| 5 মে 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতায় নারীমুক্তি

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

নারী কে? সেকি এক নম্র শিউলি ফুল, কিছুটা সময়ের জন্য সৌন্দর্য্য ও সুগন্ধ বিলি করে শুধুমাত্র ঝরে যায়! সেকি শুশ্রূষার পেলব আঙুলে জড়িয়ে রাখে তাবত জগৎসংসার! সেকি শুধুমাত্র জাতকের আধার, সেকি শুধুই যোনি ও গর্ভের সমাহার! এইসব প্রশ্নেরা আমাদের ঘিরে ধরে, ঘিরে ধরে আকুল জিজ্ঞাসা, যখন কেবলমাত্র সঙ্গিনী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় নারীকে। সঙ্গিনীই যদি বললে, তবে কেন পুরুষের আর পাঁচটা বন্ধুর মতো কমরেড হয়ে উঠতে পারে না নারী? কেন তাকে দিয়ে পুরুষের সমান বা তার চাইতে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া হয় অনেক কম মজুরিতে। কিম্বা, ধরা যাক একজন আধুনিক পড়াশুনো জানা মেয়ে সারাদিনের চাকরির পর ঘরে ফিরে একা একাই সংসারের সব ঝক্কি সামাল দেবে, কেনই বা তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাতের বিছানায় ক্লান্তি নিয়েও মিলিত হতে হবে স্বামীর সঙ্গে! এই সমস্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে যখন উত্তরের জন্য উৎসুক হয়ে উঠি, ঠিক তখনই দেখি একজন কবি লিখেছেন,

আমার দূর্গা ত্রিশূল ধরেছে স্বর্গে এবং মর্তে,
আমার দূর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজে-ই নিজের শর্তে |

তখন মনে হয় এই তো সেই আদি এবং শাশ্বত নারী, যেকে আমরা চিনতে পারি না, যাকে কেবল সেবা, মমতা ও যৌনতার প্রতিমূর্তি হিসেবে দেগে দেওয়া হয় বারবার। এই কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত, যাঁর কবিতায় পুনর্জীবিত হয়ে উঠেছে নারী। যিনি নারীকে দেখতে চেয়েছেন ঘোমটা খোলা, বোরখা বর্জিত এক আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে। ঋতুকালে যে নারী পুজোর ঘরে, মন্দিরে ঢোকার অনুমতি পায় না, তাকেই সম্বৎসর পাকঘরে হাঁড়ি ঠেলতে হচ্ছে, কই তখন তো তার হাতের অন্ন ব্যঞ্জন অস্পৃশ্য বলে মনে হচ্ছে না সংসারের মানুষের! এর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদি হয়ে উঠেছে তাঁর কলম।

গ গণিকালয় কারা বানায়
ভিয়েতনামে হাড়কাটায়

ঘ ঘর তোমার রাজ তোমার
আমি পুতুলখেলা তোমার

 ঙ নৌকা মাঝি ব্যাঙ
পুরুষতন্ত্র ড্যাডাং ড্যাং

যুগে যুগে গণিকালয় ত পুরুষেরই সৃষ্টি, নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য। তারপর সেই মেয়েটিকে গণিকা বলে চিহ্নিত করে সমাজে অছ্যুত করে দেওয়া, সেও পুরুষেরই তৈরি এক প্রথা। তাই কবি বলে ওঠেন “জরায়ু যার বাচ্চা তার”। এমন একটি দেশে বসে বলেন এই কথা, যেখানে পিতার পরিচয়ই সন্তানের একমাত্র পরিচয়। মা সেখানে গৌণ। পিতৃপরিচয়হীন সন্তান এদেশে জারজ। তাই বলে মল্লিকা সেনগুপ্তকে পুরুষবিদ্বেষি কিছুতেই বলা যায় না। তিনি নারী পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাসী। তাই তো তিনি বলেন, “মেয়ে পুরুষ জড়িয়ে থাক”। তিনি বলেন, “আধাফসল থাক পিতার”। এই সাহসী এবং নিজস্ব উচ্চারণই মল্লিকা সেনগুপ্তকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।

লাবণ্য সীতা ইলেকট্রা নোরা

ছবির মতো না, ওরা স্বয়ং
ছবি বানায় রং-বেরং

জরায়ু যার বাচ্চা তার
আধাফসল থাক পিতার

ঝগড়াঝাঁটি ঝিঁঝির ডাক
মেয়ে পুরুষ জড়িয়ে থাক

আবার আমরা চমকে উঠি, যখন পড়ি “ফ্রয়েডকে খোলা চিঠি” কবিতাটি।

পুরুষের দেহে এক বাড়তি প্রত্যঙ্গ
দিয়েছে শাশ্বত শক্তি, পৃথিবীর মালিকানা তাকে
ফ্রয়েডবাবুর মতে ওটি নেই বলে নারী হীনমন্য থাকে
পায়ের তলায় থেকে ঈর্ষা করে পৌরুষের প্রতি

প্রকৃতি সদয় নয়
পুরুষ সদয় নয়
সন্তান সদয় নয়
মেয়েদের প্রতি শুধু ফ্রয়েড সদয় !

এই দয়া কে চেয়েছে ! চিত্রাঙ্গদা ! জোন অব্ আর্ক !
সিমোন দ্য বোভোয়া না শ্যামল দ্রৌপদী !

না, নারী কোনও দয়া চায়নি, সে চেয়েছে সমানাধিকার। সে চেয়েছে ঘরে, বাইরে, যুদ্ধে, খরায়, বন্যায়, মহাকাশে পুরুষের সঙ্গে সমানে সমানে চলতে। তাই মল্লিকা বলেন,

উল্টোদিক থেকে যদি ঘোটকীর পিঠে কোনও নারী যোদ্ধা আসে
সে কী অস্ত্র ফেলে দেবে ভীষ্মের মতন—
“নারীর বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধরবো না”
অর্থাৎ নারীকে আমি দেব না অস্ত্রের অধিকার…

এ কবিতা শুধু নারীকেই নয় সমগ্র সমাজকে এক আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি করে দেয়। সমাজের ঘেঁটি ধরে ঝাঁকুনি দেয়। যে সমাজ বেহুলাকে একদিন বাধ্য করেছিল একদল পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির সামনে নিজেকে তুলে ধরতে, যে সমাজ খনার জিভ কেটে নিয়েছিল সত্যভাষণের জন্য, যে সমাজ দ্রৌপদীকে, সীতাকে ফেলে দিয়েছিল চূড়ান্ত অসম্মানের পঙ্কিল আগুনে। এই অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার ঝলসে উঠেছে মল্লিকা সেনগুপ্তের কলম। ইতিহাসের এই নারীচরিত্রগুলি পুনর্নিমিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। তাই তাঁর দ্রৌপদী বলেন,

হে পুরুষ!

রূপ দেখলেই কেন হাতের মুঠোয় চাও জ্যান্ত মানবীকে!

না পেলে তারই শাড়ি টেনে ধরে অশ্লীল হাসিতে

তার মুখ কালো করে দিতে চাও। বলো-

দ্রৌপদীর বহু পতি, বেশ্যা অতএব

আমি যদি বেশ্যা হই, তুমিও পুরুষ বেশ্যা কর্ণ মহামতি!

তোমারও শয্যায় আসে বহু পতি, বিবিধ স্ত্রীলোক

এই দ্রৌপদী অসহায় নারী নন। তিনি প্রতিবাদী, তিনি নিজেকে পুরুষের সমান করে ভাবতে জানেন। “কথামানবী” বাংলাসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থেকে গেছে। ইতিহাস কেবলমাত্র শৌর্যবীর্যের গল্প নয়, তার তলে চাপা পড়ে আছে যুগ যুগান্তের অপমানিত অবহেলিত মেয়েদের কাহিনি। নারী যেন নতুন জন্ম নিয়ে ফিরে ফিরে আসে। আমরা দেখতে পাই দ্রৌপদী, গঙ্গা, সুলতানা রিজিয়া, মাধবী যেন ফিরে এসেছেন মেধা পাটেকর, মালতী মুদি, শাহবানু বা খনার মধ্যে দিয়ে, মিশে গেছেন পৃথিবীর সমস্ত নারীর রক্তকণিকার ভেতরে। নারীও যে মাথা তুলে, মেরুদণ্ড সোজা রেখে কথা বলতে পারে, নারীও এভারেস্ট জয় করতে পারে, কল্পনা চাওলা হয়ে যেতে পারে মহাকাশে, নারী যে একই সঙ্গে হতে পারে অশ্রু ও আগুনের কথাকার, মল্লিকার লেখার প্রতি ছত্রে তারই প্রমাণ পাই। এই কবিই মেয়েদের সমকামিতা, যা বহুনিন্দিত এ সমাজে, সেই প্রসঙ্গে বলেন,

ব়্যাডিক্যালিস্ট রাগিণী মেয়ে
পুরুষ তাকে পাবে না চেয়ে

লেসবিয়ান লেসবিয়ান
যৌনতার বিনির্মাণ

………………………….

………………………………

সাফো ছিলেন প্রথমা শ্লোক
সরস্বতী আশিরনখ

হিংসা যখন ঘরের ভেতর
প্রিয়তমই মৃত্যু যে তোর

অর্থাৎ নারীর মুখ বুজে থাকার দিন শেষ, এই ঘোষণা যেমন তাঁর পূর্বসূরীদের কবিতায় পেয়েছি, তেমনভাবেই এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার চাইতেও তীব্রভাবে উঠে এসেছে মল্লিকার লেখায়। তাঁর “তেভাগার ডায়েরি” শ্রমিক মেয়েটি যখন তার শ্রমের বিনিময়ে পোকা আলু আর আতপ চাল পায় (এখানে পড়ুন পাঠক, সে তার শ্রমের মূল্য পুরুষ মজুরের চাইতে অনেক কম পায়, যা এখনও প্রচলিত), সে মাথায় লাল ফিতে জড়িয়ে নিলে, সেই লাল ফিতে কিন্তু তখন আর প্রসাধণ নয়, তা হয়ে ওঠে বিপ্লবের স্বপ্নের প্রতীক, কাস্তে হয়ে ওঠে তার গহনা। তাই সে বলে,

দূরের চাষিকে শালপাতা মুড়ে খবর পাঠাও

আনো কেরোসিন, যদি দরকার হয় আগুন জ্বালাব

শুধু ইতিহাস নয় সমকালও তাঁর কবিতার বারংবার উঠে এসেছে। চতুর্দিকে ঘটতে থাকা ধর্ষণ, খুন, নিপীড়নের ঘৃন্যতম কালো ছবি তাঁর ক্যানভাসে অনায়াস দক্ষতায় ফুটে উঠেছে। কবিতায়। বীণা সর্দার খালি গলায় এমন গান গেয়ে উঠল যে মধুসূদন মঞ্চের বাতাস করুণ হয়ে এল তেজী হরিণীর মতো সারা মঞ্চে নেচে বেড়াচ্ছে সে কে বলবে, তিনবার ওকে বিক্রি করে দিয়েছিল ওর বাবা ! নেপাল বর্ডার থেকে পুলিশ উদ্ধার করে এখানে এনেছে পুরনো কথার ঘায়ে মাঝে মাঝেই ওর মাথা খারাপ হচ্ছে । [রেডলাইট নাচ] কিন্তু শেষ অব্দি কবির বিশ্বাস ‘ঊর্বশীর মেয়েগুলি আমাদের পৃথিবীতে বাঁচতে চাইছে ’। এখানেই মল্লিকা অনন্য। তিনি হেরে গিয়ে মাথা নিচু করার কথা বলেলনি। তাঁর কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে জ্বলজ্বল করে বাজছে জীবন। এই মেয়ে বাঁচবে, এই মেয়ে সদম্ভে বলবে, আমি নারী! হে পুরুষ, তোমার পাশাপাশি হাঁটবার অধিকার আমার আছে।

‘অর্ধেক পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘আপনি বলুন মার্কস’৷ এই কবিতাটিতেই মল্লিকা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল /দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গম বোনা শুরু করেছিল/আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন করেছিল শিশু/সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে?’; গৃহশ্রম নিয়ে মার্কসের অবস্থানকে কূট তর্কের সামনে এনে ফেলেছেন মল্লিকা। প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া ক্লাসিক বাংলা কবিতাকেও পুনর্নির্মাণ করেছেন তিনি৷ ‘বীরপুরুষের মা ’ এই পুনর্নির্মাণের এক সার্থক উদাহরণ৷ রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’-এ নায়ক সেই ছোট্ট ছেলেটি, সেই মা পার্শ্বচরিত্র৷ মল্লিকার কবিতায় কিন্ত্ত কেন্দ্রীয় চরিত্র এই বীরপুরুষের মা৷ মল্লিকা লেখেন, ‘একলা মা আর একলা ছেলে/ডাকাতগুলো দেখতে পেলে/কী হবে বল্ বীরপুরুষ খোকা?/তুই করবি যুদ্ধ, আর আমি রইব বোকা !/স্পষ্ট বলছি তা হবে না আর/তুই ওদের তির ছুঁড়লে আমিও দেব মার৷’ এই উচ্চারণ বলে দেয়, পড়ে পড়ে মার খাওয়ার দিন পেরিয়ে এসেছে মেয়েরা। এখন ঢিল ছুঁড়লে পাটকেলটিও খেতে হবে, বিষাক্ত তির ছুঁড়লে, আজকের নারী পরিবর্তে তার বর্শার ফলকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে জানে।

আমার দূর্গা কখনও ঘরোয়া কখনও আগুন বন্হি,
আমার দূর্গা মেধা পাটেকর, তিস্তা শীতলা বাধেরা,
আমার দূর্গা মোম হয়ে জ্বালে অমাবস্যার আঁধেরা,
আমার দূর্গা মনিপুর জূরে নগ্ন মিছিলে হাঁটে,
আমার দূর্গা কাস্তে হাতুরি, আউস ধানের মাটে |
……………………………………………………………………

অগ্নিপথে, যুদ্ধজয়ে, লিঙ্গসাম্মে, শ্রেণীসাম্মে,

দাঙ্গাক্ষেত্রে, কুরুক্ষেত্রে মা তুঝে সালাম!
মা তুঝে সালাম!

কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতা নিয়ে এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবু বলি,  তাঁর লেখার ব্যাপ্তি, চেতনা, বোধ নিয়ে আলোচনা করার জন্য আজকের বাংলা কবিতা তাঁর সৃষ্ট কবিতার ভাষার কাছে ঋণী হয়ে থাকবে আজীবন। তিনি চেয়েছেন,“লড়াইয়ের ময়দানে তাঁর কবিতা কেবল একটি মেয়ের বন্ধুই নয়, হয়ে উঠুক তার হাতিয়ারও,”  আর কে না জানে হাতিয়ার যতই ধারালো , ‘ততই কার্যকরী!’ তাই তো তিনি বলেন,

আমার শৈশবে কোনও লিঙ্গঈর্ষা কখনও ছিল না
আত্মপরিচয়ে আমি সম্পূর্ণ ছিলাম
আজও আমি দ্বিধাহীন সম্পূর্ণ মানুষী
তৃতীয়বিশ্বের এক স্পর্শকাতর কালো মেয়ে
আজ থেকে আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে
কে অধম কে উত্তম বাড়তি কে কমতি কোনটা—
এই কূট তর্কের মিমাংসা করবার ভার
আপনাকে কে দিয়েছে ফ্রয়েড সাহেব !

এ তো শুধু কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের আর্তি নয়, এ হল যুগে যুগে সমস্ত মেয়ের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর দাবী।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত