নারীরা আজও অবরুদ্ধ
মার্কিন অভিনেত্রী ভিওলা ডেভিস। তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনয়শিল্পী, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিনোদনজগতের সবচেয়ে সম্মানজনক তিনটি পুরস্কারই পেয়েছেন—অস্কার, এমি অ্যাওয়ার্ড ও টনি অ্যাওয়ার্ড। টাইম সাময়িকী তাঁকে ২০১২ ও ২০১৭ সালে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান দিয়েছে। গত ২০ মে যুক্তরাষ্ট্রের বার্নার্ড কলেজের সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন তিনি।
‘ইতিহাস কি শুধু অতীত? ইতিহাস হলো বর্তমান। আমরা প্রতিনিয়ত ইতিহাস বয়ে নিয়ে বেড়াই। কারণ, আমরাই তো ইতিহাস!’
অন্যভাবে বলতে গেলে, আমরা আমাদের চারপাশের পরিবেশ দিয়ে তৈরি। একেকটি বিজয়, সাফল্য ও লড়াই নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা। আমাদের অস্তিত্বের অংশ সেসব নারী, যাঁরা দিনবদলের স্বপ্ন দেখেন, সাহস রাখেন। আবার আমরাই এমন এক পরিবেশের অংশ, যেখানে ঔদাসীন্য আছে, আছে সহমর্মিতার অভাব। আছে অন্যায় দেখেও নিশ্চুপ থাকা।
এখানে অন্যের লুট করা জমিতে তৈরি হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে কোনো এককালে হয়তো আমাদেরই মা, দাদি, পূর্বপুরুষ বা অচেনা কোনো নারীকে অবদমিত করে রাখা হয়েছিল। যাঁরা তাঁদের মেধাকে কাজে লাগাতে পারেননি, সুযোগ পাননি। যাঁরা মারা গেছেন যৌন নিপীড়নের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে, মানসিক অসুস্থতা নিয়ে। তাঁদেরও হয়তো শুনতে হয়েছিল তাঁরা অযোগ্য, অপদার্থ, অসুন্দর! হ্যাঁ, আমরা এমনই এক পরিবেশে বাস করি।
আর তোমাদের আজকের উদ্বেগ বা অস্থিরতাও কিন্তু ইতিহাসের অংশ।
আজ তোমরা স্নাতক করলে। এমন সুযোগ অনেকেই পায় না। তোমরা ভাগ্যবান। ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট। এ পর্যায়ে এসে তোমাদের কর্তব্য কী?
আমি বলব, চলো, আজ থেকে আমরা ইতিহাসের সবকিছু স্বীকার করে নিই। কি ভালো, কি মন্দ! চলো, মেনে নিই, আমেরিকার ৩৯ জন প্রতিনিধি যেদিন স্বাধীনতার দলিল রচনা করেছিলেন, সেদিনও এ দেশে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। তখনো নেটিভ আমেরিকানদের হত্যা করা হতো।
চলো, শতবর্ষ ধরে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চলে আসা বৈষম্যের ইতিহাস মেনে নিই। মেনে নিই আমাদের মধ্যেই কেউ আছে, যে ঘৃণা ও বিদ্বেষবশত নিরীহের ওপর গুলি চালিয়ে বসে। চলো মেনে নিই, এটাই আমেরিকা!
তবে নিজেদের ভালো কাজকেও স্বীকার করতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে নতুন নতুন ভাবনাকে। তোমরা তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্যকে নিজের লক্ষ্য হিসেবে দেখতে শুরু করো। নিজের সব ধরনের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাকে মেনে নিতে শেখো; তা সে যতই বিভীষিকাময় হোক না কেন। মনে রাখবে, আজকের পৃথিবী জরাজীর্ণ, কারণ আমরা জরাজীর্ণ।
অন্যায়-অবিচার দেখে একসময় আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। অনেকেই এসব ভুলে থাকতে চান। এসব দেখে আমরা পীড়িত হই, ক্ষুব্ধ হই। অনেকে প্রতিবাদ করেন, লড়াই করেন। একসময় আবার আমরাই ক্ষমা করে দিই—সবকিছু মিটমাট করে নিই। হৃদয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। সাহস ও আশা নিয়ে আবার নতুন করে শুরু করি। সমস্যার সমাধান করি। সমব্যথী হই। এই সমবেদনা আমাদের মনে অন্যের প্রতি শুভেচ্ছা আনে। আর অন্যের ভালো চাওয়াই কিন্তু একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা বা সৈনিককে লড়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়।
টমাস মার্টন বলেছেন, ‘আধুনিক সমাজ ও রাজনীতির ইতিহাস জানতে চাইলে নরকের দিকে তাকাও।’ আমাদের আজকের সমাজের দিকে তাকাও। দেখবে নারীরা আজও অবরুদ্ধ। এ দেশে আত্মহত্যার হার বেড়েছে। আমরা প্রজনন বা গর্ভপাতের অধিকার প্রায় হারাতে বসেছি। আমাদের আয় পুরুষের তুলনায় কম। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা অনিশ্চিত।
গত পাঁচ বছরে যৌনকর্মী হিসেবে নারী পাচার বেড়েছে শতকরা ৮৪৬ ভাগ। এদের মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগই শ্বেতাঙ্গ নয়, কৃষ্ণাঙ্গ বা অন্য বর্ণের। আজ সব দেশের ‘সেরা’ দেশটিতেও প্রসবকালীন মৃত্যুর হার বেড়েছে ২৬.৬ ভাগ। আর কৃষ্ণাঙ্গ নারীর ক্ষেত্রে তা বেড়েছে ২৪৩ ভাগ।
আজ তোমরা যে প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক করলে, তার লক্ষ্য শুধু ডিপ্লোমা দেওয়াই নয়। তা আজ তোমাদের হাতে অসি বা তরবারি ধরিয়ে দিয়েছে। তোমরা চাইলে সে তরবারি চালাতে পারো, নয়তো ফেলে রাখতে পারো।
এখন তোমাদের অনেকেই বলবে, সফল হতে কী করা চাই। তোমরা হয়তো গতানুগতিক কোনো কাজ বেছে নেবে। ভাববে সেটাই সর্বোচ্চ সম্মানের কাজ। কিন্তু একসময় সেই কাজ করতে করতে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়বে। তোমাদের ভ্রান্তি ভাঙবে। একাকিত্ব আসবে। কাজে আসবে অনীহা। কারণ, কেউ তোমাদেরকে আসল সাফল্যের পথ দেখায়নি।
মনে রাখবে, নিজের জীবনের চেয়েও বড় কিছু করার লক্ষ্যে বেঁচে থাকাই হলো সার্থকতা। এটা বীরের লক্ষণ। স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণে লেগে পড়ো। সামনে বাধা আসবে। তখন ভয়কে জয় করতে হবে। যদি বীর হতে চাও, তাহলে জীবনের একপর্যায়ে এসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোনটি বেছে নেবে—নিজের স্বার্থ, নাকি কোনো বৃহৎ স্বার্থ?
তোমরা হয়তো আমার জীবনের গল্প শুনেছ। দারিদ্র্যকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। রোডস আইল্যান্ডের সেন্ট্রাল ফলসে আমার বেড়ে ওঠা। আমি জানি, একজন দরিদ্র ব্যক্তি অদৃশ্য। জাতীয় চেতনায় এদের অস্তিত্ব নেই। কেউ এদের কথা ভাবে না। তারা বঞ্চিত। যেন তারা সমাজের অংশই নয়।
ছোটবেলার একটা ঘটনা বলি, যা আমার চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন এনেছিল। আমার বয়স তখন ৯। মাঝরাত। আমার মা-বাবা ঝগড়া করছেন। সে এক সাংঘাতিক ঝগড়া! একপর্যায়ে আমি যেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম। তারস্বরে চেঁচাতে লাগলাম। সেই সঙ্গে কান্না।
আমার চিৎকার ও কান্না দেখে আমার বোন ছুটে এল। আমাকে ঘরে যেতে বলল, যেন প্রতিবেশীরা শুনতে না পান। আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকলাম। তখনো চিৎকার করে কাঁদছি। নিজেকে থামাতে পারছিলাম না।
মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ। হাতজোড় করা। প্রার্থনা করতে লাগলাম, ‘হে ঈশ্বর, যদি তুমি সত্যি থেকে থাকো, যদি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে এক্ষুনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনব। যখন শেষ হবে, যেন দেখি আমি তোমার কাছে চলে গিয়েছি।’
এভাবে সত্যি গুনতে লাগলাম: আট, নয়, দশ। চোখ খুললাম। আমি ঠিক আগের জায়গাতেই আছি। মারা যাইনি। ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রাখলেন। কেন জানো?
কারণ, একদিন আমার বয়স হবে, অভিজ্ঞতা বাড়বে, দৃষ্টি খুলবে, শক্তি ও সাহস হবে। সেদিন যেন আমি শিশুকালের কথা মনে রাখি। মনে রাখি শিশু বয়সের ক্ষুধার জ্বালা। দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের কথা। যেন মনে থাকে মানসিক যন্ত্রণা কাকে বলে।
আমি দেখেছি অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপান। উচ্ছৃঙ্খল জীবন। আমি জানি একজন শিশুর কষ্ট—যখন তার স্বপ্ন থাকে, কিন্তু নেই সেই স্বপ্নের প্রতিফলন। সেদিন বেঁচে ছিলাম বিধায় আমি এসব কিছু দেখতে পেরেছি। এটা আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। কারণ, এই অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে অন্যের সেবায় নিজেকে নিবেদিত করতে উৎসাহ জোগায়।
বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘তুমি অন্যকে তখন বুঝবে, যখন নিজেকে তার অবস্থানে বসাবে। তার পরিস্থিতি মন দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করবে।’ যদি বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে চাও, জেনে রেখো, তুমি একাই সেই ঝুঁকি নিচ্ছ না। তোমার আগে বহু গুণীজন সেই পথ মাড়িয়েছেন। এই গোলকধাঁধা তোমার চেনা। শুধু আগে যিনি গেছেন, তাঁকে অনুসরণ করলেই চলবে।
আর এভাবে চলতে চলতেই অনেক কিছু শিখবে। হয়তো যে পথে ভেবেছিলে ঘৃণ্য কিছুর দেখা মিলবে, সে পথেই পেয়ে যাবে স্রষ্টাকে! যখন মনে করেছিলে অন্যকে বধ করতে হবে, তখন হয়তো বধ করতে হতে পারে নিজেকেই! আর যখন ভেবেছিলে অভিযানে বেরোতে হবে বাইরের জগতে, তখন হয়তো তুমি নিজেকেই আবিষ্কার করে ফেলবে। সব শেষে যখন তুমি ভাবছ তুমি একা, দেখবে পুরো দুনিয়া তোমার সঙ্গে আছে।
আজ থেকে তোমাদের যাত্রা শুরু। তোমাদের নবজাগরণ হলো। তোমরা নতুন পদক্ষেপ নেবে। ইতিহাসে দাগ কাটবে। তাহলে তোমাদের করণীয় কী? হয় কারও জন্য কিছু করে যাও, নয়তো অন্যকে অনুপ্রেরণা দাও, যেন সে কারও জন্য কিছু করে যেতে পারে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শাহরোজা নাহরিন
সূত্র: প্রথম আলো