্যে বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর, আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সিলেটের ওসমানী স্মৃতি জাদুঘর উল্লেখযোগ্য।

বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জাদুঘর

  • লুভর মিউজিয়াম, প্যারিস
  • ব্রিটিশ মিউজিয়াম, লন্ডন
  • প্রাদো মিউজিয়াম
  • গিমে মিউজিয়াম
  • মাদামতুসো মিউজিয়াম
  • মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম
  • ন্যাশনাল গ্যালারী অব আর্টস্, ওয়াশিংটন ডিসি
  • দ্য ভ্যাটিকান মিউজিয়াম
  • ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব চায়না
  • উফিজি গ্যালারি মিউজিয়াম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত