আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
নবনীতা দেবসেন কে নিয়ে কিছু লিখতে হবে শুনে সারাদিন কিছু লিখতে পড়তে পারলাম না।আসলে এটাই ভাবছিলাম কি লিখব, কতটা চিনি, কতটাই বা দেখেছি তাকে! তারপর হঠাৎ করেই পরপর দৃশ্যমান তাঁর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তে গুলো । বাবা চলে গেলেন ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি মাঝরাতে ।জানি না কিভাবে খবরটা পেয়েছিলেন তিনি। ১২ জানুয়ারি ফোন এসেছিল তাঁর।তোমার বাবা চলে যেতে জানি না কার কী ক্ষতি হল, আমার অপূরণীয় ক্ষতি হল।অমন মানুষ. . কথা শেষ করতে পারেননি। আমি টেলিফোনের ওপার থেকে তাঁর কান্নার শব্দ শুনছি।অথচ বাবা কোনোদিন তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক আছে , এমন কথা বলেননি। আমারও জানা হয়নি কী ক্ষতি হল!
তবে বাবার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় নি।আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় কঙ্কাবতীদির সূত্রে । তখন আমার ডেরা কঙ্কাবতীদির বাড়ি।প্রায় প্রতিদিনই চলে যাই আর বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় ।যেমন ভাবে পরিচিত হয়েছিলাম অর্থনীতিবিদ অম্লান দত্ত, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শিবনারায়ন রায় সহ বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে ।এরাঁ প্রত্যেকেই বাবার অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন, কিন্তু বাবার সেমিনারে, বা অনুষ্ঠানে গলায় উত্তরীয় বা ফুলের স্তবক দেওয়া ছাড়া আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
সেই সম্পর্ক গুলোই গড়ে উঠতে শুরু করল কঙ্কাবতীদির হাত ধরে।
মনে পড়ছে প্রথম যেদিন নবনীতা মাসীর সঙ্গে পরিচয় হল, উনি একগাল হেসে বলেছিলেন, তুমি তো এক্কেবারে নদী।জীবনটাও তো নদীর মতোই।নদী কিন্তু কখনো থেমে থাকে না।তুমিও থেমো না।
কল্যানকাকু মারা যাবার দিন সকালে মামনির বাড়িতে পৌঁছবার পর মাসীও এলেন।সঙ্গে একের পর এক মানুষ আসছেন।ততদিনে তিনি মামনির সূত্রে আমারও মাসি হয়ে গেছেন। সকলেই মন খারাপ করে বসে আছি।হঠাৎ তিনি বললেন, এই খেয়েছিস কিছু? তোর মেয়ে তো বুকের দুধ খায় ।নিজে না খেলে ও কী করে দুধ পাবে! আমি সেই শোকের মধ্যেও অবাক হলাম, এত মনে রাখেন মাসি! সত্যি তো আমি ভুলেই গেছি , ভোরাই তখন দুধের উপরেই নির্ভরশীল। কাউকে বলে আমাকে স্যান্ডউইচ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
বললেন, যা কিছুই হোক মেয়েকে অবহেলা করবে না।ও তোমার সবচেয়ে বড় শক্তি ।
আরো একদিন বিম্বার নাচের অনুষ্ঠান রবীন্দ্র সদনে।আমি তখন নাচ ছেড়ে দিয়েছি ।তবু মনিপুরী নর্তনালয়ের অনুষ্ঠান হলেই যাই।গুরু মা কলাবতীদির সঙ্গে কথা বলছি। মাসি গাড়িতে উঠছেন।আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন।কলাবতী দি বললেন, বিতস্তা আমার অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রী ।শুনে বললেন, ওমা তাই! তুমি নাচ করো? নন্দনা, অন্তরাও এদের কাছে নাচ করত।তারপরেই বললেন, তুমি তো বেশ গুণী।পত্রিকা সামলাচ্ছ, অনুবাদ করছ, লিখছ, আবার নাচও করো।
আমার মা সেদিন সঙ্গে ছিলেন।মার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলাম।আবারো একই কথা শুনে মায়ের খুব আনন্দ।যেমন মায়েদের হয় আর কী!
সইয়ের সদস্য নই আমি ।উনি কখনো বলেননি হতে।কিন্তু মাঝে মাঝেই মেসেজ পাঠাতেন অমুক দিন সইয়ের অনুষ্ঠান, তুমি আসবে।
খুব কম গেছি সেসব অনুষ্ঠানে।খানিক অভিমান আর খানিক মনে হত, অনাহূতর মতো কেন যাব! আমাকে তো বলেননি সদস্য হও!
আজ এমন অজস্র স্মৃতি ভিড় করে আসছে।অনুবাদ পত্রিকার জন্য নিয়মিত লেখা দিয়েছেন। অবশ্য আমি দায়িত্ব নেবার অনেক আগে থেকেই তিনি পত্রিকায় নিয়মিত অনুবাদ করেছেন ।
লেখা বের হবার পর পত্রিকার মধ্যে সামান্য কিছু পাঠাতে ফোনের পর ফোন।এটা তুমি কী করেছ? কেন টাকা দিয়েছ?
যতবার বলি, এটা আসলে আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে , তাই দিয়েছি ।শুনবেনই না।বারবার একই কথা ।শেষে বললেন, বেশ, তুমি তাহলে আমাকে পত্রিকার গ্রাহক করে নাও।
আমি আর উচ্চ বাচ্চা না করায় অতনুকেও ফোন করেছেন, একই কথা বলে।এবং নিয়মিত পত্রিকা পাঠাতে বলেছেন।
একদিন ফোনে বললেন, তুমি আমার বাড়িতে এসো, অনেক কথা আছে ।গেলাম।কিন্তু উনি নিচ থেকেই ফেরত পাঠালেন।খুব অভিমান হল।যেতে বললেন কেন! আমি তো কোথাও নিজে থেকে যাইনা।
ঠিক করলাম, আর কখনো যাব না।কিন্তু পরদিনই ফোন করলেন।শোন, আমি জানি রাগ হয়েছে ।কিন্তু, যে কথাগুলো বলতে ডেকেছিলাম, ভেবে দেখলাম, সেগুলো না বলাই ভালো ।কিছু কথা গোপন রাখতে হয় ।
আমার শোনা হয়নি সে কথা ।তবে বাবার ঘনিষ্ঠদের মুখে শুনেছিলাম, ওনার একদম কিছু ব্যক্তিগত বিষয়ে উনি যখন ভেঙে পড়েছিলেন, তখন নাকি বাবা ওনাকে অনেক শক্তি যুগিয়েছিলেন।যদিও, আমি জানি না, সে বিষয়ে কিছুই ।
সেদিন কিন্তু সত্যি এগুলো বলতে চেয়েছিলেন কিনা জানা হয়নি ।এমনকি জানতে ইচ্ছে ও করেনি।হ্যাঁ , খুব অভিমান হয়েছিল, এতদূর থেকে সব কাজ ফেলে দৌড়ে গেলাম ওনার অনুরোধে, অথচ নিচ থেকেই. .
ফোন পেয়ে সে অভিমান মিটে গেছিল।
মাঝে সাক্ষাৎকার নেবার কথা হচ্ছিল ।কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না সম্পূর্ণ না পড়ে ওনার সঙ্গে যে সাক্ষাৎকার নেবেন, তিনি কী করে বুঝবেন অনুবাদের বিষয়! বললেন, তুমিই নাও, তুমি তো এই নিয়েই কাজ করছ। আমি বললাম, বেশ, সময় দাও ।দিলেন।তারপর আবার মত পরিবর্তন করলেন।শরীর ভালো নেই।ফোনে কিছু বললে লিখে নিতে পারবে? পারব, বলাতে বললেন, বেশ, তাহলে অমুক দিন ফোন করো। তারপর বেশ কদিন কোনো উত্তর নেই।জানি অসুস্থ ।আমিও হাসপাতালে প্রায় তিনমাস।একদিন হঠাৎ ই ফোন করলেন।শুনলাম, তুমি হাসপাতালে ছিলে।কী হয়েছিল? বললাম সব।শুনে বললেন, আরে কী সর্বনাশ! শরীরের যত্ন নাও না কেন! , এত কাজ করতে গেলে আগে ওটা দরকার ।যোগাসন করো নিয়মিত? বললাম, না, সেভাবে হয়ে ওঠে না।আবার বকা।বড় কাজ করতে গেলে চরিত্রে ডিসিপ্লিনড আনতে হয় ।রোজ ব্যয়াম করো।আমি চুপ করে রইলাম।যেন বাবার কথার প্রতিধ্বনি শুনছি।
তারপর বললেন, আমি দিল্লিতে ফর্টিসে ভরতি ।নতুন নতুন টেস্ট দিয়েছে ।তিনমেয়ে আর কানাই সঙ্গে আছে।কাল ফিরব।
তারপর বললেন, প্রশ্ন তৈরি করেছ?
কিসের?
এই যে সাক্ষাৎকার নেবে বলেছ।
হ্যাঁ ।
পাঠিয়ে দাও।দেখি কী কী প্রশ্ন করেছ।
পাঠালাম মেসেজে।খুব খুশি ।কত প্রশ্ন ভেবেছ।খুব ভালো বিষয় জানতে চেয়েছ। আমি তোমাকে লিখে পাঠাচ্ছি ।
তারপর ফিরে এসে পুজোর আগে কিছু উত্তর মেসেজে পাঠালেন।কিছু ফোনে।বললেন, পুরোটা দিতে সময় লাগবে ।বললাম, শারদীয়ায় ছাপব? বললেন, না।পুরোটা একসঙ্গে ছেপো।আমি তোমাকে অনুবাদ পাঠাচ্ছি ।
সে অনুবাদ এসে পৌঁছলো পত্রিকা প্রকাশের পর ।নভেম্বর সংখ্যায় তা প্রকাশ পাবার কথা ।বললেন, শরীর খুব খারাপ ।একটু ঠিক হয়ে বাকি উত্তর গুলো পাঠাবো।কিংবা তুমি এসো, বলব।
না, আমার যাওয়া হয়নি ।আমি যেতে পারিনি। দিল্লি চলে গেছিলাম । সুখেন্দুকে বলে গেছিলাম বাকিটা নিয়ে নিতে।মাসিকে মেসেজ করে দিয়েছিলাম। শুনলাম, অল্পই দিতে পেরেছেন ফোনে ।কারণ তিনি তখন খুবই অসুস্থ ।
সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ হল না।কত কথাও তো অপূর্ণই রয়ে গেছে ।আমি শোক করব না।হ্যাঁ কষ্ট হচ্ছে খুব।কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, মানুষ বেঁচে থাকে তাঁর কাজে।তাঁর ব্যবহারে , সৃষ্টিতে।মাসির হাসিমুখ আর লেখার ভান্ডার তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন।
ভালো থেকো মাসি।
কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক