অনন্ত আগামীর দিকে নবনীতা দেবসেন
গতকাল অন্যলোকে ফিরে গেছেন কবি ও কথাসাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। তার প্রস্থানে বাংলা সাহিত্য অভিবাবক শূণ্যতার বেদনায় কাতর তেমনি পাঠকমহলেও চলছে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। ফেসবুকের পাতাজুড়েই আছে তাঁকে নিয়ে অজস্র ছবি ও কথা সেখান থেকে কিছু নির্বাচিত লেখা ইরাবতীর পাঠকদের জন্য তুলে দেয়া হলো।
কবি,কথাসাহিত্যিক
যাঁদের লেখা পড়ে বড় হলাম, তাঁরা সব একে একে চলে গেলেন। নবনীতাদির চলে যাওয়াটা আটকে ছিল ক্ষীণ আশা আকাঙ্ক্ষার সুতোয়, এই মাত্র শেষতম সংযোজন হয়ে গেল ওঁর মৃত্যু। নবনীতাদির সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল একটা লেখকদের গেট টুগেদারে, ২০১৭’র ডিসেম্বরে। বেশ অনেক বছর যাবৎ শরীরটা ভাঙছিল নবনীতাদির। হাঁটতেন লাঠি নিয়ে। সঙ্গে কেউ না কেউ থাকত। একটা শ্বাসকষ্ট ছিল ওঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। শুনেছি সেটা প্রায়ই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যেত, অথচ নাকে নল ঢুকিয়েও তিনি বসে বসে লিখতেন সেই অবস্থায়। বোধহয় প্রতিদিনের রোববার কাগজটায় তিনি টানা দশ বছর লিখে গেছেন ‘ভালোবাসার বারান্দা” নামক বহু পাঠক আদৃত মুক্ত গদ্যটি। লেখা থেকে কখনো তিনি ছুটি নেননি। সেদিন সেই লেখকদের গেট টুগেদারে এসেই বললেন,” জানিস তো, এখান থেকে আমাকে এখন এয়ারপোর্টে গিয়ে দিল্লির ফ্লাইট ধরতে হবে। একটু বসেই চলে যাব। কিছু খাব না। শুধু একটু কফি খাব।” খুব টলোমলো করছিলেন সেদিন। আমি বিস্ময় লুকোতে পারিনি। বললাম,” তুমি এয়ারপোর্ট যাবে, সেখান থেকে দিল্লি যাবে? দিল্লিতে তুমি কতদিন থাকবে?” বললেন,” দুদিন রে। দুদিন। একটা বক্তৃতা দিয়েই আবার ফিরে যাব। ফিরে আবার বিদেশ যেতে হবে।”
আমি সত্যিই তখন মনে মনে এটা ভেবেছিলাম যে, একজন প্রায় আশি ছুঁতে চলা, অসুস্থ মানুষ হিন্দুস্থান পার্ক থেকে সম্পূর্ণ উল্টো পথ উজিয়ে গ্রেট ইস্টার্ন ললিত’এ এলেন পাঁচ মিনিট বসবেন বলে? লেখকদের মাঝখানে একটা দুটো মিনিট কাটাবেন বলে? এ এক অবিশ্বাস্য জীবনীশক্তি। অবিশ্বাস্য আগ্রহ নিজের জগতটার প্রতি। এই লেখালিখির জগতটার প্রতি এই মায়া, এই টান- যদি চোখে না দেখতাম বিশ্বাস করা সম্ভব হত না। প্রবল এই মায়া না থাকলে লেখালিখির সাফল্যের শীর্ষবিন্দু; নাম, খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে ফেলেও একজন মানুষ হাঁটুর বয়সি লেখকদের সঙ্গে একটু চা পান করার আনন্দ নিতে এভাবে এতটা ঘুর পথে পাড়ি দিতে পারেন না! যে জীবন ফড়িংএর, যে জীবন দোয়েলের…- নাহ, নবনীতা দেবসেনের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। কখনো কখনো মনে হয় নবনীতা দেবসেন ৮১ বছর নয়, ১৮১ বছর বাঁচার মত করে বেঁচে গেলেন। এত কাজ করে গেছেন, এত ট্র্যাভেল করেছেন, এত সেমিনারে বক্তৃতা দিয়েছেন, এত মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের কথা মনে রেখেছেন, তাদের স্মৃতিতর্পণ করে গেছেন লেখায়, এত মন তৈরি করেছেন যাদবপুরে কম্পারেটিভ লিটারেচারের অধ্যাপক হিসেবে…, একটা বিরাট জীবন এবং একটা অতিকায় কর্মকাণ্ড। এই ছিলেন নবনীতা দেবসেন। মা রাধারাণী দেবীকে ভালোবাসতেন ভীষণ। বোধহয় প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করতেন নিজের মাকে। যোগ্য মায়ের যোগ্য মেয়ে ছিলেন তিনি। বাঙালি নারীদের চিন্তায় চেতনায় মা-মেয়ে দুজনেই প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আসলে নবনীতাদি চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু এত পরিপূর্ণ একটা জীবন তিনি বেঁচে গেলেন যে মনে হয় না আফশোস করার মত একটা অংশও তিনি রেখে গেছেন। এর থেকে পরিপূর্ণ জীবন আর হয় না। কটা বাঙালি মেয়ে এমন ভাবে সদর্পে, আনন্দ আর বৈদগ্ধ্যের পতাকা উড়িয়ে বেঁচেছেন? এমন কি মৃত্যুর আগের সপ্তাহেও তিনি লিখেছেন,” অলরাইট ক্যামেন ফাইট, ক্যামেন ফাইট।” এবং তাঁর মৃত্যুর আগেই যারা তাঁর মৃত্যুর চিন্তায় মন খারাপ করছে, যাদের সেই লেখায় একটু ধমকও দিয়ে গেছেন তিনি। যদিও কলকাতায় তিনি ‘সই’ নামক মেয়েদের সাহিত্য চর্চার আসরটি তৈরি করে গেছিলেন, কিন্তু নবনীতাদি নিজে কোন ভাবে ভেতরে বাইরে তাঁর নারীর পরিচয়ে আবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর লেখার মধ্যে যেমন ঝকঝক করত রোদ্দুর তেমনি ছিল তাঁর স্বভাব। সব সময় হাসতেন। নিজেকে নিয়ে মজা করার বিরল প্রতিভা ছিল তাঁর মধ্যে এবং সেটাকে করে ফেলেছিলেন লেখার প্রয়োজনীয় অস্ত্র। খুব কম মেয়েদের মধ্যে এই গুণটা থাকে। মেয়েরা নিজেকে নিয়ে প্রায়ই হাসতে পারে না। এমন একটা প্রাণবন্ত হাসি ছিল ওঁর যে ৮০ বছর বয়েসেও ওকে একটা বাচ্চা মেয়ে মনে হত। এরকম একটা মানুষ চলে গেলে, আশ্চর্যজনক ভাবে মৃত্যুকে ভয়ঙ্কর মনে হয় না। মৃত্যু কেমন ছেলেমানুষ হয়ে যায় এরকম একটা জীবনের কাছে। শুধু আমাদের দিক থেকে, ৫০’শের কবিদের, লেখকদের; কৃত্তিবাসী কবিদের তাঁবু গুলো বড্ড ফাঁকা দেখতে লাগে। বাঙালির জীবন আবারও খাঁ খাঁ করে ওঠে।
নবনীতা দেবসেনকে প্রথম পড়েছিলাম, খুব মনযোগ দিয়ে, তাঁর A Woman’s Retelling of the Rama-Tale: Chandrabati Ramayana Re-read in 1990 (English)। সেটা ১৯৯৯-২০০০ সালের কথা। বইটা নিজে পড়েছি তো বটেই, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে আমার চারিপাশে সারাক্ষণ ঘিরে থাকা বেশ কয়েকজনকে সেই বইয়ের প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা ইংরেজি থেকে পড়ে প্রত্যেকটি বাক্য বাংলায় অনুবাদ করে শুনিয়েছি। অজস্র আলোচনা করেছি। পরে সেই বই থেকে অবলীলায় নিয়ে, নাম কা ওয়াস্তে নবনীতার নাম একবার উল্লেখ করে বা না করে চন্দ্রাবতী বিশেষজ্ঞ হয়ে যেতে দেখলাম কাউকে কাউকে। একই লেখা শতবার শতনামে ছাপাতে দেখলাম। ছাপা হতে হতে সেসব লেখায় নবনীতার নাম আর থাকে না দেখি। যেনো বা নিজেরই লেখা! যাক, বইটা অন্য কাউকে চন্দ্রাবতী বিশেষজ্ঞ বানিয়েছে এই অজ্ঞ দেশে। নবনীতার তাতে কী-ই বা আসে যায়!
এই বইয়ের বাইরেও নবনীতার লেখা পড়েছি ততদিনে আর অমর্ত্য সেন নোবেল পাবার পরে। কী সরস লেখা! অমর্ত্যর নোবেল পাবার পরে নিজের উচ্ছ্বাস নিয়ে নিজের স্যাটায়ার পড়ার পরে বুঝেছিলাম কী জিনিস তিনি। কে তাকে কী করেছে, কী-ই বা আসে যায় তাঁর! শুধু অমর্ত্য সেনের সাথে ডিভোর্স হয়ে যাবার পরে তিনি আর তাঁর মেয়েরা হাসি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পড়ে কেনো জানিনা আমার নিজের চোখ ভিজেছিলো, ভিজেছে বহুবার।
পড়েছি তাঁর গল্প, কিছু কবিতা, আমারিকার বাঙ্গালি অভিজাত সমাজে
নবনীতার কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আবৃত্তি করতে শুনেছি পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। এমন নয় যে তারা বাংলা ভুলে গেছেন। কিন্তু স্ট্যাটাস আছে না! কী আসে যায় তা’তে নরেন্দ্র দেব আর রাধারানীর বিদূষী কন্যার! আজীবন আটপৌরে মহা বিদ্বান, সাহিত্যিক এই মানুষটির!
শুনলাম চলে গেছেন আজ। ভেসে উঠলো তার সাদাসিধে শাড়ির, সাধারণ সাজগোজে, পুরু চশমায় ঘেরা হাস্যজ্জ্বল মুখটির ভেতরের মানুষটির প্রখর ব্যক্তিত্ব। ‘সীতা থেকে শুরু’ কিংবা নেহাত ভ্রমণকাহিনী ‘করুণা তোমার পথ দিয়ে’ চলতে চলতে চলেই গেলেন অবলীলায়।
আমার ব্যক্তিগত ঋণের কথা বলি। যদিও বিশেষ তত্ত্ব কিছু না জেনেই ততোদিনে লিখে ফেলেছি ‘ঠাকুর মা’র ঝুলির সেইসব বুড়ি, সূয়োরানী ও রাক্ষসীরা’, তবুও তাঁর চন্দ্রাবতীর রামায়ন আমার চিন্তার কাঠামোকে সমর্থন দিয়েছে। তিনি নারীবাদী লেখক হিসেবে পরিচিত নন। কিন্তু এক বেগম রোকেয়া ছাড়া বাংলা ভাষায় আর কোন লেখকের লেখা আমার নারীবাদী চিন্তা গঠনে ভূমিকা রেখেছে কি? রোকেয়ার পরে নবনীতার চন্দ্রাবতীর রামায়ণ নিয়ে লেখা বইটির কথাই বলবো শুধু।
আপনার অনায়াস যাত্রা শুভ হোক।
লেখক,গবেষক
জীবনের শেষ দিককার লেখায় হাওয়াবদলের কথা লিখেছিলেন তিনি।লিখেছিলেন, ‘তিনতলায় আমি ক্যানসারের হাওয়ায় ভাসছি’।কিন্তু এখানেই বাক্য শেষ করেননি।আরও লিখেছিলেন, ‘হাওয়াবদল তো এখানেই শেষ নয়।বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি রয়।মাঝে মাঝে হাওয়াবাতাস পাল্টে যায়।মেঘ ছেঁড়া আলো এসে পড়ে জীবনে’।
শুধুমাত্র এই জীবনমুখীনতার জন্য নবনীতা দেব সেনকে মনে রাখা যায়।এমন কোনও লেখা পড়িনি নবনীতার যেখানে প্রাণের ফূর্তি নাই।এমন কোনও ছবি দেখি নাই নবনীতার যেখানে প্রাণের হাসিমুখ নাই।
মারা যাবেন ৭ নভেম্বর ২০১৯, মাত্র ১১ দিন আগে হয়তো শেষ দিককার বাক্যটি লিখছেন।লিখছেন ২০ বছর আগে তাঁর ‘অন্যদ্বীপ’ উপন্যাসটি ই-বুক করে ফ্লপিতে বেরিয়েছিল।সেই ফ্লপি আজ আর নাই।ফ্লপি ড্রাইভও নাই।লিখছেন হাওয়াবদল তো একেই বলে।
আমরা জানি নবনীতাদি, হাওয়াবদলে সবকিছু ঘুরে গেলেও অর্জুনের চোখ ঠিক লক্ষ্যভেদ করে।হাজার ঝড়ঝাপটাতেও মানুষ গুহাচিত্র আঁকে।কারও অবিশ্বাস্য জীবন কাহিনি লেখা হয় ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে’-এ।
রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন বুঝি নাম? আমার কেন জানিনা ‘নবনীতা’র সঙ্গে দান্তের ‘ নবজীবন’- এর কথা মনে পড়ে।
এই সব পরলোক টরলোক মানি না।ওই তো! জীবনের স্টিয়ারিং ধরে বসে আছেন আপনি।আরেকটা জার্নি শুরু করবেন বলে।
কবি,কথাসাহিত্যিক
ওঁর নামের পাশে ব্র্যাকেটের মধ্যে ৮১ সংখ্যাটা কেমন যেন বেমানান, বরং মিরর মোডের সেল্ফির মতো ১ আর ৮ ডিজিটদুটো ডাইনে-বাঁয়ে এদিকওদিক হয়ে গেছে ভেবে নিতে পারলে যেন প্রকৃতির বিচার সাব্যস্ত হয়েছে বলে মনে হয়।
সাত বছর আগে সুনীলদা যখন চলে গেলেন, সুনীলদার চেয়ে বছরচারেকের ছোট ওঁর এক স্মৃতিচারণ─কোথায় মনে নেই─পড়েছিলাম: কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজে ওঁদের উভয়েরই বন্ধু এমন কেউ একদিন ওঁকে সুনীলদার টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসালেন। পরিচয়পর্বের পরের অংশটা─যদ্দূর মনে আছে─ওঁরই জবানিতে, “সুনীল বলল, ‘নতুন বন্ধুকে তো মিষ্টিমুখ করাতে হয়, কিন্তু এখানে মিষ্টি পাই কোথায়?’ বলতে বলতেই টেবিলে রাখা চিনির পটটা চোখে পড়তে সুনীল ওটা থেকে একচামচ চিনি তুলে আমার হাতে দিয়েছিল। বলুন তো দেখি, এমন মিষ্টি আলাপ আর হয়?”
পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়কালব্যাপী সম্পর্ক ছিল এমন লেখকবন্ধুর প্রয়াণে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এমন একটি ঘটনা যাঁর মনের উপরিতলে ভেসে ওঠে প্রথমেই স্বচ্ছন্দ মাধুর্যে, সেই মনের অধিকারিণীর বয়সের হিসেবই বা করতে বসবে কোন অর্বাচীন, আর মৃত্যুই বা তাঁকে সত্যি সত্যি গ্রাস করবে কোন অগ্নিতে!
জানতে ইচ্ছে হয়, আজ নবনীতা দেবসেনের প্রয়াণে স্মৃতিচারণ করতে হলে কী দিয়ে শুরু করতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। মধুরতর কিছু হয়তো ছিলও বা তাঁর মনের সিন্দুকে, কিন্তু তা আর কোনওদিন জানা হবে না আমাদের। স্মৃতিচারণে রিটার্ন গিফট বলে কিছু হয় না।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
হে পূর্ণ তব চরণের তলে…
না , তাঁর বাড়িতে কখনো যাইনি আমি । কথাও হয়নি সামনা-সামনি। ফোনে দু’চারবার হয়েছে, তখন আমার কলেজবেলা। তারপর বহুবার দূর থেকে দেখেছি। আবার খুব কাছ থেকেও দেখেছি। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের আলাপ-আলোচনা, নির্মল মজা, আড্ডা শুনেছি। সুযোগ পেয়েও কথা বলা হয়নি। অদ্ভুত এক সংকোচ চিরদিন-ই আমার ছিল। তাঁর সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বহুবার কবিতা পড়েছি। তাঁর কবিতাও শুনেছি। তাঁর মুগ্ধ করা বক্তব্য-ও কম শুনিনি। তিনি আমার অন্যতম প্রিয় সাহিত্যিক নবনীতা দেব সেন। গতকাল চলে গেলেন। সময় হলে চলে যেতে হয় , চলে যেতে হবে । তবু ভেতরে ভেতরে বেদনা অনুভব করছি। মনখারাপ হয়ে আছে ঘন মেঘের মতোই।
তাঁর যে বইটি পড়ে তাঁর ভক্ত হয়েছিলাম, সেটি “মনখারাপের গল্প।” ছোটদের বই। গল্প যে এত সহজ করে লেখা যায় তিনিই দেখালেন। একটা পথ পেয়ে গেলাম যেন। তারপর থেকেই নবনীতা দেব সেনের লেখা পড়া শুরু করলাম । সে সময় ‘ বিকল্প ‘ তাঁর একটি মুক্তগদ্যের বই প্রকাশ করেছিল “বারান্দা।” গদ্যের অদ্ভুত এক জগৎ খুলে গেল আমার সামনে। তাঁর লেখা পড়ে বিদেশকে দেখলাম, জানলাম। তাঁর মতো সহজ করে গদ্য খুব কম জন-ই লিখতে পারেন। তিনি তাঁর সব লেখার মধ্যে দিয়ে পাঠকের সঙ্গে , মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চাইতেন। অত্যন্ত ক্ষুরধার ও অকাট্য যুক্তি। চমৎকার রসবোধ । ভ্রমণ সাহিত্যের নব রূপায়ন দেখেছি তাঁর ভ্রমণ-কাহিনিতে। চূড়ান্ত সমস্যা ও বিপদের মুখেও তিনি স্থির , নির্বিকার। রসিকতা করছেন এবং সেই বর্ণনাও দিচ্ছেন। ‘হে পূর্ণ তর চরণের তলে’ এই ভ্রমণের বইটি আজো আমাকে মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন করে রাখে। এমন গদ্য এমন দৃশ্যকল্পের জগৎ আর কোথায় পাবো? আকাদেমি পাওয়ার পর কিনে ফেলেছিলাম ‘নটী নবনীতা ‘। ‘শনি-রবি’ তাঁর একটি অসামান্য উপন্যাস। একান্নবর্তী বনেদী বাড়ির কথা– সে বাড়ির একাল-সেকাল, জেনারেশন গ্যাপ এসব নিয়ে লেখা। মজার ও সরস। প্রতিদিনে দীর্ঘদিন পড়েছিলাম ‘ভালো-বাসার বারান্দা’। বহু বিচিত্র বিষয় জেনেছি সে’সব পড়ে। তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ আমার কাছে সম্পদ স্বরূপ। মনখারাপ হলে পড়তে হয়। অনেক কঠিন কঠিন কথা যে সহজ করে বলা যায়, তা ওঁর কবিতায় দেখেছি। পুরনো বইয়ের দোকান থেকে তাঁর একটি বই কিনেছিলাম অনুবাদ। সেও এক আকর গ্রন্থ। অনেক ১২শ শতকের কন্নর ভাষার কবিদের আধ্যাত্মিক কবিতা– শতেক বচন। কী চমৎকার অনুবাদ! সেখানে আক্কা মহাদেবী , আল্লামাপ্রভু, বাসবান্না প্রমুখের কবিতা ছিল। ছোটদের জন্য তাঁর গল্প কম নেই। সীতাকে নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা আছে তাঁর। নতুন ভাবনা, আধুনিক চিন্তার ফসল। বই-বাজার থেকে কিনেছিলাম। তা পড়ে নতুন করে আবার রামায়ণ পড়তে হল। প্রতি বছর পুজো সংখ্যাগুলোতে আগে খুঁজে দেখতাম নবনীতা দেব সেনের কী আছে– গল্প কবিতা উপন্যাস না ভ্রমণ? তাঁর হাসিটাই ছিল প্রাণময়। ভীষণ জীবন্ত। এমন ভাবে ক’জন বাঁচতে পারে? তাঁর মধ্যে ছিল আশা, আনন্দ, প্রাণ আর চির-সবুজের সমারোহ। বার্ধক্য তাঁকে গ্রাস করেনি। মৃত্যুর আগেও তিনি মনে-প্রাণে ছিলেন চির-কিশোরী। সে কথা তিনি বলতেন-ও। তাঁর রুচি শিক্ষা আদর্শ ভাবনাগুলো যদি মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারি, তাহলেই তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে পারব। তিনি অমর — ভালো-বাসার বারান্দা তিনি আমাদের জন্য দিয়ে গেছেন , আমরা যেন ভালোবাসতে পারি মানুষকে মানুষের মতো। শেষ যাত্রায় প্রণাম নবনীতাদি।
কবি, সাহিত্যিক, অনুবাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ
নবনীতা দেব সেনের জীবনটা দেখলে মনে হয় কল্পনায় এই স্থাপত্য সব মেয়েই চায়।
এই কাজের ক্ষমতা, শিক্ষাদীক্ষা, এলেম, নিজস্ব কণ্ঠ, আর সারা জীবন নিজের কাজ করে যাবার আদর্শ পরিমণ্ডল আর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।
জীবন না পেলে অন্তত জীবনের সঙ্গে তাঁর ডানপিটে এটিচিউড আমাদের জন্য দৃষ্টিকোণ হয়ে থাকে।
অমর্ত্য সেনের নোবেলের পরে একটা লেখা বেরিয়েছিল দেশ পত্রিকায়। উনি যে অন্যের সাফল্যে, বিশেষ করে তাঁর এক্স-পারটনারের সাফল্যে এতটা সারল্য আর আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন, এটা আমাদের মুগ্ধ করেছিল। অনেক বড়ো হওয়া যায়, কিন্তু সরলতা আর সুন্দর মন নিয়ে বড়ো হতে সবাই পারে না।
কবি, সাংবাদিক
কৃত্তিবাসের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ব বলে বসে আছি। ঐ প্রথমবার। একে একে তরুণ কবিরা কবিতা পড়ছেন।কত ভাবনার নকশা উড়ে বেরাচ্ছে ছোটো ঘরটা ভেতর। সম্রাজ্ঞীদি আর অভিজিৎদার সঞ্চালনায় কতদিন পর খোলা হাওয়া কৃত্তিবাসের আড্ডায়। নবনীতা দেবসেন এক এক জনের লেখা পড়া হলেই মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছেন,আমার বেলাও ব্যতিক্রম হল না৷ প্রণববাবু জিজ্ঞাসা করলেন –
” তুমি কী করো অর্পণ? পড়াশোনা”
আমার নির্ভেজাল উত্তর ছিল-
” না! চাকরি”
নবনীতাদি কী ভেবেছিলেন জানা নেই। প্রণামের পর মাথায় হাত দিয়ে বললেন- ” লেখা ছেড়ো না কিন্তু…”
কিছু কবিতা শোনার পর বাড়িতে ডাক্তার আসার সময় হতেই ঘরের বাইরে গাড়ি এসে দাঁড়াল।
” এই ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলো এত ভালো কবিতা লেখে, ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করে না, আর ক’দিনই বা আছি আমার তো হয়েই এল, এই ডাক্তার আর ওষুধের তাড়া ঠেলে দিচ্ছে শুধু ”
আমাদের সকলের সমস্বরে প্রতিবাদ ছিল এরপর। অবশ্যি, ঘরে ফেরার তাড়ার কাছে হার মেনেছিল আমাদের আবদার আর নবনীতাদির ইচ্ছাশক্তি…
তবু তো খোলা আকাশের নীচে হাওয়ার ছাদটুকু পেলে মনে হত তিনি আছেন, ভালোবাসার বারান্দা থেকে ভেসে আসা চেনা সুর, সেই কৃত্তিবাসের সন্ধ্যেটা…।
দুদিন দুঃসহ কাজের চাপের পর ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাড়ি ফিরে খবর পেলাম তিনি নেই। নেই-এর ভেতর থেকে যাওয়ার অস্তিত্ব চিরকালই যে গাঢ়, নবনীতাদি জানতেন।
তাই হয়ত ভাঙাচোরা জীবনের কুচি গোছাতে গোছাতে কানে বাজছিল কথাটা-
” লেখা ছেড়ো না কিন্তু…”
জানিনা আমরা আপনাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কতখানি আগলে রাখতে পারব কিন্তু আপনি তো আগলে রেখেছিলেন এতগুলো দিন, এ বাঁধন ছেড়ে যাওয়া কি এতই সহজ?
বাসা বদল হলেও ছাদ কিন্তু মাথার উপরেই থাকে,আপনিও ভালো থাকবেন নবনীতা দেবসেন!